ঠাণ্ডা ঘর
ঠাণ্ডা ঘর
প্রায় মাস দুয়েক বন্দীজীবন কাটাবার পর, গত সপ্তাহে আমার শহর গ্রীনজোনের স্বীকৃতি পেয়েছে। জনজীবন আবার স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে। অনেকদিন পর বাড়ির কাছের বুটিকটা খুলতে মহানন্দে একটু শপিংয়ে এসেছি। এখানে বারবার আসা যাওয়া করতে করতে বুটিকের মালিক মিস্টার গুপ্তা এবং তার স্ত্রী আমার বেশ পরিচিত হয়ে গেছেন। আমায় দেখে সাদরে দোকানের ভিতরে নিয়ে গেলেন তারা। অন্যদিন ভদ্রমহিলা বেশ সেজেগুজে থাকেন, আজ কেমন যেন মলিন সাজপোশাক। চোখমুখও শুকনো। হয়তো মন্দার বাজারের প্রভাব পড়েছে তাদের চেহারায়। আমি কুর্তি কিনব জেনে, উনি আমায় সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন। দোকানে নতুন স্টক নেই বললেই চলে। দু মাস আগেও যা দেখে গেছি, সেসবই এখনও হ্যাঙারে ঝুলছে। একবার মনে হল, কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে যাই। পরক্ষণেই ওদের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। একটা কুর্তি অন্তত কেনাই যায়। বেশ কয়েকটা কুর্তি দেখে একটা মোটামুটি পছন্দ হলো। ট্রায়াল রুমে এসে সবে কুর্তিটা মাথা দিয়ে গলিয়েছি, হঠাৎ আলো নিভে গেল। মনে হলো পাওয়ার কাট, এক্ষুণি আলো এসে যাবে। কিন্তু কোথায় কি। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আমার হ্যান্ডব্যাগটা খুজতে লাগলাম। দরজার গায়ে লাগানো হুকেই তো ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এত ঘুটঘুটে অন্ধকারে দরজাটাই যে খুঁজে পাচ্ছি না। তিনটে দেওয়াল হাতড়ানোর পর অবশেষে দরজাটা পেয়ে গেলাম। ভাগ্যক্রমে আমার ব্যাগটাও। এ পকেট, ও পকেট খুঁজে মোবাইলটা বের করলাম। পাওয়ার কী টিপে আলো জ্বালাতেই ট্রায়াল রুমটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। আমারও ধড়ে প্রাণ এলো। আলোটা জ্বলতে খেয়াল হলো বাইরে থেকে তো কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই হঠাৎ আমার মোবাইলটা অকারণেই দপদপ করে জ্বলতে নিভতে লাগল। তারপর একেবারেই বন্ধ হয়ে গেলো। অনেক চেষ্টা করেও আর আলো জ্বলল না। এতক্ষণে অন্ধকারটাও যেন চোখে সয়ে এসেছে। কোনরকমে নতুন কুর্তিটা খুলে, নিজের টপটা গলিয়ে নিয়ে বাইরে এলাম। দোকানটা ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। আলোর লেশমাত্র নেই। বেশ ভয় করছিল আমার। পাওয়ার কাট তো হয়েই থাকে এই অঞ্চলে, কিন্তু তার জন্য তো কোনো না কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়। তাছাড়া দোকানের কর্মচারিরাই বা গেল কোথায়। দোকান বন্ধ করে কি চলে গেল সবাই? আমি যে ভিতরে আছি, কারুর খেয়ালই হলো না?এদিকে মোবাইলটাও কাজ করছে না বলে কাউকে খবরও দিতে পারছি না। আজ রাতটা কি এই অন্ধকারেই কাটাতে হবে আমায়!
হঠাৎ মনে হল, বিলিং কাউন্টারের সামনে একটা ল্যান্ডফোন দেখেছিলাম না! অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে কাউন্টারের দিকে এগোতে চেষ্টা করলাম। বেশ কয়েক পা এগোতেই, শক্ত মত কিসে একটা ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলাম। এই তো, এই তো টেবিলটা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। পাগলের মত ল্যান্ডফোনটা খুঁজতে খুঁজতে, একটা নরম কিছুতে হাত লাগতে চমকে উঠলাম আমি । ঠিক যেন মনে হল কারুর হাতে হাত লাগল আমার। তাড়াতাড়ি নিজের হাতটা সরাতে যেতেই, কেউ সজোরে চেপে ধরল আমার হাতটা। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে নিজের হাতটা ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলাম। টানাটানি করতে করতে ছিটকে পড়লাম দোকানের এক কোণে। অন্ধকার দোকানটা আমায় গিলে খেতে আসছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার মুখের ওপর কারুর হিম শীতল নিঃশ্বাস পড়ছে। আমার গলায় পরিস্কার অনুভব করছি কারুর বরফের মত ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়া। হাতের চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার। সাহায্যের জন্য এদিক ওদিক চাইতেই, দেখতে পেলাম মেঝেতে ক্ষীণ এক চিলতে আলো। বোধহয় কোনো একটা দরজার নীচ থেকে আসছে আলোটা। বাঁচার জন্য মরিয়া চেষ্টায়, হাতটার ওপর বারবার আঘাত করতে লাগলাম। হাতের বাঁধনটা সামান্য আলগা হতেই, মেঝেতে ঘষটে ঘষটে আলোটার দিকে এগোতে চেষ্টা করলাম। দরজাটার কাছে পৌঁছে, হাত দিতে বুঝলাম সেটা কাঠের। কিন্তু দোকানের ভিতর কাঠের কোনো দরজা তো দেখিনি। দুমদুম করে বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। খুলতেই একটা অদ্ভুত গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা দিল। কেমন একটা ওষুধের গন্ধে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। কোথায় এলাম আমি? এত ঠাণ্ডা কেন চারপাশ? আধো আলোয় আবছা আবছা দেখাচ্ছে সব কিছু। চশমাটা খুলে জামার কোণাটা দিয়ে মুছে, আবার চোখে লাগালাম। এতক্ষণে একটু একটু যেন চিনতে পারছি জায়গাটা। একটা হসপিটাল মনে হচ্ছে। ধুসর রঙের অ্যাপ্রন পরে বেশ কয়েকজন মানুষ ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। কিন্তু বুটিকের মধ্যে দিয়ে হসপিটালে কি করে চলে এলাম আমি। মাথা কাজ করছিল না আর। সামনেই একটা চেয়ার দেখে ধপ করে বসে পড়লাম। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে অ্যাপ্রন পরা দুজন মানুষ ছুটে এলো। দুজনেরই মুখ মাস্ক আর চশমাতে প্রায় ঢাকা। এরা পুরুষ না মহিলা বুঝতে পারছিলাম না। আমার একদম কাছে এসে আমায় দেখতে লাগলেন তারা। তারপর নিজেদের মধ্যে কিসব আলোচনা করে ব্যস্ত পায়ে ঘরের একদিকে চলে গেলেন। ঘরের ভিতরটা ভালো করে দেখছিলাম। দেওয়াল জুড়ে সার সার হাতল দেওয়া ড্রয়ার। কি ঠাণ্ডা ঘরটা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। একটু পরেই মাস্ক পরা সেই দুজন ফিরে এসে, আমায় জিজ্ঞাসা করলেন
- আপনি বডি নেবেন তো?
বডি নেব মানে কি? কি বলতে চাইছে এরা? জিভ জড়িয়ে আসছিল আমার। কোনমতে বললাম
- কার বডি? আমি তো বুটিকে এসেছিলাম।
কর্কশ গলায় হেসে উঠল দুজন।
- মর্গে এসে জামাকাপড় কিনবেন নাকি?
- মর্গ? চমকে উঠলাম প্রায়।
- হ্যাঁ এটা মর্গ।
- কিন্তু আমি তো মর্গে আসিনি।
- আপনি স্লিপ এনেছেন?
- কিসের স্লিপ?
- ওই তো আপনার হাতে। দিন স্লিপটা দিন।
আমার হাতে কোথা থেকে একটা কাগজ এলো বুঝতে পারছিলাম না। এরা প্রায় ছিনিয়ে নিল কাগজটা।
- এদিকে আসুন। বডিটা দেখে নিন।
বমি পাচ্ছিল আমার। দুজনের মধ্যে একজন জোর আমার হাত ধরে টেনে একটা বাক্সের সামনে দাঁড় করালো। অপরজন বাক্সের হাতল ধরে জোরে টান দিতেই, ঘরঘর করে একটা ট্রে বেরিয়ে এলো। ধোঁয়া উঠছিল ট্রে টা থেকে।
- দেখুন ভালো করে, একেই নিতে এসেছেন তো?
- আমি কাউকে নিতে আসিনি। ছেড়ে দিন আমায়। প্লিজ ছেড়ে দিন।
- তা বললে হবে? বডি তো আপনাকে নিতেই হবে। আসুন এদিকে।
আমায় জোর করে বাক্সের মধ্যে রাখা বডিটা দেখতে বাধ্য করল ওরা। বাক্সে উঁকি দিতেই আঁতকে উঠলাম। এতো মিস্টার গুপ্তা। আমি তো একটু আগেও ওনার সাথে কথা বলেছি। উনি কি করে...? আমার ভাবনার মাঝেই ট্রে টা থরথর করে কেঁপে উঠল। অ্যাপ্রন পরা দুজন নিমেষে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। ট্রে টা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল একসময়। তারপরেই দেখলাম ধোঁয়া ওঠা ট্রে থেকে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে আসছেন গুপ্তাজি। আমার দিকে এগিয়ে আসছেন ক্রমাগত। আমি সরতে সরতে ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারলাম, আমার আর পিছনে সরার আর জায়গা নেই। এদিকে গুপ্তাজি আমায় প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছেন। আমি পাগলের মত আমার পিছনের দরজার ওপর ধাক্কা দিতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিতেই আরও একটা ট্রে বেরিয়ে এলো। আর তার থেকে দুটো হাত বেরিয়ে আমার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরল। প্রাণপণ চেষ্টা করেও হাতদুটো ছাড়াতে না পেরে, মরিয়া হয়ে দাঁত দিয়ে একটা হাত কামড়ে ধরলাম
- ছাড়ো, ছাড়ো। কি করছ পিয়া?
সায়নের আর্তনাদে চমকে উঠে বসলাম। সায়ন বেডসুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়েছে। উফ্, স্বপ্ন দেখছিলাম তবে। এখনও বুকটা ধড়ফড় করছে। কি ভয়ানক স্বপ্ন! সায়ন জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়েছে। আমি বাথরুম থেকে ঘুরে এসে, আলোটা নেভাতে যাবো হঠাৎ চোখ পড়ল আমার হাতের দিকে। কিরকম কালো হয়ে আছে কব্জিটা। ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখলাম, সরু সরু পাঁচ আঙুলের দাগ আমার দু হাতেই। ধীরে ধীরে সেই হিম শীতল বাতাস আবার ঘিরে ধরছিল আমায়।