STORYMIRROR

Arpita Pal

Horror Thriller

4  

Arpita Pal

Horror Thriller

অভিশপ্ত ডায়রি-অন্তিম পর্ব

অভিশপ্ত ডায়রি-অন্তিম পর্ব

6 mins
307

অফিস থেকে বেরনোর ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই ঘনিয়ে আসা কালো মেঘ থেকে বৃষ্টির ধারা নামতে শুরু করেছে। এত বৃষ্টিতে রাস্তাঘাটও প্রায় শুনশান। বুক করা ক্যাব জোরাল আলোর হেডলাইট নিয়ে এতক্ষণে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ক্যাবে ওঠার পর মোবাইলে অখিলেশের ফোন এল। ফোনটা রিসিভ করে বললাম-

 " হ্যাঁ রে বল্। কি খবর তোর? "

 " আমি ভালো আছি। তবে মনের দিক থেকে ভালো নেই। সারাজীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। "

 " এখন ওসব কথা রাখ্। আমি কয়েক সপ্তাহ বাদে তোর ওখানে যাচ্ছি। কোনো আপত্তি নেই তো? "

অখিলেশ অত্যন্ত খুশি হয়ে বলল-

 " এতো খুব ভালো খবর। তুই আসলে আমি সবথেকে বেশি খুশি হব। "

অখিলেশের বাড়িতে শেষ ভয়ঙ্কর রাতটায় তনু আমার সত্যি সত্যি ক্ষতি করতে চেয়েছিল। তবে ও সেদিন আমার তনু ছিল না। ওকে মাধ্যম করে অন্য কেউ তার হিংস্রতার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আমার চিৎকার শুনে সুবোধ আর হরিশদা ছুটে আসে। হরিপদদার মুন্ডহীন দেহটা বাড়ির বাগানে ছাতিম গাছের তলায় পাওয়া যায়। সুবোধ আর হরিপদদা তনুকে ধরাধরি করে ঘরের এক কোণায় বেঁধে রাখে। টানা এক মাস আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। স্নায়ুর উপর অসম্ভব চাপ পড়ে গিয়েছিল। রাতে ঘুমের মধ্যে সেই ভয়ানক মুখটা দেখতে পেতাম। চিৎকার করে উঠতাম ঘুমের মধ্যে। বেশিরভাগ সময়টা জেগে কাটিয়ে দিতাম। কারণ আমি ঘুমতে ভয় পেতাম। মনে হত ঘুমালেই সেই শয়তানটা আবার আমার স্বপ্নে আসবে। একবার তো রাতের বেলার মনে হয়েছিল সে আমার বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ খুলে আর কাউকে দেখতে পাইনি। আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে অখিলেশ ঘটনার দুদিন পর দেশে ফেরে। আমি যতদিন হাসপাতালে ছিলাম ততদিন ও কোচবিহারে ছিল। এক মাস পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলে অখিলেশ আমায় নিয়ে আমার কলকাতার বাড়িতে তিনদিন আমার সাথে ছিল। আর তখনই ওর মুখে ওদের বাড়ির সবথেকে খারাপ ইতিহাসটা জানতে পারি। ওদের বংশে বহু বছর আগে সেই সময় বাড়ির ছোট বউয়ের প্রথম সন্তান হিসেবে একটি মেয়ে জন্ম নেয়। যার নাম ছিল স্বর্ণলতা। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার জন্মদাত্রী মারা যায়। তারও এক মাস পর স্বর্ণলতার বাবা এক কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী হন। বাড়িতে অর্থনীতিরও বেশ ক্ষতি হতে থাকে। স্বর্ণলতা পড়াশুনো করতে খুব ভালবাসত। তাই অল্প বয়সেই সে পড়া লেখায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। এদিকে বাড়িতে ছোট বড়ো মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ কিছু অমঙ্গলজনক ঘটনা ঘটতে থাকে। ব্যবসা বানিজ্যে বিপুল পরিমান ক্ষতি হতে থাকে। একবার এক ঘোর বর্ষায় বাড়ির বড়ো কর্তা বজ্রাঘাতে মারা গেলেন। একটা সময় এই সব কিছুর জন্য স্বর্ণলতাকে দায়ী করা হল। সবারই মনে হতে লাগল যে সে এই বাড়ির জন্য অশুভ সংকেত ডেকে নিয়ে এসেছে। তিনতলার কোণার ঘর যেটা স্বর্ণলতারই ঘর ছিল সেখানেই তাকে বন্দি করে দেওয়া হল। দিনে শুধু খাবারটুকু দেওয়া ছাড়া আর কেউ সেরকম তার সাথে দেখা করতে আসত না। তার বড়মা তাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি ছাড়া আর কেউ স্বর্ণলতার খাবার নিয়ে যেত না। এইভাবে সে তিন মাস বন্দি ছিল। শেষের দিকে এতটাই সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল যে তার সামনে যে-ই আসত তাকেই সে আঘাত করার চেষ্টা করত। সেই সময় বড়মা ছাড়া তাকে কেউ আর শান্ত করতে পারত না। স্বর্ণলতা খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। বড়মা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সামান্য কিছু খাওয়াতে পারতেন। প্রতিদিনের মতো একদিন বড়মা সকালে স্বর্ণলতার ঘরে খাবার দিতে গিয়ে ভয়ানক চিৎকার করে ওঠেন। তার চিৎকারে সবাই ছুটে আসে। সেই সময় ঘরের মেঝেতে স্বর্ণলতার প্রাণহীন দেহটা পড়েছিল। তবে তার মৃত্যুটা ছিল সাংঘাতিক। সে পেন দিয়ে নিজেই নিজের গলার নলি ফুটো করে দেয়। গলার চারপাশের মেঝে রক্তে প্রায় ভেসে যাচ্ছিল। বড়মা স্বর্ণলতার মৃত্যুর এই ভয়াবহ দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি। তিনি সেখানেই হার্ট আ্যটাকে মারা যান। স্বর্ণলতার দেহ সৎকারের পর তার ঘর থেকে একটা ডায়রি খুঁজে পেয়েছিলেন সেই বাড়ির মেজো কর্তা। তিনি সারা রাত সেটি পড়েন। পরের দিন তার দেহে কোনো প্রাণ ছিল না। ডায়রিটা স্বর্ণলতার নিজের হাতে লেখা ছিল। যেখানে সে তার জীবনের সব যন্ত্রনার কথা লিখে রেখে গেছে। স্বামীর অকস্মাৎ মৃত্যুতে মেজো বৌ রাগে উন্মাদ হয়ে সেই ডায়রিটাকে পুরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে তার শাড়ির আঁচলে আগুন লেগে যায়। সবাই চেষ্টা করেও সেই আগুন নেভাতে পারেনি। যতক্ষণে আগুন নেভে ততক্ষণে সে মৃত্যুর বিছানায় ঢোলে পড়েছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সেই ডায়রিটার কোনরকম কোনো ক্ষতি হয়নি। এই ঘটনার পরের দিনই এলাকার সব থেকে বড়ো তান্ত্রিককে ডেকে এনে পুজোমন্ত্র পাঠ করে ডায়রিসহ তিনতলার সেই ঘরটাকে চিরকালের জন্য আটকে দেওয়া হয়। আর সেই ঘর এতো বছর পর অখিলেশের কথাতেই খোলা হয়। সে এইসবে বিশ্বাসী নয়। আর এটার কথাই হরিপদদা বার বার বলছিল যে এই অভিশপ্ত ঘরটা একেবারেই খোলা উচিৎ হয়নি। যার জেরে স্বর্ণলতার অভিশাপের ছায়া চারিদিকে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে।  

 এদিকে তনুর জীবনে এক আমুল পরিবর্তন এল। সে ভীষণ হিংস্র হয়ে ওঠে। সামনে যাকে পেত তাকেই মারতে আসত। মাঝে মাঝে কেঁদে উঠত। আবার কখনও কখনও খিল খিল করে হেসে উঠত। অনেক সময় সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠে আমায় খুঁজত। আমার নাম ধরে ডাকত। আমার কাছে আসতে চাইত। সেই সময় আমায় সামনে না পেলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। ডাক্তার আর নার্সেরা মিলে খুব কষ্টে তাকে ধরে বেঁধে ঘুমের ওষুধ ইন্জেক্ট করে দিত। বেশিরভাগ সময়টা সে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিত। আর যখন ঘুম ভাঙত তখনই তার পাগলামো শুরু হয়ে যেত। তার এই বিভৎস স্বভাব আমি বেশিদিন সহ্য করতে পারলাম না। তার সাথে দেখা করতে যাওয়াও বন্ধ করে দিলাম। আসলে দেখা করতে গিয়েও কোনো লাভ হত না। কারণ সে আমায় সামনে দেখতে পেলেই মারতে আসত। আর খালি বলত সে নাকি আমায় শেষ করে দেবে। আমি বুকের মধ্যে একরাশ কষ্ট আর হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম। এরপর মাঝে মধ্যে ডাক্তারকে ফোন করে ওর খোঁজ খবর নিতাম। একদিন ডাক্তারের মুখেই জানতে পারি যে তনু নাকি এবার নিজেকেও আঘাত করা শুরু করেছে। তাই ওকে সর্বক্ষণ বেঁধে রাখা হত। আজ দুদিন হল তনু আমাকে ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। রাতে কি ভাবে যেন সে ঘর থেকে বেড়িয়ে হাসপাতালের পাঁচ তলার বারান্দা থেকে নীচে ঝাপ দেয়।

বৃষ্টিটা এখন অনেকটাই কমেছে। লিফট্ থেকে বেড়িয়ে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই পায়ের নীচে শক্ত মতো কিছু একটা ঠেকল। লাইটটা জ্বালিয়ে মেঝের দিকে তাকাতেই আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে এল। যেটার জন্য আমি তনুকে হারিয়েছি এখন সেটাই আমার পায়ের সামনে পড়ে আছে। স্বর্ণলতার অভিশপ্ত ডায়রি! এমন সময় হঠাৎ ঘরের আলোটা নিভে গেল। বাইরে তখনও মেঘ গর্জন করছে। সেই মেঘের বিদ্যুতের আলোয় এক ঝলকে দেখলাম আমার সামনের সোফাটায় তনু বসে আছে। সে এক অদ্ভুত চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। মাঝে মাঝে মেঘের আলোয় আমি তাকে দেখতে পারছি। আমার তাকে দেখে বড্ড মায়া হল। আমি যেন একেবারে ভুলেই গেলাম যে তনু আর বেঁচে নেই। আমায় সে বলছে-

 " আমার কাছে এস। আমার যে বড়ো কষ্ট। খুব কষ্ট। আমায় ও কিছুতেই তোমার কাছে যেতে দিচ্ছে না। তুমি আমায় ওর কাছ থেকে নিয়ে যাও। Please কাছে এস। "

আর এদিকে আমিও ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কীসের এক আকর্ষণ আমায় এক মুহূর্তের জন্যও বুঝতে দিচ্ছে না যে এখন যা ঘটছে এ সবই মায়া।


বছর তিনেক পর......

[ যেই মায়ার জাল থেকে মনোময় আর তনিমা কোনোদিন ছাড়া পায়নি। ঘটনাচক্রে আজ সেই মায়ার জালে ধরা দিতে চলেছে আরও এক দম্পতি। মনোময়ের ফ্ল্যাট থেকে তার মৃত দেহটা পাওয়ার পর পুলিশ কোর্ট কাছারি সামলে অনেক কষ্টে প্রমোটার সেই ফ্ল্যাট বিক্রি করার মতো পর্যায়ে আনতে পেরেছেন। তিন বছর পর স্বর্ণলতা আরও এক শিকারের সন্ধান পেতে চলেছে......] 


 " এই যে স্যার এদিকে আসুন। এই ফ্লাটটা আপনাদের জন্য একেবারে perfect। "

 " কি মায়া? এই ফ্লাটটা তোমার পছন্দ তো? "

 " হ্যাঁ আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। "

 " বাহ্! তাহলে তো ভালোই হল। অজয়বাবু আমার গিন্নির যখন পছন্দ তখন আমার কোনো সমস্যা নেই। "

 " তাহলে স্যার আজ কিছু advance payment করে দিন। ফ্ল্যাট আপনাদের। "

 " ঠিক আছে। "

রাতে দেবজিৎ আর মায়া দুজনেই খাওয়াদাওয়া করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। সারাদিন ধরে ঘরে জিনিসপত্র ঠিক ঠাক করে রাখতে অনেক পরিশ্রম হয়ে গেছে। অনেক গভীর রাতে মায়া ঘুমের মধ্যে শুনতে পায় কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে।

 " মায়া...... মায়া......মায়া......"

মায়ার ঘুম ভেঙে যায়। তখন আর সেই ডাক শুনতে পায় না। শুধু শুনতে পায় কেউ যেন কাঁদছে। বিছানা থেকে নামতে যাবে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য ঠিক তখনই চোখে পড়ল কোলের উপর রাখা লাল রঙের একটা ডায়রি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror