Saswati Roy

Classics Inspirational

4.3  

Saswati Roy

Classics Inspirational

উজান

উজান

7 mins
434


#উজান

#শাশ্বতী_রায়


লিস্ট মিলিয়ে স্যুটকেস গোছাচ্ছিল সৌম্য। ঠিক তিন দিন পর জাপানে যাচ্ছে সে। কোম্পানিই পাঠাচ্ছে তাকে ট্রেনিংয়ের জন্য। নতুন চাকরিটা পাবার দু বছর পর তার প্রথম বিদেশ যাত্রা। তাও আবার পুরো একমাসের জন্য। উত্তেজনায় রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারছে না সে। আগের কোম্পানিতে পজিশন তেমন ভালো ছিল না তার। কর্পোরেট পলিটিক্সে জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। তবে কাস্টমারদের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় এই কোম্পানিটায় যে ভ্যাকেন্সি আছে তার খোঁজ পায় সে। এইচ আরের সাথে কথা বলে ইন্টারভিউয়ের ডাকও পেয়ে যায়। রিসার্চ টিমে ঢুকতে পেরে মাইনে বেড়েছে, সাথে সম্মানও। আর এই ট্রেনিংটার পর প্রমোশন তো বাঁধা।


যাবার আগে আজ শেষ রবিবার। গোছগাছ আজই করে রাখার ইচ্ছে তার। জাপান যাচ্ছে বলে তো আর আগাম ছুটি পাবে না। টুথব্রাশ, মাউথ ওয়াশ, টুথ পিক সব পাউচে ঢুকিয়ে দেখল, টুথপেস্টটা মিস করে গেছে। টি শার্টটা গায়ে গলিয়ে চটপট বেরিয়ে এলো সৌম্য।


ঝাঁটায় খসখস শব্দ তুলে উঠান পরিষ্কার করছে মা। শুকনো জায়গা দেখে দাঁড়ালো সে।


- বিশুর মা আসেনি?


ছেলের গলা পেয়ে কষ্ট করে পিঠ সোজা করে তাকালো গীতা।


- এসেছিল তো।


- তাহলে ওকেই বললে না কেন উঠান পরিষ্কার করতে?


- বলে বলে মুখ ব্যথা হয়ে গেছে। তার আজকাল বড্ড তাড়া। দশ বাড়ি কাজ ধরেছে।


- কিন্তু এরপর তো পিঠের ব্যথায় দুদিন উঠতে পারবে না।


- ও কিছু হবে না। তুই এখন কোথায় বেরোচ্ছিস?


- দোকানে যাচ্ছি। তোমার লাগবে কিছু?


- আমার আবার কি লাগবে!


দু মগ জল ছিটিয়ে আবার ঝাঁটা চালাচ্ছে গীতা।


গেটটা বন্ধ করে বাড়ির বাইরে এলো সৌম্য। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের আর্ত চিৎকার কানে এলো তার।দ্রুত পায়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতেই দেখল উঠানে পড়ে আছে মা। শাড়িটা ভিজে একসা। কোনোমতে মাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এল সে। একবারেই নড়তে পারছে না মা। সমানে কঁকিয়ে চলছে। চেঁচামেচি শুনে পাড়ার কয়েকজন ছুটে এসেছে। রবিবার হওয়ায় পাড়ার ডাক্তার দেবেশবাবুকেও পাওয়া গেল। তিনি এসে সব দেখে বললেন,


- মনে হয় কোমরের হাড়ে চোট লেগেছে। এক্সরে না করলে বোঝা যাবে না।


পাড়ায় সৌম্যর পরিচিতি ভালোই। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই দু দুটো নামকরা কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে সে। এই কলোনি এলাকার ছেলেরা তাকে বেশ সমীহ করে। ক্লাবের ছেলেরা তাড়াতাড়ি গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলো। গীতা আর সৌম্যর সাথে হাসপাতালে গেল দুজন ছেলে। এক্সরে করতেই ধরা পড়ল হালকা চিড় ধরেছে হাড়ে। আড়াই মাস একদম বেডরেস্ট নিতে বলে দিয়েছেন ডাক্তার।


সেদিনটা পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য হাসপাতালে রেখে দেওয়া হল গীতাকে। পরদিন অবস্থা দেখে ডিসচার্জ করা হবে।


হাসপাতালে বসেই অফিসের অচিন্ত্যকে ফোন করল সৌম্য। অচিন্ত্যরও সৌম্যর সাথে জাপান যাবার কথা। সে সব শুনেটুনে বলল টেকনিক্যাল হেডকে একবার ফোন করতে। সৌম্য জানত তাতে বিশেষ কোনো লাভ হবে না। তার জন্য তো আর ট্রেনিং পিছিয়ে দেবে না কোম্পানি। উল্টে সৌম্য না গেলে তার প্রমোশনটা আটকে যাবে। তবু অফিসে জানাতে তো হবেই। সৌম্যর বস জাপানি। নাম তেরোমোতো। তিনি ইংরেজি বুঝলেও ভালো বলতে পারেন না। তার সাথে কথা বলে সৌম্যর বোধগম্য হল না তিনি রেগে গেছেন কিনা। তবে এটুকু বুঝলো যে তিনি বলছেন এটা সৌম্যর জন্য একটা গোল্ডেন অপরচুনিটি। এটা মিস করলে সৌম্য হয়তো অনেকটা পিছিয়ে পড়বে।


বিরক্ত হতে না চেয়েও বিরক্তিটা এসেই যাচ্ছিল সৌম্যর। যাবার মাত্র কটা দিন বাকি। তার মধ্যে এই ঝামেলা। এখন এই অবস্থায় মাকে একা ফেলে সে যায় কি করে! একদিন দুদিন তো নয়। পুরো আড়াই মাসের ধাক্কা এখন। তারপরেও মা পুরোপুরি ঠিক হবে কিনা কে জানে। কি যে দরকার ছিল উঠানে ঝাঁটা দেবার। কাজের লোক থাকতেও মায়ের এই পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিক আর গেল না। কোম্পানি কি আর অপেক্ষা করবে তার মায়ের কোমর ঠিক হবার। এত কষ্টে পাওয়া সুযোগটা পলক ফেলতেই হাতছাড়া হয়ে গেল। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল সৌম্যর।


মাইকে গীতা চ্যাটার্জীর বাড়ির লোককে ডাকছে।


অসন্তুষ্ট মুখে মায়ের কেবিনে ঢুকল সে। ব্যথার ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে মাকে। তাও কুঁকড়ে আছে চোখ মুখ। নার্সকে ডেকে সব খোঁজ নিচ্ছিল সে। ছেলের গলা শুনে চোখ মেলল গীতা। ফ্যাসফ্যাসে গলায় কি যেন বলতে চাইছে। মায়ের মুখের কাছে কান নিয়ে গেল সৌম্য।


- কিছু বলবে?


- তোর যাওয়া তো বুধবার।


- হ্যাঁ। কেন?


- এরা তো বলছে এখন আমার বেডরেস্ট।


- সে তো থাকতেই হবে। কোমরের অবস্থা ভালো নয়।


- তুই চলে গেলে আমার কি হবে?


রাগটা আবার ফিরে আসছিল সৌম্যর। দাঁতে দাঁত ঘষে বলল


- আমি যাচ্ছি না।


- যাবি না?


- বললাম তো একবার।


স্বস্তিতে চোখ বুজলো গীতা। অন্তত সৌম্যর তেমনই মনে হল। ছোট্ট কেবিনটা থেকে বেরিয়ে আসছিল সে।


মায়ের ক্ষীণ স্বরে থমকে গেল।


- আমার ওপর রাগ করিস না সমু। তোর কোনো ক্ষতি হবে না দেখিস।


সৌম্যর মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেই জ্ঞানটুকু থাকলে অকারণে উঠান পরিষ্কার করতে নামতে না।


বলতে পারল না সৌম্য। নিজেকে সামলে বেরিয়ে এসেছে কেবিন থেকে।


প্রায় দশ দিন হল গীতা বাড়িতে এসেছে। দিনের জন্য একজন আয়া রেখে দিয়েছে সৌম্য। অফিস থেকে ফিরে রাতটুকু সে কোনোমতে সামলে দেয়। পাশের কলোনির একজন খাবার হোম ডেলিভারি করে। সেখান থেকেই মা,ছেলের দুবেলার খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। অপছন্দ হলেও বাধ্য হয়ে সেসব খাবার গলাধঃকরণ করে তারা।


আজও একা একাই রাতের খাবার খাচ্ছিল সৌম্য। মা শুয়ে পড়েছে কিছুক্ষণ হল। মার্চের সবে দশ তারিখ আজ। তবু যেন গরমে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। পাখাটাকে ফুল স্পিডে করে আবার খাওয়ায় মন দিল সে। আজকাল কি যে হয়েছে, কিছুতেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে না সে। মায়ের কষ্ট, অসহায়তা সবই সে বোঝে। কিন্তু জাপান যাবার কথাটা মনে পড়লেই সব কিছু কেমন গোলমাল হয়ে যায়। এই বসন্তেও বিষাক্ত লাগতে শুরু করে গোটা পৃথিবীটাকে। তার সাথেই এমনটা হতে হল। সাহিল, সুমের,অচিন্ত্য,তেরোমোতো সবাই সুন্দরভাবে জাপানে পৌঁছে গেল। শুধু তার বেলাতেই বাধা পড়ল।


ইচ্ছাকৃতভাবে অঘটনটা না ঘটালেও কেমনভাবে যেন মা অপরাধী হয়ে গেল এই ঘটনায়।


অন্ধকার ঘরে চুপ করে শুয়েছিল গীতা। আজকাল কত কি যে খেয়াল আসে মনে। কাজ না থাকলে যা হয়। সারাদিন হয় টিভি দেখা নাহয় বই পড়া। আয়াটি বেশ চুপচাপ। বেশি কথার মানুষ না সে। তবে যত্নে কোনো ত্রুটি নেই তার। সর্বদা খেয়াল রাখে এক ভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে গীতার শরীরে কোনো গোটা বেরোলো কিনা। উষ্ণ জলে তোয়ালে ভিজিয়ে সুন্দর করে রোজ গা মুছিয়ে দেয়। পাউডার লাগিয়ে পরিস্কার নাইটি পরিয়ে দেয়। আজ অবধি একটি দিনের জন্যও বেডপ্যান ধরতে গিয়ে নাক সিঁটকায়নি সে। গীতারই বরং লজ্জা করে সবার হাত তোলা হয়ে থাকতে। ছেলের সামনেও আজকাল চোরের মত থাকে সে। রাত আটটার সময় মেয়েটি চলে যাবার পর, প্রকৃতির ডাক এলেও যতক্ষণ সম্ভব সে চেপেচুপে শুয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে খুব তেষ্টা না পেলে জলের বোতলের দিকে হাত অবধি বাড়ায় না সে। ছেলে নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলে তবেই প্রয়োজনের কথা জানায়। ছেলের গম্ভীর মুখখানা দেখলে ভারী অপরাধবোধ হয় তার। সে কি ইচ্ছে করে সেদিন উঠান পরিষ্কার করতে গেছিল! শ্যাওলা জমে জমে কি যে পিছল হয়ে ছিল জায়গাটা। সমু চলাফেরায় বড় অসাবধানী। সবসময় তড়বড় করে। বিশুর মাকে বলে বলে ক্লান্ত হয়ে শেষে তাকেই ঝাঁটা ধরতে হয়েছিল সেদিন। কিন্তু এসব কথা শুনছে কে। সমু তো আজকাল তার সাথে ভালো করে কথাই বলে না। তার কি বুক পোড়ে না ছেলের জন্য। ফিরে এসে নাকি ছেলের প্রমোশন হত। শুধু কি তাই।কত বড় মুখ করে আত্মীয়স্বজনদের ছেলের বিদেশ যাবার গল্প শুনিয়েছিল সে। কত জন ফরমাশ করেছিল জাপানি পুতুল এনে দেবার জন্য। জমানো টাকায় ছেলেটার জন্য নতুন স্যুট অবধি বানিয়ে এনেছিল সে। আজ তাকেই ভুল বোঝে ছেলে। মায়ের মুখের দিকে একটিবারও মায়ার দৃষ্টিতে দেখে না সে। একটিবারও মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করে না তার কষ্ট হচ্ছে কিনা। যন্ত্রের মত নিজের দায়িত্বটুকু শুধু পালন করে চলে। অথচ এই ছেলের জন্য কতবার অবলীলায় নিজের কত শখ বিসর্জন দিয়েছে সে। কেউ মনে রাখে না সেসব কথা।


              * * *


কাস্টমার ভিজিট করে সবে অফিসে পা রেখেছিল সৌম্য। সুমিত ছুটে এলো।


- সৌম্যদা শিগগির এসো।


- কি হয়েছে?


- তুমি এসো তো। সুমিতের চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। প্রায় ছুটে দুজনে ক্যাফেটেরিয়াতে ঢুকল। টিভি চলছে। খবরে দেখাচ্ছে জাপানে আজ ভয়াবহ ভূমিকম্প আর সুনামি হয়েছে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। মুহূর্তে অফিসে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অফিসে যে কজন জাপানি আছে তারা সবাই বাড়ির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের ফোন বিকল। বিকেল পর্যন্ত চেষ্টা করেও অচিন্ত্যদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। শেষ পাওয়া খবরে জানা গেছে প্রায় বিশ হাজার লোকের মৃত্যুর সম্ভাবনা। নিখোঁজ অসংখ্য মানুষ।


জাপান অফিসের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আজ তেমন কাজ ছিল না। ছটা নাগাদ সুমিতের সাথে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো সৌম্য। দুজনেরই বাইক থাকে পার্কিংয়ে। বাইকে স্টার্ট দিয়ে সৌম্যর দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল সুমিত,


- তুমি কিন্তু খুব লাকি সৌম্যদা। মাসিমা এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল তোমাকে।


কথাটা শুনে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সৌম্যর। সত্যি তো, আজ তো তারও ওখানেই থাকার কথা ছিল। মায়ের দুর্ঘটনাটা না ঘটলে আজ হয়তো তার অস্তিত্বই থাকত না। মা কি জানে ঘটনাটা! জেনে কি প্রতিক্রিয়া হবে মায়ের?


ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙছে বুকে। মায়ের করুণ মুখটা বারবার ঢেউয়ের সাথে ডুবছে ভাসছে। অপরাধবোধটা বুকের ওপর পাথরের মত চেপে বসেছে যেন।


গত কয়েকদিন ধরে মানুষটার ওপর বড্ড বেশি মানসিক অত্যাচার করে ফেলেছে সে। এই জীবনটা তো তারই দেওয়া। অজান্তে হলেও রক্ষা করল সেই। ভেজা ভেজা চোখে বাইকে স্টার্ট দিল সৌম্য। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে আজ। মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়াটা যে বড্ড জরুরী। বাইকের স্পিড বাড়ালো সৌম্য। মিঠে বাতাস মেখে বারবার ভেসে আসছে মায়ের গলা "তোর কোনো ক্ষতি হবে না,দেখিস সমু"।


- সমাপ্ত


( 2011 র জাপান সুনামি অবলম্বনে লেখা)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics