চলো ফিরে যাই
চলো ফিরে যাই
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মাথাটা এত গরম হয়ে গেল যে আস্ত একটা ডিম ফাটিয়ে মাথার ওপর দিলে সেটাও মনে হয় অমলেট হয়ে নেমে আসত। মাথা গরমের কারণটা বলি এবার। গতকাল ফেসবুকে একটা নতুন গেম পেয়েছি। সেটা এতটাই আকর্ষক যে খেলতে খেলতে কখন যে রাত দুটো বেজে গেছে খেয়ালই হয়নি।
ঋষি মাঝরাতে একবার বাথরুমের জন্য ওঠে। অত রাতে আমায় মোবাইল নিয়ে বসে থাকতে দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হলো। ফ্ল্যাটবাড়ি না হয়ে যদি খোলা মাঠের পাশে বাড়ি হত তাহলে কাল রাতেই হয়তো তুলকালাম হয়ে যেত। যাইহোক ভোর ছটা বাজতে না বাজতেই ঋষি যেমন রোজ ওঠে তেমনই উঠে পড়েছে আজও। এবং কাল রাতের বদলা হিসাবে আমায় সকালে ডেকে দেয়নি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমার কুম্ভকর্ণের নিদ্রা মোবাইলের সুমিষ্ট ধ্বনিতে ভঙ্গ হয় না। আমায় রীতিমত দু- চারবার ঠেলাঠুলি দিলে তবেই অতিকষ্টে আমার চোখ খোলে। আজ অবশ্য কাঁচের জানালা ভেদ করে আসা রোদের কারণেই হোক বা আমার অভ্যাসের বশেই হোক আটটা নাগাদ নিজে থেকেই আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে মোবাইলে সময়টা দেখেই আমার চোখ কপালে। হাতে আর মাত্র চল্লিশ মিনিট। এর মধ্যেই ইমলিকে তুলে, তাকে রেডি করে, তার লাঞ্চ বানিয়ে স্কুল ভ্যানের জন্য দৌড়াতে হবে।
ইমলি যথারীতি কুঁকড়ে মুকড়ে আমার কোলের কাছে এসে ঘুমাচ্ছে। কোনোরকমে বাথরুমের কাজ সেরে মেয়েকে ডাকাডাকি করতে করতেই রান্নাঘরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ঝটপট দুটো ডিম ফেটিয়ে, ময়দা দিয়ে গুলতে লাগলাম। বাটি চামচের খটাখট শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো ঋষির বাক্যবাণ। আমার দেরী করে ঘুম থেকে ওঠার কারণ হিসাবে সাধের স্মার্টফোনটাই দোষী সাব্যস্ত হল। ইতিমধ্যে ইমলিকে তৈরী করে ওর মুখে দুধের গ্লাস ধরেছি। ঋষি ভাবলেশহীন মুখে খবরের কাগজ নিয়ে সোফায়। চাইলেই এই সময় আমায় সাহায্য করতে পারে। করবে না, করবে না। মেল ইগোতে মটমট করছে যে সব সময়। তার ওপর আজ তো আবার পুরোদস্তুর প্রতিশোধ নেবার মানসিকতা। হুহ্ বয়েই গেল। আর গজগজ করার সময় পেলাম না।
স্কুল ভ্যান এসে হর্ন বাজাচ্ছে। ছোঁ মেরে ইমলিকে তুলে এনে ভ্যানে বসিয়ে দিলাম। কপালে,গালে আদর করে বলে দিলাম শান্ত হয়ে থেকো। ভ্যানটা গলির মুখে অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর মনে মনে দুগ্গা দুগ্গা বলে প্রায় চন্ডীর মূর্তিতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। ফোন নিয়ে খোঁটা দেয় আমায়। এত বড় সাহস!! ঘরে ঢুকেই ঋষির মুখের সামনে থেকে কাগজটা টেনে নিলাম।
- কি বলছিলে এবার বলো।
- কি আবার বলছিলাম?
- কেন ফোন নিয়ে কি কি যেন বললে... - ওহ, বেশ ঝগড়ার মুডে এসেছ দেখছি। - কথা না ঘুড়িয়ে পয়েন্টে এসো।
- কিসের পয়েন্ট। ঠিকই তো বলেছি। মেয়ের সকালে স্কুল জেনেও মাঝরাত অবধি মোবাইল নিয়ে এত কিসের খুটুর খুটুর তোমার?
- ভদ্রভাবে কথা বলো। তুমি দেখেছিলে আমি গেম খেলছিলাম।
- ভদ্রভাবেই বলছি। এই যে আর একটু হলে স্কুল কামাই হয়ে যেত সেটা তো ওই মোবাইলের জন্যই।
- হয়নি তো।
- দ্যাখো তর্ক করো না। ইদানিং তোমার বেশিরভাগ সময় মোবাইলে কাটে। এতে সংসারের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। তোমার নিজেরও।
- আচ্ছা? কি রকম, শুনি একটু। ঋষির মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
- কেন তুমি নিজে বোঝো না? ইমলি আগে পড়তে না চাইলে ওর পিছন পিছন ঘুরে ঘুরে তুমি পড়া মুখস্ত করাতে। আর এখন তো...
- এখন কি? আমি পড়াই না ওকে?
- হ্যাঁ পড়াও। কিন্তু ওকে পড়াতে পড়াতে চ্যাটিং চলতে থাকে তোমার। ভীষণ অন্যমনস্ক থাকো তুমি।
- হ্যাঁ, তোমার মেয়ে তো এমনি এমনি সবেতে ফুল মার্কস পায়।
- সেটা ও এখনও ছোট আছে বলে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে তুমি নিজেই বুঝবে কত ক্ষতি করছ মেয়েটার।
- আমি ক্ষতি করছি মেয়ের? রাগে আমার নাকের পাটা ফুলতে শুরু করেছে এবার।
- হ্যাঁ করছ। এই যে ডাক্তার তোমায় বলেছে, এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল নিয়ে বসে থাকলে তোমার মাইগ্রেন বাড়বে বই কমবে না সেটাতে কার ক্ষতি?
- সেটাতে ইমলির ক্ষতি?
- ক্ষতি না? তোমার যেমন ক্ষতি তেমনই ইমলিরও। তোমায় ছাড়া ও কিছু করতে পারে?
- এই লেকচার দিও না তো। তুমি চাও আমি সারাদিন তোমার কথায় ওঠবোস করি। সেটা না হলেই তোমার রাগ। এই যে ফেসবুকে আমার দুটো বন্ধু-বান্ধব সেটা সহ্য হয় না তোমার।
- হাহ, বন্ধু-বান্ধব। ওই ফোটো দেখে "কি সুন্দর, কি দারুণ, অপূর্ব" বলার লোকজনেরা নাকি বন্ধু! একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও, দরকারের সময় এই শর্মা ছাড়া আর কাউকে পাবে না। তোমার ওই দিনরাতের সোশ্যাল মিডিয়া তোমার থেকে কত কি কেড়ে নিচ্ছে কয়েক বছর পর বুঝবে।
আর সহ্য হল না আমার। খটাস করে চেয়ারটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ঠেলায় চেয়ারটা তো উল্টে পড়ে গেলই, সাথে সাথে আমার কোলের ওপর রাখা স্মার্টফোনটাও ছিটকে পড়ল মাটিতে। আহারে ফোন আমার। আদর করে হাতে তুলতেই আঁতকে উঠলাম। লম্বা চিড় খেয়ে গেছে স্ক্রিনটা। দিন দুয়েক হল স্ক্রিনগার্ডটা ইমলি খুঁটে খুঁটে তুলে দিয়েছে। আমার নতুন স্ক্রিনগার্ড লাগানও হয়নি আর আজ এই বিপত্তি। যত রাগ গিয়ে পড়ল ঋষির ওপর। ওর অভিশাপেই ফোনটা ভেঙ্গেছে। কিন্তু এভাবে তো ফোনটা রাখাও যাবে না। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে গেছিল আমার।
ঋষি বোধহয় বুঝল আমার মনের অবস্থা। ফোনটা হাতে নিয়ে বলল -আমার অফিসের কাছেই তো সার্ভিস সেন্টার। আমি ঠিক করে নিয়ে আসব বিকালে। ততক্ষণ অন্য ফোন দিয়ে কাজ চালাও। আর থাকতে পারলাম না আমি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম
- লাগবে না আমার ফোন। নিয়ে যাও সব।
- আরে ফোন লাগবে না বললে হবে? এটা একটা কাজের জিনিস তৃষা। ঋষির কথা না শুনে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। জলখাবার টেবিলে সাজানোই ছিল। ঋষি অফিসে বেরোবার আগে একটা আনস্মার্ট ফোনে আমার সিমটা লাগিয়ে ফোনটা আমার পাশে রেখে গেল। ঋষি বেরিয়ে যেতে উঠে বসলাম। এই সময়টা আমি নিজের আপলোড করা ছবি বা স্টেটাসে বন্ধুদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা নিয়ে মেতে থাকি। তারপর থাকে অন্যদের ছবিতে লাইক, কমেন্ট করা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোথা দিয়ে যে কেটে যায় বুঝতেও পারি না।
মাঝে দুবার উঠে দরজা খুলি রান্নার দিদি আর ঠিকে কাজের মেয়েটার জন্য। তাদের সাথে কথা বলিও ফোনে আঙ্গুল চালাতে চালাতে। পাশে তাকিয়ে পুচকে ফোনটা দেখে কান্না পেয়ে গেল। মুডটা ঠিক করতে এক কাপ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে এলাম।
বেতের চেয়ারটায় বসতে গিয়ে দেখলাম এখানে সেখানে তারগুলো খুলে গেছে। ইশ, খেয়ালই করিনি তো। আজ ঋষি এলেই বলতে হবে। চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতেই চারপাশটা নিরীক্ষণ করছিলাম। এই বেলাটা এক নম্বরের ফাঁকিবাজ। কি ধুলো পড়েছে জানালার কাঁচে। ইমলির সাইকেলটাতেও পুরু ধুলোর আস্তরণ। কস্মিনকালেও মোছে না বোধহয়। এদিকে ডাস্টিংয়ের জন্য আলাদা পয়সা বরাদ্দ তার। আজ আসুক, কষে ধমক দেব বেলাকে। কফিটা শেষ করে ঘরে এলাম। ঘরদোরের দিকে চোখ বোলাতে বোলাতে মনে হল সত্যিই অবস্থা সঙ্গীন। লিভিংরুমের দেওয়ালে টাঙানো গ্লাস পেন্টিংগুলো অবহেলায় এখানে সেখানে রং চটে গেছে।
ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললাম। কতদিন হয়ে গেল রং তুলি ধরিনি। নরম একটা কাপড় এনে সযত্নে মুছলাম ছবিগুলো। ফোনের শোক ভুলতে টুকটাক ঘরের কাজ করছিলাম। সেন্টার টেবিলের ওপর আজকের খবরের কাগজটা খোলাই পড়ে আছে। ভাঁজ করে রাখতে এসে দেখলাম টেবিলটার নীচের তাকে ম্যাগাজিনগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। গোছাতে শুরু করলাম তারিখ মিলিয়ে মিলিয়ে। বেশ কটা ম্যাগাজিন একেবারে নতুন। পাতা উল্টানও হয়নি। খবরের কাগজওয়ালা নিয়মিত বই দিয়ে যাচ্ছে। আমারই সময় হয়নি সেগুলোতে চোখ রাখার। অথচ একটা সময় ছিল যখন, বই হাতে আসতে দেরী গোগ্রাসে গিলতাম। কবে এত বদলে গেলাম আমি...!!
নতুন ম্যাগাজিনগুলোকে আলাদা করে একপাশে রেখে টেবিলটা মোটামুটি গুছিয়ে স্টাডিরুমে এলাম। এখানেও অবস্থা একই। ইমলির পড়ার টেবিলে বই,খাতার সাথে ছোটখাটো খেলনাও সহাবস্থান করছে।গোছাতে শুরু করলাম। সব গুছিয়ে ইমলির স্কুলের মান্থলি প্ল্যানারে চোখ রাখলাম। বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে গোটা পাঁচেক কবিতা মুখস্ত করতে দেওয়া আছে। মাসের পনেরো তারিখ আজ। একটা কবিতাও তো মুখস্ত করাইনি। মাসের শেষে তো আবার একটা স্টেজ ইভেন্টও রয়েছে দেখছি। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। তারপর উঠে চটপট একটা রুটিন বানিয়ে ফেললাম। কবে কি পড়াব। ইমলি এলেই বসতে হবে ওকে নিয়ে। ভাবনার মাঝেই আমার দুই সহকারীর আগমন। তাদের আজকের কাজ মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েই আবার ইমলির দিকে মন দিলাম।
সত্যি আজকাল ইমলিকে তেমন ভাবে আর সময় দিচ্ছি না। এই কথাটা অন্তত ঋষি ভুল বলেনি। আগে ইমলি পড়তে না চাইলে ঘাড় ধরে বইয়ের সামনে বসাতাম। আর এখন ও পড়তে পড়তে উঠে গেলে আমিও কেমন নির্বিকার থাকি। নাহ্ সত্যিই এবার ইমলির রুটিনটা একটু বদলানো প্রয়োজন। মনটা খচখচ করে উঠল, শুধু কি ইমলির রুটিনটাই বদলানো প্রয়োজন??? - বৌদি, আলুরদমে কি পেঁয়াজ দোবো নাকি নিরামিষ খাবে? রান্নার দিদির ডাকে হুঁশ ফিরল আমার। - চলো বলছি। রান্নাঘরে এসে দেখলাম বড় বড় করে কাটা আলু ভেজে তুলে ফেলেছে মায়াদি। বললাম - থাক, পেঁয়াজ দিয়ে আর কাজ নেই, যা দাম!! নিরামিষ আলুরদমই করে ফ্যালো। তোমার দাদাও ভালোবাসে। তুমি বরং একটু নারকেল কুড়িয়ে দাও। আর কসুরী মেথির প্যাকেটটা নিয়ে এসো। মায়াদির সাথে হাত লাগিয়ে আলুরদমটা বানিয়ে ফেললাম। চেখে দেখলাম কাশ্মীরী আলুরদমের মতই হয়েছে। রান্নাটা ভুলিনি তবে...।
মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। ইশ, অনর্থক ঝগড়া করলাম আজ ঋষির সাথে। নাহ্, মেটাতে হবে ঝগড়াটা। রাতে আজ লুচি, আলুরদম খেলে কেমন হয়। ঋষিও বেশ খুশী হবে আর ইমলির তো ফেভারিট লুচি। মায়াদিকে বললাম রাতের জন্য চাল না নিয়ে বরং ময়দা মেখে রাখো। সব কাজ সেরে স্নান করে নিলাম। বেরিয়েই শুনলাম ফোন বাজছে। এটাতো আমার ফোনের রিংটোন নয়। ওহো আমার ফোন তো..... বেজার মুখে পুচকে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম মা ফোন করছে।
- বলো মা।
- কি রে শরীর ঠিক আছে তো তোর? - কেন কি হবে?
- সকাল থেকে কোনো খবর নেই। হোয়াটসঅ্যাপে দেখাচ্ছে কাল রাতের পর তুই আর অনলাইন আসিসনি। এমন তো হয় না। তাই আর কি....
- উফ মা। সব কিছুতেই তোমার চিন্তা। অনলাইন থাকলেও, না থাকলেও। আশ্চর্য।
- যাক গে শোন। মুন্নির বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসের সতেরো।
- ওমা তাই ? কতদিন পর বাড়িতে একটা বিয়ে বলো মা।
মুন্নি আমার খুড়তুতো বোন। প্রায় নিজের বোনের মতই। ভীষণই আনন্দ হচ্ছিল।আসন্ন বিয়ে নিয়ে মায়ের সাথে প্রায় আধঘণ্টা বকবক করলাম। সময় কোথা থেকে গড়িয়ে গেল টেরই পাইনি আমরা মা মেয়ে দুজনেই। হঠাৎই পিকপিক শব্দে ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল। ইমলির আসার সময় হয়ে গেছে। ফোন ছাড়তে হবে।
- মা, ইমলির ভ্যান এসে যাবে। ছাড়ি এখন।
- এমা, দেখেছিস আমার খেয়ালই নেই।
- আরে না গো। আমিও তো খেয়াল করিনি।
- আসলে অনেকদিন পর তুই এমনভাবে কথা বললি তো...
- মানে? অবাক হলাম সামান্য।
- না, মানে আজকাল কথা বলার সময় দেখি বড় অন্যমনস্ক থাকিস। হ্যাঁ, হুঁ ছাড়া উত্তরই দিস না। বাড়িতে যখন আসিস তখনও দেখি সব সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত।
চুপ করে গেলাম সামান্য। আমার বদলটা তবে মায়েরও চোখে পড়েছে। মা কি বুঝল কে জানে। আবার বলল
- রাগ করিস না মা। আজ অনেকদিন পর তোর সাথে কথা বলে সেই আগের মত লাগছে রে। তাই বলে ফেললাম। রাখি তবে। তুই দিদিভাইকে নিয়ে আয়। ইমলি স্কুল থেকে ফিরতেই ওকে স্নান করিয়ে দুজনে দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। শীতের দুপুরে গুটিসুটি মেরে দুজন কম্বলে আশ্রয় নিয়েছি। ইমলি হঠাৎ বলে উঠল
- মা, তুমি ফোন দ্যাখো। আমি বিরক্ত করব না।
- কেন রে? আমি কখন বললাম তুই আমায় বিরক্ত করেছিস।
- রোজই তো বলো। আমি তোমায় বিরক্ত করি। ফোন দেখতে দিই না।
- ধুর, আমি আজকে ফোন দেখছি না। তুই যত খুশী বিরক্ত কর।
- সত্যি মা? তোমার ফোনটা কোথায়? একরাশ বিস্ময় ইমলির স্বরে।
- হারিয়ে গেছে। বলতে বলতে একটু কাতুকুতু দিলাম ইমলিকে। খিলখিল করে হাসছে ইমলি।
- জানো মা, আমার বেস্টফ্রেন্ড এখন রিয়া।
- ওমা সে কি? আগের বেস্টফ্রেন্ড এর কি হল?
- তোমায় তো বললাম সেদিন। ওর সাথে কাট্টি হয়ে গেছে।
- এই রে, ভুলে গেছিলাম। দুকানে হাত রাখলাম আমি। আবার হাসছে ইমলি। ইমলির হাসির মধ্যেই আমার পুচকে ফোনের টুংটাং শব্দ কানে এলো। ঋষির ফোন। এই সময় একবার ফোন করে মেয়ের খবর নেয় ঋষি। আজ আমার হ্যালোর সাথে ইমলির খিলখিল হাসি ঋষির কান এড়ালো না। অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল
- বাব্বাহ কি ব্যাপার আজ বাড়িতে? কোনো খুশির খবর আছে বলে মনে হচ্ছে?
- আছে তো। হাসতে হাসতেই বললাম।
- কি শুনি?
- গেস করো।
- লটারিতে টাকা পেয়েছ বুঝি?
- উহু। আর একটা চান্স পেতে পারো।
- এই রে, কি করে বলি বলতো। সকালে ওই ধুন্ধুমার কান্ড আর এখন বলছ কি যেন পেয়েছ। কি পেয়েছ বলো না।
- নিজেকে।
- নিজেকে? মানে?
- মানে যে আমিটাকে, আমি নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাকে খুঁজে পেয়ে গেছি।
- কিছু বুঝলাম না। যাক গে। তোমার ফোন ঠিক করে নিয়ে এসেছি। বিকালে হাতে পেয়ে যাবে। তারপর আবার তোমার নেট দুনিয়ায় ফিরে যেও। ঋষির বলা শেষ কটা শব্দ আমি শুনতে পেলাম না বা হয়তো শুনতে চাইলাম না। নেট দুনিয়া আছে, থাকবে। আজকের পৃথিবী এ ছাড়া অচল। আমিও অবসরে সে দুনিয়ায় বিচরণ করব নিশ্চয়ই। তবে তা করতে গিয়ে জীবনের ছোট ছোট খুশির মুহুর্তগুলোকে আমি আর বিসর্জন দেব না।
আজকের দিনটার কয়েকটা ঘণ্টার মধ্যে আমি অনুভব করেছি ডিজিটাল দুনিয়ায় বিচরণ করতে করতে আমি আমার প্রিয়জনদের থেকে ক্রমশ অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। হয়তো কিছু ক্ষেত্রে তাদের অবহেলাও করছি। নাহ্, আর নয়। এবার কল্পনার জগত থেকে বাস্তবের মাটিতে ফেরার সময় হয়েছে। ফোনটা ছাড়ার আগে আগের মত আদুরে গলায় বললাম
- তাড়াতাড়ি ফিরো প্লিজ।
- কেন?
- এমনি।
আমার হঠাৎ এমন আবদারে ঋষিও বোধহয় পুরনো দিনগুলোতে ফিরে গেছিল। সামান্য গলা নামিয়ে বলল
- আই লাভ ইউ সোনা।
হাসি চেপে বললাম - নেকু!!