STORYMIRROR

Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy Thriller

4.2  

Apurba Kr Chakrabarty

Horror Tragedy Thriller

অপত্য স্নেহ

অপত্য স্নেহ

10 mins
336

দীর্ঘ চারবছর পর, পল্টু সেদিন গ্রামের বাড়ি ফিরছে , একরাশ আশা আবার তীব্র সংশয় আর উৎকন্ঠা। অনেক আশান্বিত হয়ে বন্ধুর সাথে সুদুর আরবে সে পাড়ি দিয়েছিল।দরিদ্র সংসারে বেকার জীবন তার অসহ্য লাগছিল।বাবা দীর্ঘ দিন অসুস্থ, বড়দা অন্যের ট্রাকের ড্রাইভার, মেঝদা কাটোয়া থেকে পাইকারী সব্জি এনে করিয়েছিল বিক্রি করে, যা আয় হত, সংসার চলত, কিন্ত সচ্ছলতা ছিল না। অনেক আশা নিয়ে বাড়ির বড়রা তাকে কলকাতায় রেখে পড়াশোনা করিয়েছিল। দাদাদের ভরসা ছিল, ভাই ভালো চাকরী করবে।সংসারের হাল ধরবে।


পল্টু পড়াশোনায় ভালো,অ্যাকাউন্টেন্সিতে অর্নাস নিয়ে কলকাতার এক নামী কলেজ ভর্তি হল। তরল বুদ্ধি,গেঁয়ো উঠতি যুবা পল্টু কিন্তু পড়াশোনা, চাকরী , সংসার, ভবিষ্যত সব ভুলে আক্রান্ত হল তীব্র রাজনৈতিক নেশায়। ছাত্র রাজনীতিতে সে জড়িয়ে অনেক সময় নষ্ট করল।একটি ডিগ্রি পেলো ঠিকই তবে রেজাল্ট মামুলি ,অর্নাস কেটে গেল। চাকরীর বাজার নেই, আর মন ঊরু ঊরু, বিপ্লব আনবে, মিথ্যা রঙিন স্বপ্নে ভবিষ্যত নষ্ট করছিল।


 হঠাৎই বড়দার লাল্টু এক ট্রাক দুর্ঘটনায় এমন দশা, ছমাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারপর প্রানে বাঁচলেও কাজে ফেরা, বিশেষত তার পূর্বতন পেশা ট্রাক ড্রাইভারী দুরঅন্ত। এদিকে দাদার এ দুর্ঘটনার আগে বিয়ে হয়,বৌদি গর্ভবতী ছিল,বাচ্চা হল। মেঝ দাদার আয়ে সংসার চলে না।তার উপর প্রবল চাপ আসছিল, সঙ্গে আত্মাগ্লানি।


বিপ্লবী নেতা,আর্দশ শিক্ষক গুরু, অভিন্ন সিনিয়র বন্ধুদের স্বরূপ সে চিনেছিল।পল্টুর মনে হয় শুধুই তাদের ফাঁকা সহানুভূতি, অন্তরসার শূন্য জ্ঞান, আর বড় বড় ন্যাকামো  ভাষন, বিশ্ব পরিস্থিতি, জাতীয় সংকট, রাজ্যের দুর্দশার গালভরা যতসব আলোচনা !অলীক জগতের মানুষ,সবজান্তা ভাব। পল্টুর হতাশাগ্রস্থ ব্যর্থ জীবনে মনে হচ্ছিল যত সব ন্যাকা চন্ডী। মুখে বাঘ মারে বাস্তবে, ছুঁচো মারার ক্ষমতা নেই। যে সময় সে বুঝল, তখন অনেকটাই দেরী হয়ে গেছিল। 


হঠাৎই তার বাল্য বন্ধু পাশের গ্রামের রবি রুদ্রর সাথে দেখা।আরবে তিন বছর চাকরীসুত্রে ছিল, ছমাস ছুটিতে বাড়ি এসেছে ।পল্টু তার পরামর্শে আর সহযোগিতায় যাবতীয় যোগাযোগ পাসপোর্ট ভিসার জোগাড় হল, রিকুটমেন্ট এজেন্টের শর্ত বা বন্ড হাজার ঝক্কি সব রবি সামলানোর পর, আরবে পল্টুর চাকরীর একটা ব্যবস্থা হল। 


বাড়িতে, সেই সময়ে অর্থনৈতিক হাল খুবই খারাপ, তাই কেউ আপত্তি করেনি। আর পাশের গ্রামের ছেলের রবি অনেক টাকা এসেছে, জমি কিনছে ,বাড়ি করছে, এসব দেখে বাড়ির মানুষ মা বাবা তারাও আশা করেছিল।


পল্টুর আরব যাত্রা সুখের ছিল না,রবির মত ভাগ্য সঙ্গ দিল না। খুব শীঘ্রই এক আইনি ঝামেলায় আরবে থাকাকালীন তার দুবছর জেল হল।বাড়ির মানুষ জানত না,পল্টু বলেনি, চিঠিপত্র লিখত না।রবিও দুবছর দেশে আসেনি।পল্টু পরে জেল থেকে ছাড়া পেলে, এক অনাবাসী ভারতীয় সহযোগিতার একটা কাজ জোটে। সেখানকার চাকরীর বন্ডের বা শর্ত অনুসারে দুবছর সে বাড়ি আসতে পারে না।চিঠির লিখত সে কিন্ত উত্তর পেতো না। টাকা কম কম বারে বারে না পাঠিয়ে, পল্টু ভেবেছিল রবির মত, একসাথে সেও অনেক অর্থ নিয়ে বাড়ি ফিরবে ।


বাড়িঘর তাদের বাবার আমলে তৈরী।খানা জংশন নেমে কিছুটা গ্রাম্য মোরাম রাস্তা বরাবর রিকশা বা হাঁটা পথ । গ্রাম ঢুকতেই পড়ে তাদের বসত বাড়ি। তারপর গ্রামের হাইস্কুল,গ্রামের বাকী মানুষের বাস তারপর শুরু,তাদের বাড়ি থেকে একটু দুরে। রাস্তার ধারে, নির্জনে ফাঁকা মুক্ত পরিবেশ , তাদের পৈতৃক জমিতে সখের বাড়ি, বাড়ি সংলগ্ন জমিতে সব্জির চাষ, বাড়ির চাহিদা মিটে বরং কিছু বিক্রি হত। গো পালন, কিছু হাঁস দেশী মুরগিও ছিল। 


বিমান যোগে পল্টু সেদিন কলকাতা এল তখন সন্ধ্যা গাড় হয়েছিল।তারপর রাতে ঐ দিনই হাওড়া থেকে মোঘলসড়াই প্যাসেঞ্জার ধরে, খানা জংশন, তার আর তর সইছিল না। অসুস্থ বাবা, আর মায়ের জন্য তার মন ব্যাকুল, সঙ্গে দাদারা বৌদি, ভাইঝি ,মেঝদার বিয়ে হল কীনা।হাজার আশা উৎকন্ঠা আর আবেগ।


এদিন ট্রেন বেশ লেট, আটের দশকের মাঝামাঝি 

 যখন সে আরব যায়, তাদের গ্রামের তখন বিদ্যুত এসেছিল।তাদের গৃহে বিদ্যুতের সংযোগ ছিল না।

বৈদ্যুতিক পোল তাদের নিঃসঙ্গ গৃহের নিকটে নেই, গ্রাম থেকে খানা জংশন যাবার পথে একটু দুরে, মাঠের মধ্যে একটি মাত্র পল্টুদের বাড়ির ।এই জন্য ইলেকট্রিক পোল পোঁতার গরোজ বা কোন যুক্তি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা,পঞ্চায়েত,বা বিদ্যুত দপ্তের কর্মীদের মনে হয় নি ! 


 নিজের খরচে ইলেকট্রিক পোল বসিয়ে এই দুর্দিনে বৈদ্যুতিক সংযোগ বা বিজলী আলোর কথা তারা ভাবে নি।পল্টুর মনে স্বপ্ন ছিল, আজও যদি,তাদের বাড়ি, বিদ্যুত হীন থাকে, নিজের খরচে পোল কিনে বাড়ি অবধি পোল বসিয়ে, তাদের বাড়িতে বিজলী আলো সে জ্বালাবেই।


দীর্ঘ চার চারটে বছর কম নয়। বাড়ির সবার জন্যই কিছুনা কিছু পোষাক আসাক,কাপড় চোপড় জামা সে কিনেছে, চমক দেবে। মিষ্টি আর ফল, বিশেষত আরবের খেজুর এনেছে। ল্যগেজ বেশ ভারী, রাত তখন প্রায় একটা, ট্রেন খানা জংশনে থামল। টিম টিম করে স্টেশনের প্লাটফর্মে কয়েকটা মাত্র আলো জ্বলছিল। কিন্ত একটু গ্রামের পথে হাঁটতেই গাড় অন্ধকার নেমে এল।

মার্চের প্রথম দিক , রাতের আবহাওয়া তাই একটু ঠান্ডা,তবু পল্টু শরীরে ঘাম। দুটো ল্যগেজ, ব্যাগে মালে ঠ্যাসা বেশ ভারী। এত রাতে রিক্সা,ভ্যান ছোট জংশন স্টেশনে কিছুই নেই।মনে মনে ভাবছিল খুব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ রাতে বর্ধমানে কোন হোটেলে থেকে গেলেই ভালো হত। সকালে বাড়ি ফিরতাম। আবেগে অনেক সময়ই এমন ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে যায়।


 আকাশে শুক্লা প্রতিপদের চাঁদের দেখা নেই । নির্জন নিঃশব্দ পরিবেশ,নিশুতি গাড় অন্ধকারঘন গভীর রাত, কেমন থমথমে ভাব।দু একটা নিশাচর পাখির ডাক আর, কুকুরের কদাচিৎ আনাগোনা মাঝে মধ্যে নজরে আসছিল। মালবাহী গাধার মত ভারী বোঝা নিয়ে গ্রাম্য সংকীর্ণ মোরাম পথে হাঁটা বড় একঘেয়েমী, তার চেয়েও ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে পল্টু আর পায়ে জোর পারছিল না। অনেকটাই পথ দেড় দুই কিলো মিটারের কম নয়। 


একসময় পল্টু তার বহু প্রতিক্ষিত বাড়ির কাছে এসেছিল। বাড়ির কেউ জানে না সে আসবে,তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাতে সবাই নিদ্রা মগ্ন। এত রাতে বাড়ির দরজা বার বার কড়া নেড়ে কতক্ষনে যে বাড়ির মানুষদের ঘুম ভাঙ্গামো যাবে ! আর এ ছাড়া উপায় কী! তবে আজ একবার কড়া নাড়তেই পল্টু অবাক,দরজা খুলে মা বের হল। হাতে হ্যারিকেন, কালী পরা কাঁচে মৃদু সলতে উসকানো লাল আবছা আলোয়, কিছু স্পষ্ট দেখা যায় না। 


এতদিন শহরের কোলাহল আলো ঝলমল রঙিন জগত থেকে, আজ যেন কোন আদিম যুগে তার এই আগমন ।

 কেমন ক্লান্ত কাহিল মা, উদাসীন বিষন্ন গলায় নিচু স্বরে বলল, " তুই এসেছিস পল্টু ! "

" হ্যাঁ মা,তোমারা ভালো আছো! " বলে পল্টু প্রনাম করতে যায়। 

মা শঙ্কিত হয়ে বেশ খানিকটা সড়ে যায় বলে, "যবনের দেশ থেকে এসেছিস বাবা।বাড়িতে গঙ্গা জল রাখা আছে, কাল গঙ্গার জল ছিটিয়ে বামুন ঠাকুর তোকে শুদ্ধ করবে,তারপর আমাদের ছোঁবি। "


পল্টু একটু দুঃখ পেয়ে বলল," তাই হবে মা, আজ 

কী ঘরে ঢুকতে পারব!"

"বাইরের বৈঠকখানায় আজ রাতটা কাটা,ওখানে বিছানা বালিশ সব আছে। মালপত্র সব আজ ওখানেই রাখ।"

বৈঠকখানার ঘরটা বাড়ির মুল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন, কেবল একটি সংযোগ দরজা ভিতরের মুল বাড়ির সাথে যুক্ত। মা বৈঠকখানার বাহির দরজার কপাট খুলে দিল, পল্টু ঘরে ঢুকল।

মা বলল,"বাড়ির সবাই ঘুমুচ্ছে ,ওদের রাতের ঘুম নষ্ট করে লাভ নেই, তুই এঘরে ঘুমো, সকালে উঠলে সব শুনব।" এরপর সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে মুল গৃহে ঢুকে গেল। 


মা কেমন উদাসীন, এতদিন পড়ে এলাম! এক গ্লাস জল খেতে দিল না! কেমন আছি,কিছু খাবো কিনা ,কিছুই জিজ্ঞেস করল না ! হয়ত মায়ের কোন রাগ অভিমান আছে! চার বছরে কত সমস্যা কত বিপদ গেছে কে জানে ! সে মেধাবী তাই অনেক আশা নিয়ে এত অসচ্ছল ঘরে ছেলে হলেও তাকে কত খরচ করে নামী কলেজে কলকাতায় ভর্তি করে। যোগ্য ছেলের বিন্দুমাত্র কাজ সে করতে পারেনি।


 মগোজ ধোলাই হয়ে দীর্ঘদিন সময় নষ্ট করেছে। তার কাছে হয়ত আর বাড়ির মানুষ কোন আশাই করে না। এইসব নানা কথা ভেবে চোখের জল মুছে বৈঠক খানার মেঝেতে পল্টু ল্যগেজ ব্যাগ রেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল । ব্যাগ থেকে একটা জলের বোতল বের করে একটু জল খেলো।ক্ষীদে ছিল, ব্যাগে মিষ্টি ফল সব ছিল, দুঃখে অভিমানে হতাশায় কিছুই খেলো না।


ঘরে খিল লাগিয়ে সবে হ্যারিকেনের সলতে নামিয়ে প্রায় নিভিয়ে, হাজার চিন্তা, আত্মগ্লানিতে বিছানায় উঠবে। বাইরে মুল বাড়ির ভিতর হঠাৎই একটা তর্কাতর্কি গুঞ্জন সে শুনতে পেলো।মাকে যেন কেউ বকাবকি করছে ! বড়দার গলা ! 


মা বলছে "কী করব মা হই তো ,তোরা বুঝবি না।" বাবার কষ্ঠের মত মনে হল কেউ বলছেন, বড় দাদার উদ্দেশ্যে "দেখ লাল্টু তোর ভাই ওটা,শত্রু নয়, ও তাদের কোন ক্ষতি করে নি। আর ও তো এ পরিবারের ভালোর জন্য আরবে কাজে গেছিল, দুর্ভাগ্য ওর, আমাদেরও ওকে জেল যেতে হল।" 


মেঝদা বল্টুর গলা এবার শুনল, "ওকে নিয়ে এসব ভেবে কী হবে! এ ঘরে ও এক রাতও থাকবে না ,আমি সব সত্যিটা বলে ওকে বার করে দেবো, তাতে ও মরে মরুক।"

 

মা বলল "ওর সদিচ্ছার,ভালোবাসার অভাব নেই , আমাদের সবার জন্য ব্যগভর্ত্তি কত সব পোষাক কাপড় চোপড় এনেছে!"

" কে পড়বে! তুমি পড়বে?

"ওর কী দোষ, ও কী জানে ! "

" এ বাড়িতে ও থাকতেই পারে না, ওকে ডাকলে কেন! সত্যি বলতে কষ্ট হচ্ছিল ! "

" কী বলছিস বল্টু ! ও ভীষন ক্লান্ত, দুর্বল শরীর বেচারা বিকাল থেকেই কিছু খায়নি, কত দুর থেকে কত আশা নিয়ে আসছে !এত ভারী ব্যাগ নিয়ে এক মাইল হেঁটেছে ,সব সত্যিটা ওকে বললে সহ্য করতে পারত ! নির্জন ও একা, অন্ধকার গভীর রাত, ওতো ভয়ে ভিরমী খেয়ে মরেই যেত!"

" যাক না মরে, আমাদের সাথে থাকার ওর বড় সখ তো !"

 বাবা গলা এবার ধমকের সুর "ছি বল্টু,ও বংশের একমাত্র আশা, বেঁচে আছে ,ও থাকলে বিয়ে থা করলে আমাদের বংশ থাকবে।"

"দরকার নেই বংশের, আমি ওকে সব সত্য জানাব এখুনি এই রাতেই ! "

পল্টু কেমন সব হেঁয়ালী মনে হয়। হঠাৎই নজর পড়ে, ঘরের হ্যারিকেন কেমন রহস্যজনক ভাবে পুরো দমে জ্বলছে, আর ঘরের দেওয়াল জুড়ে যে আয়না যেখানে,একটা সাদা কাপড় ঢাকা মনে হল শবদেহ! কিন্ত কার প্রতিবিম্ব! ঘরে তো কিছুই নেই! এবার একটা নয় ! ছ ছটা আয়নায় দেখতে পাচ্ছে সাদা কাপড়ে ঢাকা শবদেহ,আর যার মধ্যে একটা শিশুর! তীব্র ভয় আর আতংকে পল্টু কাঁপছিল।


 বাইরের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বাড়ছিল, বাবা মা বার বার তাকে গার্ড করছে।আর দুই দাদার এ গৃহে তার উপস্থিত সহ্য নয়।এ বাড়ী তাদের, এ বাড়ী কোন জীবিত মানুষের নয়। সে ভাই হোক,আর যেই হোক ,বাড়িতে ঢুকেছে মরতেই হবে। জোরে জোরে বৈঠকখানার আর মুল বাড়ির সংলগ্ন দরজায় এবার ধাক্কাধাক্কি শুরু হতেই পল্টু ভয়ে অচেতন হয় পড়ে। 

বাবা মায়ের তীব্র বিরোধ, আর প্রতিরোধে এই ধাক্কাধাক্কি দুই দাদার একটু পর বন্ধ করেছিল, কিন্ত পল্টু তখন অচেতন। 


যখন জ্ঞান ফিরল,সূর্য উঠেছে ভাঙ্গা পুবের জানালা দিয়ে চোখে রোদ পড়ছে।সে তাদের বৈঠকখানায় কিন্ত, না বিছানা ! না বালিশ ! না খাট, হ্যারিকেন আয়না কিছুই নেই,শুধুমাত্র তার দুটি মস্ত ল্যগেজ মাথায় লাগিয়ে লতা পাতা ছোট গুল্মের জঙ্গলে ভরা মেঝে আধ শুয়ে আছে। ঘরের উপরে ছাদ আছে, দরজা জানালার কপাট নেই ,ফ্রেমের ভগ্ন দশা,পুবের জানালা দিয়ে রোদ ঢুকছে।


চমকে দ্রুত সে উঠে দাঁড়াল, ঘর থেকে বের হল,তাদের সমস্ত বাড়ির একই হাল পরিত্যক্ত পুরোন যেন এক ভুতুরে বাড়ী। গতরাতে যা কিছু দেখেছে সব মায়া, অলৌকিক ভ্রম।মুল বাড়িটাও ভগ্ন পরিত্যক্ত, তবু সীল করার মত কাঠের সদর দরজার ফ্রেমের উপর ঘন ঘন বাঁশ দিয়ে অজস্র গজাল পিটিয়ে ব্লক করা, মানুষ কেন, কুকুর বিড়াল ঢুকতে পারবে না। 


তবে অশরীরী সব পারে, বৈঠকখানা বনজঙ্গল ভরা ঘরেতে সুসজ্জিত খাট বিছানা রাতে দেখেছে।তাই রাতে ভৌতিক অলৌকিক বলে, মা তাকে ভিতরে মুল গৃহে ঢুকাতেই পারত। তবে দুই দাদা যে আরও নিকট আয়ত্ত সীমানায় পল্টুকে পেলে কী আচরণ তার প্রতি করত, মায়ের মনে সংশয় ছিল।তাই মা তাকে বৈঠক খানায় থাকতে বলেছিল।এই রাত টুকু সময়ের জন্য, পল্টুর এমনই মনে হয়। মৃত অশরীরী মায়ের ভালোবাসা স্নেহের কথা ভেবে দুচোখ জলে ভরে যায়।


 জীবিত দশা কালেই দুই দাদা, পল্টুর হটকারী রাজনীতি, আর দেশ ছেড়ে আরবে পাড়ি ভালো চোখে দেখত না।বিশেষত তাদের অপঘাতে মৃত্যুর আগের পল্টুর আরব যাত্রার প্রথম আড়াই বছর পল্টু একটা টাকাও পাঠাতো না, চিঠিপত্রও প্রথম দুবছর দেয়নি।জেল যাবার কথা তারা জানত না তাই দাদাদের তার প্রতি চরম স্বার্থপর বেইমান ধারনা সৃষ্টি হয়। পরে পত্র এলেই বাবা মা কে না জানিয়ে দাদারা ও বৌদি পল্টুর চিঠিপত্র ছিড়ে ফেলত।পল্টু হতাশায় ভাবত ডাকযোগে গোলমাল আছে, চিঠিপত্র মা বাবা পায় না। পল্টু পত্র লেখাই ছেড়ে দেয়।


এবার নজর পড়ল সকলে তাদের বাড়ির পাশ বরাবর গ্রাম্য পথ দিয়ে,গ্রামের মানুষ শংকর বাগ্দী গরুর লাঙ্গল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে।তাকে দেখেই শংকর তীব্র ভয়ে চমকে ওঠে ,ভয়ার্ত্ত আতংকিত মুখে সে রাম রাম করছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভগ্ন পরিত্যক্ত বৈঠকখানা থেকে বের হয়ে পল্টু রাস্তার পাশে একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাল্য স্মৃতি মনে করছিল।


পল্টু এবার আশ্বাস সুরে বলে,"শংকর দা, আমি পল্টু জীবিত, বেঁচেই আছি, গতকাল রাতেই দীর্ঘ চার বছর পর আরব থেকে বাড়ি ফিরেছি, কিছুই জানি না।" তারপর গতরাতের তার সব অভিজ্ঞতা বলল।


শংকর যেন প্রান ফিরে পায়।সে বলে "আজ থেকে দেড় বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির দুপুরে তোমাদের বাড়ীতে এক ভয়াবহ বজ্রপাত হয়, তখন ভাদ্র মাস, ফাঁকা মাঠে তোমাদের বাড়ীতে ঐ অভিশপ্ত বাজ এতটাই তীব্র আর ভয়ঙ্কর ছিল,তখন সবাই ওরা একসাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছিল । সবাই ঝলসে বাজের আঘাতে মারা যায় । সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর ঘটনা আজও গ্রামের মানুষ কে আতংকিত করে,কেউ বাঁচেনি । " 


একটু নীরব থাকে দুঃখে স্মৃতিচারণ করে ভারী গলায় বলে " তুমি ছিলে না, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মৃত্যুর জন্য সরকারের একটা ত্রান আছে নিকট আত্মীয়স্বজন দের ক্ষতিপূরণ দেয়, যাক সে কথা। তোমার মা মারা গেলেও মা ! আর বাবা,সন্তান স্নেহ ভুলে না। মা তোমাকে যে প্রনাম করতেও দেয়নি, অশরীরীকে স্পর্শ করলে শুনেছি সে মারা যায়। আর যাতে রাতের অন্ধকারে সব সত্য জেনে ভয়ে মরে যাও ! তাই মিথ্যার গল্প বানিয়ে, বৈঠকখানায় থাকতে বলেন।"


কিছুটা আতংকিত আর ভয়ার্ত্ত মুখে , মুল ভগ্ন পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে তাকায়, পরে মৃদু চাপা স্বরে সে বলে " মুল বাড়ির ভিতর ঢুকলে কেউ বাঁচে না।কুকুর বিড়াল রাতে ঢুকলে আর রক্ষে নেই, ওরাও জেনে গেছে।গতবার কালবৈশাখীর সময় এক রাখাল ছেলে বৃষ্টির সময় বিকালে ঐ বাড়িতে বৃষ্টি ঝড় থেকে রক্ষা পেতে ঢুকেছিল,সন্ধ্যার পর বাড়ি না ফেরাতে বাড়ির মানুষ খোঁজখুজি করে। বাচ্চা ছেলে এ অভিশপ্ত ভুতুরে বাড়ীর কথা জানত না,সে আর জীবিত ফিরে নেই। পরদিন সকালে তার মরা ফ্যাকাশে শরীর ঐ অভিশপ্ত বাড়ি থেকে পাওয়া গেল। 


ঐ রাতে রাখাল ছেলের বাড়ির লোকদের গ্রামের মানুষ এ বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি।পুলিশকে খবর দেয়, পুলিশ এল, তখন রাত দশটা।বাড়ির ভিতর যেতে পারেনি।ভয়ঙ্কর কিছু দৃশ্য দরজার কাছে যেতেই দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়।তারপর পরদিন মুল বাড়ি পুলিশ সীল করে, এখন কুকুর বিড়ালও মুল গৃহে ঢুকতে পারে না।


গভীর রাতে কেউ কেউ চলাচলের পথে হঠাৎই ওদের আবছা দেখেছে,ঘরের ভিতর থেকে,বিকট চিৎকার কখনও বা কান্নার শব্দ শুনেছে, তবে ভয় পেলেও, কেউ মরেনি। এক ভুতের ওঝা গননা করে বলেছিলেন, বজ্রপাতের ওদের মৃত্যুর সংলগ্ন আর প্রত্যক্ষ এলাকায় ওরা চরম সক্রিয়, সূর্য ডোবার পর সেখানে ভয়ঙ্কর এক অলৌকিক প্রভাবে ওদের অতৃপ্ত আত্মা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, লৌকিক জগতের জীব সে সময়ে ওখানে উপস্থিত থাকলে মারা যায়। 


বৈঠক খানায় আর সংলগ্ন রাস্তায় পরোক্ষ প্রভাবে ওরা ভয় দেখায়, আর কিছু করতে পারেনা।আর তোমার মা বাবা অশরীরী হলেও তোমার সঙ্গেই ছিল। তাই তোমারও সাহস ছিল। তীব্র একাকীত্বের ভয়ে তুমি ভিরমি খেয়ে মরো নি বা হয়ত অশরীরী হলেও তোমার বাবা মায়ের আর্শীবাদে তুমি বেঁচে আছো।"


শংকর পল্টুকে এরপর এ বাড়ীর মায়া ছেড়ে কোন আত্মীয়স্বজন বাড়ীতে চলে যেতে পরামর্শ দেয়। তারপর নিজের কাজে সে মাঠে লাঙ্গল নিয়ে চলে গেল। 


পল্টু , সমস্ত পরিবারের মানুষদের হারিয়ে দুঃখে কাঁদবে ! না এই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচবে ! তবে অশরীরী হয়েও মা যে স্নেহময়ী মা ই থাকে,আর বাবার স্নেহভরা রক্ষন থাকে, পল্টু অনুভব করল।


এ গ্রামের মায়া কাটিয়ে পল্টু তারপর মামার বাড়ি গলসী চলে যায়।






Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror