আলপনা - ড. রীতা দে
আলপনা - ড. রীতা দে
আলপনা ! সকালের দরজা খুলেই ! আমারই বাড়ির সদর - চৌকাঠ লাগানো পাকা উঠোনে !উঠোনে আবার খড়া মেঝে ।আলপনায় স্পষ্ট এক তুলসী গাছ । আর ফুটে উঠেছে একটা আয়তকার সমতল ভিত ।সেখান থেকে বেরিয়ে আসা গাছের গোড়ার মাঝ অংশ- তার থেকে বিস্তৃত হওয়া শাখা প্রশাখা ডালপালা, সরু শাখা মাঝারি শাখা । শাখা প্রশাখা আবার গাছের উচ্চতা অনুযায়ী - তার ডালপালা সরু মোটা মাঝারি । এহেন তুলসী গাছ তো আমাদের নাগালের মধ্যে, গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত ।তুলসী পাতা তো নারায়ণ ঠাকুরের বড়ো আদরের ।সেই আদুরে গাছের পাতাগুলো একটু বড়ো হতে পারে আবার ছোটও হতে পারে । ডালগুলো পাতাগুলোকে এমনভাবে আগলে রেখেছে যেন তারা ভাইবোন । ছোট পাতাগুলো ছোট্ট ছোট্ট বোনেরা, মাঝারি পাতাগুলো মেজদিরা আর বড়ো পাতাগুলো অবশ্যই বড়দিদের দল। সকলে মিলে কেমন সুন্দর নড়ছে এদিক থেকে ওদিকে । প্রাণে ভরপুর । কেমন উজ্জ্বল ? সে কথা সূর্যই বলবে । কালো সাদায় আঁকা আলপনা। সূর্যের আপাত চলাফেরায় কালো অংশ যতো ঘন থেকে ঘনতর হয়ে উঠেছে সেই একই মাত্রায় সাদা অংশগুলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে । কালো কৃষ্ণবর্ণের ডালপালা পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বিছিয়ে থাকা অংশগুলো রাধারঙ মেখে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে । আর কেমন সুন্দর নাচছে ! বাতাসের নীরব স্নিগ্ধ বোলে কৃষ্ণবর্ণের ডালপালা পাতাগুলো বাঁশির সুরে মেতে উঠতেই সে কি নুপুরের শব্দ ছন্দ মেলে ধরা রাধারঙ মাখা শ্বেতশুভ্র উজ্জ্বল অঙ্গে। বইছে বাতাস নাচছে আলপনা ।
অবাক কান্ড !কালো সাদায় আঁকা আলপনা মাঝে মাঝে মাঝে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে বাতাসের হাতে হাত রেখে ।তুলসী গাছের বিপরীতে থাকা একটা ফুলের গাছ । তুলসী গাছের থেকে দ্বিগুণ তিনগুণ বড়ো ।ফুলগুলো গুচ্ছ গুচ্ছ, দেখতে অনেকটা উত্তল ঝাড়লন্ঠনের মতো , বাতাসের ইঙ্গিতে মাঝে মাঝেই ঐ কালো সাদায় আঁকা নৃত্যরত আলপনাকে সঙ্গ দিতে ওর হাত ধরছে । আর আলপনার রূপও পাল্টে যাচ্ছে । যেমন স্টেজে একদল মেয়ে নাচে আর মাঝে মাঝেই অন্য আর একদল মেয়ে পর্দার আড়াল থেকে নাচতে নাচতে বেরিয়ে এসে ঐ নৃত্যরত মেয়েদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নাচটাকে আরও বৈচিত্র্যময় আরও বর্ণাঢ্য করে তোলে ।
কালো সাদায় আঁকা আলপনা বাতাসের তালে তালে এদিকে ওদিকে নড়ছে ঠিকই তবে সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর দরজায় টোকা দিয়ে বলছে - এসো এসো, আমায় তোমার মৌসুমী স্নেহে ভিজিয়ে দাও - এই বলে দক্ষিণ -পশ্চিম কোল থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে উত্তর-পূর্ব কোণে । কোথাও কোন এলোমেলো ব্যাপারে নেই ।
অবশ্য মানুষের আঁকা আলপনার মধ্যেও কোনোভাবেই কোনো খাপছাড়া ব্যাপার নেই । এক্কেবারে নিখুঁত - কি আঁকার মধ্যে, কি মাপজোকে , কি রঙের ক্ষেত্রে । তবে কেমন যেন লেপ্টে থাকে মেঝে সঙ্গে । মৃত মৃত একটা ব্যাপার । প্রকৃতির দেওয়া আলপনার মতো মোটেই জীবন্ত নয় ।
বসুধা মানুষের দেওয়া আলপনা দেখে দেখে ক্লান্ত ।সরস্বতী পুজোয় , লক্ষ্মী পুজোয় বা যে কোন শুভ কাজে । ভুলচুক হবার কোন জায়গায়ই নেই ঐ আলপনা আঁকার মধ্যে । আর ঐ আলপনাকে ঘিরে কি হৈচৈ ! 'কে এঁকেছে কে এঁকেছে ' ? সত্যি সত্যিই দক্ষ হাতের টান । বসুধার ভালো লাগে না । নিখুঁত তো অবশ্যই তবে মোটেই জীবন্ত নয় । রঙ যখন কাঁচা থাকে তখন আলপনার ওপর হাত দেওয়াই যাবে না , তাহলেই ধেবড়ে যাবে। শুকনো অবস্থায় আবার আলপনার ওপর হাতের চাপ জোরে পড়লেই রঙ উঠে গিয়ে ধেবড়ে গিয়ে মাখামাখি একাকার । সরস্বতী ঠাকুরের সামনে যাবার জো আছে ঠাকুরকে প্রণাম করার জন্য ?হাত পা কে শাসন করে তবে সরস্বতী ঠাকুরের সামনে যাওয়া যাবে ।
কি বিড়ম্বনা !
অথচ এদিকে দেখ , বসুধার হাতের নিবিড় স্পর্শ পেয়েই ঐ কালো সাদা আলপনা আবার আরও আরও প্রাণে ভরপুর হয়ে বসুধাকে যেন জড়িয়ে ধরতে চাইছে । না আছে আলপনাকে না- ছোঁয়ার হাত পা- র শাসন , না আছে ঘেঁটে যাবার মরণ- ভয় ।
হ্যাঁ, সেই কালো সাদায় চিত্রিত আলপনা আবার প্রকৃতির অমোঘ আকর্ষণে সাড়াও দেয় । আলপনায় স্পষ্ট পাতা আকৃতিগুলো কেমন করে যেন গুচ্ছ গুচ্ছ নক্ষত্রে চিত্রিত হয়ে উঠেছে তেমনই আবার আয়তকার সমতল ভিত ঢেউ খেলানো ত্রিকোণকারে মূর্ত হচ্ছে । বাঁধ ভাঙা আনন্দ ।সূর্যের আপাত চলাফেরায় আলপনাটা আকারে ছোট, একটু বড়ো, আরো বড়ো তারপরে এক্কেবারে ছোট্ট হয়ে ওর গোড়ায় ভিত ঘেঁষে কোথায় যেন হারিয়ে গেল সূর্যের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে !
এ তো অন্তর্ধান নয় , এতো হারিয়ে যাওয়া নয় - এ আর এক জগৎ - নিজের মধ্যেই নিজের চুপ করে ডুবে যাওয়া ।
কি নিস্তব্ধতা ! ' বার্ধক্যে বারাণসী ' বলে একটা কথা আছে । বসুধার কাছে বারাণসী বলে বিশেষ কোনো জায়গা হয় না । বারাণসী তার নিজের ভেতরেই আছে । পার্থিব ভোগসুখ পার যে নির্মোহ বোধ তাইই বারাণসী । বাইরে যতই হট্টগোল হোক্ আর বাইরে যতই মরণ - ফাঁদ নিস্তব্ধতা থাকুক না কেন ধ্যানের মূর্ত জগৎ বারাণসী তোমার নিজের মধ্যেই । যেমন মনুষ্য জঙ্গল বা অরণ্য কোনোটারই দরকার পড়ে না তেমনই বয়স কোনো হিসেবের মধ্যেই পড়ে না । এই বারাণসীর উপলব্ধি ব্যক্তির একেবারেই একান্ত নিজস্ব ব্যাপার ।
ভাবতে ভাবতে বসুধা কখন যেন পায়ে পায়ে চেতন জগৎ পার হয়ে অবচেতন মধ্যে দিয়ে অচেতন জগৎ -এ ডুবে গেছে সে জানেই না ।
শুধু ভেসে আসে -
" ' যথ আপ চ পঠবী তেজ বায়ো ন গাধতি
ন তথ্থ সুক্কা জোতন্তি আদিচ্চ ন পক্কাসন্তি
ন তথ্থ চন্দিমা ভাতি তম তথ্থ ন বিজ্জতি
যদা চ অত্তন ' আভেদি মুনি মনেন ব্রাহ্মণ
অথ রূপ অরূপ চ সুখদুক্খা পমুচ্চতি ।। ''
যেখানে জল স্থল আগুন বায়ুর কোনো অস্তিত্ব নেই ,যেখানে নক্ষত্র গ্রহ কোনো আলো বিচ্ছুরণ করে না, সেখানে জ্যোৎস্নাও দেখা যায় না আবার চাঁদ দেখা যায় না, তবুও সেখানে অন্ধকার নেই, সেখানে রাতও নেই ...
জন্ম জন্মান্তরের মধ্যে দিয়ে জীব হৃদয়ের নীরবতায় এই জগৎ - কে উপলব্ধি করে ।।