অনন্য মাতৃত্ব
অনন্য মাতৃত্ব
মাতৃত্বের আস্বাদ কে না গ্রহণ করতে চায়! সব মেয়েরাই নিজের জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে চায় তার কোল আলো করে কেউ আসুক। যার কাছ থেকে সে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য লাভ করবে। অহনাও তার ব্যাতিক্রম না। কিন্ত ভাগ্য, সে অহনার সাথে পরিহাস করেছে। বিয়ের ৭ বছর হয়ে যায় কিন্তু অহনা গর্ভধারণ না করতে পারায়, পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রায় সকলেরই কাছ থেকেই প্রতিনিয়ত নানা কটূক্তি শুনতে হয় অহনাকে। শহরের নামি-দামি ডাক্তার, বদ্দি কোনো কিছুই বাদ যায়নি। কিন্ত ফলাফল সেই শূন্য।
একদিকে নিজের অক্ষমতা তো আরেক দিকে স্বজন-পরিজনদের ব্যাঙ্গ এবং কটূক্তি। সবকিছু মিলিয়ে অহনার জীবনটা যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তাই তো ধীরে ধীরে অহনা সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে শুরু করে দেয়। সারাদিন ঘরের চারদেয়ালে নিজেকে বন্দি করে রাখে। পরিবারের কারোর সাথে কথা বলা দূর, এখন তো অহনা নিজের নিত্যনৈমিক কাজগুলো পর্যন্ত করে না। দিন দিন কেমন যেন নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে, এমনকি পরিমলের থেকেও।
নিজের স্ত্রীর এমন অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা পরিমল। তাই অহনাকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য পরিমল মনোবিদের দ্বারস্থ হয়।
এদিকে অহনার প্রতিনিয়ত গুমড়ে থাকা আচরণ এবং অক্ষমতার জন্য পরিমলের মা-বাবা অহনার সাথে ডিভোর্স করিয়ে পরিমলের দ্বিতীয় বিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু ওনাদের এই ইচ্ছেতে বাঁধ সাধলো পরিমল। সে কিছুতেই নিজের স্ত্রী অহনাকে ছাড়তে রাজি নয়। পরিমল নিজের বাবা-মা'কে বোঝানোর চেষ্টা করে তাঁরা পরিমলের জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ অহনা।
অসংখ্য থেরাপি-ওষুধ এবং পরিমলের ভালোবাসা ও যত্নে বছর দুই পর অহনার জীবনটা পুনরায় ছন্দময় হয়ে উঠলো। এবার যাতে অহনা এই ছন্দময় তাল কাটিয়ে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে না নেয় তাই অনেক বুঝিয়ে একদিন পরিমল অহনাকে একটা অনাথ আশ্রমে নিয়ে গিয়ে ওর হাতে একবছরের ছোট্ট শিল্পীকে তুলে দিয়ে বলে, "আজ থেকে শিল্পী আমাদের মেয়ে।"
অহনা ছোট্ট শিল্পীকে কোলে নিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করতেই অহনার চোখে জল এসে যায়। হটাৎ যেন নিজের অন্ধকার জীবনে আলোক তরঙ্গের উৎসের সন্ধান পেয়ে যায়। অহনা শিল্পীকে নিজের মমতা এবং ভালোবাসার আঁচলে ঢেকে বছরের পর বছর, দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।
আজ অহনার সেই ছোট্ট শিল্পীর সাধ অনুষ্ঠান। অহনা শিল্পীকে হলুদের উপর লাল সুতোর কাজ করা একটা জামদানি পরিয়ে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে নিয়ে এসে বসালো। শিল্পীকে ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করার সময়ে অহনার চোখের কোন থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো দেখে শিল্পী তার মাকে জিজ্ঞাসা করে, "কি হলো মা? তোমার চোখে জল কেন?"
অহনা গাল ভর্তি হাসি নিয়ে বলে," এটা তো আনন্দাশ্রু। আমার সেই ছোট্ট শিল্পী আজ কত বড়ো হয়ে গেছে! খুব শীঘ্রই সে মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে এক সম্পূর্ণ নারীতে পরিণত হবে।"
হটাৎ করে শিল্পীকে পেটে হাত দিতে দেখে অহনা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে শিল্পী বলে, "মা মনে হলো বেবি কিক করলো। "
এটা শুনেই অহনা শিল্পীর পেটের ওপর হাত রেখে শিল্পীর অনাগত সন্তানকে অনুভব করার চেষ্টা করে। অহনার পূর্ণ মাতৃত্বের আস্বাদ গ্রহণ করতে না পারার আক্ষেপটা আজ যেন মিলিয়ে গেল। সকলের অজান্তে মাতৃত্বের প্রতিটা পর্যায়ের যে অনন্য স্বাদ, সেই স্বাদ শিল্পীর মাধ্যমে অহনা আজ প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করছে।
শিল্পীর পেটের ওপর হাত রেখে শিল্পীর অনাগত সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বলে, "ছোট্ট সোনা তাড়াতাড়ি আসো। আমরা সবাই যে তোমার অপেক্ষা করছি।"
©স্বত্ব সংরক্ষিত
