আলো
আলো
আজ কালীপুজো। চারিদিকে প্রচুর আলো।আলোয় আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক। দাদু আলো, দিদা আলো, মা আলো, বাবা আলো, ছোট্ট আলো, দিদি আলো, দাদা আলো এমন আরো কত আলো…সে আমি বলে শেষ করতে পারবো না!!
আলো গুলো খুব সুন্দরভাবে সেজেছে আজ, আর সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। তার মধ্যেই একটা দুষ্টু ছোট্ট আলো লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের মধ্যে থেকে, একটু ঘোরাঘুরি করবে বলে।
ছোট্ট আলোটা, যার নাম টুনি, সে বেশ নেচে নেচে কালীপুজোর প্যান্ডেল গুলো ঘুরে দেখতে লাগলো। তবে সে শুধু সব প্যান্ডেলে ওই হিন্দি গানগুলো শুনছিলো আর মনে মনে বলছিলো - "ধুর,ছাই! আমি ওসব হিন্দি-টিন্দি বুঝি নাকি বাপু? চালাও না গো বাংলা গান!ওই দেখো আমি না পুরো পাগলি,থুরি, আলো।আমার কথা কি আর ওরা শুনতে পাবে?বোঝো কান্ড!"
ছোট্ট আলো কপালে হাত চাপড়ে এগিয়ে চললো ঠাকুর দেখবে বলে, এক একটা প্যান্ডেলে তো এত ভিড় যে ঠিক করে ঠাকুর দেখাই যাচ্ছে না।
কিছুটা দূরে গিয়ে সেই ছোট্ট আলো টা দেখলো একটা ১৩-১৪ বছরের মেয়ে এবং তার পরিবারের সকলে মিলে একটা ছোট্ট ঘরোয়া পুজো করছে, কিন্তু একটা লোক ও সেখানে নেই ঠাকুর দেখার মতো। আলোটা আর একটু কাছ থেকে দেখার জন্য নিচে নেমে এলো। আর মনে মনে বললো - "যাক বাবা, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।এখানে কি সুন্দর বাংলা গান চালিয়েছে, মনটা ভরে গেলো,যতই হিন্দি গান চলুক, বাংলা গানের মাধুর্য টাই আলাদা।"
আলো নিচে নামতেই ছোট্ট মেয়েটার চোখ পড়লো আলোর দিকে। আলোটা প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গেলেও মেয়েটার চোখের জল দেখে থেমে গেলো।তারপর বললো-"কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেনো? আজকে তো কালী পুজো, আজকের দিনে কি কাঁদতে আছে?" বাচ্চা মেয়েটা তো অবাক, আলো আবার কথা বলতে পারে নাকি! তবে কি সে ভুল দেখছে? বাচ্চা মেয়েটি একবার চোখ দুটো ঘষে আবার একবার দেখলো, না, সে ঠিকই দেখছে!!
বাচ্চা মেয়েটি কিছুটা অবাক হয়ে নিজের কান্না থামিয়ে বললো -"আমি উমা, তুমি কে? আর তুমি তো আলো, তুমি কথা বলছো কি করে?"
পাল্টা প্রশ্নে আলো টাও কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে মিষ্টি হেসে বললো - "আমি যে-সে আলো নই!! আমি কথা বলতে পারি, আর কারোর কষ্ট দেখতে আমার মোটেই ভালো লাগে না, এই যেমন তুমি কাঁদছ তাই তোমার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম।তো এবার বলো তোমার কি হয়েছে?"
উমা বললো-"আমি আর আমার পরিবার প্রতি বছর কালী পুজো করি, কিন্তু কোনো বছর আমাদের এই ঠাকুর দেখতে কেউ আসে না। "
টু্নি বললো-" তা,এই জন্য তোমার মন খারাপ? ঠিক আছে, আমি তোমার মন এক্ষুনি ঠিক করে দিতে পারি।"
উমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে -" কি করে ঠিক করবে? তুমি কি সবাইকে এখানে ডেকে আনবে?"
টুনি বললো -" আমি তো শুধুই আলো, আমি কি আর লোকেদের ডাকতে পারবো?তবে আমি তোমার মন নিশ্চয় ঠিক করে দিতে পারবো। "
উমা অবাক নেত্রে জিজ্ঞেস করে -" কি করে?"
টুনি বলে-" চোখ দুটি বন্ধ করো তো বাপু, সব বুঝতে পারবে!"
আর চোখ বন্ধ করার পর…
চোখ খুলে উমা দেখলো, সে তো তার বাড়িতে নেই, এ যে এক অন্য জগত। না আছে শহরের কোলাহল, ব্যস্ততা, না আছে কোনো বৈষম্য। অবশ্য উমা যতক্ষণ এখানে এসেছে একজন মানুষ ও তার চোখে পড়েনি, উমা মনে মনে ভাবলো -" মানুষ যেখানে নেই, সেখানে রাগ, হিংসা, বিদ্বেষ আসবেই বা কোথা থেকে ?!"
এ কি! এতক্ষণ তো দিনের আলোয় ঝলমল করছিলো চারিদিক, কোথায় গেলো সূর্য? এত তাড়াতাড়ি রাত হয়ে গেলো নাকি?
হঠাৎ করেই আবার আলোয় আলোয় ঝলমল করে উঠলো চারিদিক। এত আলো, উমা কখনো নিজের চোখে দেখেনি।আলোর ঝর্ণা, আলোর নদী, মনে হচ্ছে আলো দিয়েই সব কিছু তৈরি হয়েছে। উমা একটু একটু করে এগিয়ে চললো… সামনে আলো দিয়ে তৈরী একটা সেতু চোখে পড়লো। পা বাড়াতে গিয়েও পিছিয়ে এলো উমা, যদি ভেঙে যায়! কিন্তু আলো উমার কানের কাছে এসে বললো-"কি হলো উমা? পিছিয়ে গেলে কেনো? তুমি কি ভাবছো?আলো দিয়ে তৈরী বলে কি ভেঙে যাবে? তেমন কিছু হবে না! এগিয়ে যাও!"
উমা পা রাখলো আলোর সেতুতে, আলোর ঝলকে চোখ ঝলসে যাওয়ার জোগাড়। আলোর ফুল, আলোর গাছ। আর বুঝি আকাশে তারার দরকার নেই। উমা বুঝি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না, নিজে নিজেই খেলতে শুরু করলো। নাচতে, গাইতে শুরু করলো আলোর কণা গুলোর সাথে। এত আনন্দ, সে বুঝি আর জীবনে কখনো পায়নি। আনন্দের চোটে তো সে নিজের বাড়ি, নিজের দুঃখ সবকিছু ভুলে গেলো।
এরপর টুনি এসে বললো - "কি উমা! বাড়ি ফিরবে না? ওদিকে যে কালীপুজো শেষ হতে চললো।"
উমার তখনই বুঝি সবকিছু আবার মনে পড়ে গেলো। "ধুর! আর বাড়ি যেতে ইচ্ছেই করছে না আমার।"
আলো বলে-"তা বললে কি চলে উমা? যাও, বাড়ি ফিরে যাও। আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।"
উমা বললো-"হ্যাঁ, আজ থেকে আমার সবথেকে ভাল বন্ধু তুমি। ধন্যবাদ, বন্ধু।"
হঠাৎ ই সব কিছু বদলে গেলো উমার চারপাশে। কাশর, ঘন্টা বেজে উঠলো, সাথে বাংলা গান আর লোকেদের কোলাহল শুনতে পেলো উমা। উমা আর দেখতে পেলো না টুনিকে। আবার ফিরে আসা ব্যস্ত জীবনে...
আর এদিকে টুনি তো দারুণ খুশি কালী পুজোর দিনে উমার মুখে হাসি ফুটিয়ে দিতে পেরে। তারপর সেও নিজের পরিবারের কাছে চলে গেলো হাসতে হাসতে।
আমার কথাটি ফুরালো,
কালীপুজাও ফুরালো।।