অপূর্ণ কাজ পূর্ণ
অপূর্ণ কাজ পূর্ণ
আজ আমি আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু দিনের কথা শোনাবো। আমি চাকরির ছয় মাস পরেই বদলি হই বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও পেটের টানে যেতেই হয়। আর সেখানের কিছু দিন আমার জীবনের এক উল্লেখ যোগ্য অধ্যায় হয়ে থাকবে চিরকাল। আমি ট্রেন থেকে নেমে ভাবছি রিক্সা বা টাঙ্গা করে যাওয়া যাবে কিনা, কারণ জায়গাটা যে শহর থেকে অনেক দূরে সেটা অফিস থেকে জেনেছিলাম। হঠাৎ একজন বয়স্কা ভদ্রমহিলা স্টেশনের এক কোণে একটি চায়ের কেটলি আর স্টোভ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমার দিকে ইশারা করলেন, যেন আমি তার কাছে এগিয়ে যাই। আমার ভালোই হল কারণ আমিও খুঁজছিলাম এমন একজনকে যে ওই জায়গাটা সম্পর্কে আমাকে কিছুটা বলতে পারে। আমি আমার লাগেজ নিয়ে কিছুটা এগোতই মহিলাটিও একটু এগিয়ে আমাকে বললেন "আপনি কি চৌধুরীদের বাড়ি খুঁজছেন?" আমি অবাক হয়ে বললাম যে "আমি ওই বাড়িতে যাবো কি করে জানলেন আপনি?"
এবার মহিলাটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো "আসলে সকালে চৌধুরী বউদি কেউ আসার কথা আছে বলছিলেন, আর আপনাকে দেখে আমার মনে হলো হয়তো আপনিই হবেন,তাই" আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম "চৌধুরী বউদি কি আমার এখানে আসার কথা জানতেন, তিনি কে?" এবার মহিলাটি ঠিক সোজা ভাবে আমার কথার উত্তর না দিলেও বুঝলাম ওই চৌধুরী বাবুদের ভাড়া ঘরেই আমাকে আপাতত কয়েকদিন থাকতে হবে, তারপর কোয়াটার পাবো। সেই ব্যবস্থাই করা হয়েছে। আমি এক ভাঁড় চা খেয়ে টাঙ্গায় উঠলাম। অফিসে যা শুনেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি দূর। প্রায় বিকেল বেলা পৌঁছলাম। আমার জন্য চৌধুরী বাবুর চাকর প্রহলাদ বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম আমার ঘর পরিষ্কার করেই রেখেছে। সারাদিনের পারিশ্রমে আর কিছু ভালো লাগছিলো না। খিদের চোটে পেট চোঁ চোঁ করছে। প্রহলাদ কে বললাম
"আজ খেয়ে শুয়ে পড়ব, কাল চৌধুরী বাবুর সাথে দেখা করতে যাবো, কেমন"
প্রহলাদ মুখে কিছু না বললেও যেনো এক অবাক করা দৃষ্টি বুলিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে চলে গেলো।
পরদিন সকালে দরজায় কেউ শব্দ করায় ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখি প্রহলাদ চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। আমি চা হাতে নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম "চা খেয়ে আসছি চৌধুরী বাবুর সাথে একবার দেখা করবো"
প্রহলাদ বলে উঠলো "আর কি তার সাথে দেখা করতে পারবেন? তিন মাস হলো তিনি আর এই জগতে নেই" আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম "সে কি, তবে চৌধুরী বউ তো আছে" প্রহলাদ চোখ দুটো বড় বড় করে বলে উঠলো "হ্যাঁ আছে, তার সাথে গিয়ে দেখা করে নেবেন সময় করে"। আমি এবার স্টেশন এ ওই মহিলার কথা বললাম। প্রহলাদ এর উত্তরে আমাকে জানালো যে ওই মহিলাটি চৌধুরী বউয়ের বাড়িতে কাজ করে, আবার স্টেশন এ চা ও বিক্রি করে। খুব গরীব মহিলাটি। আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভাবলাম কয়েকদিনের তো ব্যাপার তারপর তো নিজের কোয়াটার পেয়েই যাবো।
দ্বিতীয় দিন এভাবেই কেটে গেলো। পরদিন কাজে যোগ দিলাম। এই কয় দিনে চৌধুরী বউ কে একবারও দেখতে পাই নি কিন্তু পঞ্চম দিনে কাজ থেকে ফিরে সবে ঘরে ঢুকেছি, প্রহলাদ এসে বলে "আপনাকে আজ একবার চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে বাবু, বউ রানী র তলব হয়েছে"
আমি যেনো একটু তাচ্ছিল্যের সুরেই বললাম "তলব করলেই যেতে হবে নাকি"? প্রহলাদ তার ভাটার মত চোখ টা আরো বড় করে বলে উঠলো "না গেলে উপায় নেই গো বাবু, এ ডাক চরম ডাক"
আমি মুখে হাসি এনেও কঠিন সুরে বলে উঠলাম "কেন তোমার বউ রানী কি ডাকাত রানী"? প্রহলাদ কথাটা শুনে যে একটু চমকে উঠেছে তা আমি লক্ষ্য করেছি কিন্তু কোনো কথা না বলে চলে যাওয়াতে আমি আর উচ্চ বাচ্ছ করলাম না। মনে মনে ঠিক করলাম দেখা করতে যাবো না, দরকার হলে তিনি আসবেন।
প্রহলাদ রাতের খাবার দিতে এসে পুনরায় মনে করিয়ে গেলো বউ রানীর সাথে দেখা করার কথাটা। আমি ওর কথা শুনে না শোনার ভান করে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। বেশ অনেক রাতে দরজায় শব্দ শুনে ঘুম ভেংগে গেল। উঠে বসে চিৎকার করলাম "কে, এত রাতে কি দরকার আমাকে?" এক মহিলা কণ্ঠ নিচু স্বরে বলে উঠলো "দরজা টা খুলুন ভয় নেই আপনার কোনো ক্ষতি হবে না" কি করি ভাবতে ভাবতে আরো তিনবার দরজায় আঘাত। সাহস করে দরজা খুলে দিলাম। ঘরে ঢুকে এলেন এক মধ্য বয়সী বিধবা মহিলা, বুঝতে ভুল হলো না, ইনি চৌধুরী বউ। আমার থেকে বেশ অনেকটাই তফাতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জানতে চাইলেন "আমি ডেকেছিলাম কিন্তু যান নি, কেনো?" আমি বেশ রাগত স্বরেই উত্তর দিলাম "কারণটা না বললে যাই কি করে, আর আমার সাথে দরকার কি থাকতে পারে সেটা তো বুঝতে পারছি না"
আমার কথা যেনো ছিনিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন "আপনার সাথে দরকার একটাই, সেটা হলো টাকা, এই গ্রামের উন্নয়নের জন্য অনেক টাকা প্রয়োজন" একথা শুনে আমি বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে বলি "মাঝ রাতে আপনি উন্নয়নের টাকা সংগ্রহ করতে বেড়িয়েছেন? এটা কি বিশ্বাস যোগ্য?"
আমার কথায় বেশ নরম সুরে বলে উঠলেন "আমার স্বামী এই কাজ টা করতেন, এখন উনি নেই কিন্তু আমাকে দিয়ে এই কাজ হয়তো উনিই করেন।"
আমি বেশ অবাক হয়ে বলি "আমার মত দিন আনা দিন খাওয়া লোকের কাছে কি ই বা পাবেন আপনি?" স্মিত হেসে জবাব দেন "বিন্দু বিন্দু জলেই সাগর হয়"।
আমি যে বেশ বিরক্ত হয়েছি সেটা বুঝেই বলে ওঠেন "প্রায় ছয় দিন আপনি এসেছেন কিন্তু আমার দেখা করা হয়ে ওঠেনি, তাই আজ এলাম, তবে কাল গেলে আর আসতাম না" আমি অনিচ্ছা সত্বেও ভদ্র মহিলাকে ঘরে আসতে অনুরোধ করলাম। বেশ সুন্দরী বলা যেতে পারে। তন্বী, দুধের মত গায়ের রং, মুখশ্রী যেনো পান পাতার মতো। সব মিলিয়ে বেশ চটক আছে চেহারায়। ঘরে ঢুকে বসতে বললেও বসলেন না। সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন "আপনাকে কিন্তু সাহায্য করতে হবে আমাদের" আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই একটু মুচকি হেসে বললেন "আমাদের মানে এই গ্রামকে , এখানকার লোকেরা খুব গরীব, তাই আমার স্বামী এদের সাহায্যের জন্য একটা কমিটি তৈরি করে অর্থ সংগ্রহ করতেন, আপনার আগে যিনি এসে ছিলেন তিনিও বেশ কিছু অর্থ দান করে গেছেন" আর কথা এগোতে না দিয়ে আমি বেশ রুষ্ট হয়ে বলে উঠলাম "কে টাকা দিয়েছে, সে হিসাব আমার চাই না, আমার পক্ষে এখন কোনো অর্থ দেওয়া সম্ভব নয়, এটা জেনে রাখুন"। I কথাটা বলেই বুঝতে পারলাম কথার ঝাঁঝটা একটু বেশি হয়ে গেছে, তাই যথা সম্ভব গলা নামিয়ে বললাম "আপনার স্বামী তো এখন নেই, এইসব দায়িত্ব কেনো ঘাড়ে নিচ্ছেন?" ভদ্রমহিলা মুখ নামিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলেন, তবে যেতে যেতে যে কথাটা বলে গেলেন তা আমি কখনো ভুলবো না, বললেন "দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে সেটা নামিয়ে দেওয়া যায় কিন্তু স্বামীর অপূর্ণ কাজ পূর্ন করার জন্য শুধু দায়িত্ব নয়, মনের তাগিদ চাই" ভদ্র মহিলা সেদিন চলে গিয়েছিলেন।
আমি দিন সাতেক পরে অফিস কোয়াটারে শিফট করে গেলাম। প্রায় ভুলতে বসেছিলাম ওই মহিলাটির কথা, যদি না অফিসের পিয়ন তার মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ না করতো। বেশ রাত হয়েছিল বিয়ে বাড়ী যেতে। টাঙা থেকে নেমে দেখি কয়েকজন শন্ডা মার্কা লোক লাঠি হাতে বিয়ে বাড়ী ভাঙচুর করছে। আমার সাথে লাঠি বা লোকজন কোনোটাই ছিল না, তাই একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়ানোই শ্রেয় মনে করলাম। হঠাৎ নজরে পড়লো ওই ভদ্র মহিলা একটি লাঠি হাতে খুব জোরে চিৎকার করে সবাইকে
শান্ত হতে বলছেন। সত্যি ওনাকে দেখে গুন্ডা বাহিনী শান্ত তো হলো উপরন্তু কেউ কেউ হাতজোড় করে প্রণামও করে ফেললো। পরিবেশ শান্ত দেখে আমার পুরুষত্ব জেগে উঠলো।এগিয়ে গেলাম ব্যাপারটা বোঝার জন্য। দেখলাম বরের বাড়ী পন না পাওয়ায় বিয়ে বাতিল করেছিল। কন্যা পক্ষের হাজার অনুনয় বিনয় পায়ে ঠেলে তারা বর নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে গ্রামের লোকেরা বাধা দেয়, আর তাতেই লেগে যায় ধুন্ধুমার কান্ড। ভদ্র মহিলা খবর পেয়ে ছুটে আসে। বড় পক্ষ পাশের গ্রামের হলেও চৌধুরী বৌদিকে বিলক্ষণ চেনে, শুধু তাই নয় যথেষ্ট সন্মানও করে। সেদিন গ্রামবাসীদের জন্য চৌধুরী বাবুর গড়া কমিটির অর্থ খরচ হলো এক নিতান্ত গরীব মেয়ের বিয়েতে। বিয়ের কাজকর্ম সমাপ্ত হলে ভদ্রমহিলা টাঙায় উঠলেন। আমি তাকে ভুল ভেবেছিলাম বলে একটু অনুতপ্ত হলাম। চোখাচোখি হতেই সেই মুচকি হাসি হেসে বললেন "আরে, আপনি এখনো বদলি হন নি, আমি ভাবলাম, আমার কথায় গ্রামের ওপর রাগ বুঝি চলে গেলেন" আমি মাটির দিকে তাকিয়ে বোঝালাম আমি অনুতপ্ত। বললাম "আমি কিছু অর্থ দিতে চাই, চৌধুরী বাবুর গড়া কমিটিতে" ভদ্রমহিলা সেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হেসে বললেন "নিশ্চয়ই, কাল বাড়িতে এসে দিয়ে যাবেন, ধন্যবাদ" মহিলাটির যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে ভাবতে লাগলাম কতটা মনের জোর থাকলে সে গুন্ডা বাহিনীর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে। একটাই আশা তার স্বামীর কাজের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করা। মনে মনে তাকে প্রণাম জানিয়ে সেদিন বাড়ির পথ ধরেছিলাম।
