আগুন
আগুন
সন্ধ্যা থেকেই বেশ অনেকক্ষণ এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েছে, ঠান্ডার রেশ, চন্দ্রানী ফায়ারপ্লেসে শুকনো লাকড়িগুলো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে একটি বই নিয়ে বসে পরলো। কত্তদিন ধরে বইটা পড়ে শেষ করে উঠতে পারছে না, আজ বইটা শেষ করে ওঠারই ইচ্ছা।
রাত তখন ৯ টা বাজছিল প্রায়, হঠাৎ ডোরবেল বেজে উঠতেই একটু অবাক হয়ে ওঠে চন্দ্রানী... মনেমনে ভাবতে থাকে এই সময়ে আবার কে এলো! একরাশ কৌতূহল নিয়ে দরজা খুলতেই দেখে সামনে দাড়িয়ে অরুণ। মনেমনে প্রমাদ গুনলো চন্দ্রানী, এই সময়ে চন্দ্রানীর স্বামীর বন্ধু অরুণ এখানে? কি মনে করে?
চন্দ্রানীর প্রতি এক কুটিল হাসি দিয়ে ভেতরে আসার আগ্রহ প্রকাশ করাতে সামান্য অভিবাদন টুকু সেরে চন্দ্রানী ভেতরে এসে বসতে বললো অরুণকে। তার এইকথা ঐকথা আর কুশল সংবাদ জানার এত আকুলতা একটু বেমানানই লাগলো চন্দ্রানীর কাছে।
চন্দ্রানী সরাসরিই জিজ্ঞেস করে বসলো যে, "এখানে হঠাৎ কি মনে করে অরুণ বাবু?"
অরুণ মুচকি হেসে একটা সিগারেট ধরালো, দু একবার সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বলতে লাগলো, "কেন বিনা প্রয়োজনে আসতে পারি না বুঝি? আফটার অল এটা আমার বন্ধুর বাড়ি।"
চন্দ্রানীর বড্ড অস্বস্তি লাগছিল অরুনের হেঁয়ালিগুলো। ঘরময় গুমোট পরিবেশ, সিগারেটের ধোঁয়ায় আরো অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি।
অরুণের কথার পরিপ্রেক্ষিতে চন্দ্রানী বলে, "কিন্তু আপনি জানেন অরুণ বাবু যে গৌতম অফিসের কাজে আউট অফ স্টেশন, আর এখন..."
চন্দ্রানীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই অরুণ বলে উঠে, "সে আমি জানি, আর জানি বলেই তো এলাম। মাসের ৮-১০ দিনই তো কাজের জন্যে গৌতমকে বাইরে থাকতে হয়, একা থাকতে ভয় করে না বুঝি আপনার? গৌতমের মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি কিছু আছে নাকি?" বলতে বলতে অরুণ চন্দ্রানীর পাশের কাউচটিতে এসে বসে।
চন্দ্রানী একদম চুপ, শুধু অরুণের গতিবিধি লক্ষ্য করছে দাঁতে দাঁত চেপে।
পাশের কাউচটায় বসে খুব ধীরে ধীরে বলা শুরু করে অরুণ, "আমি জানি চন্দ্রানী একা থাকতে যে তোমার বড় ভয় হয়, নতুন নতুন বিয়ে হয়ে এসেছ, আর গৌতম তোমার মত সুন্দরীকে ছেড়ে কাজ পাগলা হয়ে থাকে, সেটা কি আর আমি বুঝি না? তাই তো চলে এলাম। একটু গল্প হবে, একটু আড্ডা...."
চন্দ্রানী শিউরে উঠে, লোকটা আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলো। প্রচণ্ড ক্রোধিত কন্ঠে সে বলে, "আপনি ভুল জানেন অরুণ বাবু, আমার কোনো অসুবিধে হয় না একা থাকতে, আমার মনে হয় আপনার এখন বিদায় নেওয়া উচিৎ।"
"চলে তো যাবই, দু দণ্ড তোমার সাথে বসলে কি এমন আপত্তি?" বলতে বলতে আবার সেই কুটিল হাসি আর কুটিল চাউনী...
চন্দ্রানীর ঘেন্না লাগছিল অরুনের পাশে বসে থাকতে, ধীর পায়ে উঠে গিয়ে জ্বলন্ত ফায়ারপ্লেসটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় চন্দ্রানী।
অরুণ সিগারেটে সুখ টান দিতে দিতে আবার শুরু করলো, "তোমার মনদশা কি আমি বুঝি না ভেবেছ? একা একা থাকা যে বড়ই যন্ত্রণার। তোমার যখনি মনে হবে তুমি একা আছো, একবার বলবে শুধু, আমি এসে পড়বো চন্দ্রানী তোমার কাছে, যদিও আমারও ঘর পরিবার আছে, কিন্তু তুমি তাদেরও উর্দ্ধে, তোমার এক ডাকেই আমি এসে পড়বো, তোমারও তো চাহিদা বলে কিছু আছে তাই না?" বলতে বলতে অরুণ খুব কাছে এসে দাঁড়ায় চন্দ্রানীর, ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছিল অরুণ। চন্দ্রানী আড়চোখে দেখতে পায় অরুণের হাত তাকে ছোঁয়ার জন্যে নিশপিশ করছে যেন।
চোয়াল শক্ত করে চন্দ্রানী, চোখে যেন আগুন জ্বলছিল তার। ফায়ারপ্লেস থেকে সহসা একটি জ্বলন্ত লাকড়ি উঠিয়ে অরুণের মুখের সামনে ধরতেই হকচকিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলো অরুণ। এবার চন্দ্রনীর পালা পাল্টা জবাব দেওয়ার "ইতর, জংলী, অভদ্র। আপনাদের মত মানুষরূপী পশুগুলোকে শায়েস্তা কি করে করতে হয়, তা ভালো করেই জানি আমি, বেরিয়ে যান এখুনি নয়তো শেষ রক্ষা হবে না আর।"
ধু ধু করা আগুনের লেলিহান শিখার মশাল হাতে চন্দ্রানী রূদ্ররূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে অরুণের মুখের সামনে। সইতে পারে না অরুণ এই তেজ, আগুন দেখলে পশুরা যেমনটি ভয়ে পালিয়ে যায় এখানেও অরুণ নামক জানোয়ারটি পালিয়েছে, ভয়ে....