শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Children Stories

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Abstract Children Stories

অভিশপ্ত টাইপরাইটার!

অভিশপ্ত টাইপরাইটার!

5 mins
173


ছোট একটা ঘর, মৃদু আলো জ্বলছে, ঘরের চারিদিকে বড় বড় বুকস্লেফ এবং প্রচুর বই এর স্তূপে ভরা। ঘরের দেওয়ালে একটা পুরনো দিনের ঘড়ি, কিছুক্ষন আগেই বেজে উঠল... একবার ঢং.... ঢং....করে সময়ের জানান দিতে, এবং প্রকৃতির বুকে রাতের গভীরতা বোঝাতে। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল, টেবিলের ওপরে রাখা একটা বহু পুরনো টাইপরাইটার,আর তার পাশে কিছু দামী পুরনো দিনের পেন, ঠিক.... টেবিলের পাশে রাখা নবাবী আমলের কারুকার্য করা লন্ঠন। ঘরের এক কোনে একটা ছোট্ট খাট, তার পাশে একটা ছোট্ট টেবিল তার ওপর একটা গ্রামাফোন সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। টেবিলের সামনে একটা কাঠের চেয়ারে বসে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে আপন মনে খট....খট.... শব্দ করে টাইপ করে চলেছেন বছর ষাটের পরিতোষ বাবু।

*****************************************


পরিতোষ বাবু ফরেস্ট রেঞ্জার ছিলেন। এই মাস... দুয়েক আগে রিটায়ার্ড করেছেন। কাজের সুত্রে তিনি নানা জঙ্গলে, জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বাস করেছেন অনেক নতুন নতুন জায়গায় এবং অনেক মানুষের সাথে মিশেছেন। পরিতোষ বাবুর সহধর্মীনি ইহজগতের মায়া ত‍্যাগ করেছেন। পরিতোষ বাবুর নিজের বলতে এখন ওনার সাথে আছে মেয়ে ঐশী, আর নাতনি ওলি। পরিতোষ বাবুর পুরনো দিনের অ‍্যান্টিক জিনিস পত্র সংগ্রহ করার খুব নেশা। তাই যখন তিনি সন্ধান পান, কিছু না... কিছু সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। পরিতোষ বাবুর বয়স ষাটের গোড়ায় গেলেও, পরিতোষ বাবু এখনও ফিট এবং স্ট্রং। কয়েকমাস আগে পরিতোষ বাবু এই টাইপরাইটারটা কিনে এনেছেন বেশ অনেক টাকার মূল‍্যে।


টাইপরাইটারটা আনার পর থেকেই পরিতোষ বাবুর ইচ্ছে হয়েছে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে কিছু গল্প লিখবেন।


এবং সেটা মনে মনে ঠিক করেও ফেলছেন। কিন্তু দিনের বেলায় যখন তিনি টাইপিং করতে বসেন তখন অদ্ভুত ভাবে কোন কাজ হয়না টাইপরাইটারে। কিন্তু রাত্রি বেলায় যখন টাইপ করেন তখন সবকিছু লেখা হয়। এমনি একদিন মনের খেয়ালে একটি গল্প টাইপিং করতে বসেন। কিছু পাতা লেখা হবার পর..., যখন পাতা গুলো উল্টাতে থাকেন.... তখন গল্পের চরিত্রগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। পরিতোষ বাবু দেখেন তার সৃষ্টি চরিত্র জীবত হয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবং যা তিনি গল্পে লিখেছেন সেই রকম হবুহু সবকিছু করে চলেছে। প্রথমে পরিতোষ বাবু ভয়ের চোটে দিশাহীন হয়ে পড়েন, কি..... করবেন! কিছুই বুঝতে পারেন না.!

ভাবতে থাকেন টাইপরাইটারটাকে কোথাও কি... ফেলে দিয়ে আসবেন, আবার পরক্ষনেই ভাবেন যদি খারাপ হাতে চলে যায়... তাহলেতো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে! পরিতোষ বাবুর চোখ থেকে ঘুম উড়ে যায় চিন্তায়। তিনি আবার উঠে গল্পটা লিখতে শুরু করেন, এবং ভালো করে টাইপরাইটারটা লক্ষ্য করে দেখেন অনান‍‍্য টাইপরাইটারের থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা, টাইপরাইটারের একদম কর্নারে একটি বটন আছে সেটা লাল রঙ করা, পোরিতোষ বাবু সবকিছু ভালো করে লক্ষ‍্য করে ঐ...লাল বটনটা টিপে দিলেন, সাথে সাথে প্রত‍্যেকটা পৃষ্ঠা এক সাথে বেঁধে বইয়ের আকারে তৈরী হয়ে গেল আপনা আপনি। এবং বইটি রূপ নিয়ে নিল একটি বড়ো বক্সের, এবং তার মুখের কাছে ঝুলতে থাকল একটি ছট্টো তালা। গল্পটি বাক্সের মধ‍্যে লক হয়ে গেল।

*****************************************

যবে থেকে পরিতোষ বাবু টাইপরাইটারের এই ব‍্যাপারটা জানতে পেরেছেন, তবে থেকে তিনি এই ঘরে কাউকে আসতে দেননা! কিন্তু পরিতোষ বাবুর নাতনি ওলির... খুব ঝোঁক এই ঘরে আসার, আসলে কৌতূহল! ওলির ছোট মনে অনেক প্রশ্ন... ওর দাদু এত কি.... লেখে? অথচ কাউকে কিছু শোনায় না...! আবার দেখায়ও না....! আবার ঘরে যেতেও দেয়না...? আর ঐ.... পুরনো টাইপরাইটারটা ওলির খুব পছন্দের, ওর খুব ইচ্ছে করে দাদুর মত খট.... খট.... শব্দ করে লিখতে। কিন্তু দাদু দেয়না! তাই ওলির দাদুর ওপর খুব রাগ।


পরিতোষ বাবু সারা রাত ধরে টাইপিং করে একটি গল্প লিখলেন। এবং গল্পটি তখনও শেষ হয়নি অথচ রাত্রের অন্ধকার কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করছে, আর টাইপরাইটারে টাইপিংও বন্ধ হয়ে গেছে । তবে এই গল্পটা লিখতে পেরে পরিতোষ বাবু খুব খুশি। তিনি তার ফরেস্ট লাইফে দেখা সমস্ত প্রানিদের মিশ্রনে এবং কল্পনাকে মিশিয়ে এক অদ্ভূত প্রানের সৃষ্টি করেছেন। যে... একদিকে হিংস্র, আবার অন‍্যদিকে কিছুটা শান্ত, রাগি, রক্তচোষা নরখাদক। অনেক দিন ধরে পরিতোষ বাবুর কল্পনায় তার আসা যাওয়া চলছিল, তাই তিনি সেই প্রানি চরিত্র সৃষ্টি করেই ফেললেন, নিজের কল্পনার দক্ষতায়। পরিতোষ বাবু ক্লান্ত শরীরটাকে চেয়ারেয় এলিয়ে দিলেন। গল্পটাকে বক্সে লক করে।


****************************************

ছোট ওলির ভোর ভোর আজ ঘুম ভেঙ্গে গেছে, মায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে ছোট ওলি এক পা... এক পা... করে এগিয়ে চলল তার মনের কৌতূহল মেটাতে দাদুর ঘরের দিকে। আস্তে করে ঘরের দরজা খুলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল টাইপ রাইটারের কাছে। পরিতোষ বাবু তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওলি দাদুকে ভালো করে দেখে একবার সারা ঘরটা ঘুরে নিল, তারপর টাইপরাইটারটা ভালো করে দেখতে লাগল। টাইপরাইটারের লাল বটনটা ওলির দৃষ্টি আকর্ষন করল। ছোট্ট ওলি আর সময় নষ্ট না... করে বোতাম টা... টিপে দিল।


সাথে সাথে একটা তীব্র আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের চারিদিকে। আলোর তীব্রতায় পরিতোষ বাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তিনি চোখটা হাল্কা কুঁচকে তাকিয়ে দেখলেন সামনে ওলি দাঁড়িয়ে আছে দুটো হাত দিয়ে চোখ ডেকে। এবং তার লেখা গল্পের পৃষ্ঠাগুলো খুলতে শুরু করেছে এবং প্রত‍্যেকটা চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওলি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল পরিতোষ বাবু ওলিকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। এই বার জীবন্ত হয়ে উঠল পরিতোষ বাবুর অদ্ভুত সৃষ্টি সেই প্রানী, যার উড়ন্ত ডাইনোসরের মত চেহারা, কুমিরের মত লেজ, জিরাফের মত গলা, হাতির মত কান, সিংহর মত গর্জন, আর জলহস্তির মত মুখ, সে এক বিশালাকায় হিংস্র প্রনী, যার নাম দিয়েছেন পরিতোষ বাবু হিপোটিনোলিনোসেরাস। হুঙ্কার ছেড়ে উঠল সে,এই ভয়ংকর আওয়াজ শুনে পরিতোষ বাবুর মেয়ে ছুটে আসল বাবার ঘরের দিকে, কিন্তু সেই প্রথম খাদ‍্যে পরিনত হল সেই হিংস্রো প্রানীর। পরিতোষ বাবু কোনরকমে ওলির হাত ধরে লুকানোর চেষ্টা করলেন, প্রানীটি হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

পরিতোষ বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ক্ষত বিক্ষত মেয়ের দেহের কাছে। এবং ভাবতে লাগলেন এখন কি... করবেন। কিছুক্ষনের মধ‍্যে শহর জুড়ে অ‍্যাম্বুলেন্স, দমকলের ইঞ্জিন এবং মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসতে লাগল। সেই প্রানী শহর জুড়ে তান্ডব করতে শুরু করে দিয়েছে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টর লোকেরা তাকে কোন ভাবে আটকাতে পারছেনা। তাই শহরের বুকে নামানো হচ্ছে যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় সসস্ত্র আর্মি। এবং শহর জুড়ে মাইকিক করা হচ্ছে, এবং হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয়েছে। পরিতোষ বাবু হেল্পলাইন নম্বরে ফোন করে সমস্ত ঘটনা এবং প্রানিটির সৃষ্টি তিনি করেছেন সেটাও খুলে বললেন। এবং এও... বললেন তিনি সন্ধ‍্যের আগে কিছুই করতে পারবেননা। সারাদিন ধরে তান্ডব চালিয়ে হিপটিনোলিনোসেরাস এখন ক্লান্ত। তাই সে কিছুটা শান্ত।

সূর্য ডুব দিয়েছে কিছুক্ষন আগে, পরিতোষ বাবু আবার বসলেন টাইপরাইটার নিয়ে। শুরু করলেন লেখা, সৃষ্টি করলেন এক শক্তিশালি ভয়হীন, বুদ্ধিদীপ্ত পুরুষের, যার নাম দিলেন তৈমুর। তৈমুরের হাতে তুলে দিলেন এক ধারাল অস্ত্র সুলেমানি। পরিতোষ বাবুর লেখার সাথে সাথে তৈমুরের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল............ হিপটিনোলিনোসেরাসের বিরুদ্ধে। তৈমুর তার অস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল............ হিপোটিনোলিনোসেরাসের ওপর এবং হিপোটিনো লিনোসেরাসের ধারাল নক এবং লেজের আঁচরে ক্ষত বিক্ষত হতে থাকল তৈমুরের দেহ। বিধ্বংসী লড়াইয়ের এক পর্য়ায়ে তৈমুর তার ধারালো সুলেমানি অস্ত্র দিয়ে হিপোটিনোলিনোসেরাসের শরীর দুইভাগ করে দিল। হুঙ্কার ছাড়তে....... ছাড়তে..... হিপোটিনোলিনোসেরাস তার শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করল। এবং পরিতোষ বাবু গল্পের সমাপ্তি ঘটালেন। এবং টাইপরাইটারের লাল বোতামটা টিপলেন, সাথে সাথে এক ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে টাইপরাইটার ধ্বংস হয়ে গেল। এই বিস্ফোরণে সৃষ্টি এবং শ্রষ্ঠার একসাথে বিনাশ হলো।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract