অলৌকিক
অলৌকিক
প্রকৃতির সবকিছুই যেন অলৌকিক। ভোরের সূর্য ওঠা থেকে চাঁদ ওঠা, রাতের আকাশে তারা দের মিটমিট করে চেয়ে থাকা পর্যন্ত সবকিছুই!!!! কোথাও পাহাড়, কোথাও সমুদ্র আবার কোথাও সমতল, আবার কোথাও ঘন জঙ্গল। সবই কেমন অলৌকিক!!!! সমুদ্রের গভীরে যে... কাদের বসবাস তাও আমাদের অজানা!! সবাই সবার নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ, কেউ একচুল নড়াচড়া করেনা। প্রকৃতিই হচ্ছে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জীন। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে নতুন নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলে। প্রকৃতির বুকে প্রতিটাদিন কাটানো এবং তাকে দুচোখ ভরে উপভোগ করাটাও অলৌকিক ব্যপার। তবে প্রত্যেক মুহুর্তে কোথাও না... কোথাও অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে!!! যেটা নিজের চোখে দেখেও অনেক সময় বিশ্বাস করা যায় না...!! কারন মন আর মস্তিষ্কের মধ্যে সেই নিয়ে দ্বন্দ চলতে থাকে। এমনি একটা অলৌকিক ঘটনার বর্ননা আজ আপনাদের শোনাব!!!
আমার বাড়ি নদীয়া জেলার একটা ছোট্ট গ্রামে। আমি যে... সময়ের কথা বলছি তখন আমাদের গ্রামে বৈদ্যুতিক আলো আসেনি!!! যৌথ পরিবার ছিল আমাদের, অনেক লোকজনে বাড়ি গমগম করত। আমাদের চাষ আবাদ করেই দিন কাটত। আমাদের প্রচুর জমি জমা, পুকুর, বাগান ছিল। এক কথায় গ্রামের ছোটখাটো জমিদার বলা যায় আরকি। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ আমাদের পরিবার কে এক নামে চিনত।
শীতকাল মাঘ মাসের মাঝামাঝি। আমার দিদির মেয়ের বিয়েতে বর্ধমান গিয়ে ছিলাম আমি। বিয়ে বাড়ি থেকেই বেড়োতে বেড়োতে প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তাই যখন বাড়ি ফেরার জন্য ঘাটে আসলাম তখন রাত্রি দশটার কাছাকাছি। আর বাড়ি ফিরতে গেলে ঘাট পার হতে হবে!! কারন এটাই ছিল একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম!!! এত রাতে নৌকা পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। তাই মনে মনে ভাবলাম রাতটা বুঝি এইখানেই কাটিয়ে দিতে হবে!!!
হঠাৎ করে পিছন থেকে একটা চেনা গলার আওয়াজ আসল কানে, আরে বিশু তুই.... এখন এখানে!!!
আমি পিছন ঘুরে দেখলাম রহমান দা!! আমাদের গ্রামেই বাড়ি মেজদার বন্ধু। এই ঘাটে নৌকা পারাপার করে। আমি বললাম ঐ দিদির বাড়ি বর্ধমান গিয়ে ছিলাম, আসতে রাত হয়ে গেল, তারপর জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এখন এখানে কি... করছ??? বাড়ি ফেরনি!!! নৌকা পারাপারতো বন্ধ হয়ে গেছে।
রহমান দা একমুখ হাসি নিয়ে বলল, আমার একটু কাজ ছিল তাই দেরী হয়ে গেছে!! চল একসাথেই তাহলে ফিরি ভালোই হলো তোকে আর অপেক্ষা করতে হলোনা সারারাত!!!
আমি বেশ আনন্দ নিয়ে বললাম হ্যাঁ.... তা ঠিকই বলেছ। আমি নৌকায় উঠে বসলাম। রহমান দা নৌকা বাইতে শুরু করল। পূর্নিমার রাত চারিদিকে যেন চাঁদের আলো মুক্ত ছড়াচ্ছে। জলটা যেন চিকচিক করছে সেই আলোতে। চারিদিক জুড়ে কেমন একটা নিঃস্তব্ধতা, তবে থেকে থেকে রাতজাগা পাখি এবং শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। নৌকায় উঠে থেকে রহমান দা আর একটাও কথা বলেনি, কেমন অবাক শূন্য দৃষ্টিতে জলের দিকে চেয়েছিল!!!
ঘাটে আসার সাথে সাথে নৌকাটাকে পাড়ে বেঁধে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের গ্রামে ঢোকার আগে একটা কবরস্থান পড়ে। কবরস্থানের কাছে আসার সাথে সাথে রহমানদা বলল, এইবার তুই একাই চলে যা... আমি আর যেতে পারবনা!!!!
আমি অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলেছিলাম কেন তোমার বাড়িতো এখনও আসেনি!!! সেতো আমার বাড়ির অনেক পরে তাহলে যেতে পাড়বেনা কেন?? আর এত রাতে কবরস্থানে তুমি কি.... করবে।
রহমান দা একটু হেসে বলল, আমার কাজ আছে!! আর তাড়াতাড়ি পা... চালিয়ে বাড়ি যা... তাহলে সব জানতে পারবি!!! আর যাওয়ার পথে পিছন ঘুরে তাকাবিনা ঠিক আছে!!!
আমি বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাড়ির পথে পা... বাড়ালাম। তবে পিছনঘুরে যে... দেখতে ইচ্ছে হয়নি!!! তা কিন্তু নয়, তবে এর আগে কবরস্থানের নামে অনেক কিছু অলৌকিক কথা শুনেছি তাই আর সাহস করে পিছন ফিরে তাকায় নি!!!
*****************************************
বাড়ি ফিরে সদর দরজায় আঘাত করলাম বারকয়েক, তারপর বড়দা সাড়া দিল, এবং কিছুক্ষণের মধ্যে এক হাতে লাঠি আর এক হাতে হ্যারিকেন নিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
আমার দিকে তাকিয়ে বড়দা প্রশ্ন করল এত রাতে কি.... করে ফিরলি???? ঘাটে নৌকা পারাপার তো... বন্ধ হয়ে যায়!!!
আমি হাসতে হাসতে বললাম সে..... অনেক কথা এখন ঘুমিয়ে পরো সকালবেলায় সব বলব।
বড়দা আর কথা না... বাড়িয়ে ঘরে চলে গেল, আর আমিও জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল বেলায় চায়ের আসরে বসে কালকে রাতের সমস্ত কথা বললাম। সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল।
মা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল কি.... বলছিস তুই.? এটা কি... করে সম্ভব!
আমি অবাক হয়ে বললাম, সম্ভব না হওয়ার কি.... আছে?
বাবা বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললেন, গতকাল সকালে রহমান আত্মহত্যা করেছে, জলে ডুবে!!! দুপুরের দিকে তাকে মাটি দেওয়া হয়েছে। তাহলে রাতে সে... কি.... করে তোমাকে ঘাট পার করালো???
আমি যেন আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে পড়লাম। গলা দিয়ে যেন আওয়াজ বেড়োচ্ছেনা, শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবুও মৃদু স্বরে বললাম, ওর জন্য কবরস্থানের কাছে এসে রহমান দা বলল আমি আর যেতে পারবোনা!!!! আর পিছন ঘুরে তাকাবিনা!!!
সবাই একটা জোড়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল আর মা আমার মাথায় হাত দিয়ে ঠাকুরের নাম জপ করতে লাগল। আর আমার মনে নানা রকমের চিন্তা ভীড় করল এবং চোখের সামনে রহমানদার মুখটা ভেসে উঠতে লাগল। আর মনে মনে বলে উঠলাম এও সম্ভব। সত্যি এই দুনিয়া বড়ই অলৌকিক।

