অব্যক্ত
অব্যক্ত
#অনুপ্রেরণা - আমার এক পরিচিত দাদার মেসজীবনে এক বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুর দিন সেই বন্ধুর রুমে রাত কাটাতে গিয়ে যে রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই গল্পটি শুনেছিলাম দাদার মুখে। আমার এই গল্পের অনুপ্রেরণার উৎস সেই ঘটনাটিই। তবে কল্পনার রং মিশিয়ে সমাজের একটি কালো দিক অর্থাৎ LGBT Community র প্রতি হওয়া সামাজিক অন্যায়ের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে ঘটনাটিকে নিজের মতন করে সাজিয়ে নিয়েছি।
রাত এখন বোধহয় সাড়ে দশটা হবে, অন্ধকার করিডোরে হাত ঘড়িটা দেখতে পেলাম না ঠিক করে। হাতে এতগুলো জিনিস নিয়ে কসরৎ করে মোবাইলটাও জ্বালাতে ইচ্ছে হল না। ডান হাত দিয়ে জিনিসগুলোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে চাবিটা কি হোলে গলানোর চেষ্টা করলাম, পিছলে গেল। করিডোরের আলোটা আজ দিন তিনেক ধরেই খারাপ, কেউ সারায়নি কেন কে জানে! মোবাইলটা জ্বাললে হয় কিন্তু ইচ্ছে করছে না যে! আরেকবার চেষ্টা করলাম চাবিটা গলানোর, উফফ আবার পিছলে গেল… আরেকবার… আহ এইবার ঢুকেছে তবে। খুট করে একটা আওয়াজ করে তালাটা খুলল অবশেষে। দরজা ঠেলে ভেতরে এলাম আমি, একটা নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে আছে ঘরটা। এই ঘরটায় আমি আগে কোনোদিনও আসিনি তাই আন্দাজ করে করে দেওয়ালের গায়ে থাকা সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। অন্ধকারটা দূর হলো বটে কিন্তু সেই সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার বসবাসের অজস্র স্মৃতি, তার অস্তিত্বের অসংখ্য প্রমাণ। ওপাশের দেওয়ালের গায়ে ঠেকে থাকা কাউচটার ওপর রাখা একটা ম্যাক্সি, বেরোবার আগে ছেড়ে রেখে গিয়েছিল হয়তো, ভেবেছিল ফিরে এসে পরবে। এদিকের ছোট্ট টেবিলটায় রাখা একটা অর্ধেক ভর্তি জলের মগ আর গ্লাস। গ্লাসটার কিনারে গোলাপী লিপস্টিকের দাগ, নিশ্চয় বেরোবার ঠিক আগে মুহূর্তে গলাটাকে ভিজিয়ে নিয়েছিল একটু। আচ্ছা এই গ্লাসটা কি জানতো সে আর ফিরবে না কোনোদিনও, তাই কি তার ঠোঁটের চিহ্ন এঁকে রেখে দিয়েছিল নিজের গায়ে? আলমারির সঙ্গে লাগানো আয়না আর তার সামনে থাকা স্বল্প জায়গাটার মধ্যেই গায়ে গায়ে রাখা কতকগুলো কসমেটিকসের বোতল, তাদের মধ্যেই লক্ষ্য পড়ল ওর প্রিয় পারফিউমের শিশিটাও। খাটের ওপর ছড়ানো বই খাতা, তারই মাঝে অবহেলায় শুয়ে একটা ক্ল্যাচার, খান দুয়েক চুল লেগে আছে ওটার গায়ে। উফফ অসহ্য! ও সত্যিই আর ফিরবে না? কোনোদিনও না? কোনোদিনও আর ব্যবহার করবে না এই জিনিসগুলো?
এই পাণ্ডব বর্জিত এলাকায় দৈত্যের মত দাঁড়িয়ে থাকা এই ফ্ল্যাট বাড়িটা দেখলে রাতের বেলায় যে কোনো অজানা লোকের হৃদকম্প হতে পারে ঠিকই তবে আমাদের মত বেকার ছেলেমেয়েদের কাছে এ হল স্বর্গ। মেস মালিকের হাজার শর্তের হুজ্জুতি পোহাতে নেই, নিজের খুশিতে থাকো, নিরিবিলিতে পড়াশুনো করো, আবার জমিয়ে আড্ডা দাও তাতেও কেউ কিছু বলবে না, আসলে বলার লোকই তো নেই। তবে শুধু বেকার ছেলেমেয়েরা নয় কিছু সাকার মানুষও একলা চাকরি করতে এসে একসঙ্গে কয়জন মিলে একেকটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন এখানে। শুনেছি এক বিরাট বড় প্রজেক্ট হিসেবে এই “প্যারাডাইস কমপ্লেক্স” তৈরি শুরু হয় কিন্তু তারপর আচমকা অংশীদারদের মধ্যে কিছু গন্ডগোল হওয়ায় প্যারাডাইস থেকে হেল এ পতন হতে বেশি সময় লাগেনি সেই প্রজেক্টের। কোনোমতে ফ্ল্যাট বাড়িটা খাড়া হয়েছিল ঠিকঠাক, আশেপাশের এতো বিপুল জমি ব্যবহারের অভাবে কয়েক বছরেই জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে। যারা ফ্ল্যাটগুলো কিনে রেখেছিলেন তারা আমাদের মত পড়ুয়াদের ভাড়া দিয়ে নিজেরা অন্যত্র আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। অবশ্য কয়েকটা ফ্ল্যাটে কিছু ফ্যামিলিও আছে। যাইহোক সব মিলিয়ে আমাদের কাছে বেশ আরামের জায়গা এখানি। দিব্যি চলছিল সব কিছু, কিন্তু তারপরেই আচমকা এই ছন্দপতন…!
অন্যদিনের মতোই আজও সন্ধ্যেবেলার আড্ডাটা জমে উঠেছিল বেশ। তর্ক বিতর্ক হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই হঠাৎ ঋদ্ধির ফোনটা বেজে ওঠে, আর সেটা ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে খবরটা। দোয়েলকে বরফের ঘরে ঘুম পাড়িয়ে ধৃতিরা যখন ফেরে তখন রাত প্রায় পৌনে ন’টা। ওরা আসার পর থেকে শুধুই চলে সে আলোচনা… কিভাবে দোয়েলের নরম শরীরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেই দৈত্যের শকটের ভারে… কিভাবে ওর ঘন কালো চুলে ভর্তি মাথাটা থেঁতলে গিয়ে মিশে গিয়েছিল কালো পিচের মধ্যে… উফফ … বীভৎস… কত কষ্টই না জানি হয়েছে মেয়েটার…! ওদের আলোচনা আর সহ্য করতে পারছিলাম না আমি, বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই আজকের সন্ধ্যেতে আমাদের আড্ডার বিষয় ছিল অতিলৌকিক ব্যাপার স্যাপার। কে ভুতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে আর কে না এই নিয়ে বেঁধেছিল জোর তর্ক। সেই প্রসঙ্গেই শ্রীময়ী আবার বলতে শুরু করেছিল ওর ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর কিভাবে ওদের বাড়িতে অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটতে থাকে সেই সব কথা, কিন্তু শ্রীময়ীর গল্প শেষ হওয়ার আগেই আসে দুঃসংবাদটা। ধৃতিরা ফিরে আসার পর কে যেন আবার পুরোনো বিষয়টা উত্থান করে, কেউ বা আবার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে আজকের রাতটা দোয়েলের ফ্ল্যাটে একা কাটানোর চ্যালেঞ্জ। দোয়েল সবে মাস চারেক হল এসেছিল এখানে তাই হয়তো ওর প্রতি আত্মিক টানটা এখানে কারুরই সেভাবে তৈরি হয়নি, তাই হয়তো এতো সহজেই সবাই এসব খেলার কথা মাথায় আনতে পারছিল। অবশ্য ওর রুমমেট রিয়া বাড়ি গিয়েছে কয়েকদিন হল, সে থাকলে তার মনের অবস্থা কিরকম হত বলা যায়না। যাইহোক, কে কি বলেছিল আমি জানিনা, খেয়াল করিনি অতশত তবে চ্যালেঞ্জের কথাটা মনে ধরেছিল বেশ। নাহ নিজের সাহস প্রমাণ করার তাগিদ আমার একটুও ছিল না, আমি শুধু চাইছিলাম একটু একা থাকতে, ওদের ওই আলোচনার জাল থেকে একটু মুক্তি পেতে। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না আর, তাই তো ওদের চ্যালেঞ্জটা লুফে নিয়ে চলে এলাম এই ফ্ল্যাটে। শীত শীত করছে বেশ। ভেতর থেকে একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাইছে যেন। গোটা ঘরে দোয়েলের একটাও ছবি নেই তবুও যেন আমি ওকে অনুভব করতে পারছি এই ঘরে, ঘরের প্রতিটা জিনিসের মধ্যে। আজ সকালেও ওর স্পর্শ পেয়েছে এরা, এখনও যেন ওর গায়ের গন্ধ লেগে আছে এই প্রতিটা জিনিসে। দোয়েল… দোয়েল… উফফ আর কোনোদিনও দেখতে পাবো না ওর ওই মিষ্টি হাসিটা…! কোনোদিনও আর ওকে দেখে আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে না…! আর কোনোদিনও ওকে বলা হবে না আমার মনের কথা…! দোয়েল চলে গেছে, আর ফিরবেনা কোনোদিনও। যখন ও আমার সামনে ছিল তখন ওকে মনের কথা জানাতে ভয় পেয়েছি বারবার। প্রত্যাখ্যান এলে তা হয়তো সহ্য করে ফেলতে পারতাম কিন্তু ওর ঘৃণা সহ্য করতে পারতাম না। যতবার ওকে মনের কথা বলবো ভেবেছি ততবার মনে পড়ে গেছে কলেজ জীবনের সেই ঘটনাটা। দোয়েলের আগেও একজনকে ভালো লেগেছিল আমার, তার নাম ছিল রিনিতা। সাহস করে একদিন তাকে বলে ফেলেছিলাম মনের কথা, কিন্তু তারপর…! রিনিতা এমন ভাবে তাকিয়েছিল আমার দিকে যেন মনে হয়েছিল আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসা কোনো প্রাণী। সেদিন থেকে শুধু রিনিতাই নয়, গোটা কলেজ আমায় কেমন ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিল। কি কষ্টে যে কলেজের শেষ একটা বছর কাটিয়েছি তা আমিই জানি। কিন্তু কেন! কি অপরাধ আমার! আমার কি ভালোবাসার অধিকার নেই! ওরা বলতো আমি অস্বাভাবিক, কিন্তু এতে আমি কি করব? প্রকৃতিই তো আমায় এমন করে তৈরি করেছে!
চোখের সামনে যতই ওর জিনিসপত্রগুলো দেখছিলাম ততই যেন আরও বেশি করে কষ্ট হচ্ছিল, তাও ভালো এখানে চলে এসেছিলাম বলে নিজের মত করে একটু কাঁদতে অন্তঃত পেরেছি। আলোটা নিভিয়ে এবার শুয়ে পড়ব বলে স্থির করলাম। একটু ঘুমোলে হয়তো হালকা লাগবে খানিকটা। যত যাইহোক এ কষ্ট তো আমাকেই সামলাতে হবে, কাল সকালে স্বাভাবিক চোখ মুখ নিয়ে সবার সামনে যেতে হবে, কাউকে বুঝতে দিলে চলবেনা কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার ভেতরে।
কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘাড়ের কাছে ক্রমাগত একটা গরম বাতাস এসে লাগতেই ঘুমটা ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম আমি, আমার হাত লেগে খাটের একপাশে পড়ে থাকা দোয়েলের ক্ল্যাচারটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। ঘরটার ভেতরে একটা জমাট অন্ধকার, খেয়াল করলাম নাইট বাল্বটা কখন যেন নিভে গেছে। একটা ঢোঁক গিললাম আমি। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিনা কিন্তু মনে হচ্ছে যেন আমি ছাড়াও আরও কেউ আছে এই ঘরে। ঢোকার পর তো দরজাটা লাগিয়েছিলাম ঠিক করেই, তাহলে কেউ কি করে ঢুকবে! ঘাড়ের কাছে আবার একটা গরম বাতাস এসে লাগতেই ভয়ে ভয়ে পেছন ঘুরলাম, নাঃ কেউ তো নেই… অন্ধকারে চোখটা আস্তে আস্তে সয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কিছু একটা গন্ডগোল আছে এই ঘরে, কিছু একটা স্বাভাবিক নেই। আস্তে আস্তে খাট থেকে নামলাম আমি। ঠান্ডা মেঝের স্পর্শে শরীরটা কেঁপে উঠল একবার। পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে জলের জগ থেকে জল খেতে গেলাম খানিকটা কিন্তু জগটা নিয়ে জলটা গলায় ঢালার জন্য মাথাটা উঁচু করতেই… একি! নাহ… নাহ… এ হতে পারে না… এ কি করে সম্ভব! দোয়েল…! না না … ওভাবে ওর মাথাটা শূন্যে ঝুলে আছে কি করে! জলের জগটা হাত থেকে ছাড়া হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে… ঝনঝন শব্দে সেটা ভেঙে কাঁচ ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আতঙ্কে ছুটে পালাতে গিয়ে আমার পায়ে একটা কাঁচ সজোরে বিঁধে গেল, যন্ত্রনা শুরু হল প্রচন্ড তাও ছুটতে গেলাম আমি কিন্তু কিসের সঙ্গে গিয়ে যেন ধাক্কা খেলাম। আবার মেঝেতে ধাতব আওয়াজ উঠল। কোনোমতে এগিয়ে গিয়ে দরজার ল্যাচটা খুলে প্রাণপণে ছুট লাগলাম আমি, ঘর থেকে বেরোবার আগে মুহূর্তে নাকে এসে ধাক্কা লাগল একটা চেনা পারফিউমের গন্ধ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে আমি কখন যেন এসে পড়লাম সেই জঙ্গলে রাস্তায়। উফফ… আর পারছি না, শরীরের সব শক্তি যেন শেষ হয় এসেছে, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো আমার…
"এই যে শুনছেন? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো…"
অপরিচিত এক পুরুষ কণ্ঠের ডাকে আস্তে আস্তে চেতনা ফিরতে লাগল আমার। কিন্তু চোখ খুলেও কিছু দেখতে পেলামনা, জঙ্গলের এদিকে আলো নেই একফোঁটাও। আজ কি অমাবস্যা! তাই হবে বোধহয়, নয়তো এমন নিশ্চিদ্র অন্ধকার রাত্রি হয় নাকি! কোনোমতে অস্ফুটে বললাম, "কে?"
"আমায় আপনি চিনবেন না, আমি এই ফ্ল্যাটেই থাকি। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন এতো রাত্রে?"
লোকটার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরল আমার। কি করছি আমি এখানে? একটু আগে যা কিছু দেখেছি সব যেন ছবির মত আবার আমার মানসপটে ভেসে উঠতে লাগল, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগল আবার।
"কি হল ম্যাডাম?" আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেই প্রশ্ন করল লোকটা, "আপনি কত নম্বর ফ্ল্যাটে থাকেন বলুন পৌঁছে দিচ্ছি আমি।"
"৪০৭।"
"আচ্ছা, চলুন।"
আমি লোকটাকে দেখতে পাচ্ছিনা পরিষ্কার কিন্তু অনুভব করতে পারছি একটা হাত এসে স্পর্শ করল আমার হাত। লোকটা আমাকে ছোঁয়া মাত্রই গরম লাগার বদলে শরীরে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেল ক্ষণিকের জন্য। পরমুহূর্তেই আবার সব স্বাভাবিক। লোকটা অন্ধকারের মধ্যেই কি করে কে জানে আমাকে ধরে ধরে ঠিক নিয়ে এলো ৪০৭ নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে। বন্ধ দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। আমি কি ছুটে পালানোর সময় দরজাটা লাগিয়ে বেরিয়েছিলাম! তাই কি? মনের মধ্যে একটা দ্বিধা নিয়ে দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল ওটা। ঘরটা এখন অন্ধকার। আমি কেন নিজের রুমে না গিয়ে আবার এই ঘরটায় ফিরতে চাইলাম তা নিজেও জানিনা। আবার দেওয়াল হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালালাম। অন্ধকার ঘরটা মুহূর্তে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। আর আমি চমকে গিয়ে দেখলাম ওর খাটটা হুবহু সেই আগের মতোই অগোছালো, বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এদিক সেদিক। এমনকি যে ক্ল্যাচারটা ছিটকে পড়েছিল মেঝেতে সেটাও আগের মতোই খাটে রাখা। তাহলে আমার যে স্পষ্ট মনে আছে আমি সব সরিয়ে শুয়েছিলাম বিছানায়! মেঝেতে ভাঙা জলের জগ আর টাটকা রক্তের দাগটা অবশ্য আমার অস্তিত্বের প্রমাণ দিচ্ছে এখনও। কিন্তু…! আতঙ্কে পেছন ফিরলাম আমি, কেউ নেই দরজার সামনে। ছুটে বেরিয়ে এলাম করিডোরে। নাহ, কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। আশ্চর্য! লোকটা এতো দ্রুত অন্তর্হিত হল কিভাবে! আমার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে, মনে হচ্ছে জ্বর আসছে হয়তো। কোনোক্রমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম নিজের রুমের দিকে… এই ৪০৭ নম্বর রুমে ঢোকার সাহস আর নেই আমার, আর কোনোদিনও হবেও না হয়তো।
★★★★★
"আপনি লোকটা আসলে কে বলুন তো?"
"ধরে নিন আপনার মতোই কোনো হতভাগা।"
"ওসব ধরাধরি করতে পারবনা, স্পষ্ট করে বলুন কে আপনি?"
"স্পষ্ট করেই তো বললাম আপনার মতোই এক হতভাগ্য যে জীবনের মাত্র ছাব্বিশটা বসন্ত দেখার সুযোগ পেয়েছিল।"
"আমার বয়েস ছাব্বিশ না, মাত্র কয়েকদিন আগেই কুড়ি বছরের জন্মদিন পেরিয়েছে।"
"আপনি তো তাহলে আরও হতভাগ্য।"
"হয়তো…কিন্তু আপনি আমায় সাহায্য করলেন কেন?"
"আপনাকে! কখন? আমি তো ওই মেয়েটাকে সাহায্য করলাম।"
"না… মানে…"
"হাঃ হাঃ সবই বুঝি ম্যাডাম। তা নাম কি আপনার?"
"দোয়েল। আপনার?"
"অনমিত্র। এই প্যারাডাইস কমপ্লেক্সের একজন পার্টনারের একমাত্র ছেলে ছিলাম কোনোকালে।"
"আপনি…"
"বাবাদের পার্টনারে পার্টনারে বিবাদ, বলি হলাম আমি। এই জঙ্গলেই ওরা পুঁতে রেখেছে আমার দেহটা। কেউ এতো বছরেও খুঁজে পায়নি জানেন!"
"ওহ মাই গড।"
"ভুতের মুখে ভগবানের নাম! ভালো ভালো… তা আপনার গল্পটা কি?"
"আমার গল্প?"
"খুব ভালোবাসেন তো ওই মেয়েটাকে…?"
"কি যা তা বলছেন আপনি!"
"এখন তো সব লজ্জা লুকানোর উর্দ্ধে চলে গিয়েছেন, এখন স্বীকার করতে বাধা কোথায়?"
"ঠিকই বলেছেন আপনি। আজ আফসোস হচ্ছে যে বেঁচে থাকতে কেন সাহস করে বলতে পারলাম না আমার মনের কথা, কেন ভয় পেলাম ও আমায় কি ভাববে সে কথা ভেবে। একবার বলে দেখলে কি ক্ষতি হয়ে যেত!"
"যা করেননি তা নিয়ে তো আফসোস করার জায়গা নেই আর, কিন্তু ভালোবাসতেন তো আজ ওকে এভাবে ভয় দেখালেন কেন? আপনার সম্পর্কে মধুর স্মৃতিগুলো ওর মনে আজ থেকে তিক্ত হয়ে গেল তো!"
" ভালোবাসতাম বলেই তো আজকের এই ভয়টা দেখানোটাও জরুরি ছিল। বেঁচে থাকতে বুঝিনি যে আমার মত ওউ… মরার পর বুঝলাম কিন্তু এখন তো অনেক দেরী হয়ে গেছে তাই আমি চাই আমার সম্পর্কে ওর মনে কোনো মধুর স্মৃতি যেন অবশিষ্ট না থাকে। ও যত ভয় পাবে, তত আমাকে হারানোর দুঃখ ওর মন থেকে মুছে যেতে থাকবে।
কি হল ওভাবে তাকিয়ে আছেন যে?"
"দেখছি আপনাকে, অদ্ভুত লাগছে। জীবনের ছাব্বিশটা বসন্ত পের করে ফেলেছিলাম কিন্তু সে বসন্তে রঙ লাগেনি কখনও তাই আজ আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি। সত্যিই কবিরা ঠিকই বলেন ভালোবাসা বড় জটিল বিষয়।"
"হয়ত তাই।"
"হুমম, বাই দ্য ওয়ে একটা কথা তো আপনাকে বলাই হয়নি এখনও।"
"কি কথা?"
"ওয়েলকাম টু দ্য নিউ প্যারাডাইস কমপ্লেক্স আকা দ্য প্যারাডাইস অফ ডেডস…"
শেষ।

