অভিশপ্ত ডায়রি-চতুর্থ পর্ব
অভিশপ্ত ডায়রি-চতুর্থ পর্ব
কেরকম একটা হিস্ হিস্ শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শব্দটা কেবলই দূরে যাচ্ছে আর কাছে আসছে। হঠাৎই মনের মধ্যে দমকা হাওয়ার মতো এক জোরালো ভয় আমায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। ঘরে কি তাহলে সাপ ঢুকল? এই প্রাণীটার সাথে আমার ভয়ের সম্পর্ক বহু বছরের। একাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন একবার স্কুল থেকে সুন্দরবন বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস! অঙ্কের স্যার সাপটাকে দেখে ফেলেছিল। নাহলে ভগবানেরও সাধ্যি ছিল যে আমায় সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে।
সাপটা কোথায় দেখার জন্য চারিদিকে তাকাতেই দেখি ঘরে এখন আর দিনের আলো নেই। তার বদলে দুটো ক্ষীণ আলোর বাতি জ্বলছে। যার জন্য ঘরে সব কিছু স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না। তনুও তো কোথাও নেই। এদিকে শব্দটার মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাহলে কি প্রাণীটা আমার আশে পাশেই কোথাও আছে? এবার কি হবে? বিছানার পাশের টেবিলটায় আমার মোবাইলটা রাখা ছিল। ভাবলাম তনুকে ফোন করে কাউকে ডেকে নিয়ে আসার কথা বলি। কিন্তু এ কি? আমার হাত যে কিছুতেই নড়ছে না। এমন কি শরীরে আর কোডঃে অঙ্গকেও নাড়াতে পারছি না। অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু সব চেষ্টাই বিফলে গেল। মনে হচ্ছে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার সর্ব শক্তি দিয়ে আমাকে বিছানার সাথে চেপে রেখে দিয়েছে। তাহলে আর ফোন করে তনুকে ডাকা সম্ভব নয়। আমি বরং জোরে চিৎকার করি। সেক্ষেত্রে কেউ না কেউ আমার গলার আওয়াজ শুনতে পারবে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে আমার শরীরের মতো গলার আওয়াজটাও অচল হয়ে গেছে। বাইরে থেকে আমাকে নিশ্চল মনে হলেও শরীরের ভেতর ক্রমাগত এক অস্বাভাবিক যুদ্ধ হয়ে চলেছে নিজেকে এই বিপদ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিবারই কোন এক অদৃশ্য অদম্য শক্তির কাছে হেরে যাচ্ছি। হঠাৎই ঘরের দরজাটা সজোরে খুলে গেল। দেখলাম একটা ঝোড়ো হাওয়া ঘরে ঢুকে সব কিছু লন্ড ভণ্ড করে দিচ্ছে। দরজা জানালা গুলো বার বার বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। ওহ্! সে কি আওয়াজ! মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে রক্ত বেড়িয়ে যাবে। এদিকে কান দুটোকে চেপে ধরতেও পারছি না। কি যে শারিরিক আর মানসিক অত্যাচার চলছিল সে বলে বোঝাতে পারব না। কয়েক সেকেন্ড এরকম চলার পর যেন সব কিছু হঠাৎই থেমে গেল। সব চুপ! আর কোনো শব্দ নেই। সেই হিস্ হিস্ শব্দটাও আর হচ্ছে না। এই সব কীর্তি কলাপের জন্য ডিসেম্বরের কন কনে ঠাণ্ডাতেও আমার শরীর ঘামে ভিজে গেছে। গায়ের উপর থেকে যে কম্বলটা সরাবো সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। আগের মতোই আমার শরীর সেই অদৃশ্য শক্তিটার কাছে হার মেনে অসাড় হয়ে পড়ে রইল। হঠাৎই এক কান্নার আওয়াজ সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে আমার কানে এসে পৌছালো। আওয়াজটা বেশ ক্ষীণ ভাবে আসছে। সেটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম কোনো একটা মেয়ে কাঁদছে। কিন্তু কে কাঁদছে? আর কেনই বা কাঁদছে? এই বাড়িতে তো তনু ছাড়া আর কোনো মেয়েমানুষ নেই। তাহলে কি তনু কাঁদছে? কেন কাঁদছে? কি হয়েছে ওর? কোনো কি বিপদে পড়ল? এটা মনে হতেই আমার শরীর এক অসীম উত্তেজনায় ছটফট করে উঠল। কিন্তু তার কোনো কিছুই বাইরে প্রকাশ পেল না। মনে মনে ভাবলাম যে করেই হোক এই বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে। তনুর কাছে পৌছাতেই হবে।
আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো ভাবেই সেই অদৃশ্য শক্তিটার কাছে জিততে পারলাম না। এমন সময় কম্বলের ভেতর কিছুর একটা নড়াচড়া অনুভব করলাম। যার অবয়বটা কম্বলের বাইরে ফুটে উঠেছে। দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই যে সেটা কি? অথচ তার স্পর্শ বরফের মতো ঠাণ্ডা! তবে সেটা কিন্তু সাপের মতো কিছু নয়। আকারে বেশ বড়ো যা হামাগুড়ির মতো ধীরে ধীরে আমার মাথার দিকে উঠে আসছে। সেই মুহূর্তে ভয়-আতংক-উত্তেজনা সব কিছু মিলিয়ে এমন এক মানসিক অবস্থার তৈরি হয়েছে যে আমার হার্ট বিটের রেট যেন প্রায় ১০ গুণ বেড়ে গেছে বলে মনে হল। যার আওয়াজ পর্যন্ত আমি শুনতে পারছি। সেই অবয়বটি এখন আমার মাথা থেকে প্রায় এক হাতের দূরত্বে রয়েছে। আর হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তাকে দেখতে পারব। এই অজানা বিপদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রানপণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো ফল হল না। একটা কিছু ভয়ানক ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরেও কিছু করে উঠতে পারছি না। নিজেকে এতটা অসহায় আগে কখনও মনে হয়নি। ভয় আর উত্তেজনার পারদ এতটাই বেড়ে গেছে যে নিজের স্নায়ুর উপর নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় সেই মুহূর্তটা এসে হাজির হল যেই মুহূর্তে কম্বলের ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল অপার্থিব ভয়ঙ্কর মুখ। ধব ধবে সাদা চামড়ার মুখে অজস্র জায়গায় ফেটে গিয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। চোখের মণি বলতে কিছু নেই। আর সেই চোখে এক পৈশাচিক হাসি নিয়ে যেন আমারই দিকে তাকিয়ে আছে। সেই বীভৎস মুখটা যখন ধীরে ধীরে আমার মুখের ঠিক উপরে চলে আসল তখন তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসা রক্ত আমার মুখের উপর ফোটা ফোটা করে পড়তে লাগল। তাতে আমার মুখ যেন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এই রকম একটা সাংঘাতিক উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে আমি একেবারেই নিশ্চল। তবে কি এই সেই অদৃশ্য শক্তি যা এখন আমার সামনে দৃশ্যমান? এমন সময় হঠাৎই সে বিশাল বড়ো হা করে আমায় প্রায় গিলতে আসলো। আর তক্ষুনি চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুমাত্র গোঙানির আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ বের হল না। আর ঠিক সেই সময় আমার মনে হল কেউ যেন আমায় ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে-
" এই কি হল? এরকম করছো কেন? কি হয়েছে তোমার? এই যে? "
আমি তাড়াতাড়ি চোখ মেললাম। দেখলাম সামনে আর সেই বীভৎস মুখটা নেই। সাথে সাথে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এ কি? আমি তো দিব্যি উঠে বসতে পাড়ছি। হাত পা গুলোকে নাড়াতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমি তো এখন পুরোপুরি স্বাভাবিক। সেই অসাড় ভাবটাও শরীরে এখন আর নেই। তবে আমি এখন রীতিমতো হাপাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে অস্বাভাবিক ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সাক্ষী হওয়ায় মনের উপর খুব চাপ পড়েছে। এমন সময় হঠাৎ আমার কাঁধে হাত রেখে কেউ আমায় বলছে-
" এই কি গো? কি হয়েছে তোমার? এরকম করছ কেন? "
পাশে তাকিয়ে দেখি তনু বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার সে আমায় বলল-
" কি হয়েছে বলবে তো? "
মনে মনে ভাবলাম তনুকে কি সত্যিটা বলা উচিৎ? ও সবটা শুনলে ভীষণ ভয় পেয়ে যাবে। না না। শুধু শুধু ওকে ভয় পাইয়ে কোনো লাভ নেই। এমনকি আমি এটাও জানি না যে এতক্ষণ ধরে আমার সাথে যা সব ঘটলো সেগুলো সত্যি না মিথ্যে?
তনু এবার হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বলল-
" আরে চুপ করে আছো কেন? কিছু বলবে তো নাকি? "
আমি পরিস্থিতিটাকে একটু হালকা করার জন্য সামান্য হেসে নিয়ে বললাম-
" ও...ও কিছু না।একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিলাম। "
" কি স্বপ্ন দেখেছিলে? "
" আরে তেমন কিছু নয়। তুমি এখন এসব ছাড়ো। আগে বল এখন কটা বাজে? "
ঘরে পূর্ব দিকের দেওয়ালে একটা ঘড়ি টাঙানো ছিল। সেটা খুব পুরনো হলেও এখনও পর্যন্ত সময়ের সঠিক হিসাব দিয়ে যাচ্ছে। সেটার দিকে তাকিয়ে তনু বলল-
" ৭.৩০ টা বাজে। "
আমি অবাক হয়ে বললাম-
" বাপরে! এর মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গেল? "
" হ্যাঁ তুমি অনেক্ষণ ধরেই ঘুমাছ্ছ। তোমার শরীরটা খারাপ বলে আমি আর তোমাকে জাগায়নি। খাওয়া দাওয়াও তো হয়নি তোমার। আমি বরং এক্ষুণি গিয়ে হরিশদাকে বলি আজ একটু তাড়াতাড়ি রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে। "
এই বলে তনু ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আমি সাথে সাথে মোবাইল নিয়ে অখিলেশকে ফোন করলাম। কিন্তু ফোনের ওপার থেকে এক মেয়েলি যান্ত্রিক গলায় একটা কথা ভেসে এল।
" The number you have dialed is currently switched off. Please try after some time. "
এরপর আরও কয়েকবার ফোন করেও অখিলেশকে পাওয়া গেল না।
ক্রমাগত.......