NISHA KAMILA

Tragedy Thriller

4.3  

NISHA KAMILA

Tragedy Thriller

আমি সেই চুপকথা।।

আমি সেই চুপকথা।।

7 mins
513


শিলিগুড়ি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি। 

কলেজের হোস্টেলের একটা ঘরে আমি আর আমার তিন বান্ধবী লিজা, তিন্নি আর রুমা থাকি। 

কলেজের চারপাশে সুন্দর চা বাগান আর প্রচুর মহিলা শ্রমিক কাজ করছে। প্রকৃতির সমস্ত রূপ যেনো ভগবান এখানেই বর্ষণ করেছেন, দেখলে চোখ দুটিও সার্থক হয়। আমরা সবাই রোজ সময় পেলেই চা বাগানে বেড়াতে যাই তাই সেখানকার মোটামুটি সমস্ত শ্রমিক দের চিনে ফেলেছিলাম। 


একদিন একটা অচেনা মুখ দেখে চোখ পড়ে গেলো সেই মহিলার চোখে। কিন্তু এই দৃষ্টি আমার যেনো বহুদিনের চেনা। মহিলাটির ঘোলাটে দুটি চোখে সে কি জিঘাংসা! তবু আমি যেনো তাকে চিনি। ডান চোখের নিচের এই কাটা দাগ! না, আমি চিনি ওনাকে, কিন্তু কি করে? কোথাও কি দেখেছি? না, তা কি করে হয়?উনি তো আজকেই এলেন আর তাছাড়া আমি এই হোস্টেলে আছি ৩ মাস ও হয়নি। তাহলে? না! আর ভাবতে পারছি না আজকের মতোন ফিরে যাই। সেই মতোন সবাইকে নিয়ে ফিরে এলাম হোস্টেলে। 


রাতে আমার ভীষণ জ্বর এলো, জ্বরের মধ্যে প্রলাপও বকলাম বোধ হয় তারপর আর কিছু মনে নেই… 

জ্ঞান ফিরল ভোর বেলা… 


পাহাড়ি অঞ্চল তাই তখনও ঠিক সকাল হয়নি, জানলা দিয়ে বাইরেটাও ঠিক করে দেখা যাচ্ছে না, ঘরের মধ্যেও অন্ধকার হাতড়ে ফোন টাও হাতের কাছে পাচ্ছি না যে আলো জ্বালাবো। 


মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিলো, ইচ্ছে তো করছিলো চিৎকার করে এক্ষুনি বাকি সবাইকে ডেকে দিই। কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে এবার দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কেউ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি বোধ হয়। 

কেমন একটা অজানা আতঙ্ক গ্রাস করলো আমায়। হঠাৎ করেই মনে হলো একি আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? এটা তো আমার কলেজের হোস্টেল নয় এ তো একটা পুরোনো রাজপ্রাসাদ। আমি এখানে কি করে এলাম? এক্ষুনি তো হস্টেল এই ছিলাম!কিন্তু এই রাজপ্রাসাদ, এই সমস্ত ঘর…হঠাৎ করেই মনে হলো একজনকে দেখলাম। চকিতেই মনে পড়ে গেলো ওনাকে তো আমি কাল চা বাগানে দেখেছিলাম…উনি এখানে কি করে এলেন? কাছে এগিয়ে যেতেই দেখলাম কেউ নেই… কিন্তু বড্ড চেনা চেনা লাগছে সব কিছু। কিন্তু কি করে? 


তারপরে হঠাৎ একটা শব্দ হতেই পেছনে ফিরে দেখি আমি সেই কলেজের হোস্টেল এই আছি। তাহলে কি দেখলাম এই কয়েকটা মুহূর্তে? 


হয়তো বা মনের ভুল ! মাথাটা কেমন যেনো করে উঠলো… 


দেখলাম আমার বান্ধবীরাও উঠে পড়েছে তাই ওদের নিয়ে চা বাগানে বেড়াতে চলে গেলাম কিছু তো একটা রহস্য আছে ওই চা বাগানের মহিলাটির মধ্যে যা আমাকে জানতেই হবে… 

সেই মতোন সকালের প্রাতঃরাশ সেরে নিয়ে ঘুরতে গেলাম চা বাগানে, আজকেও সেই মহিলাটিকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞাসা করলাম ওনাকে - "আপনার নাম কি? এর আগে তো আপনাকে দেখিনি… নতুন এসেছেন বুঝি?" 

কিন্তু উনি আমার উত্তর দেওয়ার আগেই আমাকে প্রশ্ন করে উঠলেন - "তুমি সেই দাসী তাই না?বলো?" 

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, আমি আর দাসী…? আমার বাবা যথেষ্ট ধনসম্পদশালী, তো দাসী হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে? 

হঠাৎ করেই বান্ধবীদের ডাক শুনে চলে যেতে হলো মনের মধ্যে একরাশ খটকা নিয়ে। 


রাতে শুয়ে শুয়ে একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম -" এ তো সেই রাজবাড়ি, কিন্তু এখন সেটা পুরোনো লাগছে না, বেশ সুন্দর ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো ঝকঝক করছে রাজবাড়ি! কিন্তু এ কি!? এ কি দেখছি আমি!এ তো আমি নিজে!কয়েকজন প্রহরী আমাকে দাসী হিসাবে নিয়ে আসছে টানতে টানতে…আর দেখতে পারলাম না, নিজের থেকেই চোখের পাতা খুলে গেলো বোধ হয় সব অন্ধকার দেখলাম তারপর মনে পড়লো - "রাতে ঘুমানোর সময় আমি নিজেই আলো বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম।" 


সকাল হতেই বেরিয়ে পড়লাম সেই পুরোনো রাজবাড়ির খোঁজে, হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়লো,সেই রাজ বাড়ির ছবি আছে। আর লেখা আছে যে একদিন ওই রাজবাড়িতে থাকতে পারবে তাকে ওই রাজবাড়িটা কয়েকটা টাকার বিনিময়ে দিয়ে দেবেন। এ তো মেঘ না চাইতেই জল! কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগলো, এত বড় রাজবাড়ি এই কয়েকটা টাকার বিনিময়ে কেনোই বিক্রি করবে কেউ? কি ওই রাজবাড়ির রহস্য… জানতেই হবে আমাকে!. 


রহস্যের টানে আমার মন ও পাড়ি দিতে চাইলো অজানা অচেনার উদ্দেশ্যে… 

পরের দিন ভোর ভোর রওনা হলাম রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে, খুঁজে খুঁজে রাজবাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৯ টা বেজে গেলো। কত রহস্য লুকিয়ে আছে এই রাজবাড়িতে, ভাবতেই কেমন শিহরণ খেলে গেলো আমার। 


রাজবাড়ির সামনে আগাছা জন্মেছে। শ্যাওলা আর পচা পাতার মাঝে কত কি যে লুকিয়ে আছে! যাই হোক, কিছুক্ষণ পর কিছু স্থানীয় লোক কে দেখতে পেলাম এবং ওনাদের দিয়ে ঘরের কিছুটা জায়গা আগাছা পরিষ্কার করে নিয়ে বাসোপযুক্ত করে নিলাম সাথে একটা টর্চলাইট ও এনে ছিলাম। বিকেল বিকেল কিছু খাবার ও নিয়ে নিলাম যাতে সেদিনটা আর বাইরে যেতে না হয় তারপর ৮:৩০ নাগাদ খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে! উঠে দেখি কই, কোথাও তো কিছু নেই! কিন্তু কি জানি? আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিলো কিছু তো একটা হবেই! তাই আমাকে জেগে থাকতেই হবে! 


ঠিক ১ মিনিট বাদেই দেখলাম, এই কি সেই পুরোনো রাজবাড়ি? এ তো নতুন বানানো কোনো রাজবাড়ি, আলোয় আলোয় ঝলমল করছে রাজবাড়ির চারদিক। হঠাৎ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি এই তো! এই তো সেই চা বাগানের মহিলা। উনি এখানে কি করছেন? চমকে উঠলাম আমি। তারপর হঠাৎ দরজার দিকে চোখ ফিরতেই বুঝলাম এখনও চমক বাকি আছে! এ তো আমি নিজেই, সেই দিনের স্বপ্নের মতোন আজকেও সেই দৃশ্য! কয়েকজন প্রহরী আমাকে দাসীর মতোন টানতে টানতে নিয়ে আসছে, আহ্! গলায় কি অসহ্য যন্ত্রণা করছে, মনে হচ্ছে যেনো আমি ওই দাসীর মধ্যেই বিলীন হয়ে গেছি। আর ওই মহিলাটি রাজার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছেন। কি নিষ্ঠুর সেই হাসি! যেনো কত জন্মের শত্রু আমি! চিৎকার করতে গেলাম কিন্তু পারছি না, মনে হচ্ছে আমাকেও কেউ বেঁধে রেখেছে। তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। 


সকালে উঠে দেখলাম সেই পুরোনো রাজবাড়ির সেই ঘরটাতেই আছি যেখানে কাল রাতে ঘুমিয়েছিলাম, তাহলে পুরোটাই কি আমার স্বপ্ন? যাই হোক মাথাটা তখনও যন্ত্রণাতে ছিঁড়ে যাচ্ছে। 

যাই হোক আর একটা দিন থেকে দেখা যাক কি হয়… 


সকাল টা কোনো রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যে হতে না হতেই ঘুমিয়ে পড়লাম, যাতে রাতে জেগে থেকে মনের অনুসন্ধিৎসা দূর করতে পারি, ভীষণ ভয় লাগছিলো কিন্তু তবুও শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। 


অনেক রাতে ঘুম ভাঙল একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদে, ঘুম ভাঙতেই দেখি আমি একটা বিশাল ঘরের মধ্যে আছি। মনে হলো শব্দটা কাছ থেকেই আসছে। উঠে গিয়ে দেখলাম, শব্দটা আসছে রাজবাড়ির বিচারসভা থেকে। দেখলাম - সেটা আমিই ছিলাম, যে এই শব্দটা করছিলাম। আমি মানে তো আর এখনকার আধুনিক সেই আমি নই, এ হলো সেই দাসী আমি। হঠাৎ করেই মনে হলো আমি নিজের মধ্যে নেই, আমি হলাম সেই দাসী। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সাদা কুর্তি পরে আমার অবয়ব টাও আছে। কিন্তু তাতে যেনো প্রাণ নেই। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শুধু, এটা বুঝতে পারছিলাম আমার ভীষণ যন্ত্রণা করছে ঘাড়ে, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। তারপর অন্য সব দাসীর সঙ্গে আমাকেও দাসী মহলে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু রাজবাড়ির লোকেদের অত্যাচার বিশেষত চা বাগানে দেখা সেই মহিলার আদেশ, আমি সহ্য করতে না পেরে একদিন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এ কি করে সম্ভব? কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছিলাম না আর তারপর… 


                  … 

যন্ত্রণায় মাথা টা ছিঁড়ে যাচ্ছে, ভোরের আলো আস্তে আস্তে ফুটে উঠেছে। চোখ মেলতেই দেখলাম যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, শুধু ভীষণ মাথা ব্যথা করছে। যখন মাথা ব্যথা কিছুটা কমলো, বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ ঘুরতে ঘুরতে একটা চা দোকান দেখলাম, চা দোকানীকে এ ব্যাপারে বলতেই ওই রাজবাড়ির ইতিহাস জানতে পারলাম…


নিজের মত করেই বলছি… 

সালটা ১৫২১…

একপ্রকার দুঃখ কে সহায় করে জন্মেছিলাম আমি বিলাসপুর গ্রামের এক ছোট্ট কুঁড়েঘরে। জন্মের পরেই আমার নাম রাখা হয় যর্সিনী। ছেলেবেলা খুব একটা আনন্দে অতিবাহিত না করতে পারলেও অভাব কাকে বলে তা জানতাম না। নেহাত কম বয়স আর শিক্ষা না পাওয়ার কারণেই বোধ হয় জানতাম না অভাব কী? 


ছোটো থেকেই বাড়ির মোটামুটি সব কাজেই পটু ছিলাম আমি আর বেশ মিশুকে হওয়ার জন্য গ্রামের সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলাম আমি। 

তবে যেই দেখত সে বলতো-"যার এমন রূপ, গুন সে কিনা জন্মালো এক হতদরিদ্রের গৃহে। আরে তোর তো রাজার ঘরে জন্মানো উচিত ছিলো। তাও বা হলি নামের একি দশা?" 

আমি শুধুই চুপ করে তাদের কথা শুনতাম আর মনে মনে খুব হাসতাম। 

তিল তিল করে সকলের সামনে সুখ, দুঃখ নিয়ে বেড়ে উঠলাম আমি। বড় হতেই আস্তে আস্তে বুঝলাম অভাব কাকে বলে? 

আমার যখন ১৪ বছর বয়স রাজার পাইক এসে কিনে নিয়ে গেলো আমাকে, বাবা মায়ের করুণ আর্তনাদ উপেক্ষা করে, অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমি কিন্তু কোনো কথা শোনেনি ওরা। রাজার দাসী মহলের প্রধান ছিলেন রাজার মা, করমাবাঈ,ডান চোখের নিচে একটা কাটা দাগ ছিলো যা ওনার মানসিকতার সাক্ষর। তিনি ভীষণ জেদী, রাগী প্রকৃতির ছিলেন। তার বাক্যের বাণ বর্ষণে যে কেউ নিজ মৃত্যু কামনা করতে বাধ্য তার অধীনে থাকার চেয়ে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো, সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলাম আমি। সে মৃত্যু ছিলো এক মর্মান্তিক মৃত্যু! আমার অতৃপ্ত আত্মা সেদিন থেকেই আছে ওখানে। শোধ আমিও তুলেছিলাম…রাজবাড়ির সকলের ওপর। তবুও রয়ে গেছিলাম… বোধ হয় সত্যি টুকু জানানোর জন্য। রাজবাড়ির কোনায় কোনায় জমে থাকা ধুলো বালি সব কিছুর মাঝে রয়ে গেছিলাম এক বেদনাদায়ক চুপকথা হিসেবে, যার কলঙ্ক বহন করেছিলো এই রাজবাড়ি, বছরের পর বছর। 

তারপর সেই রাজবাড়ি ভেঙে আবার নতুন করে চায়ের কারখানা তৈরী করা হয়েছিল বোধ হয়। আমি সেখান থেকে চলে এসেছিলাম তারপর, কিন্তু সেই ইতিহাস গেঁথে গিয়েছিলো আমার মর্মে মর্মে… আজও মনে পড়লেই মৃদু স্বরে নিজের মনেই বলে ফেলি - "হ্যাঁ, আমিই সেই চুপকথা!একটা ভাঙা ইতিহাসের অংশ আমি নিজেই। " 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy