নালিশ
নালিশ
আজ বলবো একটি ছোট্ট মেয়ের কথা। তার জন্য যেতে হবে কিছু বছর আগের বাঁকুড়ার মুকুটমনিপুর গ্রামের একটা ছোট্ট বাড়িতে ।
ছোট্ট বাড়িটিতে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়েটির নাম রিমলি। তার বাবা আর সৎ মা, আর সৎ বোনদের নিয়ে তার পরিবার। মুখে ভালো আছি বললেও শুধু তার বাবা বুঝতে পারতো সে কতটা কষ্টে আছে।
কংসাবতী নদীর ধারে এই বাড়িটি। জরাজীর্ণ হলেও আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিলো সেই ছোট্ট বাড়িটিতে । নদীর দিক থেকে বয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাস দোলা দিয়ে যেতো তাদের দাওয়ায় মেলা কাপড় গুলোকে। চারিদিকে বিরাজ করতো একটা শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ, মনে হতো গ্রামে কেউই কখনো কষ্টের মুখ দেখেনি একজন বাদে। সে ছিলো রিমলি।
তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা মেয়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। কিন্তু মানুষের মন তো বোঝা বড় দায়। বিবাহের কিছু বছরের মধ্যেই সেটা চোখে পড়লো। সৎ মেয়ে রিমলি কে একদম সহ্য করতে পারতো না তার সৎ মা আর সৎ বোনেরা।
তখন সবে সবে নারী শিক্ষার প্রচলন সমাজে। সকলেই ধীরে ধীরে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে চাইলো। তবে স্কুল এ পড়তে খরচ ও লাগে, কিন্তু সৎ মেয়ের জন্য সে টাকা খরচ করতে নারাজ তার সৎ মা।
রিমলি তার মায়ের মুখের ওপরে কথা বলতে পারে না কখনোই। তাই সৎ মায়ের কথাতেই রিমলি জীবনে শিক্ষার কুঁড়ি ফুটতে গিয়েও ফুটলো না।
কিন্তু রিমলির পড়ার ইচ্ছে প্রবল সে যে ক্লান্ত সারাদিন কাজ করে এবার সেও চায় পৃথিবীটাকে জানতে।তার কাছে পৃথিবীর সীমানা কংসাবতী নদীটুকুই।
একদিন এক ভিক্ষুক রিমলি দের বাড়িতে কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে আসলো। রিমলি তার নিজের পাতের একটুকরো শুকনো রুটি দিয়ে দিলো ভিক্ষুক কে। রিমলির মা তাই দেখে মেয়ের চুল ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে এসে তাকে ভীষণ প্রহার করতে শুরু করলেন। সে চিৎকার করে বলছিলো-"হতভাগী! নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আবার সাধ করে গেছেন ভিখারীকে দান করতে।"
কাঁদতে কাঁদতে মাত্র ৪ বছরের মেয়েটি তার বাবার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলো - "বাবা, আমার মা কোথায় বাবা? আমি আর পারছি না, আমার মা কে কাছে পেলে আমি সৎ মায়ের নামে অনেক নালিশ করবো দেখো। মা নিশ্চই সৎ মাকে বকা দেবে।"
এইটুকু মেয়ের অভিমান দেখে তার বাবা নিজের মনে হাসতে চাইলেও কষ্ট পেলো মেয়ের কথা ভেবে। তাই আর কিছু বলতে চেয়েও পারলো না।
আরো একদিনের কথা, রিমলির বাবা জানতো যে তার মেয়ে পড়তে চায়। তাই একদিন রিমলি তার মায়ের সামনেই বাবার কাছে আব্দার করলো -" বাবা, আমাকেও পড়তে দাও গো। আমিও পড়তে চাই বাবা।"
তার বাবা তখন তাকে বললো-"দেখ, মা আমি সামান্য কাপড়ের কলে চাকরি করি। এত বই কেনার সামর্থ্য আমার নেই। তুই বরং তোর দিদি দের বই নিয়েই পড়া শুরু কর, আমি তোকে বই এনে দেবো।"
কিছুদিন পরে একটু বেশি উপার্জনের জন্য রিমলির বাবা শহরে চলে গেলো। সে চলে যেতেই রিমলির মায়ের অত্যাচার দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
একদিন রিমলি তার দিদির বই পড়তে গেলে তার মা তাকে বলে -" খবরদার! যদি বইতে আর কখনো হাত দিস তাহলে তোর হাত ভেঙে দেবো। "
অগত্যা রিমলি কাঁদতে কাঁদতে বাসন মাজতে চলে গেলো। চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছিলো। আজ তোর চোখের জল যে বাধ মানছে না।
এদিকে তার বাবা বাড়ি আসবে বলে চিঠি লিখে জানায়। বাড়ি আসার পর রিমলি তার বাবাকে প্রশ্ন করে -" আচ্ছা বাবা, আমার মা কি এই কংসাবতী নদীতে আছে? সেখান থেকেই কি আমার মা আমায় দেখে?"
বাবা কোনো উত্তর দিতে না পারলেও সম্মতি জানালো।
তবে রিমলি এই কয়েকদিনের কষ্টের কথা বললো না। সারাটা দিন কাজ করে আর রাতে ঘরের কোণে চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রু বর্ষণ করেছে সে, সে সমস্ত কোনো কথাই ব্যক্ত করতে পারলো না সে।
তার বাবা কিছুদিনের মধ্যেই আবার শহরে চলে গেলো। আরো কিছুদিন বাদে চিঠি এলো - "আমার ভীষণ জ্বর। তাই এক মাসের জন্য আমি টাকা পাঠাতে অক্ষম।"
তাই শুনে তো রিমলির মায়ের মাথায় বাজ পড়লো। তাই মাত্র ৬ বছরের রিমলি কে গিয়ে বললো-"শুধুমাত্র তোর জন্য তোর বাবার এই অবস্থা! এখন তোকেই টাকা রোজগার করতে হবে যে করেই হোক। নাহলে এই বাড়িতে যদিও দুই বেলা দুই মুঠো গিলতে পারতিস আর তাও পারবি না।বুঝলি? "
ছোট্ট রিমলি নির্বাক হয়ে রইলো ওই টুকু বয়সে সে কি করে চার জনের পেট চালাবে?
তবে রিমলি ছোট্ট হলে কি হবে বুদ্ধি তার মোটেই কম নয়। তার কাছে কংসাবতী নদী পৃথিবীর শেষ সীমানা সে ঠিক করলো সেখানে মাছ ধরেই সে উপার্জন করবে।
পরের দিন থেকে তার এই কাজ শুরু হল। নদীর পাড়ে যেকটা মাছ পেতো তাই নিয়েই সে হাটে বিক্রি করতো।
কিন্তু কিছুদিন হলো রিমলি খুব অসুস্থ রোজ রাতে একটা নির্দিষ্ট সময় জ্বর আসে। কিন্তু তাকে দেখার মতোন কেউ নেই।ঘরের কোণে চুপচাপ শুয়ে থাকতো সে আর সকাল হলেই মাছ ধরতে যেতো।
ওদিকে তার বাবা এখন সুস্থ আর রিমলির অসুস্থতার খবর পেয়ে সে বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করে।
বাড়ি ফিরে প্রথমে ডাক্তার কে খবর দিতে ডাক্তার এলো। রিমলি কে দেখে নিয়ে তিনি বললেন রিমলির ম্যালেরিয়া হয়েছে।
ডাক্তার ওষুধ দিয়ে গেলেন কিন্তু এত দামী দামী ওষুধ কেনার ক্ষমতা ছিলো না রিমলির বাবার। অগত্যা ওরকম ভাবেই রয়ে গেল রিমলি। একদিন সন্ধ্যেবেলা রিমলির আর জ্বর আসলো না। সে তার বাবার কোলে মাথা রেখে হঠাৎ করে বলে উঠলো - "বাবা, তুমি কিন্তু মনে করে ওই কংসাবতী নদী থেকে মা কে খুঁজে আনবে! আমার যে নালিশ করা বাকি আছে এখনো।"
এটাই রিমলির জীবনের শেষ কথা। ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে এলো রিমলির দেহ। নিথর মূর্তির মতোন সে তার বাবার কোলে মাথা রেখে সারা জীবনের মতোন ঘুমিয়ে পড়লো।
কিন্তু সেই দেহ পোড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না তার। তাই কংসাবতী নদীতেই ভাসানো হল ছোট্ট রিমলির দেহ।
ওদিকে তার বাবাও ঠিক করলো শহরে ফিরে গিয়ে আস্তে আস্তে কাজ শুরু করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! রিমলির মৃত্যু তার বাবাকে অসহায় করে তুলেছিল।
রিমলির বাবা রাস্তায় যেতে যেতে ভাবছিলো-"যদি আজ রিমলির নিজের মা থাকতো এরকম দিন দেখতে হতো না। এবার আমার রিমলি তার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করতে পারবে মনের মতোন করে।"
নিজের অজান্তেই রিমলির বাবা একটা বাসের সামনে চলে এলো। এবার হয়তো তারা সপরিবারে শান্তিতে থাকতে পারবে। কংসাবতী নদীতে না ভাসলেও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন রিমলির পিতাও।