Saswati Roy

Classics

3  

Saswati Roy

Classics

সমার্থক (জন্ম-মৃত্যু)

সমার্থক (জন্ম-মৃত্যু)

8 mins
793



#এক


দক্ষিনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। নাহ, ঘড়ি দেখিনি। তাই হিসাব করে সঠিক সময়টা বলতে পারবো না। হয়তো একঘণ্টা বা হয়তো চল্লিশ মিনিট। ঠিক জানিনা। অতীশ চলে যাবার পর থেকে আর সময় মেপে চলি না।


অতীশ আমার স্বামী ছিলেন। 

হ্যাঁ, এবার থেকে "ছিলেন"ই তো বলা উচিৎ। এখন তো বাতাসে মিশে গেছে অতীশ। তবে চোখ বুজে নিঃশ্বাস নিলে অতীশের গন্ধটা ঠিক পেয়ে যাই। কিন্তু আজ তার সাথে বারবার অগরুর গন্ধটা মিশ খাচ্ছে কেন?

কে যেন বড্ড বেশি করে ঐ গন্ধটা ছড়িয়ে দিয়েছিলো সেদিন। বলেছিল দুদিন হয়ে গেছে, গন্ধ বেরোচ্ছে বডি থেকে। 

বডি..! সত্যিই তো, অতীশ তো তখন বডি। আমার স্বামী নয়, রাজার বাবা নয়। শুধু একটা নিষ্প্রাণ শরীর। আটচল্লিশ ঘন্টা আগের সুস্থ সবল অতীশ মজুমদার তখন ছেলের হাতের একটু আগুনের অপেক্ষায়।


রোজকার মতই তো সেদিনটাও শুরু হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা মেপে একের পর এক প্রাত্যহিক কাজগুলো সারছিলাম আমি। অতীশ জলখাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছিল। একটা গোঙানির শব্দে ঘরে গিয়ে দেখলাম বিছানা থেকে পড়ে গেছে অতীশ। গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে মুখ থেকে। অ্যাম্বুলেন্স ডাকার আগেই সব শেষ। পাড়ার ডাক্তার এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়ে গেলেন। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক।


রাজা এসেছিল দিল্লী থেকে। একাই। কনফারেন্স শেষ করে তবে আসতে পেরেছিল। আমি তাড়া দিইনি। কি হবে! যার যাবার সে তো চলেই গেছে। যারা আছে তারা সুস্থ থাকুক।


-আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে বৌদি? এবার ভিতরে চলো। অশৌচের মধ্যে অন্ধকারে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো নয়। চলো ভিতরে চলো। টেবিলে খাবার দিয়েছি তোমার। 

আমার একমাত্র ননদ অনু ডাকতে এসেছে। সৎকারের পর সবাই চলে গেলেও অনু যায়নি। তিনদিন ধরে আমায় আগলে আগলে রেখেছে। একমুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করেনি। রাতে আমার খাওয়ার জন্য দুধে খই ভিজিয়েছে অনু। চামচে করে অল্প অল্প খাচ্ছিলাম। 

সামনে দাঁড়িয়ে অনু। সেই ছোটবেলার মতো।

অতীশের স্ত্রী হয়ে এ বাড়িতে পা রাখার পর আড়ষ্ট হয়ে থাকতাম। দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে হয়ে মফস্বলের নিয়ম কানুনগুলো আমার বুঝতে একটু সময় লাগছিল। আমার অপটু হাতের কাজকর্ম দেখে দুই খুড়শাশুড়ি আমায় নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করতেন, বুঝতে পারতাম। শাশুড়ি মা বহু বছর আগে গত হয়েছেন। আমায় শিখিয়ে পড়িয়ে নেবার মতোও কেউ ছিল না। আমার শ্বশুরমশাই মানুষটি ছিলেন একেবারেই নিরীহ। তার সাথে আমার স্বামীটিও। যৌথ পরিবারের রান্নাঘরে পা রেখেই বুঝেছিলাম আমার স্বামী ও শ্বশুরের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের লুটেপুটে খাচ্ছে পরিবারের বাকি সদস্যরা। অনুই একমাত্র বন্ধু ছিল তখন। আমাকে একটু হলেও বুঝত সে। বলতো - সংসারটা একটু শক্ত হাতে ধরো বৌদি, আমার দাদাটির একেবারেই সাংসারিক বুদ্ধি নেই। 


বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যে সংসারের হাল ধরে ফেলেছিলাম আমি। অতিরিক্ত খরচগুলো বন্ধ করতে শুরু করলাম। মাসের শেষেও অতীশের পকেটে কিছু বেঁচে যেত। এরপর রাজা এলো। খরচ বাড়তে লাগলো। অতীশের সাথে তুমুল অশান্তি শুরু করলাম যাতে গ্র্যাজুয়েশনটা শেষ করে। বাড়ি সুদ্ধু লোক তখন আমার ওপর রেগে গেল। কেউ কেউ এমনও বললো আমি পয়সার লোভে বরকে আবার লেখাপড়া শুরু করতে জোর করছি। মুখে প্রকাশ না করলেও অতীশেরও এতে সায় আছে বলেই মনে হয়েছিল। 


আমি টানা দুদিন না খেয়ে থাকার পর অতীশ পরীক্ষা দিতে রাজি হলো। পাশও করে গেল। রেজাল্ট নিয়ে বাড়িতে ফিরে চুপ করে বসেছিল অতীশ। কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করিনি অতীশকে। শুধু কাছে গিয়ে আলতো করে পিঠে হাত রেখেছিলাম।

রেজাল্টটা আমার হাতে ধরিয়ে সেদিন ছেলেমানুষের মতো ডুকরে কেঁদে উঠেছিল অতীশ। ভয়ে ভয়ে রেজাল্টের দিকে চোখ রেখেছিলাম। স্বপ্ন সত্যি হবার আনন্দে লাজলজ্জা ভুলে অতীশকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম আমিও। তারপরেই অতীশের জামার পকেট থেকে বেড়িয়ে এসেছিল আমার কানের দুলজোড়া। অতীশের পরীক্ষার যাবতীয় খরচ যোগানোর জন্য বাধা রেখেছিলাম ওদুটো । এমনই ছিল অতীশ। সবেতেই তার প্রকাশ ছিল বড়ো কম। প্রেম, অভিমান বা ক্রোধ সবই তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে নিতে হতো আমায়।

অতীশের প্রমোশন হবার পর পরই শ্বশুরমশাইয়ের জোরাজুরিতে আমাদের বেড়াতে যেতে হয়েছিল। রাজা তখন সবে তিনে পড়েছে। তবুও সমুদ্র দেখে তার কি আনন্দ! পুরীর ওই পাঁচটা দিনে বুঝেছিলাম, অতীশও ভালোবাসতে জানে। আমিও রূঢ়তার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছিলাম।

সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে অতীশকে বলেছিলাম

- তোমার আফশোস হয় না?

- আফশোস? কেন?

- একটা বদমেজাজি বৌ নিয়ে সংসার করতে হয় বলে।

- ওই বদমেজাজটা তো তোমার খোলস বিপাশা। তুমি শক্ত না থাকলে আমাদের সংসারটা হয়তো গড়েই উঠতে পারতো না।

ফিসফিস করে বলেছিলাম

- এত বোঝো তুমি আমায়!

চোখের জলটা সামলাতে গিয়ে জোর বিষম খেলাম। অনু তাড়াতাড়ি জল নিয়ে এসেছে। মাথায় ফুঁ দিচ্ছে আমার। অনেকদিন পর অনুকে ভালো করে দেখছিলাম।

একদা বৌদির পায়ে পায়ে ঘোরা অনু, আজ দুই ছেলের মা, সুগৃহিনী। সাংসারিক জীবনের যাবতীয় বিষয়ে বৌদির পরামর্শ নেওয়া সেই অনু, আজ কেমন যেন দয়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার বৌদির দিকে। বিষ...বিষ... বড়ো বিষ লাগে সবকিছু। সকলের এই দয়া নিয়ে বেঁচে থাকা যেন অসহ্য। নিজেকে বড়ো করুণার পাত্রী বলে মনে হয় আজকাল। 


#দুই


কাজকর্ম মিটে যেতে বাড়িটা খালি হয়েছে। রাজার সাথে সাথে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি আমিও। কাল বাদ পরশু রাজা চলে গেলে আরও একা হয়ে যাবো আমি। ধুত্, একা আবার কি..! আমার বই আছে, গান আছে, সাধের ছোট্ট বাগানখানা আছে। দেখতে দেখতে কখন সময় কেটে যাবে, নিজেই বুঝতে পারবো না।

দুপুরে খেয়ে উঠে একটা শারদীয়া সংখ্যায় চোখ রেখে বসেছিলাম। আমার বরাবরের অভ্যাস দুপুরে খেয়ে উঠে বই পড়া। পড়তে পড়তে দশ- বিশ মিনিটের জন্য চোখও লেগে আসে মাঝে মধ্যে।আজ অবশ্য সে সম্ভাবনা কম। পাড়ার ক্লাব থেকে দু তিনজন এসেছে। রাজা তাদের অতীশের জামা কাপড়, চাদর, সোয়েটার ইত্যাদি বস্তা ভরে দিয়ে দিচ্ছে। ক্লাব থেকে দুঃস্থ মানুষদের ওগুলো দান করা হয়। 

অবশ্য সকালেই আমাকে জিজ্ঞাসা করে নিয়েছিল

- মা, ইন্সিওরেন্সের কাগজগুলো আলমারিতে তুলতে গিয়ে দেখলাম বাবার জামা কাপড়ে আলমারিটা একেবারে ঠাসা । ওগুলো কি করবে?

- কি আবার করবো! ওগুলো তোর গায়ে তো হবে না। আর বেশিরভাগই তো পাঞ্জাবি। গায়ে হলেও তুই পরতিস না। সবজি কাটতে কাটতেই উত্তর দিয়েছিলাম।

- তাহলে? রাজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। ছেলে নিজে থেকে দায়িত্ব নিতে চাইছে বুঝে আর কথা বাড়ালাম না।

তবে তাতেও যে বিপত্তি হবে বুঝিনি। 

- তাহলে আর কি, যা ভালো বুঝিস কর।

- এক কাজ করলে হয়। ক্লাব থেকে তো বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণের জন্য জামাকাপড় পাঠানো হয়। ওদেরই দিয়ে দি বরং। এত ভালো ভালো জামাপ্যান্ট দেখলে তো ওরা লুফে নেবে। 

- তাই কর তবে। ওদের খবর পাঠালেই ওরা এসে নিয়ে যাবে।

- ঠিক আছে, আমি ক্লাবে গিয়ে বলে আসছি কাউকে পাঠিয়ে দিতে। যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো রাজা। সোজাসুজি তাকিয়েছে আমার দিকে

- তুমি কি বাবার কোনো স্মৃতিই আর রাখতে চাও না মা? এখনও এত রাগ তোমার বাবার ওপর!! বাবা তো আর ফিরবে না কোনোদিন।


বুকের ভেতরটা মুহুর্তের মধ্যে যেন খালি হয়ে গেছিল আমার। রাজার শেষ বাক্যটা ফ্যানের হাওয়ার সাথে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে ঘরের মধ্যে।

ক্লাস ফাইভ থেকে হস্টেলে পড়াশুনা করে বড় হয়েছে রাজা। ছুটি ছাটায় যখন বাড়িতে আসত তখন কখনো সখনো দেখেছে আমার সাথে অতীশের ঝগড়াঝাঁটি। যদিও সেটা এক তরফা হওয়ায় রাজার আদালতে বরাবর আমিই অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি। তাতে অবশ্য আমার কোনো দুঃখ নেই। রাজা কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কিই বা হতে পারে।

সবাই যখন সপ্রশংস দৃষ্টিতে রাজাকে দেখে, গর্বে বুক ভরে ওঠে আমার।


রাজাকে কোনোদিনই বুঝতে দেইনি সংসারের অভাব অনটনগুলো। রাজা বুঝতেও চায়নি কোনোদিন। নিজেকে নিয়েই সব সময় ব্যস্ত থেকেছে সে। সেই ছেলে হঠাৎ করে মা-বাবার সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে পড়লো কেন?

অতীশের এভাবে আগে চলে যাওয়াটা কি আমার অপরাধ? আমি আগে চলে গেলে কি রাজা এই একই ব্যবহার করতো তার বাবার সাথে? 

কত সহজেই রাজা বলে দিলো, অতীশের আর কোনো স্মৃতি আমি কাছে রাখতে চাই না। কি করে ছেলেকে বোঝাই অতীশকে মনে করার জন্য আমার পার্থিব কোনো অবলম্বনের দরকার পড়ে না।


ঘরে পরা চটির ফটাস ফটাস শব্দে বই থেকে মুখ তুললাম। রাজা এসেছে ঘরে। কেমন যেন ইতস্তত করছে। কিছু কি বলতে চায় রাজা? হাতের বইটা মুড়ে রেখে সোজা হয়ে বসলাম।

-কিছু বলবি?

-আমি কিন্তু তাহলে পরশু দুপুরের ফ্লাইটেই ফিরছি মা। 

-জানি তো। সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। বেশি কথা বলতে আজকাল আর মন চায় না।

-তুমি তো তোমার জেদ নিয়েই থাকবে।

যাবে না আমার সাথে।

কি বলতে চায় রাজা! রসিকতা করছে কি? হাসি পাচ্ছিল আমার। ছেলের হাবেভাবে পরিস্কার বোঝা যায় মা কে নিয়ে যেতে সে এতটুকু আগ্রহী নয়। বৌ-মেয়েকে নিয়ে রাজার এখন ভরা সংসার। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে চাকরি করে। উইকেন্ডে বাইরে খাওয়া, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, নাহয় কাছাকাছি কোথাও বেড়িয়ে আসা। রাজার ভাষায় "লাইফ, ফুল অফ মস্তি"। সেই মস্তির জীবনে কি এই বুড়িকে মানায়! 

-আমি তোর বোঝা হতে চাই না রাজা।

তোরা ভালো থাক। আমি দূর থেকেই খুশী হবো।


রাজাও বোধহয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। বুকটা চিনচিন করে উঠলো আমার।

গতকাল দুপুরে আমি স্বকর্ণে শুনেছি রাজা আত্রেয়ীকে কৈফিয়ত দিতে দিতে জেরবার হয়ে যাচ্ছিলো। 


রাজা চলে গেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। 

যাবার আগে আরও একবার আমাকে অনুরোধ করেছিল দিল্লী যাবার জন্য।

আমি কান দেইনি ছেলের কথায়।

-সারাজীবন তো এই জেদ করেই গেলে মা। এবার একটু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করো। তোমার এই স্বভাবের জন্যই হয়তো বাবাও এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। 

আমার আহত মুখখানা দেখে বুঝি সংযত হয়েছে রাজা।

- সরি মা, আমি এভাবে বলতে চাইনি। 

প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম

- সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো? পৌঁছে একটু জানিয়ে দিস। আর এই বছরটা তোরা একটু সাবধানে চলিস। আত্রেয়ীকে বলিস দিদিভাইয়ের খেয়াল রাখতে। তোদেরকে তো সে খুব ভালোবাসতো...

- বাবা কিন্তু তোমাকেও খুবই ভালবাসতো মা। তুমিই শুধু শুধু অশান্তি করতে।

ছেলের সাথে তর্কে যেতে ইচ্ছে করলো না এই মুহুর্তে। আমার স্বামীকে আমি ভালোবাসায় রেখেছিলাম না তার জীবন অশান্তিতে ভরিয়ে রেখেছিলাম সে কৈফিয়ত কাউকে দিতে বাধ্য নই আমি।


রাজা চলে যাবার পর থেকে দোতলা বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে যেন। সারাটা দিন যাও বা কেটে যায়, দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলেই এক অদ্ভুত একাকিত্ব গ্রাস করে আমাকে। না টিভিতে মন বসে, না গল্পের বইতে। রাতের বেলা একা একা থালা সাজিয়ে খেতে বসতেও ইচ্ছে করে না।

মঞ্জু প্রায়দিনই বলে - তুমি দাদার সাথে চলে গেলেই ভালো করতে মাসি। এত বড়ো বাড়িটায় একা একা থাকো কি করে? আমার তো দিনের বেলাতেই দোতলাটা মুছতে যেতে ভয় করে। 


- কিসের ভয় হ্যাঁ? আমি দিনরাত একলা থাকি আমার ভয় করে না আর তোর দিনের বেলাতেও ভয়? মঞ্জুকে ধমকে চুপ করালেও আমি জানি ওর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। ফাঁকা বাড়িতে আমারও কি অস্বস্তি হয় না! 


অনুর বিয়ের বছরখানেক পরেই অতীশের দুই কাকা নিজেরা বাড়ি করে উঠে গেছিলেন। এই বাড়িটা আমার শ্বশুরমশাইয়েরই তৈরী হওয়ায়, শুধু আমরাই থেকে গেছিলাম। এখন অবশ্য গোটা বাড়িটায় আমি একা। সত্যিই রাতের দিকে গাটা কেমন ছমছম করে। 

সে কথা মঞ্জুর সামনে প্রকাশ করলে আবার কাজ না ছেড়ে দেয়।


প্রতিদিনের মতো আজও সন্ধ্যাবেলা অতীশের ছবির সামনে ধূপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে ছিলাম । কেমন যেন দমচাপা পরিবেশ আজ। হয়তো ঝড়বৃষ্টি হবে। অগরুর গন্ধটা ফিরে ফিরে আসছিল আবার।

-কি গো, আছো কেমন? 

চমকে উঠে চারদিকে দেখলাম। ধূপকাঠি থেকে ওঠা ধোঁয়া ছাড়া আর কোত্থাও কিচ্ছু নেই। তবে যে স্পষ্ট অতীশের গলা শুনতে পেলাম।

- কি গো, বললে না তো কেমন আছো?

নাহ্, এবার আর কোনো ভুল নেই। অতীশেরই গলা। নিজের মনে বলে ফেললাম 

- ভালো নেই গো আমি। একদম ভালো নেই।

- কেন, ঝগড়া করার লোক পাচ্ছো না বলে?

- আমি তো বরাবরই ঝগরুটে। সারাটা জীবন তোমার হাড়মাস কালি করেছি। যাক এখন শান্তিতে আছো তো?

- ধুর, ওই ঝগড়াটুকু নিয়েই তো বেশ ছিলাম।

- তাই কি? তোমার ছেলে তো অন্য কথা বলে।

- ছেলের কথায় মন খারাপ কোরো না। ও ছেলেমানুষ, কিই বা বোঝে?

- কেই বা বোঝে? বুঝলে কি আর আমায় একা ফেলে যেতে পারতে ? স্বার্থপর, তোমরা সবাই স্বার্থপর।

দক্ষিনের জানালাটা হরাস করে খুলে গেল। ফাল্গুনের বাতাস ঘরে ঢুকতে পেরে শিশুর মত ছোটাছুটি শুরু করেছে। চোখটা জ্বালা জ্বালা করে উঠলো। হাওয়ার সাথে ধুলো ঢুকছে কি? তাড়াতাড়ি জানলাটা বন্ধ করতে গেলাম। দমকা হাওয়ায় ফের খুলে গেছে জানালা। 

হাওয়ার সাথে যুদ্ধ করতে করতে মনে হলো অতীশ যেন প্রাণপণে নিজের অস্তিত্ব জানান দেবার চেষ্টা করছে আমাকে। ভাবনাটা আসতেই জানালাটা হাট করে খুলে দিলাম। অতীশ কোত্থাও যায়নি। আমাকে ছেড়ে যেতেই পারে না অতীশ। ওই কলহটুকুই তো আজও বিপাশা আর অতীশকে বেঁধে রেখেছে। কলহ আর ভালোবাসায় কি খুব তফাৎ আছে?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics