অভিশপ্ত ডায়রি-ষষ্ঠ পর্ব
অভিশপ্ত ডায়রি-ষষ্ঠ পর্ব
সকালের ঝলমলে রোদের আলো জানালা দিয়ে আমার গায়ে এসে পড়েছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তনু। সুবোধ ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে। ডাক্তারবাবু আমার হাতে ইঞ্জেকশন দিচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখতে লাগলাম। ধীরে ধীরে গতকাল রাতের ঘটনা গুলো সব মনে পড়ে যাচ্ছে। তনুকে তো পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে এখন ও কোথা থেকে আসলো? গতকাল রাতেই বা কোথায় ছিল? এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? ডাক্তারবাবু কিছু ওষুধ লিখে বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। সুবোধ দুধের গ্লাসটা তনুর হাতে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। এখন ঘরে আমি আর তনু ছাড়া কেউ নেই। সে আমার দিকে উৎকণ্ঠা ভরা মুখে চেয়ে বলল-
" তোমার যে মাঝে মাঝে কি হয় কিছুই বুঝতে পারি না। হঠাৎ করে রাতের বেলায় তুমি উপরে উঠতে গেলে
কেন? "
তনুর এই প্রশ্নে আমি একেবারে চমকে গেলাম। ও এসব কি বলছে? গতকাল রাতে ওরই সাথে তো উপরে উঠেছিলাম। তাহলে এখন কেন এসব কথা বলছে? আমি অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
তনু বলে উঠল-
" কি দেখছো এই ভাবে? নাও ওঠো। এই দুধটা খেয়ে নাও। "
আমি উঠে বসতে গিয়ে কোমরে বেশ যন্ত্রনা অনুভব করলাম। সেই যন্ত্রনায় আমার মুখ চোখও কুঁচকে গেল।
তনু সেটা দেখে বলল-
" কি হল? কি হয়েছে তোমার? কোথাও ব্যথা লাগছে? "
এই কথাগুলো বলতে বলতে সে আমায় ধরে বালিশে হেলান দিয়ে বসতে সাহায্য করল। আমি বসে নিয়ে কোমরে হাত দিয়ে বললাম-
" হ্যাঁ। এই কোমরটাতেই ব্যথা করছে। বোধহয় সিঁড়ি দিয়ে পড়ার সময়ই লেগেছে। "
এই শুনে আমার জন্য গরম সেঁকের ব্যবস্থা করবে বলে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময় আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। তনু পিছন ঘুরতেই আমি বললাম-
" থাকো না কিছুক্ষণ আমার সাথে। বড্ড ভয় করছে। "
সত্যি বলতে গতকাল রাতের ঘটনার পর থেকে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। মনের ভেতরের সব সাহস যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে।
তনু আমার পাশে এসে বলল-
" এই তো আমি তোমার পাশেই আছি। একদম ভয় পেয় না। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখছি তোমার শরীর একদম ভালো যাচ্ছে না। কাল সকালেই এখান থেকে বেড়িয়ে যাবো। তুমি দুধটা খেয়ে নাও। আমি ততোক্ষণে গরম সেঁকটা নিয়ে আসছি। "
তনু বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। আমি দুধের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তনু যেইভাবে কথা বলছে তাতে তো মনে হচ্ছে ও গতকাল রাতে আমার সাথে ছিলই না। তাহলে কি আমার কোথাও ভুল হচ্ছে? কোথাও তো একটা গণ্ডগোল আছেই। নাকি আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এসব ভাবতে ভাবতে দেখি দুধের রঙটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে আসছে। কেমন যেন রক্তের মতো গাড় লাল। আর সেই লাল রঙের ভেতর দিয়ে ফুটে উঠল একটা মুখ। একটা বাচ্চা মেয়ের মুখ। যেই মুখে জগতের সমস্ত মায়া যেন জড়িয়ে আছে। যার থেকে চোখ ফেরানো যায় না। যেন তার সাথে আমার পরিচয় বহু বছরের। তার সেই মুখের মায়ার জালে আমি কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে সে ছাড়া আমার এই জগতে কেউ নেই। কি নিদারুন তার আকর্ষণ! কিন্তু এমন সময় সেই মুখ ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে সাদা ফ্যাট ফ্যাটে ফাটল ধরা রক্ত মাখানো মুখে। মায়ার ভরা চোখের জায়গায় এখন হিংস্র নেকড়ে বাঘের মতো দুটো জ্বল জ্বলে চোখ আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। আমার সমস্ত শরীরে ভয়ের তরঙ্গ খেলে গেল। যেন এক ঝটকায় আমার সমস্ত মোহ কাঁচের মতো ভেঙে গেল। দুধের গ্লাসসহ আমার সমস্ত শরীর ভয়ে কাঁপছে। ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করে দুধের গ্লাসটাকে সাথে সাথে ছুড়ে ফেলে দিলাম। ওহ্! এই দৃশ্য আর আমি সহ্য করতে পারছি না। চোখ মুখ ঢেকে নিজেকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিলাম। আমি রীতিমত ঠক ঠক করে কাঁপছি। এবার বোধহয় সত্যি সত্যি আমি পাগল হয়ে যাবো। আমার স্নায়ু আর এসব নিতে পারছে না। এরই মধ্যে তনু প্রায় ছুটতে ছুটতে আমার ঘরে এসে ঢুকল। হাপাতে হাপাতে ও বলল-
" কি হয়েছে তোমার? এরকমভাবে চিল্লালে কেন? আর এই দুধের গ্লাসটা পড়ে গেল কি করে? "
আমি কোনো উত্তর দিতে পারছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল ঐ শয়তানটা আমায় বাঁচতে দেবে না। তনু আমার পাশে এসে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল-
" এই কি হল তোমার? এরকম করছো কেন তুমি? "
সেইসময় আমি তনুকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বললাম-
" ও আমায় মেরে ফেলবে তনু। মেরে ফেলবে। আমি পাগল হয়ে যাবো। আমি এখানে আর থাকব না। থাকব না। "
" Please শান্ত হও। এরকম কোরো না। কে মেরে ফেলবে তোমায়? "
" আমি জানি না তনু। সত্যি জানি না। চলো আমরা এখান থেকে চলে যাই। "
" দেখ তোমার শরীর এমনিতেই ভালো নেই। আজ এই ভাবে যাওয়া সম্ভব নয়। "
সেইসময় ঘরে সুবোধ, হরিপদদা আর হরিশদাও ছিল। হরিপদদা আমাদের কাছে এসে তনুকে উদ্দেশ্যে করে বলল-
" বৌদিমনি দাদাবাবু ঠিকই বলছেন। আর এক রাত্রিও এখানে থাকবেন না। আপনারা আজই এখান থেকে চলে যান। "
তনু হরিপদদাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে কিছু না বলে নিজের মনে বক বক করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। সুবোধ আর হরিশদাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ হল না। তারা এই ব্যপারে কিছুই বলতে পারল না। তবে তনু কিছুতেই রাজি হল না আমাকে এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে বের করতে। সুবোধকে কাল ভোর বেলায় বেরোনোর জন্য একটা গাড়ি ঠিক করে দেওয়ার কথা বলা হল। তবে আজও আমার মনে হয় সেদিন যদি তনু চলে যাওয়ার জন্য রাজি হত তাহলে ঐ দিনের সব থেকে ভয়ঙ্কর রাতটায় কাউকে সাক্ষী থাকতে হত না।
ঘর থেকে সবাই বেড়িয়ে গেলে আমি তনুকে সবটা বললাম। তার পরিপ্রেক্ষিতে ও আমায় যা বলল তাতে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। তনু নাকি ঐ দিন রাতে আমার সাথেই ছিল না। আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেলাম তখন আমার চিৎকার শুনে ছুটে আসে।
সন্ধ্যেবেলায় আমরা দুজনে কেউই এই বিষয়ে আর কোনো কথা বললাম না। তনু ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্যগপত্র গোছাতে। আমার কোমরের ব্যথাটাও একটু কমেছে। অখিলেশকে ফোন করার অনেক চেষ্টা করলাম। কাল ভোরবেলায় আমরা বেড়িয়ে যাচ্ছি। Flight-এর টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। ওকে তো জানানো দরকার। কিন্তু কোনোভাবেই ওকে পাওয়া গেল না। তাই একটা voice message পাঠিয়ে দিলাম।
কীসের এক শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলটা অন্ করে দেখি রাত দুটো বাজে। আওয়াজটা শুনে মনে হচ্ছে এই ঘরেই কোথাও সেটা হচ্ছে। তবে আওয়াজটা কীসের সেটা বুঝতে পারলাম না। বিছানার পাশে রাখা টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে তনুকে ডাকতে গিয়ে দেখি সে আমার পাশে নেই। এতো রাতে কোথায় গেল? বাথরুমে গেল কি? নাকি আবারও আমার সাথে কিছু একটা ঘটতে চলেছে? সত্যিই কি কিছু ঘটতে চলেছে? নাকি আমি আবার কোনো স্বপ্নের মধ্যে আছি? এদিকে আওয়াজটা হয়েই চলেছে। তার সাথে এখন গর গরে গলায় একটা হাসির শব্দ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। আমি যেন চোখের সামনে সেই ভয়ঙ্কর মুখটাকে দেখতে পাচ্ছি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে আসছে। অথচ একটা কৌতহল আমাকে সেই আওয়াজটার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব। প্রতিবার সে আমায় ধোকা দিতে পারবে না। বিছানা থেকে নেমে ঘরের টিউবলাইটটা জ্বালালাম। বিছানার সোজাসুজি একটা বড়ো কাঠের আলমারি রাখা ছিল এবং আওয়াজটা সেখান থেকেই আসছে। সেদিকে তাকাতেই আমার হৃৎস্পন্দন প্রায় থেমে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। আলমারির উপর ওখানে কে বসে আছে? আর তার হাতে ওটা কি? আমার দিকে সে চাইতেই আমি ভয়ে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লাম। এ যে তনু! ওর সারা মুখে রক্ত মাখানো। আর কিছু একটা থেকে কিসব ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। দূর থেকে সেটা বুঝতে পারলাম না। এদিকে তনুর মুখে এক উন্মত্ত হিংস্রতা ফুটে উঠেছে। ওর চোখ দুটো যেন জ্বল জ্বল করছে। এক অদ্ভুত পৈশাচিক হাসি নিয়ে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। যেটা সে এতক্ষণ ধরে খাচ্ছিল এখন সেটাকে হঠাৎ আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। সেটাকে দেখে আমার পেটের ভেতরে সব নাড়িভুড়ি যেন বেড়িয়ে আসতে চাইল। ওটা আর কিছুই নয়। হরিপদদার আধ-খাওয়া মাথা! মাথার খুলি ফাটিয়ে ঘিলু বের করে নেওয়া হয়েছে। গাল থেকে মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে। চোখ গুলোও খুবলে খেয়ে নিয়েছে। আমার শরীর যেন অবশ হয়ে যেতে লাগল। এদিকে তনু আলমারি বেয়ে নেমে আসছে যেমন করে মাকড়সা দেওয়াল ধরে নামে ঠিক সেই ভাবে। এ আমি চোখের সামনে কি দেখছি? এও কি সম্ভব? এবার সে হামাগুরি দিয়ে আমারই দিকে এগিয়ে আসছে। তার মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে রক্ত ঝরে পড়ছে। ওকে এখন আর তনু বলতে ইচ্ছে করছে না। রক্ত পিশাচ ছাড়া এখন আর সে কিছুই নয়। এমন সময় হঠাৎ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেল। কি হল? কারেন্ট চলে গেল নাকি? এবার কি হবে? কিছুই যে দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আর সেই গর গরে শব্দটা এখন আমার খুব কাছ থেকেই শুনতে পারছি। একটা আঁশটে পচা গন্ধ নাক মুখ দিয়ে ঢুকে শরীরের ভেতের যেন বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। আমার নিঃশ্বাস নিতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে এখনি মারা যাব। এমন সময় আমার মুখের উপর ফোটা ফোটা করে তরল কিছু একটা পড়ছে। মুখে হাত দিয়ে বুঝতে পারলাম না সেটা আসলে কি? এবার আমাকে আলোর ব্যবস্থা করতেই হবে। চারপাশে একটা দম বন্ধ হওয়া পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মোবাইলটা বিছানার উপরেই রেখেছিলাম। একটু উঠে বিছানায় হাতড়াতেই মোবাইলটা পেয়ে গেলাম। কিন্তু এবার আরও ভয় করছে যে মোবাইলের আলো জ্বালালে চোখের সামনে কি দেখতে পারব এই ভেবে। ভগবানের নাম নিয়ে আলো জ্বালতেই দেখলাম আমার হাতে রক্ত লেগে আছে। তাহলে কি আমার মুখেও রক্ত লেগে আছে? কাপা কাপা হাতে আলোটা সামনে ধরতেই দেখলাম তনু তার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে আমার থেকে এক-দু হাতের দূরত্বেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছু করা বা বোঝার আগেই সে আমার দিকে দ্রত গতিতে এগিয়ে এল আর আমার গলা চিঁড়ে বেড়িয়ে এল এক আর্তনাদের চিৎকার।
, (ক্রমশ...)