অঘোরির প্রতিশোধ
অঘোরির প্রতিশোধ
ছোটবেলায় আমার দাদুর মুখে শোনা একটি গল্প । আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশে, কালো জাদু বছরের পর বছর ধরে ভাল এবং মন্দ উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়ে আসছে । এই মানুষদের তাদের কালো জাদুতে অগাধ বিশ্বাস আছে । বেশিরভাগ সময় এটি কুসংস্কার হয় তবে কিছু লোক তাদের প্রজন্মের পরম্পরা সম্পর্কে ভাল অধ্যয়ন করে এবং এই লোকেরা জানে কিভাবে তাদের অঘোরি বিদ্যা ব্যবহার করতে হয় ।
ঘানা আগে ব্রিটিশ শাসিত ছিল । সে সময় অনেক জায়গায় এদেশের মানুষ শ্বেতাঙ্গ কর্মকর্তাদের খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত । থমাস হারবিন নামে একজন ব্রিটিশ অফিসারের খামারে কাজ করছিলেন ম্যাম্বো নামে এক স্থানীয় যুবক । ম্যাম্বো কাজে ভালো ছিল কিন্তু দিনের পর দিন কাজে অনুপস্থিত থাকার বদ অভ্যাস ছিল তার । থমাস তাকে কয়েকবার তিরস্কার করেছিলেন এবং বরখাস্ত করার হুমকি দিয়েছিলেন । প্রতিবার ম্যাম্বো বরখাস্ত না করার জন্য অনুরোধ করতো, তাকে আশ্বাস দিতো যে এইরকম আর হবে না । কিন্তু একদিন বিরক্ত হয়ে থমাস তাকে বরখাস্ত করেন এবং তাকে আর খামারে উপস্থিত না হওয়ার নির্দেশ
দেন । এতে ম্যাম্বো খুব রেগে গেল এবং তার ভাষায় উচ্চস্বরে অভিশাপ দিয়ে চলে গেল ।
বেশ কিছু দিন কেটে গেছে এবং থমাস একদিন সন্ধ্যায় মাঠ পরিদর্শন করার জন্য মাঠে একা হাঁটছিলেন । তখন অবশ্য সমস্ত ক্ষেতমজুররা সারাদিনের কাজ শেষ করে বাড়ি চলে গেছে । হাঁটতে হাঁটতে তিনি হঠাৎ মাঠের মধ্যে একটি বুনো শুয়োর দেখতে পেলেন, বুনো শুয়োর দেখা মাত্রই থমাস ভয়ে কেঁপে উঠল । সেই শূকরটি দেখতে খুবই ভয়ঙ্কর ছিল । শুয়োরটি স্থির দৃষ্টিতে থমাসের দিকে তাকাল, মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বাঁকা কাঁটার মতো দাঁত প্রাণীটিকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল ।
প্রথমে থমাস ভেবেছিল পালিয়ে যাবে । কিন্তু শুয়োরটি সেখানে থাকলে খামারটি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এবং যদি সে দৌড়ে যায় তবে শুয়োরটি তাকে অনুসরণ করার ভয়ও ছিল তাই থমাস সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলেন ভয় না করে হাতে লাঠি নিয়ে পশুটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করলে হয়তো ভয়ে পালিয়ে যাবে । থমাস খুঁটির উপরের তার আঁকড়ে ধরলেন এবং দুই হাত দিয়ে এটিকে ধরে পোলটি উঁচু করলেন এবং আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমায় একটা দোল দিলেন । এই মুহুর্তে, থমাস লক্ষ্য করলেন যে শুয়োরটি কেবল তাকাচ্ছেই না বরং রাগের বশবর্তী হয়ে ঘোৎ ঘোৎ করে শব্দও করছে । তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে শুয়োরটি একেবারেই ভয় পায়নি বরং আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল । কিছুক্ষণের মধ্যে শুয়োরটা একটু এগিয়ে এল এবং পা দিয়ে কাদায় মারল । থমাস ভয়ে একটু পিছিয়ে গেল কিন্তু বুঝতে পেরেছিল যে কাদা মাড়ানোটি দৌড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত , কারণ পরের মুহুর্তে শুয়োরটি তার দিকেই দৌড়ে আসবে । থমাস একটু ঘুরে মাঠের শস্যাগারের দিকে দৌড়ে যেতেই শুনতে পেল শুয়োরটিও তার পেছনে দৌড়াচ্ছে । তিনি ভেবেছিলেন শুয়োরটি যে কোনও মুহুর্তে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে কিন্তু কোনোভাবে তিনি শস্যাগারে পৌঁছেছেন । একদিকে ভালো তার ভাগ্য শস্যাগারের দরজায় তালা দেয়নি । থমাস দ্রুত দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল ।
থমাস প্রচুর ঘামছিল এবং ভয়ে হাঁপাচ্ছিল । তিনি লক্ষ্য করলেন শস্যাগারে ঢোকার পর শুয়োরটি কোনো শব্দ করছে না, হয়তো সেখান থেকে চলে গেছে । কিন্তু ভীত এবং ক্লান্ত হয়ে থমাস কয়েক মিনিটের জন্য শস্যাগারে বিশ্রাম নিলেন এবং তারপর শস্যাগারে একটি টর্চ জ্বালিয়ে দরজা খুলতে উদ্যত হলেন । তখন বাইরে বেশ অন্ধকার । কিন্তু সত্যিই বাইরে শুয়োরটি ছিল না তা সত্ত্বেও তিনি প্রথমে টর্চের আলোয় যতদূর সম্ভব দেখেছিলেন , না শুয়োরটি ছিল না। এক হাতে টর্চ আর অন্য হাতে মোটা লাঠি নিয়ে তিনি তার গাড়ির কাছে গেলেন এবং বেশি সময় নষ্ট না করে বাড়ির পথ ধরলেন ।
থমাস খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখন থেকে যখনই খামারে যাবেন শটগানটা সাথে নেবেন এবং একজন চাকরকে সাথে নিয়ে যাবেন । পরের দিন পরিকল্পনা মতো তিনি একটি শটগান এবং কোডজো নামে একজন চাকরকে নিয়ে খামার পরিদর্শনে যান । সেদিনও সে সেই শুয়োরটিকে দেখেছিলেন । তিনি সঙ্গে সঙ্গে শটগান বের করে শুয়োরটিকে লক্ষ্য করে গুলি চালান । থমাসের লক্ষ্য সঠিক হলেও শুয়োরটিকে আঘাত করা যায়নি । থমাস দ্রুত বন্দুকটি লোড করে আরেকটি গুলি চালান । তবে শুয়োরের কিছুই হয়নি । ওনার সাথে আসা চাকরটি বেশ বিভ্রান্ত হয়েছিল । থমাস ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকালেন । থমাস ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করলেন "কডজো, তুমি কি এই শুয়োরটাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিতে পারবে ? " তখন কোডজো বললো "কোন পিগ মাস্টার ? আমি কোনো পিগ দেখতে পাচ্ছি না।" কথাটা শুনে থমাস হতবাক হয়ে গেলেন । তিনি পালানোর চেষ্টা করলে শুয়োরটি তাকে অনুসরণ করবে এবং বাধা দিলে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করবে তাই থমাস আবার চাকরকে জিজ্ঞাসা করলেন, " তুমি কি ঐ বড়ো শুয়োরটি দেখতে পাচ্ছ না ? " কোডজো আবার দুপাশে মাথা নেড়ে " না " করলো । থমাস প্রথমে বুঝতে পারে যে শুয়োরটি কেবল তাকে অনুসরণ করছে অথচ কোডজোর দিকে তাকাচ্ছেই না । থমাস ভেবেছিলেন যে যদি তিনি এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন তবে প্রাণীটি কিছুই করতে সক্ষম হবে না এবং তিনি সেখানে গর্জনকারী শুয়োরটির সামনে দাঁড়ালেন । শুয়োরটি কিছুক্ষণ গর্জন করতে থাকে কিন্তু শীঘ্রই প্রাণীটি থমাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে । থমাস মাটিতে শুয়ে পড়ল এবং শুয়োরটি তার সামনের পা তার বুকে রাখতেই এবং তিনি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন । থমাসের চোখের সামনে প্রায় দশ - বারো ইঞ্চি ছিল সেই শুয়োরটির ভয়ঙ্কর
মুখ । ভয়ে থমাস একেবারে নিথর হয়ে গেলেন । কোডজো তার দিকে দৌড়ে যেতেই এবং শুয়োরটি পালিয়ে গেল । কোডজো থমাসের সাথে গাড়ির কাছে গেল, থমাস তখনও ভয়ে কাঁপছিলেন । কোডজো থমাসকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল এবং তাকে পান করার জন্য জল দিল । জল খাওয়ার পর থমাস কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন তারপর কথা বলতে লাগলেন ।
থমাস : কোডজো, তুমি কি শুয়োরটি দেখতে পাচ্ছো ? এবং কেন ওটা আমার উপর হামলা করছিল ?
কোডজো : মাস্টার, আমি শুয়োরটিকে দেখতে পাচ্ছি না, তবে আমি বুঝতে পারছি এটি কী ধরনের । আমাদের সমাজে কেউ আপনার উপর কালো জাদু ব্যবহার করছে ।
থমাস : কিন্তু তুমি কাছে আসতেই শুয়োরটি চলে গেল কেন ?
কোডজো : আমাদের সমাজে আমরা ছোটো থেকেই একটি আচার পালন করে এই ধরনের শক্তি থেকে রক্ষা পাই । তাই হয়তো আমি কাছে আসতেই ওটা চলে যায় ।
থমাস : আমার মনে হয় যে শুয়োরটি আমাকে ধীরে ধীরে মারতে চায় । কিন্তু এর সমাধান কি ? তার জন্য আমি যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত ।
থমাস কোনোদিনও এই ধরনের জিনিসগুলিতে বিশ্বাস করেননি, কিন্তু অদ্ভুত শুয়োরটি অনুভব করার পরে বিশ্বাস না করে তার কোন উপায় ছিল না ।
কোডজো : আমি এমন একজন মানুষকে চিনি যে এই বিদ্যা জানে । তিনি একাই আপনার সমস্যা সমাধান দিতে পারেন ।
থমাস : আমরা কি এখন ওনার সাথে দেখা করতে পারি ?
কোডজো : চলুন আমি আপনাকে তার বাড়িতে নিয়ে যাই ।
তারা দুজনেই লোকটির বাড়িতে যায়। কাকৌল্লি নামের বৃদ্ধ লোকটি থমাসের সব কথা শোনে এবং তাকে বলে যে এটি অবশ্যই একটি ভুডু মন্ত্র এবং আপনার পুরানো শত্রু কেউ এটি করেছে । তিনি বলেন এর সমাধান নিশ্চয়ই আছে তবে এর জন্য প্রচুর অর্থ দাবি করেন । থমাসের টাকার অভাব নেই তাই দাবির সব টাকা দেয় এবং সমাধান চায় । কাকৌল্লি পরের দিন সকালে তাদের দুজনকে ডেকে পাঠান কারণ বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য তাকে সেই রাতে একটি অনুষ্ঠান করতে হবে ।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, পরের দিন থমাস আর কডজো কাকৌল্লির কাছে যায় । কাকৌল্লি থমাসকে একটি বোতল থেকে একটি কালো তরল দেয় এবং তাকে বোতল থেকে তরলটি শুয়োরটির উপর ঢেলে দিতে বলে যখন সে আবার উপস্থিত হবে তখন ।
পরে সেই সন্ধ্যায় থমাস এবং কাডজো খামারে ফিরে যান এবং আবার থমাস শুয়োরটিকে দেখেন । কিন্তু এবার থমাস সব কিছু সাবধানে করেন । তিনি জানতেন যে তিনি যদি কিছুক্ষণ শুয়োরটির দিকে তাকিয়ে থাকেন তবে এটি আবার তাকে আক্রমণ করবে । থমাস অপেক্ষা করছিলেন শুয়োরটির আক্রমণের জন্য । প্রত্যাশিত হিসাবে, শুয়োরটি গর্জন করে এবং থমাসকে আক্রমণ করে, কিন্তু এবার থমাস তার কোমর থেকে বোতলটি বের করে শুয়োরটির মুখে কালো তরল ঢেলে দেয় । পদার্থটি মুখে পড়ার সাথে সাথেই শুয়োরটি একটি অদ্ভুত চিৎকার দেয় এবং একটি কর্কশ শব্দ করে মাটিতে পড়ে যায়, কালো ধোঁয়ায় বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগে । থমাস একটু ভীত কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট যে সমাধান কাজ করেছে ।
পরের দিন, থমাস খবর পায় যে এক মাস আগে সে যে ম্যাম্বোকে তাড়িয়ে দিয়েছিল সে মারা গেছে । মৃত্যুর কারণ জানা না গেলেও তার মুখে ও বুকে বড় ধরনের পোড়া ছিল যেন কেউ তার মুখে ও বুকে গরম লাভা নিক্ষেপ করেছে । থমাস বুঝতে পারে যে ম্যাম্বোই তার উপর শুয়োরটির কালো জাদু নিক্ষেপ করেছিল এবং ম্যাম্বো নিজেই একটি শুয়োর হয়ে যায় এবং তাকে আক্রমণ করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ।
--------- সমাপ্ত ----------

