আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
সপ্তষষ্টিতম অধ্যায়
শিউলিদের বাড়ীটা তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ । সমরেশের ইনফরমেশন অনুযায়ী পুলিশ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসাবে ওদের বাড়ী ঘিরে রেখেছে । একদল পুলিশ হুড়মুড় করে ঢুকে গেল অন্দর মহলে । হাতের সামনে যাকে পেল পেটাতে শুরু করল । ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি কাউকেই রেয়াত করল না ।
অবশেষে শিকার না পেয়ে ওরা যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল । সঙ্গে তুলে নিয়ে গেল সমরেশকেও । বেচারা সমরেশ! লোভের বশে যা' করে ফেলল তার উপযুক্ত ইনামই পেল। হাড়গোড় ভাঙা মার আর ইনফর্মারের পদটিও খোয়া গেল ।
শিউলি আমাকে ফোন করে ঘটনার বিবরণ দিল এবং পুলিশের এই অযথা হয়রানি এবং সম্মানহানি বিষয়ে কি করণীয় জানতে চাইল । আমি বললাম - থানায় যেয়ে তো কোন লাভ হবে না । তবু নিকটবর্তী থানায় যেয়ে অভিযোগ দায়ের করে আসতে বললাম ।
বড়দা বলল - কিছু হবে না । সঙ্গে একজন আইনজ্ঞকে নিতে হবে । তবে যদি পুলিশ ডায়েরী নেয় । নিলেও যে কোন একশন নেবে বলে মনে হয় না । তবু যদি জি ডি নাম্বার পাওয়া যায় তবে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে । না নিলে ওই উকিলকে দিয়ে আদালতে কেস ফাইল করে দিতে হবে ।
শিউলি সব শুনে বলল - আমাদের ভীষণ ভয় করছে স্যার । বাবার বয়স পঁয়ষট্টি প্লাস তবু পুলিশ ওঁকে মেরেছে । আমরাও বাদ যাইনি । একবার যদি আসতে পারতেন বুকে বল পেতাম ।
বড়দা বললেন - আচ্ছা দেখছি । কোন ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যাবে ?
- স্যার, আমাদের বাড়ীতে তো সিসিটিভি নেই । তবে রাসতায় যে সিসিটিভি লাগানো আছে তার অভিমুখ আমাদের বাড়ীর দিকেই আছে। সেখান থেকে যদি কিছু পাওয়া যায় !
বড়দা বললেন - তোমরা এখনই উকিল নিয়ে থানায় যাও । যেয়ে জিজ্ঞেস করবে কি কারণে পুলিশ এই হঠকারিতা করল । আমরা তো দুমকায় আছি; যেতে সময় লাগবে, তার আগেই যেন এই কাজগুলো করে নিও ।
বড়দা মিঃ সন্তু মুখার্জীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন । তাঁকে ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়ে বললেন - সাহেব, এগুলো কি হচ্ছে ? দেশে কি আইনকানুন নেই ? এখন তো রাষ্ট্রপতি শাসন চলছে মানে কেন্দ্রীয় আইন বলবত আছে। তা' সত্বেও সাধারণ ছাপোষা মানুষ কেন পুলিশের অত্যাচার সহ্য করবে ।
সন্তু মুখার্জী বললেন - বি কাম মিঃ রায়চৌধুরী! লেট মি নো ফার্স্ট হোয়াই পুলিশ ওয়েন্ট দেয়ার ? আমি ঘটনার খবর নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি ।
- আপনি সংশ্লিষ্ট থানাকে বলে দিন অত্যাচারিত পরিবারটি থানায় ডায়েরী করতে যাচ্ছে ; পুলিশ যেন সঠিক ভাবে ডায়েরী লিখে নেয় । আমি আগামীকাল কলকাতায় যাচ্ছি; গভর্ণরের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সাক্ষাৎ করব । তারপর দেখি কি করতে পারি ।
মিঃ মুখার্জী উৎসব রায়চৌধুরীকে ভালোমত চেনেন । প্রয়োজনে তিনি যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দরবার করতে পারেন সেই ক্ষমতা তাঁর আছে ।
বললেন - আসুন অবশ্যই ; আমারও আপনার সঙ্গে কিছু আলোচনা আছে । খবর পেয়েছেন নিশ্চয় মিঃ ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত ভোটে দাঁড়িয়েছেন! আর বীরেশ্বর রক্ষিতও দলীয় মুখপাত্র নির্বাচিত হয়েছেন । এ' ভাবে রং বদলে দুষ্কৃতীরা যদি শাসন ক্ষমতা ধরে নেয় তবে পুলিশ তো হাতের পুতুল হতে বাধ্য । মিঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্যও ভীষণ আক্ষেপ করছিলেন ।
বড়দা বললেন - রক্ষিত ব্রাদার্স যতই ক্ষমতা ধরুন না কেন ; আদতে তাঁরা অপরাধী । আর সেই অপরাধ প্রমাণ করার দায়িত্ব এবং সংকল্প আমাদের - আপনার, আমার এবং পরমেশ্বর সাহেবেরও । আসুন আমরা জোট বেঁধে এই দুষ্কৃতীরাজের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই শুরু করি ।
মিঃ মুখার্জী খুবই উৎহাহিত বোধ করলেন। বললেন - আমি মিঃ ভট্টাচার্য্যকে আপনার পরামর্শের কথা জানাচ্ছি । আশা করি তিনি সম্মত হবেনই ।
বড়দা ' ধন্যবাদ ' বলে তখনকার মত ফোন রেখে আমাকে বললেন - আজই আমাকে কলকাতা যেতে হবে । তোরা আমার যাবার বন্দোবস্ত করে দে ।
আমি বললাম - আমিও যাব আপনার সঙ্গে । কারণ শিউলি রায় আমাকে দেখলে ভরসা পাবে ।
বড়দা বললেন - ঠিক আছে । চল তবে ।
শহীদ মিনারের পাদদেশে সব রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ চলছে । আজ এ' দল তো আগামীকাল সেই দল চাঁচাছোলা ভাষায় নিজেদের বক্তব্য পরিবেশন করছে । ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে শুরু করে চরিত্রহনন ইত্যাদি চলছে। রাজ্যের উন্নয়নের বিষয়ে কারও বক্তব্যে তেমন ধার নেই ।
এজেণ্ডার কপি বিতরণ করা ছাড়া বক্তব্যে তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে না । অথচ জনসমাবেশের একটা বিশাল প্রতিযোগীতা চলছে রোজই । কোন দল বলছে সমাবেশে পাঁচ লক্ষ লোক হয়েছে, কেউ বলছে সাত ছাড়িয়ে গেছে তো কেউ বলছে অন্তত পনের লাখ লোক এনে দেখিয়ে দিয়েছি । এই হল নির্বাচনী নির্ঘন্ট । কেন্দ্রের শাসকদল তো বলেই দিয়েছে ক্ষমতায় এলেই রাজ্য সরকারী কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় বেতন আয়োগের অধীনে নিয়ে আসবে ।
এমতাবস্থায় আমি এবং বড়দা দুমকা থেকে গাড়ি করে কলকাতায় এলাম । উঠলাম শিয়ালদার সেই পরিচিত মেসে । গভর্ণরের সঙ্গে এপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেছে। বিকেল সাড়ে চারটায় দশ মিনিটের জন্য । দশ মিনিটে কি কি কথা বলা যাবে তার তালিকা বড়দা তৈরি করে রেখেছেন ।
তার আগে আমাকে বললেন - চল মিঃ মুখার্জীর সঙ্গে আলোচনা করে আসি । মিঃ ভট্টাচার্য্যও আসছেন । মিঃ মুখার্জী এবং ভট্টাচার্য্য সাহেব এখন লালবাজারে উঁচু পদে রয়েছেন। আমার তো দারুন এক্সাইটমেন্ট হচ্ছে । কারণ দেখছি বড়দা এখন সব জায়গায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন ।
আমার শখের গোয়েন্দাগিরি করবার সাধ পূর্ণ হতে চলেছে বলে বড়দার উপর শ্রদ্ধা ভক্তি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বড়দা বললেন - রেডি হয়ে নে । রাজভবনে পৌঁছানোর আগে আমাদের লালবাজারে যেতে হবে ।
আমি বললাম - লালবাজারে কেন ?
- গেলেই বুঝতে পারবি । নে আর বেশী কথা না বলে তৈরী হয়ে নে । পনের মিনিট সময় দিলাম ।
পনের মিনিটের মধ্যে রেডি হতে হবে ; অথচ এখনও স্নান খাওয়া হয়নি । বললাম - স্নান করে নিই ?
- ও বাবা ! এখনও তোর স্নান হয়নি ? তবে থাক, তোকে আর যেতে হবে না ।
অনুনয় বিনয় করে বললাম - পনের মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে যাচ্ছি ।
- ওকে । কিন্তু অলরেডি দু'মিনিট ওভার । যা ।
সময় ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে । কোনমতে স্নান সেরে জামা প্যান্ট পরে বেরিয়ে দেখি বড়দা পায়চারি করছেন ।
আমাকে দেখে বললেন - চল চল , বেরিয়ে পড়ি । ওখানেই লাঞ্চ সেরে নেব ।
যাক খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে ভেবে অনেকটা তৃপ্তি পেলাম । একটা হলুদ ট্যাক্সি নিয়ে লালবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
রাইটার্স পেরিয়ে দেখি মিঃ মুখার্জী এবং মিঃ ভট্টাচার্য্য দু'জনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন । গাড়ি এসে থামল তাঁদের সম্মুখে । বড়দা নেমে দু'জনের সঙ্গে করমর্দন করলেন । আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম । এটাকে নাকি প্রোটোকল বলে ।
মিঃ ভট্টাচার্য্য বললেন - মিঃ রায়চৌধুরী! বীরেশ্বর রক্ষিতকে তো আইনের মধ্যেই ধরতে পারব । কিন্তু ত্রিলোকেশ্বর রক্ষিত যিনি সবকিছুর নায়ক তিনি তো এখন ভোটপ্রার্থী ; সুতরাং তাঁর ব্যাপারে আপনাকে কিন্তু গভর্ণরের পারমিশন আদায় করে নিতে হবে ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - আমরা আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করব । কিন্তু পারমিশন না পেলে ওঁকে ধরা যাবে না । বর্তমানে তিনি যেহেতু একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ।
বড়দা বললেন - আরে রাখুন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কথা । উনি আগে অপরাধী তারপর রাজনীতিক । আর রাজনীতির তিনি বোঝেনটা কি ? ওঁর চেয়ে আমি ভালো বুঝি ।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে আমরা সময়ের অপেক্ষায় রইলাম । তাঁর মধ্যেই রক্ষিত পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বড়দা ওঁদের সামনে তুলে ধরলেন ।
মিঃ মুখার্জী বললেন - মুর্তজার খুনীর খুনীকে আমি সনাক্ত করতে পেরেছি । তার প্রমাণ স্বরূপ এই ভিডিওটা আমার হাতে এসেছে । শুনেছি বীরেশ্বরের ড্রাইভার হাজি মস্তানকে দুমকা পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে । ওর কাছ থেকেই ভিডিওটা পাওয়া গেছে ।
বড়দা আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলেন কিন্তু এ বিষয়ে কোন কথা বললেন না।
( চলবে )

