Dola Bhattacharyya

Classics Others Children

4  

Dola Bhattacharyya

Classics Others Children

অদ্ভুত কিছু গল্প

অদ্ভুত কিছু গল্প

7 mins
216



আমাদের বাড়ির সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই অনেক গল্প শুনে আসছি। এগুলো ঠিক গল্প না গুল্প তা কে জানে। আসলে আমার বাবা, জেঠুরা মুখে মুখে অনেক গল্প বানাতে পারতেন। গল্পগুলো সত্যি মিথ্যায় মিশিয়ে এক একটা অপরূপ আখ্যানে পরিণত করতেন তাঁরা। আর সেগুলো আমরা খুব মনোযোগ সহকারে শুনতাম। আজ সেইসব মানুষগুলো আর নেই। তবে আমার রাতের স্বপ্নের ভিতরে তাঁদের আসা যাওয়া টের পাই আজও । যে গল্পগুলো ফেলে গেছেন তাঁরা, সেগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে লিপিবদ্ধ করে রাখলাম আমার খাতার পাতায়। 

সেটা ছিল পৌষ মাসের হাড়কাঁপানো একটা শীতের সন্ধ্যা । বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে। জমিয়ে গল্পের বই পড়ছি। আচমকা লোডশেডিং হয়ে গেল। যাঃ। কি করব! তখনকার দিনে ঘরে ঘরে এমন ইনভার্টার ছিল না। মোমবাতি আর হ্যারিকেনই ভরসা। মা একটা হ্যারিকেন জ্বেলে দিয়ে গেল। ওই স্বল্প আলোতে বই পড়া মুশকিল। তাই বাবাকে ধরে বসলাম, "গল্প বলতে হবে"। 

 গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাবা বলতে শুরু করলেন, —:

আমার ঠাকুরদার ছিল ভ্রমণের সখ। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় তিনি ঘুরেছেন, পায়ে হেঁটে। একবার উত্তর ভারত ভ্রমণে গিয়ে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। কোনো একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে তখন যাচ্ছিলেন ঠাকুরদা। হঠাৎ শুনতে পেলেন কেউ যেন তাঁর নাম ধরে ডাকছে, "কুঞ্জ, কুঞ্জবিহারী, এসো, এদিকে এসো, আমার কাছে এসো"। ঠাকুরদা তো অবাক। এই বিজন দেশে কে ওঁর নাম ধরে ডাকছে! ঠাকুরদা খুঁজতে শুরু করলেন। খুঁজতে খুঁজতে ওই পাহাড়েরই একটা গুহার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। বুঝতে পারলেন, এই গুহার ভেতর থেকেই আসছে আওয়াজ টা। থমকে দাঁড়ালেন ঠাকুরদা। ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না ভাবছিলেন। এবারে সেই কন্ঠ বলে উঠল, "এসো কুঞ্জ, ভেতরে এসো। আমি অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য। 

গুহার ভেতরটা আবছা অন্ধকার মতো। চোখটা একটু সয়ে এলে ঠাকুরদা দেখতে পেলেন এক যোগী পুরুষকে। সৌম্যদর্শন। হরিণের চামড়ার আসনে বসে রয়েছেন। দৃষ্টি ওঁরই দিকে নিবদ্ধ। যোগীপুরুষ ঠাকুরদাকে বললেন," তোমার এখানে আসাটা পূর্ব নির্ধারিত। আমার ইচ্ছাতেই তুমি এখানে এসেছো। তোমাকে এখন অনেক কাজ করতে হবে। তার আগে আমি দীক্ষা দান করব তোমায়।" 

ইনিই হলেন ঠাকুরদার দীক্ষা গুরু। বারো বছর ধরে ওঁর কাছে সম্মোহন শিক্ষা করেন ঠাকুরদা। তারপর ফিরে আসেন ভাটপাড়ায়। 

(কার কথা মনে পড়ছে পাঠক? যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর কথা! হ্যাঁ। খটকা একটা আমারও আছে বটে। কিন্তু যখন শুনেছিলাম এসব গল্প, তখন তো শ্যামাচরণ লাহিড়ী সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।) 

ঠাকুরদা ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। সম্মোহনের মাধ্যমে বহুজনের বহু দূরারোগ্য ব্যাধি সারিয়েছিলেন তিনি। ওঁর লেখা দুটি বইও ছিল। বই দুটির নাম যথাক্রমে 'সরল মেসমেরিজম শিক্ষা', আর 'বিসূচিকা চিকিৎসা'। বই দুটি এখন বিলুপ্ত। 

মন্ত্রমুগ্ধের মতো গল্প শুনছিলাম। এবার জিজ্ঞেস করলাম, "বই দুটোর একটা কপিও নেই?" বাবা বললেন, নাঃ। নেই। সে কি আজকের কথা! ভারত তখনও ভাগ হয়নি। কত কদর ছিল তখন ওই বই দুটোর। তারপর শোন —একবার ঢাকার নবাব খবর পাঠালেন, তাঁর একমাত্র কন্যা গুরুতর অসুস্থ। ইংরেজ ডাক্তারের চিকিৎসা ব্যর্থ হয়েছে। ঠাকুরদাকে সেখানে যেতে হবে, নবাব কন্যার চিকিৎসার জন্যে। ঠাকুরদাকে নিয়ে যাবার জন্যে দ্রুতগামী ছিপ পাঠালেন নবাব। নবাবের ছিপ নৌকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ঘোড়ায় চেপে রওনা দিলেন ঠাকুরদা। ছিপ নৌকা পৌঁছানোর অনেক আগেই নবাব কন্যার চিকিৎসা করে, তাকে সুস্থ করে ফিরে এসেছিলেন ঠাকুরদা। নবাব ঠাকুরদা কে একটা বহুমূল্য পশমিনা শাল উপহার দিয়েছিলেন।

অদ্ভুত ব্যাপার! ঠাকুরদা গেলেন, চিকিৎসা করে ফিরেও এলেন, আবার উপহারও পেলেন। তারপর ঢাকায় পৌঁছোলো ছিপ নৌকার দল! ঠাকুরদা যদিও ঘোড়ায় গিয়েছিলেন। তবুও একদিনের মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে চিকিৎসা করে ফিরে আসা! ব্যাপারটা একটু কিরকম যেন হল না। ভাটপাড়া থেকে ঢাকার দূরত্ব কত? পাঠক! কি মনে হয়?যাইহোক, জিজ্ঞেস করলাম, "সে শাল এখন কোথায়"? 

বাবা বললেন, ধ্যুর বোকা! সে কি আর এখন থাকে! আমি নিজেই তো সেই শাল কখনো চোখেই দেখিনি। 

সম্মোহন বিদ্যায় ঠাকুরদার মতোই পারদর্শী ছিলেন বিনোদবিহারী, ঠাকুরদার ভাই, আমাদের ছোড়দাদু। ঠাকুরদা নিজে তাঁকে শিখিয়েছিলেন এই বিদ্যা। বিনোদবিহারী আবার অন্যভাবে কাজে লাগাতেন এই বিদ্যাকে। এর মাধ্যমে তিনি জনমনরঞ্জনের কাজ করতেন। জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার ছোড়দাদু কি ম্যাজিক দেখাতেন"? 

ঠিক বলেছিস। ওই ম্যাজিক দেখার লোভে কত লোক আসত। আমাদের এই বাড়িটাই ছিল ছোড়দাদুর বাড়ি। ঠিক এই ঘরটাতেই বসত ম্যাজিকের আসর। ঘরের মাঝখানে একটা মাঝারি মাপের চৌকিতে বসে গড়গড়া টানতেন ছোড়দাদু। আর চৌকির চারপাশ ঘিরে বসত বাকি সকলে, মানে ছোড়দাদুর সাঙ্গপাঙ্গরা । রোজ সন্ধ্যায় ভিড় জমাত তারা ম্যাজিক দেখার লোভে। আর ভারি অদ্ভুত ছিল সেইসব ম্যাজিক। যেমন, ঘোর শীতের সন্ধ্যায়, কেউ হয়তো পাকা কাঁঠাল খেতে চাইল। কিংবা ভরা বর্ষায় কেউ হয়তো বলে বসল, ছোড়দাদু, বড় লাউ চিংড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। ছোড়দাদু কেবলমাত্র শুণ্যে একবার হাতটা ঘুরিয়ে কোথা থেকে একটা লাউ বা কাঁঠাল পেড়ে এনে তাদের হাতে দিয়ে বলতেন, যা! বাড়ি গিয়ে খা গে! লাউ প্রেমী এবং কাঁঠাল প্রেমী দুজনেই খুশি। তারা তো তক্ষুণি বাড়ির রাস্তা ধরল ।কিন্তু ঘর থেকে উঠোনে নামতেই লাউ - কাঁঠাল দুটোই হাওয়া। একদিন সবাই ধরে বসল, ছোড়দাদু, ওসব ম্যাজিকের লাউ কাঁঠাল অনেক খাইয়েছো। এবার নতুন কিছু দেখাও। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। ঘরে তখনও আলো জ্বালানো হয় নি। 

ছোড়দাদু বললেন, এইরে। আজ তো কিছু দেখাতে পারবো না। আমাকে যে এক্ষুণি বেরোতে হচ্ছে। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, কোথায় ছোড়দাদু! কোথায় যাবে তুমি! 

এই দ্যাখ না, স্বর্গ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র ডেকে পাঠিয়েছেন। ওখানে দেবাসুরের মধ্যে ভীষণ লড়াই বেঁধেছে। আমাকে গিয়ে অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে। তোরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। গোটাকতক অসুর মেরেই আমি ফিরে আসব। এসে তোদের যুদ্ধের গল্প বলব ক্ষণ। বলতে বলতেই ছোড়দাদু ভ্যানিশ। সবাই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কোথায় গেল মানুষটা! হঠাৎ শোনা গেল - মার-মার! ধর-ধর! কাট-কাট! কী ভীষণ শোরগোল! সবাই তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে। ও কিসের আওয়াজ! হঠাৎ ঘরের মাঝখানে কোত্থেকে একটা কাটা মুন্ডু খসে পড়ল। মাথায় বড় বড় শিং। রাক্ষসের মুন্ডু! সকলে চেঁচিয়ে উঠল ভয়ে, ছোড়দাদু! কোথায় তুমি? অদৃশ্য ছোড়দাদু উত্তর দিলেন, ভয় পাস না। এক্ষুণি আসছি আমি। বলতে বলতেই কোত্থেকে একটা কাটা হাত এসে পড়ল। তারপর একটা কাটা পা ।সকলের তো ভয়ে দাঁতকপাটি লাগার যোগাড়। 

অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল ছোড়দাদুর গলা, কিরে! এতেই ভয় পেয়ে গেলি! তবে যে বললি নতুন কিছু দেখবি! ঘরের আলোটা একজন জ্বালিয়ে দিতেই সকলে দেখতে পেল, ছোড়দাদু নিজের জায়গাতেই বসে মিটিমিটি হাসছেন। 

ছোড়দাদুর এক বন্ধু ছিল। তার নাম ছিল ভুবন। বিহারের ছাপড়া জেলায় ছিল তার বাড়ি। থাকত এখানেই। আমাদের বাড়িতে তখন বেশ কিছু আশ্রিত বাস করত। আস্তাবলের পেছন দিকটায় ছিল সেইসব আশ্রিতদের ঘর। ভুবনদাদুও সেখানেই থাকতেন। 

ভুবনদাদু ছিলেন ঘোরতর ভুত অবিশ্বাসী। ভগবানে বিশ্বাস থাকলেও ভুতে ছিল তীব্র অবিশ্বাস। এই নিয়ে ছোড়দাদুর সাথে অনেকবার বাকবিতন্ডাও হয়েছে। একদিন ভরা আসরে ছোড়দাদু প্রতিজ্ঞা করলেন, ভুবনকে আমি ভুতে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়ব। সবাই বলল, কিভাবে হবে ব্যাপারটা? 

ছোড়দাদু হাসতে হাসতে বললেন, দ্যাখ না! শুধু দেখে যা তোরা, কি করি আমি। ভুবনদাদু তো কটমট করে তাকিয়ে রয়েছেন ছোড়দাদুর দিকে। ছোড়দাদুও হাসি হাসি মুখ করে ওঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। হঠাৎ ছটফট করে উঠলেন ভুবন দাদু। পেটটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি উঠে আস্তাবলের দিকে দৌড়োলেন ভুবন দাদু। ছোড়দাদু তো সঙ্গে সঙ্গে দুজন কে পাঠালেন, শিগগিরই যা, দ্যাখ ও কি করে। চুপি চুপি যাবি। তবে দেখিস, যেন পায়খানায় ঢুকে পড়িস না ওর সঙ্গে। 

এদিকে ভুবনদাদু তো খাটা পায়খানায় ঢুকে পড়ল। লোকদুটো বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিছু একটা মজা দেখার আশায়। কী মজা দেখবে, সেটা অবশ্য জানে না। হঠাৎ পায়খানার মধ্যে থেকে গোঁ গোঁ শব্দ ।ভুবনদাদু অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওরা ভুবন দাদুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ছোড়দাদুর কাছে গেল। একটু পরে, চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে ভুবনদাদু তো উঠে বসল। তারপরেই ভেউ ভেউ করে কি কান্না! আছে, আছে! ভুত আছে! আমি নিজের চোখে দেখেছি রে বিনোদ ভাই। ছোড়দাদু বললেন, কি দেখলি রে ভুবন? 

দেখলাম, পায়খানার চাতালে একটা ঝাঁটার কাঠি পড়ে রয়েছে। গজগজ করে তোমায় খুব গাল দিচ্ছিলাম। হুঁঃ! আমায় নাকি ভুত দেখাবে! নিকুচি করেছে তোমার ভুতের। হঠাৎ দেখি, কাঠিটা লাফিয়ে উঠল চাতাল থেকে। তারপর একটা গোঁফের আকার নিল। আমি হাঁ করে দেখছি, কি হচ্ছে ব্যাপারটা। গোঁফ থেকে এবার এল দুটো চোখ ।তারপর মুখ, কান, নাক, শেষে একটা মুন্ডু হয়ে গেল। আমার নাকের ডগায় দুলতে দুলতে মুন্ডুটা বলতে লাগল, ক্যায়া ভুবন বাবু! ভুত নেহি হ্যায়! এটা দেখেই তো আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। সব শুনে ছোড়দাদু বললেন, তাহলে ভুবন! ভুত আছে তো! 

হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। খুব আছে। যা দেখলাম আমি, ওরে বাবা! 

না। নেই। ছোড়দাদু এবার বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, ভুত সত্যিই নেই। ওটা আমিই তোমাকে দেখিয়েছি। মুন্ডু নাচানোটা আমারই এক কৌশল। তুমি তো ভয় পাওনা। তাই তোমার সঙ্গে একটু মজা করেছি মাত্র। আর কিছু না। সবটা শুনে ভুবনদাদু তো রেগে কাঁই। বললেন আমি আর থাকবোই না এখানে। তবে সত্যিই তিনি ছাপড়ায় ফিরে গিয়েছিলেন কিনা, সেটা আর জানা নেই আমার। 

এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। হঠাৎ কারেন্ট চলে আসায় চমকে উঠলাম। সেটা দেখে হাসতে হাসতে বাবা বললেন, যাই, ক্লাবে গিয়ে একটু আড্ডা মেরে আসি।


বি দ্র :—গল্প টার হয়তো উৎকর্ষতা নেই খুব একটা। তবুও আমি চেয়েছি গল্পগুলো শেয়ার করতে। কিছু ঘটনা সত্য। বিনোদবিহারী সত্যিই ওইরকম ম্যাজিক দেখাতেন।তবে পয়সার বিনিময়ে নয়।শুধুমাত্র মানুষ কে খুশি করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। কুঞ্জবিহারী ডাক্তার ছিলেন। তাঁর রচিত বইদুটিরও অস্তিত্ব ছিল। তবে কাহিনী তে কিছু জল মেশানো তো হয়েইছে, যেগুলোর ইংগিত আমি দিয়েছি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics