Saswati Roy

Horror

3.4  

Saswati Roy

Horror

আতঙ্ক

আতঙ্ক

29 mins
822


#পর্ব-এক

আজ রাগিণীর অঙ্ক পরীক্ষা। সকাল থেকেই সে বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছে অ্যালজেব্রার ফর্মুলাগুলো। এবার অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি খেটেছে সে। বাড়িতে একজন স্যার ক্লাস সিক্স থেকে রাগিণীকে পড়াতে আসেন। তৎসত্ত্বেও রাগিণী এই বছর ক্লাস নাইনে উঠতেই তার বাবা তাকে একটা নামকরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছেন। ডঃ রঞ্জন সেন একেবারেই চান না তার মেয়ে কোনো বিষয়েই পিছিয়ে পড়ুক। অন্য সব বিষয়ে রাগিণী নিশ্চিন্তে ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর নিয়ে এলেও এই অঙ্কের জন্য সব সময় পিছিয়ে পড়ে। যতই চেষ্টা করুক, মেরে কেটে সত্তরের বেশী নম্বর আনতেই পারে না সে। আর এখানেই হাই জাম্প দিয়ে রাগিণীকে পিছনে ফেলে দেয় তারই প্রিয় বান্ধবী সুনেত্রা। প্রতিবছর ক্লাসের সেরা ছাত্রীর মেডেলটা সুনেত্রার গলাতেই ঝলমল করে। কথাটা মনে হতেই রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো রাগিণী। আছেটা কি ওই মেয়েটার মধ্যে। দেখতে তো অতি সাধারণ তার ওপর আবার বাঁ পাটা ছোট হওয়ায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। ওই দেখিয়েই তো সবার সহানুভূতি কিনছে। টিচারদেরকেও দেখি সব সময় ওর নাম জপছে। একা একাই বিড়বিড় করে উঠলো রাগিণী "নাহ, এবার আর তোর ফার্স্ট হওয়া হচ্ছে না নেত্রা"। - নটা বেজে গেছে রিনি, খেতে আয় এবার। মায়ের ডাকে তড়িঘড়ি স্কুলব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এলো রাগিণী। পরীক্ষার কটা দিন মায়ের হাতেই খায় সে। রিভিসন করতে সুবিধা হয় তার। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। থিওরেমে চোখ রেখে কোনোরকমে ভাতগুলো গিলছিল রাগিণী। 

- ওভাবে খাচ্ছিস কেন, গলায় আটকে যাবে তো।

 - উফ মা, থামবে একটু। তখন থেকে কানের কাছে বকবক করে যাচ্ছো। দেখছো রিভাইস করছি.... 

- জানি না বাপু, পরীক্ষার দিন সকালে কিসের এত পড়াশুনা। সারা বছর কি করিস তবে? বাড়িতে স্যার আসছেন, কোচিংয়ে পড়তে যাচ্ছিস, তারপরেও পড়া তৈরী হয়না? দিপালী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়ের দিকে।

 - তুমি কি আমায় পড়তে দেবে নাকি উঠে যাবো? সব সময় কানের কাছে ভ্যাজর ভ্যাজর। 

মেয়ের উগ্রমূর্তি দেখে দিপালী একটু মনক্ষুন্ন হলেও মুখে আর কিছু বলে না। স্কুল ভ্যান এসে গেছে, হর্ন বাজাচ্ছে ঘনঘন। নিয়মমাফিক মা আর ঠাকুমাকে প্রণাম করে রাগিণী স্কুল ভ্যানে উঠে বসলো। রাগিণীদের বাড়িটা বড় রাস্তা থেকে বেশ অনেকটা ভেতর দিকে হওয়ায় স্কুলবাস বাড়ি অবধি আসে না। তাই বাধ্য হয়েই এই ভ্যানের ব্যবস্থা। যেতে যেতে সেই ভাঙা বাড়িটা আবার চোখে পড়লো রাগিণীর। বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হবার কথা। কিন্তু বাড়ি ভাঙার কাজ হতে হতে প্রোমোটারের সাথে কর্পোরেশনের কিসব ঝামেলার জন্য কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেলো এভাবেই পড়ে আছে বাড়িটা। রাগিণী একদিন বিকালের দিকে বেড়াতে বেরিয়ে এসেছিল এদিকে। তখনই গা ছমছম করে উঠেছিল তার। রাতে না জানি কেমন পরিবেশ হয়। ফ্ল্যাটটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে হবে বলে আশেপাশে কোনো বাড়িও নেই তেমন। বাবার মুখেই রাগিণী শুনেছিল, এসব। অনেকে আবার বলে বাড়িটায় নাকি ভূত আছে। রাগিণী যদিও ভূতে বিশ্বাস করে না। তবে মাঝে মাঝে ওর মনে হয় যদি ভগবান থাকেন তাহলে ভূত থাকাও কি খুব অসম্ভব!! ঢং ঢং ঢং .... হাতঘড়িতে চোখ রাখল রাগিণী। আর মিনিট পনেরো বাকি ফাইনাল বেল বাজতে। এদিকে জিওমেট্রির এক্সট্রাটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না তার। ডটপেনের পিছন দিকটা চিবিয়ে চিবিয়ে প্রায় চিড়ে চ্যাপ্টা দশা। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সুনেত্রাকে দেখল রাগিণী। নিশ্চিন্ত মুখে খাতার পাতা উল্টাচ্ছে। তার মানে সব পেরেছে সুনেত্রার। এখন শুধু খাতা মিলিয়ে দেখে নিচ্ছে। মনে মনে ফুঁসে উঠল সে। নাহ্ আর একটাই উপায় আছে। ধীরে ধীরে স্কার্টের পকেট থেকে চিরকুটটা বের করল রাগিণী। তারপর ইনভিজিলেটরের চোখ এড়িয়ে ফেলে দিল সুনেত্রার পায়ের কাছে। ************** 

-ম্যাম বিশ্বাস করুন। এই কাগজটা আমার নয়।

 - তোমার মত ছাত্রীর কাছ থেকে এটা আশা করা যায় না সুনেত্রা। পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার জন্য এত নিচে নেমে গেছ, ছিঃ। 

- ম্যাম এই কাগজটা আমার নয়। আমি কেন কপি করব? আমার প্রিপারেশন খুব ভালো ছিল। 

প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সুনেত্রার হাতের লেখার সাথে ওই কাগজটার লেখাটা মেলাচ্ছিলেন। অজান্তেই ভুরুতে ভাঁজ পড়ল ওনার। 

- চুপ করো। পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এটা তোমার হাতের লেখা। তুমি নিজেই দ্যাখো। 

কাগজটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলো সুনেত্রা। এটা সত্যিই তারই হাতের লেখা। তবে এটা সে নিজের জন্য লেখেনি। রাগিণী যাতে পরীক্ষার আগে দ্রুত একবার সব সূত্রতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারে তার জন্য ছোট ছোট হরফে সমস্ত সূত্রগুলোকে একই পাতায় লিখে দিয়েছিল সে। কিন্তু সেই কাগজ তারই পায়ের কাছে পড়ে থাকল কি করে। তবে কি রাগিণী ইচ্ছে করেই.... 

সুনেত্রাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ধারনা বদ্ধমূল হলো। সুনেত্রাকে ওনার ঘরের বাইরে দাঁড়াতে বলে সহশিক্ষিকাদের সাথে এই প্রসঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতে কৌতূহলী ছাত্রীরা ভীড় জমিয়েছে নাটক দেখার জন্য। প্রায় মিনিট দশেক পর তার আবার ডাক পড়ল। নত মুখে প্রিন্সিপাল ম্যামের সামনে গিয়ে দাঁড়াল সুনেত্রা। 

- তোমার পুরনো রেকর্ড খুব ভালো বলে এবার তোমায় শুধু ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে সুনেত্রা।

 - থ্যাংক ইউ ম্যাম। আনন্দে চোখে জল এসে যায় সুনেত্রার।

 - দাঁড়াও, আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। তোমায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু এই পেপারে পাসিং মার্কসের এক নম্বর বেশি তুমি পাবে না। 

সুনেত্রার অনেক কান্নাকাটিতেও প্রিন্সিপাল ম্যামের মন নরম হল না। উনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। ঠিক এক মাস পর রেজাল্ট বেরতে দেখা গেল শীর্ষস্থানে জ্বলজ্বল করছে রাগিণীর নাম। বহুবছর প্রতীক্ষার পর এই ফল আসায় রাগিণীর বাড়িতে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে গেল। কেউ জানতে পারল না সুনেত্রার স্বপ্নগুলোকে হত্যা করেই রাগিণীর এই স্বপ্নপূরণ। রেজাল্ট এর পর নতুন ক্লাস শুরু হতেই দেখা গেল সুনেত্রা আর স্কুলে আসছে না। কেউ বলল এ বছর প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে না পেরে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে সুনেত্রা। কেউ বলল ওর বাবার অন্য শহরে ট্রান্সফার হয়েছে। সুনেত্রা ছিল খুবই সাধারণ পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে ফোনও ছিল না তাদের। আর সে সময় মোবাইল ফোনের এত চল না থাকায় সুনেত্রার খবর কেউই সঠিক ভাবে দিতে পারল না। ক্লাস টেনের পড়াশুনার চাপে ধীরে ধীরে সুনেত্রা প্রায় সবার মন থেকেই মুছে গেল। স্কুলে এখন রাগিণীর কদর সবচেয়ে বেশি। একেই সে নামকরা হার্ট স্পেশালিস্ট রঞ্জন সেনের আদুরে মেয়ে তার ওপর এখন সে ই স্কুলের ফার্স্ট গার্ল। সবারই তার ওপর অগাধ বিশ্বাস। টেস্ট পরীক্ষা এসে গেছে। দম ফেলার ফুরসত নেই কারো। ইঁদুর দৌড়ে কে কাকে পিছনে ফেলবে সেই নিয়ে দিনরাত গবেষণা চলে রাগিণীদের বন্ধু মহলে। কখনো কখনো সুনেত্রার নামও উঠে আসে আলোচনায়। আবার মিলিয়েও যায়। রাগিণী মুখে না বললেও মনে মনে নিজেও জানে সুনেত্রা থাকলে তার এক নম্বরে থাকাটা অসম্ভব হয়ে যেত। একটা প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই উঁকি দিয়ে যায়, কোথায় গেল সুনেত্রা? একেবারে কর্পূরের মত উবেই গেল? 

#পর্ব_দুই 

সারা দুপুর পড়াশুনা করতে করতে মাথা ধরে গেছিল রাগিণীর। দিপালী কফি নিয়ে এসে দেখল পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়ে। আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত রাখল সে। 

- রিনি.... 

- উমম 

- ওঠ কফি এনেছি তো।

 - খাআআবো না মা।

 - ঠিক আছে খাস না। কিন্তু এখানে শুয়ে ঘুমোচ্ছিস কেন? বিছানায় শো। 

ঘুম শব্দটা এবার অবচেতনেও রাগিণীর মস্তিস্কে আঘাত করলো।ঘুমোনোর তো উপায় নেই তার। আর মাত্র চার দিন বাকি পরীক্ষা শুরু হতে। সাথে সাথেই আলস্য ঝেড়ে টানটান হয়েছে শিরদাঁড়া। 

- ইশ, দেখেছ কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। দাও শিগগিরই কফিটা দাও। সামনে খোলা বইয়ের পাতা ওলটপালট করতে করতেই গরম কফিতে চুমুক দিল রাগিণী। 

-থাক। এত পড়তে হবে না। সারাদিন তো বইয়ে মুখ গুঁজে রয়েছিস। বইটা একরকম জোর করেই বন্ধ করে দিল দিপালী। 

- প্লিজ মা। 

- না, একদম না। কফিটা খেয়ে একটু হেঁটে আয়। আধঘণ্টা খোলা হাওয়ায় থাকলে কিচ্ছু এমন পড়াশুনার ক্ষতি হবে না।

 অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাগিণী বাড়ির বাইরে পা রাখল। প্রায় দিন তিনেক পর একটু বেরিয়ে ভালই লাগছিল তার। মাথাটাও হালকা হালকা লাগছে। নাহ্ আজ সত্যিই মায়ের একটা থ্যাঙ্কস প্রাপ্য। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সেই ভাঙ্গা বাড়িটার কাছে চলে এসেছে খেয়ালই করেনি রাগিণী। অন্যমনস্কতার মধ্যে হঠাৎ বাড়িটা দেখে একটু চমকেই উঠল সে। বাড়িটা পুবমুখো হওয়ায়, শেষ বিকেলে ভিতরটা ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। খুব সাহসী লোকেরই হয়তো গা ছমছম করবে। দীর্ঘদিন কেউ বসবাস না করার ফলে বাড়িটার চারপাশ ঝোপজঙ্গল ভর্তি। রাগিণীর ভূতের ভয় না থাকলেও সাপের ভয় আছে। অতএব সে পিছন ঘুরে হাঁটা দিল। দু পাও এসেছে কিনা সন্দেহ হঠাৎ একটা অতি পরিচিত কন্ঠস্বর থামিয়ে দিল তাকে। সেই রিনরিনে স্বর....

 - কেমন আছিস? 

কলের পুতুলের মত ঘুরে তাকালো রাগিণী। সুনেত্রা... হ্যাঁ, সুনেত্রাই তো। সাদার ওপর হলুদ ফুলছাপ কামিজ, হলুদ চুরিদার, হলুদ ওড়না। সেই পরিচিত হাঁটা। ভাঙ্গা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে সুনেত্রা।

 - কিরে ভূত দেখছিস নাকি। একদম সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলো সুনেত্রা।

 - তু..তুই!! তুই এখানে? কোথায় ছিলি এতদিন? আর ঐ বাড়িটায় কি করছিলি?

 - বাব্বাহ্ কত প্রশ্ন। সব এখানে দাঁড়িয়েই শুনবি নাকি?

 - না, না চল এখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই শুনব সব। সাপ খোপের আখরা এই বাড়িটা।

 - ঠিক আছে, চল। রাগিণীর পাশে পাশে হাঁটছে সুনেত্রা। আড়চোখে সুনেত্রাকে দেখছিল রাগিণী। সব সময় লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত মুখটা আজ কেমন যেন হালকা, নির্ভার। এত শীতেও তার গায়ে কোনো গরম জামা নেই। সুনেত্রাকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছিল তার।

 - তুই স্কুল ছেড়ে দিলি কেন? রাগিণী সামান্য নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করল। 

- কেন তুই জানিস না? সুনেত্রার গলার ব্যঙ্গের সুর। একটু থমকে গেল রাগিণী। দাঁড়িয়ে পড়েছে রাস্তার মাঝখানে। রাগিণীকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল সুনেত্রা।

 - ওই দ্যাখ। দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।

 - ওভাবে বলছিস কেন?

 - ও কিছু না। আসলে আমরা আর এই শহরে থাকি না রে। শুধু কিছু জিনিস রয়ে গেছিল। হিসাব মিলছিল না। তাই কদিনের জন্য ফিরলাম। 

কথায় কথায় রাগিণীর বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। এতদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ায় অপরাধবোধ কুরে কুরে খাচ্ছে রাগিণীকে। মনে সাহস এনে সরাসরি তাকালো সুনেত্রার দিকে

 - তোকে আমার কিছু বলার ছিল নেত্রা। 

- জানি কি বলবি। চাপা হাসি খেলা করছে সুনেত্রার চোখেমুখে। - কি জানিস? ঢোক গিলল রাগিণী। 

- যেটা তুই বলতে চাস। তবে এখন আর সেসব কথা বলে কোনো লাভ নেই।

 - আমি জানি আমি অন্যায় করেছি... কিন্তু বিশ্বাস কর তারপর থেকে আমি তোর কাছে.... 

রাগিণীর কথা শেষ হবার আগেই লোডশেডিং হয়ে গেল। আজকাল প্রায়ই এই অঞ্চলে এমন হচ্ছে। একবার গেলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আলো আসে না। হঠাৎ করে আলো নিভে যাওয়ায় রাগিণী বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে। সঙ্গে টর্চও নেই। তখনই সুনেত্রার গলা শুনতে পেল

 - ভয় পাচ্ছিস? আমার হাতটা ধর। 

- না না। ঠিক আছি আমি। ওই তো আমার বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কথাটা বলেই রাগিণীর খেয়াল হল, সত্যিই তো সে নিজের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। ওই তো ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। গেটের সামনের বাল্বটাও তো দিব্যি জ্বলছে। তবে তার চারপাশটাই এরকম অন্ধকার কেন? সুনেত্রাকে কথাটা বলবে বলে পাশ ফিরতেই দেখল কেউ কোত্থাও নেই। হলুদ আলো ছড়ানো স্ট্রিট ল্যাম্পের নীচে সে একা দাঁড়িয়ে। প্রায় উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে গেট খুলে বাড়িতে ঢুকল রাগিণী। উন্মাদের মত বেল বাজাচ্ছে। দিপালী দরজা খুলেই দেখল মেয়ের মুখ কাগজের মত সাদা। 

- ওভাবে বেল বাজাচ্ছিলি কেন? কি হয়েছে ? 

মাকে কোনো উত্তর না দিয়ে আগে দরজায় ছিটকিনি তুলল রাগিণী। দরজায় পিঠ চেপে হাঁপাচ্ছে। দিপালী আবার প্রশ্ন করলো

 - হয়েছেটা কি বলবি তো। এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন? 

মা কে কোনরকমে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল রাগিণী। বাইরের জামা কাপড় না ছেড়েই শুয়ে পড়েছে বিছানায়।মাথার ভিতরটা কেমন যেন করছে। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব চিন্তা ভাবনা। সুনেত্রা হঠাৎ কোথা থেকে এলো আর চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই মিলিয়েই বা গেল কোথায়? ভাবনার মাঝেই দিপালী এসেছে দরজায়। সন্দিহান দৃষ্টিতে দেখছে মেয়েকে

 - কি হয়েছে রে রিনি ? ভয় পেয়েছিস নাকি কিছু দেখে? মা কে দেখে উঠে বসল রাগিণী। প্রাণপনে স্বাভাবিক রাখতে চাইল নিজেকে

 - কিছু হয়নি মা। আমি একটু ঘুমাব।

 - এখন? এই সন্ধ্যেবেলায়? 

দিপালী একটু অবাকই হল মেয়ের কথায়, তবে মুখে আর কিছু বলল না।পরীক্ষার আগে তার বইকুনো মেয়ে ভর সন্ধ্যেয় ঘুমাতে চাইছে। এমনটা তো হবার কথা নয়। একটু চিন্তিত মুখেই দিপালী সরে এলো রাগিণীর ঘরের সামনে থেকে। মাকে চলে যেতে বলেও স্বস্তি হচ্ছিল না রাগিণীর। কেমন একটা ভয় চেপে বসেছে তার মনের মধ্যে। সুনেত্রার হঠাৎ আগমনের থেকেও বেশি রহস্যজনক আচমকা তার মিলিয়ে যাওয়াটা। অত তাড়তাড়ি কোথায় গেল ও? রাস্তার আলোটা জ্বলতেই রাগিণী ভালো করে দেখেছিল, সুনেত্রা কোত্থাও ছিল না। সত্যিই কি এসেছিল সুনেত্রা নাকি তার মনের ভুল? প্রশ্নগুলো পাকে পাকে বেঁধে ফেলছিল রাগিণীকে। কেন আবার এলো সুনেত্রা... রাগিণীকে সব মনে করাতে নাকি শাস্তি দিতে। হিংসায় জ্বলে পুড়ে সেদিনের কাজটা সে একেবারেই ঠিক করেনি। সে নিজে ছাড়া আর কেউ এই ঘটনার কথা জানত না কিন্তু আজ সুনেত্রার কথা শুনে মনে হল সেও সব কিছুই জানে। সুনেত্রা কি সত্যিই পেরেছে তাকে ক্ষমা করতে? সুনেত্রা যদি এসব কথা স্কুলে জানিয়ে দেয়, ম্যামেরা কি ভাববেন আর বাবা-মা, তারা এসব জানলে তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে। ক্লাস নাইনে পড়া মেয়ের এই কুকীর্তিকে কেউই কি ছেলেমানুষি খেয়াল বলে ক্ষমা করবে? বরাবর সুনেত্রাকে হিংসে করে গেছে রাগিণী। অথচ সুনেত্রা কিন্তু বিপদে আপদে সব সময় তার পাশে থেকেছে। সেই অঙ্ক পরীক্ষার দিন যখন সুনেত্রাকে প্রিন্সিপালের ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন কি অদ্ভুত আকুতি নিয়ে তার দিকে তাকিয়েছিল সুনেত্রা। হয়তো ভেবেছিল এই সঙ্কটে রাগিণীকে পাশে পাবে। স্বপ্নেও হয়তো ভাবেনি ওই বিশ্রী পরিস্থিতির জন্য রাগিণীই দায়ী। ভাবতে ভাবতে রাগিণী কখন যে ছাদে উঠে এসেছে নিজেরই খেয়াল হয়নি। তাদের দোতলা বাড়ির ছাদটা খুব সুন্দর। বাড়ির চারদিকে সুপারি আর নারকেল গাছ থাকায় ছাদে উঠলেই মনোরম হাওয়া বাতাস পাওয়া যায়। ছাদের ডানদিকে জলের ট্যাঙ্ক বসানো। তারপাশেই বসার জন্য সিমেন্টর ধাপি তৈরী করা। খোলা হাওয়ায় একটু বসার জন্য রাগিণী সেদিকেই এগিয়ে গেল। দু পা এগিয়েই থমকেছে, ধাপিতে কেউ বসে আছে কি? আধো আলোয় ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না রাগিণী। চশমাটাও পরে আসেনি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল

 - কে ওখানে? কোনো উত্তর নেই। কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলো ছায়া মেখে কেউ ওখানে বসে আছে। রাগিণী ধীর পায়ে ধাপিটার দিকে এগোতে শুরু করতেই, ছায়া মূর্তিটাও পায়ে পায়ে রেলিংয়ের দিকে এগোতে শুরু করল। হাঁটাটা খুব চেনা লাগছিল রাগিণীর। বাঁ পাটা ঘষে ঘষে চলেছে ছায়ামূর্তি, কিসের টানে কে জানে রাগিণীও তাকে অনুসরণ করল। ছাদের একদম ধারে গিয়ে মূর্তিটা একবার পিছন ফিরে দেখল রাগিণীকে তারপর যেন হাওয়ায় মিশে গেল। রাগিণী বোধহয় একটু বেশি দ্রুততার সাথে আসছিল, আর টাল সামলাতে পারল না..... ছাদ থেকে পড়ে যেতে যেতেও দূর থেকে যেন মায়ের গলা শুনতে পেল রাগিণী।

 - রিনি, রিনি....ইই ওরকম ছটফট করছিস কেন মা? 

দিপালী জোরে জোরে ঝাঁকালো মেয়েকে। ধড়মড় করে উঠে বসল রাগিণী। বেঁচে আছে সে। ছাদ থেকে পড়ে গিয়েও বেঁচে আছে কি করে? নাকি স্বপ্ন ছিল সব? উফ্ মাগো, কি ভয়ানক স্বপ্ন তবে..... 

#পর্ব_তিন 

- কি হয়েছে তোর? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস বুঝি? দিপালীর প্রশ্নে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল রাগিণী। 

- কি হয়েছে বল আমায়। মায়ের স্নেহের স্পর্শে রাগিণী আরও দুর্বল বোধ করছিল। বহুদিন পর আবার মা কে জড়িয়ে ধরল সে। প্রায় বিড়বিড় করে উঠল 

- আমার খুব ভয় করছে মা। আমায় ছেড়ে কোত্থাও যেও না তুমি। 

দিপালী ঠিক বুঝতে পারছিল না রাগিণীর এরকম আচরণের কারণ। 

-কিসের ভয় পাচ্ছিস তুই? বল আমাকে। দিপালীর কোল থেকে মুখ তুলল রাগিণী। তারপর কানের একদম কাছে এসে ফিসফিস করে বলল

 - ও ফিরে এসেছে মা। 

- কে ফিরে এসেছে? 

- সুনেত্রা। ওকে মনে আছে তোমার?

 - সুনেত্রা ফিরে এসেছে ? একটু অবাকই হল দিপালী। তবে এবার রাগিণীর এই অদ্ভুত আচরণের একটা কারণও খুঁজে পেল সে। সুনেত্রা প্রতি বছর ফার্স্ট হওয়ায় তাকে নিয়ে রাগিণীর বেশ দুশ্চিন্তা ছিল। সুনেত্রা পরীক্ষায় কপি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এটা সে মেয়ের কাছেই শুনেছে। এবং তারপর সেই মেয়ে স্কুলও ছেড়ে দেয়। অনেক বছর প্রতীক্ষার পর ওই আসনটা পেয়েছে রাগিণী। এখন হঠাৎ করে সুনেত্রা ফিরে আসলে একটু ঘাবড়ে তো যাবেই সে। মেয়েকে তবু সাহস দেবার চেষ্টা করল দিপালী। 

- ও ফিরে এসেছে তো কি হয়েছে। দেখিস তুই ই আবার ফার্স্ট হবি। 

- তুমি বুঝতে পারছ না মা। ও ফিরে এসেছে কিন্তু.... 

- আর একটা কথাও আমি শুনব না। তুই খেয়ে নিবি চল। তোর বাপির আজ ফিরতে রাত হবে। বাপির জন্য আজ আর অপেক্ষা করতে হবে না। 

- আমার একদম ইচ্ছে করছে না মা খেতে। 

- ইচ্ছে করছে না বললেই হবে? চল বলছি। 

- প্লিজ মা। রাগিণীর মুখটা দেখে মায়া হল দিপালীর। নরম গলায় বলল

 - আচ্ছা ঠিক আছে। তোকে নীচে যেতে হবে না। আমি তোর খাবার এখানেই নিয়ে আসছি।

 শাশুড়ি মাকে রাতের খাবার দিয়ে দিপালী রাগিণীর ঘরে খাবার নিয়ে এল। রাগিণী তখনও ঘাড় গোঁজ করে বসে আছে। চিন্তা হচ্ছিল দিপালীর। চারদিন বাদে পরীক্ষা, মেয়ের যা অবস্থা তাতে তো টেনশনেই অর্ধেক পরীক্ষা খারাপ করে ফেলবে। দিপালীর হাতে খাবারের প্লেট দেখে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে বসল রাগিণী। ক্লান্ত গলায় বলল 

- এত খেতে পারব না মা। 

- এত কোথায়? দুটো তো মাত্র রুটি এনেছি। আর তোর পছন্দের চিকেন স্টু। এটুকু না খেলে হয়? স্টুয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে কোনোরকমে একটা রুটি গলাধঃকরণ করলো রাগিণী। দিপালী চলে যেতে ঘর লাগোয়া বাথরুমে মুখ ধুয়ে এসে আবার শুয়ে পড়েছে। পরীক্ষা সামনে তাও একদম পড়তে ইচ্ছে করছে না আজ। শরীরটা কেমন যেন করছে। ভার হয়ে আসছে চোখের পাতা জোড়াও। একটানা একটা ঘণ্টার মত শব্দে ধীরে ধীরে চোখ মেলল রাগিণী। জানলাগুলো পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকায় ঘরের ভিতরটা অন্ধকার। চোখ খুলে রাগিণী বুঝতে পারছিল না এখন দিন না রাত। ঘুম ভাঙার পরেও আচ্ছন্নের মত পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। সারা গা হাত পায়ে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে। মাথার ভিতরটাও দপ দপ করছে যন্ত্রনায়। জ্বর আসবে মনে হচ্ছে। একটা প্যারাসিটামল এক্ষুনি দরকার তার। কোনরকমে বিছানা থেকে নামলো রাগিণী। বেডসুইচটা টিপে আলোটা জ্বালাতে গেল। জ্বলল না আলো। আবার হয়তো লোডশেডিং। অন্ধকারটা এখন অনেকটা সয়ে এসেছে চোখে। দরজা খোলার জন্য এগোল সে। এক পা এগিয়েও থেমে গেছে। দরজার কাছে কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে। অল্প ধোঁয়া ধোঁয়া মত। বাইরে কি কিছু পুড়ছে? ভাবতে ভাবতেই রাগিণী দেখল ধোঁয়াটা ক্রমে ক্রমে পাক খেয়ে খেয়ে ওপর দিকে উঠছে। অন্ধকারেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর রংটাও বদলে বদলে যাচ্ছে। রাগিণীর মাথা ছাড়িয়ে গেল এবার ধোঁয়ার কুণ্ডলী। রাগিণী বুঝতে পারছিল না কি করবে। চিৎকার করে মা কে ডাকতে চাইল সে, কিন্তু গলাটা যেন কেউ টিপে ধরে রেখেছে। এক ফোটা শব্দ বেরোল না গলা থেকে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবার মানুষের আকার নিচ্ছে। পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিল রাগিণী, সুনেত্রা তার সামনে দাঁড়িয়ে। ঠিক যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে রাগিণীর একদম সামনে চলে এল সুনেত্রা। তার ঘৃণাভরা চোখ রাগিণীর চোখে স্থির। ফ্যাসফেসে গলায় বলে উঠল সুনেত্রা

 - খুব ভয় পাচ্ছিস না রে? আমিও সেদিন খুব ভয় পাচ্ছিলাম যখন ম্যাম আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। 

- আমায় ক্ষমা কর নেত্রা। কঁকিয়ে উঠল রাগিণী।

 - ক্ষমা? তোকে? তুই আমায় বাঁচতে দিস নি। খুব যন্ত্রনা নিয়ে আমি মরেছি জানিস? তোর জন্য শুধু আমি নই আমার পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। 

- ভুল হয়ে গেছে আমার। ক্ষমা করে দে। 

- তুই যখন যা চাইবি তাই হবে নাকি? 

- কি করব বল তাহলে।

 - যা বলব করবি ? 

- হ্যাঁ করব.... - স্কুলে গিয়ে সবার সামনে স্বীকার করবি তুই কি করেছিস। 

- স্কুলে গিয়ে? 

- হ্যাঁ । নাহলে যে আমার মুক্তি নেই।

 - আমার বাবা মা লজ্জায় অপমানে মরে যাবে নেত্রা।

 - আর আমার বাবা মা? তাদের কি? ভেবেছিস কোনোদিন? কিভাবে আছে তারা? আমি তো গলায় দড়ি দিয়ে সব অপমানের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গেছি। তারা তো প্রতিদিন মরছে। আর এসব শুধু তোর জন্য। তোকে সব অন্যায় স্বীকার করতেই হবে। 

- তুই বেঁচে নেই? 

- ওসব কথা ছাড়। স্বীকার করবি কি না বল। 

- প্লিজ নেত্রা এছাড়া আর যা বলবি....

 - তাহলে তুই স্বীকার করবি না। ঠিক আছে, আমার সাথে আয় তবে। 

সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে হাতছানি দিচ্ছে সুনেত্রা। রাগিণী আর উপেক্ষা করতে পারল না তার ডাক। এগিয়ে গেল সুনেত্রার দিকে। 

******************** 

রাতে খেতে বসে ভাতগুলো নিয়ে নাড়াচারা করছিল দিপালী। রঞ্জনের একটু সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞাসা করল 

- কি হল খাচ্ছ না কেন?

 - কই, খাচ্ছি তো। 

- বললেই হবে! তখন থেকে দেখছি খুঁটে চলেছ। কি ব্যাপার বলতো। রিনির সাথে কিছু হয়েছে নাকি? ও তো আজ খেতেও এলো না দেখলাম। 

- হ্যাঁ, ও টেবিলে আসতে চাইল না। তাই ঘরেই খাইয়ে এলাম। 

- সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন এল না?

 - জানি না। আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে জানো? 

- কি?

 - ও বেরিয়েছিল একটু। বাড়িতে ফিরল ছুটতে ছুটতে। মুখচোখ দেখে মনে হল খুব ভয় পেয়েছে। তারপর.... 

- কি তারপর? 

- আমায় বলল ঘুমাবে। কিছুক্ষণ পর একটা শব্দ পেয়ে ওর ঘরে গিয়ে দেখি, ঘুমের মধ্যে অস্বাভাবিকভাবে গোঙাচ্ছে। শরীরটাও কেমন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিলো। আমার খুব ভয় করছিল গো। তারপর ঘুম থেকে উঠে বলল ওর সেই পুরনো বান্ধবী সুনেত্রা নাকি ফিরে এসেছে।

 - ফিরেছে তাতে ভয় পাবার কি আছে? 

- না গো, ও ঠিক স্বাভাবিক নেই বিশ্বাস করো। তুমি এত ক্লান্ত হয়ে ফিরলে তাই তক্ষুনি আর এসব বলে বিরক্ত করিনি। রঞ্জন ব্যাপারটাকে খুব একটা আমল দিল না। প্রতিবারই পরীক্ষার আগে দুশ্চিন্তায় রাগিণী কিছু না কিছু গোলমাল বাঁধায় বাড়িতে। রাগিণীর কাছে এটা নতুন কিছু নয়। তবু দিপালীকে আশ্বস্ত করল 

- ভয় পাবার মত কিচ্ছু হয়নি। পরীক্ষার মুখে অনেক সময় নার্ভাসনেস থেকে এরকম হয়।

 - তুমি বুঝতে পারছ না। এই ব্যাপারটা সেরকম নয়।

 -তবে কি রকম শুনি।

 - আমি হয়তো তোমায় ঠিক বোঝাতে পারছি না। ও পরীক্ষার আগে টেনশন করে ঠিকই। কিন্তু আজ ওর চোখেমুখে যে ভয়টা দেখেছি সেটা পরীক্ষা নিয়ে নয়। ও কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে।

 - ওহ, প্লিজ দিপালী এখন তুমি আষাঢ়ে গপ্প ফেঁদো না। খুব টায়ার্ড আছি আজ। কাল সকালে দরকার হয় রিনির সাথে কথা বলে নেব।

 - কি কথা বলবে বাপি? 

দিপালী আর রঞ্জন খেয়ালই করেনি কখন যেন রাগিণী এসে দাঁড়িয়েছে ডাইনিং রুমে। রাগিণীর ঠাণ্ডা স্বরে চমকে উঠল দুজনেই।

 - ওমা তুই? তুই কখন এলি? দিপালী তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। রাগিণীর চোখ তার বাবার দিকে স্থির। কেমন যেন অস্বাভাবিক দৃষ্টিটা। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

 - তেমন কিছু না। ওই তোর প্রিপারেশন কেমন সেই নিয়ে আর কি।

 - তাই? বরফের থেকেও ঠাণ্ডা স্বর রাগিণীর। 

- হ্যাঁ তাই। রঞ্জন হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে মেয়ের দিকে। আজ অনেক রাত হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা কথা বলব। 

- ও, আচ্ছা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে রাগিণী। পিছন থেকে মেয়েকে দেখছিল রঞ্জন। হাঁটাটা যেন কেমন কেমন লাগছে। বেসিনে মুখ ধুতে ধুতে দিপালীকে বলল 

- রিনি কি পায়ে ব্যথা ট্যথা পেয়েছে নাকি?

 - কই না তো। আমায় তো কিছু বলেনি। 

- মনে হল সিঁড়ি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে উঠছে। জানি না হয়তো আমারই চোখের ভুল। 

- হ্যাঁ তাই হবে। তোমার মেয়ে তো ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়। পায়ে চোট পেয়ে থাকলে কি আর চুপ করে থাকত? চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় করতো। 

- যাক গে, মা শুয়ে পড়েছে?

 - অনেকক্ষণ। মায়ের রাতের ওষুধটা কিন্তু ফুরিয়ে এসেছে। কাল মনে করে নিয়ে এসো।

 - হুম। চিন্তিত মুখে রঞ্জন শোবার ঘরের দিকে চলে গেল। রাতের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যাবার পরেও প্রচুর কাজ থাকে। সব গুছিয়ে দিপালী যখন শুতে এলো ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেছে। ঠাণ্ডা পড়ে গেছে বেশ। আজ আর হালকা সুজনীটায় কাজ হবে বলে মনে হয় না। বক্স খাট থেকে গত বছর কেনা কম্বলটা বের করল। তুলতুলে নরম কম্বলটা নিয়ে বিছানায় উঠতে গিয়েও থেমে গেল দিপালী। রিনিটার পরীক্ষা দোর গোড়ায়। নির্ঘাত রাত জাগছে। আজ তো শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে খেলও না তেমন কিছু। একটু হরলিক্স করে দিয়ে এলে হয়। হরলিক্সের গ্লাস হাতে দোতলায় উঠতে উঠতে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ পাচ্ছিল দিপালী। রিনির ঘরের সামনে যেতে শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট হল। বুক হিম হয়ে এল দিপালীর। বন্ধ ঘরে রিনি গোঙাচ্ছে কেন? দরজায় টোকা দেবার বদলে দুমদুম করে ধাক্কাই দিয়ে ফেলল দিপালী। ওমনি থেমে গেছে শব্দটা। দিপালী এবার বেশ জোরে ডেকে উঠল - রিনি..., রিনি....ইই। দরজা খোল। কোন সাড়া না পেয়ে দিপালী আবার দরজায় ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আর দরকার হল না। দরজা খুলে গেছে। রাগিণী সামনে দাঁড়িয়ে। দুধ সাদা নাইটিতে কেমন রহস্যময় দেখতে লাগছে তাকে। - কি হল, দরজা খুলছিলি না কেন? - শুনতে পাইনি। অসম্ভব কর্কশ গলা রাগিণীর। ঘরের ভিতরটা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিল দিপালী। নাহ্ দেখা যাচ্ছে না। দরজাটা অল্প ফাঁক করে দাঁড়িয়ে রাগিণী। মাথাটা নিচু করে রেখেছে। ফাঁপানো খোলা চুলে মুখের অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে। দোতলার ড্রয়িংরুমের আলোটা নেভানো থাকায় মেয়ের মুখটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল না দিপালী। মেয়েকে কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছিল দিপালীর। সত্যি বলতে কি, একটু ভয় ভয়ই করছিল তার। পরক্ষণেই রঞ্জনের আশ্বাসবাণী মনে পড়তে জোর করে হাসি ফোটাল মুখে। হরলিক্সের গ্লাসটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল - এটা খেয়ে নিস। আর বেশি রাত জাগিস না। গ্লাসটা হাতে নিয়ে কলের পুতুলের মত ঘরে ঢুকে গেল রাগিণী। দরজা বন্ধ হয়ে গেছে আবার। মেয়েকে একা রেখে যেতে সাহস হচ্ছিল না দিপালীর কিন্তু দ্বিতীয়বার ডাকতেও সাহস হচ্ছিল না তার। বিছানায় শুয়েও এপাশ ওপাশ করছিল দিপালী। কিছুতেই ঘুম আসছে না আজ। নরম কম্বলটাও যেন পাথরের মত বুকের ওপর চেপে বসে আছে। আলো আধারিতে দেখা রাগিণীর আবছা মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিকাল থেকে কি অদ্ভুত আচরণ করে যাচ্ছে মেয়েটা। এদিকে তার বাবাকে দ্যাখো, বিছানায় পড়তে দেরী ভোঁস ভোঁস করে ঘুম শুরু। জেগে থাকতে থাকতে জল তেষ্টা পাচ্ছিল দিপালীর। বেড সাইড টেবিলে হাত দিতে গিয়েও থমকে গেল। ইশ, শোবার আগে মনটা এত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল যে জল আনার কথা মনেই ছিল না। এদিকে বেশ পিপাসাও পাচ্ছে। প্রায় নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ডাইনিং রুমে এলো দিপালী। খাবার টেবিলে ভরা জলের বোতল সাজানোই থাকে। একটা বোতল খুলে ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল গলায় ঢালল সে। উফ গলাটা একদম শুকিয়ে গেছিল। জল খেয়ে বোতলটা নিয়ে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলো দিপালী। তার আগেই চোখ আটকে গেছে ফ্রিজের পাশে। লম্বা ফ্রিজটার আড়ালে কেউ যেন লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে। সুইচ বোর্ডটা হাতের নাগালেই তবু হাত বাড়িয়ে সুইচ অন করতে ভুলে গেল দিপালী। রঞ্জনকে ডাকতে গিয়েও গলা থেকে একটা ফোটা শব্দ বেরোল না তার। ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তার মধ্যেই নিশিতে পাওয়া মানুষের মত ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেল দিপালী। তাদের বেডরুমের আলোটা সামান্য এসে পড়েছে প্যাসেজে সেই আলোতেই দিপালী দেখল রাগিণী জড়সড় হয়ে বসে আছে ফ্রিজটার পাশে। কিসের ভয়ে কে জানে দীপালির হাত থেকে কাঁচের বোতলটা পড়ে চুরমার হয়ে গেল। বোতল ভাঙার শব্দে রঞ্জনেরও ঘুম ভেঙে গেছে। ডাইনিং রুমে এসেই বড় আলোটা জ্বেলে দিয়েছে রঞ্জন। আলো জ্বলতে রাগিণী আরও কোণের দিকে সরে গেল। দিপালী তখনও স্থানুর মত দাঁড়িয়ে। দিপালীর দৃষ্টি অনুসরণ করে রঞ্জন ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যেতেই বেরিয়ে এলো রাগিণী। রঞ্জন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অমানুষিক জোরে রঞ্জনকে একটা ধাক্কা দিয়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল রাগিণী। তীব্র একটা শব্দে দোতলার দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর হুঁশ ফিরল দিপালীর। ছুটে এসেছে রঞ্জনের কাছে। বেসিনের কোণায় পড়ে রঞ্জনের কপালের ডানদিকটা মুহুর্তে ফুলে উঠে কালশিটে পড়ে গেছে। দিপালীর সাহায্যে কোনোরকমে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো রঞ্জন। তার বিহ্বল দৃষ্টি তখনও সিঁড়িতে। ঘরে এসে রঞ্জনের কপালের ব্যথার জায়গাতে বরফ লাগিয়ে দিচ্ছিল দিপালী। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে রঞ্জনের চোখমুখ। হঠাৎই হাত চেপে ধরেছে দিপালীর। অস্ফুটে বলল - সাইকো.... সাইকো হয়ে গেছে আমাদের মেয়েটা দিপালী। - না, না ওসব বোলো না প্লিজ। - তাহলে কি বলব। এত জোর ওইটুকু মেয়ের শরীরে এলো কোথা থেকে? - আমার মনে হয় ওকে কেউ তুকতাক করেছে। - অশিক্ষিতদের মত কথাবার্তা বোলো না দিপালী। - তুমি না মানলেও এসব হয়। বুঝতে পারছ না কিছু? পরশু থেকে পরীক্ষা। আমার মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো বলে নিশ্চয়ই কেউ কিছু করেছে। - কি যাতা বলছ। আমি এসব মানি না। - তুমি না মানলেও আমি মানি। আর আমি কালই মালতীর সাথে কথা বলব। ওদের পাড়ায় কে যেন ঝাড়ফুক করে। - এসব পাগলামি একদম করবে না। আমি সাইকিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করব কাল। 


#অন্তিম_পর্ব 

#সাইকিয়াট্রিস্টের_কাছে

 - তোমার নাম কি? - রাগিণী। রাগিণী সেন। - তোমার বাবা আমার বন্ধু জানো? অল্প ঘাড় কাত করল রাগিণী। - আচ্ছা রাগিণী আমরা কি আজ থেকে বন্ধু হতে পারি? মানে এমন বন্ধু, যার কাছে তুমি তোমার মনের সব কথা বলতে পারো। - আপনি আমার বন্ধু না। আপনি তো সাইকিয়াট্রিস্ট। আমায় ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার ট্রিটমেন্ট করবেন ভেবেছেন? ডক্টর পিনাকী সিনহা বছর পনেরোর একটা বাচ্চা মেয়ের থেকে এরকম উত্তরের আশা একেবারেই করেননি। বোধহয় একটু হকচকিয়ে গেলেন। রাগিণী আবার বলল - আপনার বন্ধুকে বলবেন আমি পাগল নই। - কোন বন্ধুকে বলব? -কেন যিনি আপনাকে আমার ট্রিটমেন্ট করতে বলেছেন, ডক্টর রঞ্জন সেন। তাকেই কথাটা জানিয়ে দেবেন। - ওভাবে বলছ কেন? উনি তো তোমার বাবা। অদ্ভুত একটা হাসি ফুটে উঠল রাগিণীর ঠোঁটের কোনায়। ডক্টর সিনহা আবার প্রশ্ন করলেন - তুমি কি তোমার বাবার ওপর কোনো কারনে রাগ করে আছো? ইউ ক্যান টেল মি রাগিণী। আই অ্যাশিওর ইউ, আই উইল কীপ দিস আ সিক্রেট। - লিসেন ডক্টর, আই অ্যাম নট বাউন্ড টু টেল ইউ এনিথিং। ক্যান আই লিভ নাও? ডক্টর দেখিয়ে রাগিণীকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। গোটা রাস্তা রাগিণী বাবা-মা কারুর সাথে কোনো কথা বলল না। গুম হয়ে বসে রইলো গাড়ির পিছনের সিটে। বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই প্রায় দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। দরজায় দাঁড়ানো ঠাকুমার দিকে ফিরেও তাকালো না। সেই রাতে রাগিণী সবার সাথেই খেতে বসল। কিন্তু বলতে গেলে কিছুই খেল না। ফেলে ছড়িয়ে উঠে গেল টেবিল থেকে। রঞ্জন দিপালীকে বারণ করল জোরাজুরি করতে। ডক্টর সিনহা বারবার করে বলে দিয়েছেন কোনো ব্যাপারেই রাগিণীকে জোর না করতে। রাতে আর তেমন কিছু গোলমাল হল না। শুধু দিপালীর ঘুমের ঘোরে একবার মনে হল কেউ যেন ভারী কোনো জিনিস দোতলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে। রঞ্জনকে ডাকতে যাবে ভাবতে ভাবতেই শব্দটা থেমে গেল। সারাদিনের ধকলের পর দিপালী কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই বোঝেনি। চোখ খুলল রঞ্জনের ডাকে। - অ্যাই, শুনছো.... - কি হয়েছে? রিনি ঠিক আছে তো? ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল দিপালী। - রিনি ঠিক আছে। ঘুমোচ্ছে। আমি দেখে এসেছি। সবকিছু একদম নর্মাল। - ওহ। সামান্য নিশ্চিন্ত হল দিপালী। - শোনো কাল থেকে ওর পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। আজ কিন্তু কোনো কিছু নিয়ে ওকে জোর করবে না বা ওর সাথে তর্কে জড়াবে না। সিনহা কিন্তু স্ট্রিক্টলি বারণ করে দিয়েছে। আর ওর মেডিসিনগুলো টাইমলি দেবে। আমার কিন্তু আজ ফিরতে রাত হবে। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা। যেকোন সময় হয়তো বৃষ্টি নামবে। রাগিণী সারাদিন নিজের ঘরেই রয়েছে। দিপালী ঘরে গিয়ে দুপুরের খাবার খাইয়ে এসেছে। গত কয়েকদিনের তুলনায় বাড়ির পরিবেশ আজ বেশ শান্ত। দিপালী বার কয়েক চুপিচুপি গিয়ে উঁকি দিয়েছিল রাগিণীর ঘরে। প্রতিবারই দেখেছে রাগিণী বইয়ে মুখ গুঁজে শোয়া। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা পাথরটা যেন ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছিলো দিপালীর। বিকাল চারটে নাগাদ কফি নিয়ে রাগিণীর ঘরে গিয়ে দিপালী দেখল ঘর ফাঁকা। ব্যালকনি, বাথরুম সব জায়গা খুঁজে দিপালী ছাদটা একবার দেখতে উঠল। নাহ্, ছাদের দরজাতেও ভিতর থেকে তালা ঝুলছে। শীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল দিপালীর কপালে। তরতর করে একতলাতে নেমে এল সে। যা ভেবেছিল তাই, সদর দরজার ছিটকিনি খোলা। বাইরের গেটটাও হাঁ হয়ে আছে। উদভ্রান্তের মত রাস্তায় বেরিয়ে এলো দিপালী। সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই জিজ্ঞাসা করছে মেয়েকে দেখেছে কিনা। দেখতে দেখতে ভীড় জমে গেল পাড়ায়। সবারই মুখে এক কথা "রিনি তো এভাবে না বলে কোথাও চলে যাবার মেয়ে নয়"। কেউ কেউ আবার কানাকানি করতে শুরু করল "আরে নির্ঘাত ভেগেছে কারুর সাথে। যতই লুকোক, এসব কি আর চাপা থাকে?" পাড়ার একটি ছেলে সাইকেল নিয়ে এদিকেই আসছিল। জটলাটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সেও। কোন একজনের মুখ থেকে কারণটা শুনে সে জোরে জোরে সাইকেলটা চালিয়ে রাগিণীদের বাড়ির দিকে চলল। গেটের মুখেই দিপালী দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে পাড়ার কয়েকজন মহিলা। ডাক্তারবাবুর মেয়ের পালিয়ে যাবার খবরে এই শীতেও পাড়া বেশ উত্তপ্ত। ছেলেটি সোজা এগিয়ে এলো দিপালীর দিকে - কাকিমা, আমি রিনিকে দেখেছি। - কোথায়? কোথায় দেখেছ? দিপালীর চোখে আশার আলো জ্বল জ্বল করে উঠল। - ওই বড় মাঠের পাশে যে ফ্ল্যাট বাড়িটা তৈরী হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল... রিনি সেই বাড়িটার দিকেই যাচ্ছিলো। আপনি একটু ওয়েট করুন আমি এক্ষুনি দেখে আসছি। - আমিও আসব তোমার সাথে। দিপালী বলে ওঠে। - আচ্ছা আসুন। দিপালী আর ছেলেটির পিছনে বেশ বড় একটা দল পাড়া থেকে চলল রাগিণীর খোঁজে। আজ দুপুরের পর থেকে সমানে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হবার জন্য ঠাণ্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে আজ। বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। ঝোপজঙ্গল ঘেরা অন্ধকার বাড়িটার ভিতর এই সন্ধ্যাবেলা কেউই ঢোকার সাহস পাচ্ছিল না। বাইরে থেকেই সবাই রিনি রিনি বলে ডাকাডাকি করতে লাগলো। কেউ কেউ বলতে লাগল ওখানে ও যাবে কেন? সাপ, বিছে কি না কি রয়েছে ওই বাড়িতে কে জানে। বাড়ির ভিতর খুঁজে কোনো লাভ নেই। কিন্তু দিপালীর মন বলছিল রাগিণী এখানেই থাকবে। এসব আলোচনার মধ্যেই কেউ একজন গিয়ে একটা টর্চ নিয়ে এলো। টর্চের আলো পেয়ে সবার মনেই সাহস ফিরে এলো। বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে হাতে খান কয়েক লাঠি নিয়ে এবার বাড়ির ভিতরে ঢুকল। বেশি খুঁজতে হল না অবশ্য। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেই রাগিণীর দেখা পাওয়া গেল। তার মুখখানা দেখলেই যে কারুর মনে হবে যেন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। টর্চের আলো মুখে পড়তেই সজাগ হয়েছে রাগিণী। ধড়মড়িয়ে উঠে বসল সে। ভয়ার্ত চোখে চারপাশ দেখছে। দিপালী ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিলো রঞ্জন। পাশের ঘরে কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে রাগিণীকে। দিপালী মেয়ের সঙ্গেই আছে। ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখল রঞ্জন। ঘুমন্ত রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছে দিপালী। কি ফ্যাকাশে লাগছে রিনিকে। বিছানায় মিশে আছে যেন। কি হল এমন। কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না রঞ্জন। সারা জীবনের ডাক্তারি বিদ্যা দিয়েও রিনির অসুস্থতার কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না সে। ডক্টর সিনহা নিজে বাড়িতে এসে দেখে গেছেন। তিনিও কিছুই আশার কথা শোনাতে পারেননি। আজ বড্ড অসহায় লাগছে রঞ্জনের। রিনি কি কোনোদিনই আর স্বাভাবিক হবে না...... ******************** আজ থেকে রাগিণীর পরীক্ষা শুরু। গতকালের ঘটনার পর থেকেই দিপালী আর মেয়েকে চোখের আড়াল করেনি। রাগিণীর আচরণেও কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না। অন্যদিনের চেয়ে শুধু একটু বেশি চুপচাপ। সকালে দিপালী আর রঞ্জন দুজন মিলেই তাকে স্কুলে পৌঁছাতে গেছিল। ছুটির সময় দিপালী নিয়ে আসবে তাকে। বাড়িতে ফিরে রান্নার মেয়েকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে সবে এক কাপ চা নিয়ে বসেছে দিপালী। ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। কাপটা পাশের টেবিলে রেখে ফোন কানে চাপল দিপালী - হ্যালো... - হ্যালো, আমি শেরউড স্কুল থেকে বলছি। রাগিণী সেনের বাবা বা মা কারুর সাথে কথা বলা যাবে? টেনশনে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল দিপালীর। - ম্যাম, আমি রাগিণীর মা কথা বলছি। কিছু হয়েছে রাগিণীর? - রাগিণীর শরীরটা একটু খারাপ করেছে। আপনারা প্লিজ একবার স্কুলে আসুন। - এক্ষুণি আসছি। এক্ষুণি আসছি আমরা। - থ্যাংক য়ু ম্যাম। ফোন কেটে গেছে। মাথা কাজ করছিল না দিপালীর। কি হল রিনির? এই মুহুর্তে রঞ্জনকে ভীষণভাবে প্রয়োজন। দুর্ভাবনার মাঝে দিপালীর মনে পড়ছিল না রঞ্জনের এই সময় কোন হসপিটালে থাকার কথা। পাগলের মত একটার পর একটা হসপিটাল, নার্সিংহোমে ফোন করতে থাকল দিপালী। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে পেয়ে গেল রঞ্জনকে - হ্যালো, তুমি এক্ষুনি রিনির স্কুলে চলে এসো। আমিও পৌঁছাচ্ছি। - কি হয়েছে বলবে তো। - ওরা কিছুই বলেনি। শরীর খারাপ বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছে। - কি আশ্চর্য, আমি কনফারেন্সে আছি। মাঝপথে বেরিয়ে যাই কিকরে? - যে ভাবে হোক এসো। তোমায় বলেছিলাম ও ঠিক নেই। তুমি বিশ্বাসই করলে না। সাইকো সাইকো বলে উড়িয়ে দিলে। - আচ্ছা, আচ্ছা আসছি আমি। ডোন্ট প্যানিক। স্কুলে যে এই দৃশ্য তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল রঞ্জন- দিপালী স্বপ্নেও ভাবেনি। তাদের দেখেই হেডমিস্ট্রেস নিজে ছুটে এলেন। - আসুন ডক্টর সেন, প্লিজ এদিকে। রাগিণী সিক রুমে আছে। - সিকরুমে? - হ্যাঁ, মানে.... পরীক্ষা দিতে দিতে হঠাৎ করেই ও নিজের আনসার শিট ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে। ঘরে যিনি ইনভিজিলেটর ছিলেন তিনি বাধা দিতে গেলে এত জোরে তাকে ধাক্কা দিয়েছে যে খুব চোট পেয়েছেন তিনি। তারপর কোনরকমে ওকে সিকরুমে এনে বসানো হয়। সামান্য গলা নামালেন হেডমিস্ট্রেস। - হয়তো বিশ্বাস করবেন না। তিন চারজন গার্ড মিলেও ওকে সামলাতে পারছিল না। কথা বলতে বলতেই সিকরুমের সামনে পৌঁছে গেছে সবাই। বাইরে বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মী দাঁড়িয়ে। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ দেখে রঞ্জন বেশ বিরক্ত গলাতেই বলে উঠলেন - একি ওকে বন্ধ করে রেখেছেন কেন? ঘরের ভিতরে কিছু বিপদ ঘটলে আপনারা দায়িত্ব নেবেন? বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষিকাদের মধ্যে একজন বলে উঠলেন - ও যা করছিল তাতে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ডক্টর সেন। ঘরের জানলা দিয়ে রঞ্জন-দিপালী ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। যেটুকু দেখা গেল, তাতে ভয়ে কেঁপে উঠল দুজনেই। গোটা সিকরুম তছনছ। মেঝেতে ছড়ানো বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, ভাঙ্গা ওষুধের শিশি। তার মধ্যেই রাগিণী ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঁ পা টা টেনে টেনে আর নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছে। স্কার্টের মধ্যে গুঁজে রাখা টপ অর্ধেকের বেশি বাইরে বেরিয়ে এসেছে। খোলা চুল অবিন্যস্ত, পায়েও জুতো মোজা কিচ্ছু নেই। মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে আর থাকতে পারল না রঞ্জন। নিজেই দরজার ছিটকিনি খুলে ঢুকে পড়ল সিকরুমে। সাড়া পেয়েই ঘুরে তাকিয়েছে রাগিণী। টকটক করছে লাল তার দুই চোখ। মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য রঞ্জন কাছে গিয়ে হাত ধরল তার। রাগিণীর হাত ধরেই ভয়ে ছেড়ে দিল রঞ্জন। বরফের মত ঠাণ্ডা শরীর রাগিণীর। বাবাকে ভয় পেতে দেখে বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল সে। হাসতে হাসতে বেঁকে যাচ্ছে শরীর তবু যেন সে থামতে পারছে না। রঞ্জন অবাক হয়ে দেখছিল রাগিণীকে। এই কি তার সেই পুতুলের মত মেয়েটা! সবাইকে চমকে দিয়ে হঠাৎ করে চুপ করে গেল রাগিণী। তারপর শরীরটাকে দুমড়ে মুচড়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দিপালী ছুটে এসেছে এবার - রিনি রিনি ওঠ মা। তুমি একটু দ্যাখো না। রঞ্জনের দিকে ফিরল দিপালী। রঞ্জন অ্যাটাচি থেকে ঘুমের ইঞ্জেকশন বের করছিল। ইঞ্জেকশন পুশ করার জন্য রাগিণীর গায়ে হাত ছোঁয়াতেই উঠে বসেছে রাগিণী। এক ঝটকায় ফেলে দিয়েছে সিরিঞ্জ। ঘাড় কাত করে একবার দেখল সবাইকে তারপর বিড়বিড় করতে শুরু করল আবার - এ কিউব প্লাস বি কিউব প্লাস থ্রি এ স্কোয়ার বি..... দিপালী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল এবার। - কি হয়ে গেল গো, কি হয়ে গেল। - আহ দিপালী এখানে সিন ক্রিয়েট কোরো না। আমি হসপিটালে ফোন করছি। এক্ষুনি অ্যামবুলেন্স এসে যাবে। - হসপিটাল না। পুলিশে ফোন করতে হবে। রাগিণীর কর্কশ স্বরে চমকে উঠল সবাই। - পুলিশ.... রাগিণীর কথার অসংলগ্নতায় রঞ্জনের এবার বিরক্ত লাগল। স্কুলে তার একটা আলাদা সম্মান আছে। আর কিচ্ছু রইলো না। - হ্যাঁ পুলিশ। - কি পাগলামি করছিস রিনি। চল বাড়ি চল। দিপালীর কথায় জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায় রাগিণী - না আগে পুলিশ আসবে। - কেন পুলিশ কেন? - কারণ আমি খুন করেছি। - কিইই? কি সব বলছিস রিনি? রাগিণী ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে তখনও তারপর হঠাৎ স্কার্টের পকেট থেকে টুকরো টুকরো কাগজ বের করতে শুরু করল। - কি এগুলো? কি করছিস মা? বাড়ি চল। দিপালী ধরতে এলে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রাগিণী। আচমকা ধাক্কায় পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠেছে দিপালী। রাগিণীর তবু ভ্রুক্ষেপ নেই। উবু হয়ে মেঝেতে পড়ে যাওয়া কাগজগুলো কুড়োচ্ছে। মুঠো ভর্তি কাগজ নিয়ে প্রায় বুকে হেঁটে ঘরের বাইরে এলো সে। রাগিণীকে বাইরে আসতে দেখে জমে থাকা ভীড়টাও পিছু হটতে শুরু করেছে এতক্ষণে। সবারই চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠেছে। হেডমিস্ট্রেস মিস দাসের একদম সামনে এসে থেমে গেল রাগিণী। মুঠোয় ভরা কাগজগুলো তুলে ধরেছে তার দিকে। - ওঠো রাগিণী। শান্ত গলায় বললেন মিস দাস। - আমি কাগজটা ফেলেছিলাম ম্যাম। - কি কাগজ? মিস দাস সামান্য অবাক হলেন। - সুনেত্রা সেদিন কিছু করেনি ম্যাম। সব আমি করেছিলাম। - কি করেছিলে তুমি? মিস দাস যতটা সম্ভব অচঞ্চল রাখলেন নিজের গলা। - ওই কাগজটা আমিই সেদিন ওর পায়ের কাছে ফেলে দিয়েছিলাম। অস্পষ্ট গলায় জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছে রাগিণী। ও আমায় লিখে দিল আর আমি সেটা দিয়েই ওকে.... ও সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল ম্যাম। বাড়িতে গিয়ে নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়ে.... সব আমার জন্য, আমার জন্য। নিজের মাথা মাটিতে ঠুকতে শুরু করল রাগিণী। - কিন্তু আমরা তো জানতাম ওরা অন্য শহরে চলে গেছে। তুমি এসব জানলে কি করে? মিস দাস মেঝে থেকে ওঠানোর চেষ্টা করলেন রাগিণীকে। অল্প একটু মাথা তুলে চারদিকে দেখল রাগিণী। তারপর ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে বলল - সুনেত্রা কোত্থাও যায়নি ম্যাম। এখানেই আছে। এখনও খুব কষ্ট পাচ্ছে ও। আপনি ওকে বলুন ওকে আপনি আর খারাপ ভাবেন না। - আচ্ছা আচ্ছা বলব। তুমি ওঠো তো আগে। - আপনি বলুন ওকে ম্যাম। ও এখানেই আছে। - এখানে আছে? - হ্যাঁ আছে। এই তো আমার পাশেই। দেখতে পাচ্ছেন না আপনি? প্লিজ ওকে বলুন ম্যাম। রাগিণী এবার মিস দাসের পা জড়িয়ে ধরল। মিস দাস বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছিলেন চারদিকে। রঞ্জন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে, পাশে দিপালী অঝোরে কেঁদে চলেছে। মিস দাস কোনো উপায়ান্তর না দেখে বাতাসের উদ্দেশ্যে যেন বলে উঠলেন - আমার সেদিনই মনে হয়েছিল সুনেত্রা, যে এ কাজ তোমার মত মেয়ে করতে পারে না। কিন্তু সব প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে থাকায় আমার কিছুই করার ছিল না। তবে এর জন্য যে তুমি এভাবে চলে যেতে পারো আমি তা ভাবিনি। একা রাগিণী নয়, আমরা সবাই এর জন্য দায়ী। আমাদের পারলে তুমি ক্ষমা কোরো। মিস দাসের কথা শেষ হতে না হতেই ঘর থেকে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস সবার হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে রাগিণী জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। 

#উপসংহার 

মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে প্রায় সপ্তাহ দুয়েক হয়ে গেল। রাগিণী বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু যথারীতি অঙ্কে সে লেটার মার্কস আনতে পারেনি। এতে যদিও তার মনে কোনো প্রভাব পড়েনি। সে উচ্চ মাধ্যমিকে আর্টস নিয়ে পড়বে ঠিক করেছে। গত কয়েকমাসের ক্রমাগত কাউন্সেলিং তাকে মানসিক দিক দিয়ে একেবারেই সুস্থ করে তুলেছে। সুনেত্রাকেও ভোলেনি সে। তাকে নতুন জীবন দিয়ে গেছে সুনেত্রা, বন্ধুত্বের সঠিক অর্থ শিখিয়ে গেছে। আজ রাগিণী জানে কাউকে হিংসে করে বা অসৎপথ অবলম্বন করে নয়, কঠোর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়ই মানুষকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror