STORYMIRROR

arijit bhattacharya

Abstract

5.0  

arijit bhattacharya

Abstract

আদিপরাশক্তি

আদিপরাশক্তি

19 mins
1.4K


"দেখুন দাদা,আপনারা এই অঞ্চলে নতুন। বলি কি দাদা,জায়গাটা দেখতে যতোটাই সুন্দর-সুদৃশ্য লাগুক না কেন,জায়গাটা খুব একটা ভালো নয়। কাছাকাছিই অরণ্যের কোনো গহন স্থানে পঞ্চমুণ্ডির আসন অধিষ্টিত রয়েছে। একসময় তো শবসাধনাও হোত। তাই বলি কি,সূর্যের আলো পড়ে আসার পর আর পারতপক্ষে বাইরে বেরোবেন না। আর পশ্চিমের জঙ্গল তো কথাই নেই। যতোই দূরে সুন্দর পাহাড় থাক,ওর ধারেকাছেও যাবেন না। ওখানেই আছে সেই ভাঙা অভিশপ্ত মন্দির।" এতক্ষণ একটানা কথা বলে থামলেন প্রমিতবাবু। "আপনি জানেন,আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি। শহরের কৃত্রিমতা,জনকোলাহল আর ব্যস্ততা থেকে দূরে এরকম একটা সুদৃশ্য মনোরম নির্জন স্থান, আমার মতো উঠতি কবির জন্য প্রচুর উৎকৃষ্ট,নতুন প্রেমিককুলের নতুন প্রেমকাহিনী রচনা করার এক আদর্শ স্থান,আর সেখানে আপনি কিনা আমাদের ভূতের ভয় দেখাচ্ছেন!" প্রথম দিকে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেও রক্তিমের এরকম সপাট জবাবে হেসে ফেলল ঐন্দ্রিলা। 

ঐন্দ্রিলা রক্তিমের সদ্যপরিণীতা স্ত্রী। আগের বছরই রক্তিমের সাথে তার পরিচয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই পরিচয় ধীরে ধীরে প্রগাঢ় হতে হতে পরিণতি পায় পরিণয়ে। রক্তিম পেশায় এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার,এ ছাড়াও রক্তিমের এক পরিচয় আছে। সে একজন কবি,প্রেমের কবিতা লিখতে ভালোবাসে। কবিতাই বলতে গেলে ওর প্যাশন।ঐন্দ্রিলা প্রথম থেকেই রক্তিমের কবিতার বর্ণনা,তার কবিতার ভাব আর তার ছন্দমাধুর্যের একজন বড়ো ফ্যান।এখন হয়তো পরিণীতা অর্ধাঙ্গিনী,কিন্তু সেই ক্রেজিনেস একই রকম ভাবে থেকে গেছে।

 যাই হোক,রক্তিম বিয়ের পর হানিমুন করার জন্য বেছে নিয়েছে বাঙালীর প্রিয় ঘাটশিলার কাছেই ধূসর পাহাড় আর শালবনে ঘেরা রোম্যান্টিক ও আধিভৌতিক স্থান ধলভূমগড়। হাওড়া থেকে ভোরের ইস্পাত এক্সপ্রেসে ঘাটশিলা আর সেখান থেকে এই ধলভূমগড়। স্টেশান থেকে দু'কিলোমিটার দূরত্বেই সবুজ অরণ্যের মধ্যে পাহাড়ের কোলে ধলভূমগড়ের বনবীথি ফরেস্ট গেস্ট হাউস। কোলকাতার আড়াইশো কিলোমিটারের মধ্যেই,অথচ রক্তিমের মনে হচ্ছে,সে আর ঐন্দ্রিলা সভ্য জগৎ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে কোনো রূপকথার দেশে চলে এসেছে।

এখানেই নাকি শাল সেগুন মহুয়ার অরণ্যের গভীরে কোথাও আছে রঙ্কিণীদেবীর এক অতি প্রাচীন ধ্বংসপ্রায় মন্দির। বনবীথি রেস্টহাউসের ম্যানেজার কাম কেয়ারটেকার প্রমিতবাবুর কথায় যে মন্দির আর মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল অভিশপ্ত।

ঘাটশিলা বলতেই ভ্রমণপিপাসু বাঙালীর কাছে ভ্রমণের প্রিয় স্থান। ঘাটশিলা মানেই তিরতির করে বয়ে চলা উদ্ভিন্নযৌবনা সুবর্ণরেখা,দিগন্তে ধূসর ফুলডুঙরি পাহাড়শ্রেণী,সবুজ শালবনের মধ্যে পাহাড়ি ঝরণা আর রঙ্কিণী মন্দির। শিল্পনগরী জামশেদপুর আর রাকা মাইনস খুব কাছেই। বিভূতিভূষণ জীবনের এক বড়ো অংশ কাটিয়েছেন এই পূর্ব সিংভূমে। এখানে তাঁর বাড়িও রয়েছে,বলা বাহুল্য পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা এই সিংভূমেই হয়েছিল তাঁর কিছু আদিভৌতিক অভিজ্ঞতা।যাই হোক,এ ছাড়াও ঘাটশিলার ইতিহাসও রোমাঞ্চকর। ঘাটশিলার ইতিহাস জানতে হলে আমাদের পাড়ি দিতে হবে সুদূর রাজপুতানায়। রাজস্থানের মাণ্ডু ও ধার অঞ্চলের রাজপুতেরা তাদের অঞ্চলে মুসলিম অনুপ্রবেশ করলে শাসনকার্য চালাবার জন্য এক নিরাপদ স্থান অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করেন। আর সেই নিরাপদ স্থান অনুসন্ধান করতেই করতেই তাঁরা চলে আসেন সাঁওতাল ও মুণ্ডা অধ্যুষিত এই পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা সিংভূমের জঙ্গলমহলে। তাদের প্রবল পরাক্রমী নৃপতি জগৎ দেব এখানে এসে প্রসিদ্ধ হন জগন্নাথ ধল নামে। আর এই শাল সেগুনের অরণ্যের মধ্যে তাদের গড় ছিল বলে অঞ্চলটার নাম হল ধলভূমগড়।

যাই হোক, রাজা জগন্নাথই সেই ব্যক্তি যিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে গালুডির কাছে যদুগোডায় নির্মাণ করেন রঙ্কিনী দেবীর মন্দির।প্রথম দিকে দেবীর পূজাপ্রক্রিয়া সেখানেই সম্পন্ন হত। পরে কোনো কারণবশতঃ ঘাটশিলার কাছেই তিনি নির্মাণ করেন রঙ্কিনী মায়ের মন্দির এবং সেটাই মূল মন্দিরের মর্যাদা পায়। ঘাটশিলা যেহেতু তখন তাদের শাসনকেন্দ্র ছিল। যদুগোডার টাও থেকে যায়। এই গেল ইতিহাস!

রঙ্কিণী মাতা ছিলেন রাজপুতানা থেকে আসা রাজপুতদের প্রধান আরাধ্যা দেবী।এছাড়া,তখন রাজপুত সংস্কৃতি সর্বপ্রথমবারের জন্য জঙ্গলমহল ও তদসংলগ্ন অঞ্চলের আদিবাসী সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন।এই মুণ্ডা উপজাতির আদিবাসীরাই প্রোটো অস্ট্রালয়েড শ্রেণীর মানুষ যারা আগে পরিচিত ছিল অসুর রূপে।এখনোও তারা কেউ কেউ নিজেদের অসুরের বংশধর বলে মনে করে।

যাই হোক,এর ফলে রঙ্কিনী দেবীর চরিত্রেও আসে কিছু পরিবর্তন। বরাভয়প্রদানকারী মাতার প্রসাদের স্থান নেয় রক্ত। মাকে তুষ্ট করার জন্য ছাগবলি এমনকি নরবলি হয়ে ওঠে এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কিন্তু,মা কি কখনোও সন্তানের রক্তে পরিতৃপ্ত হন! স্রষ্টা কখনোই চান না সৃষ্টিকে এভাবে ধ্বংস করা হোক।


যাই হোক,আশেপাশে ছোটখাটো অনেক রঙ্কিনী মন্দিরই আছে,শাল মহুয়ার গহন অরণ্যের মধ্যে এমন কিছু রঙ্কিনী মন্দির আছে ,যেগুলোর কথা সভ্যসমাজের মানুষ জানে না। রঙ্কিনী মাতা মা কালীরই অপর রূপ। কালক্রমে এই গুপ্ত স্থান গুলোই হয়ে ওঠে কামাখ্যা থেকে আসা কাপালিক তান্ত্রিকদের সাধনক্ষেত্র।নরবলি তো ছিলই,এছাড়া নানা গুপ্ত স্থানে স্থাপিত হয় পঞ্চমুণ্ডীর আসন,মারন উচাটন প্রক্রিয়া ,কর্ণপিশাচিনী সাধনা। এখন বনবীথি গেস্ট হাউসের প্রমিতবাবু যে ভাঙা মন্দিরটার কথা বলছেন,সেটা নাকি ধলভূমগড়ের জঙ্গলের গভীরে অবস্থিত। এই গেস্ট হাউসের পশ্চিম দিকে। ওটাই নাকি ধলভূমগড়ের রাজা জগন্নাথ দেবের প্রথম প্রতিষ্ঠিত মন্দির,গালুডির টা নাকি তার পরে তৈরি।যাই হোক,এখানে নাকি পরে এক কাপালিক তান্ত্রিক এসে আস্তানা গড়ে তোলেন। তন্ত্র উপাচারের জন্য তিনি অমাবস্যার কালো নিশুতি রাতে আশেপাশের আদিবাসী বসতি থেকে ছলে বলে কৌশলে কুমারী মেয়েদের সংগ্রহ করে নাকি বিভিন্ন উপাচার সম্পন্ন করার পর দেবী রঙ্কিনীর কাছে তাকে নরবলি দিতেন। এইভাবে প্রতি অমাবস্যা রাতেই আদিবাসী বসতি থেকে কেউ না কেউ নিখোঁজ হতে থাকে। পরে স্থানীয় মুণ্ডা অধিবাসীরা জানতে পারে,এসব আর কিছুই নয়,কাপালিকের কীর্তি,যিনি এইভাবেই নিজের তমসাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে চাইছেন। কিন্তু সেই কাপালিককে তারা হাতেনাতে ধরার আগেই সবুজ গহন অরণ্যের ভেতর কাপালিক বেমালুম অদৃশ্য হয়ে যান।

এরপরেই শুরু হয় বিপদের ঘনঘটা। আশেপাশের আদিবাসী বসতিতে শুরু হয় অশান্তি,দেখা যায় মারণরোগ।আসলে রঙ্কিনী দেবীর ঐ মন্দিরের খুব কাছেই ক্রূর কাপালিক স্থাপন করেছিলেন মহা ভয়ঙ্কর পঞ্চমুণ্ডির আসন। মুণ্ডা চাঁড়াল,গোখরো সাপ,ক্ষিপ্র বেজী ,ধূর্ত শিয়াল আর ব্রহ্মজ্ঞানী হনুমানের কাটা মাথা দিয়ে স্থাপিত করতে হয়েছিল সেই আসনকে। তারপর তাকে ঘৃত ও দধি দ্বারা পরিশুদ্ধ করার পর মন্ত্রের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলেছিলেন সেই আসনকে নিজের তামসিক ক্রিয়ার জন্য। প্রতি অমাবস্যার রাতে তার আগমন হত,পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে নির্জন রাতের নিশুতি আঁধারে তিনি সম্পন্ন করতেন নানা তান্ত্রিক ক্রিয়া। জঙ্গলের গভীরে খুঁজে পাওয়া যেত আদিবাসীদের অর্ধভুক্ত মৃতদেহ, রাতের আঁধারে ঐ আদিবাসী বসতিতে ঘুরে বেড়াত কিছু বিকটাকার কালো ছায়া। জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসত অজানা পশুর হাড় হিম করা অপার্থিব হিংস্র গর্জন। ভয়ে কাঁপতে শুরু করে আদিবাসীরা। এরপর সর্বসমক্ষে উপস্থিত হন কাপালিক। আদিবাসী মোড়লের কাছে গিয়ে দাবি করেন যে তিনি মা রঙ্কিনীর আশীর্বাদপ্রাপ্ত। সুতরাং,তাকে তুষ্ট না করতে পারলে স্বয়ং বোঙাবাবাও তাদের কাপালিক তান্ত্রিকের কোপ থেকে রক্ষা করতে পারবেন না।আর মাও তাঁকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন,তিনি অসুরের রক্তেই তুষ্ট হবেন। তাই তাঁর আবির্ভাব এই জঙ্গলমহলে। বাধ্য হয়েই মোড়লকে রাজি হতে হয়,যে তিনি তাঁর কাবিলা থেকে প্রতি অমাবস্যায় একজন কুমারী মেয়েকে ভেট হিসাবে পাঠাবেন। কিন্তু তান্ত্রিককেও তাঁর তামসিক শক্তির রক্তপিপাসা পরিহার করতে হবে। এরপর প্রতি অমাবস্যার অন্ধকারেই একজন কুমারী মুণ্ডা যুবতী গিয়ে পৌঁছাত তান্ত্রিকের কাছে। আর কাপালিকও বলি সমাধা করে আরোও শক্তিশালী হয়ে উঠতেন। কিন্তু আদিবাসী বসতিতে তামসিক শক্তির তাণ্ডব কিছু কমল না। ততদিনে নাকি তান্ত্রিক একুশদিন টানা ব্রহ্মচর্য পালন করে জাগিয়ে তুলেছেন মহাভয়ঙ্করী কর্ণপিশাচিনীকে। চলতে থাকল পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের ভৌতিক তাণ্ডব। 

"ওং হ্রীং শ্রিং ক্লীম

চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।"

এরপরেই ঘটল সেই চমৎকার। আকস্মিক এক অমাবস্যার রাতে থেমে গেল মৃত্যুলীলা। হয়তো কেউ তামসিক শক্তির প্রভাবে মৃত্যুলীলা শুরু করুক,এটা স্বয়ং মাও চান না। তাই তো ঈশ্বর লাভের জন্য নিজের মনের অহংকার ত্যাগ করতে হয়,ত্যাগ করতে হয় অপরের ক্ষতি করার ইচ্ছা। রক্তে কখনো ঈশ্বরের তৃপ্তি হয় না,ঈশ্বর তুষ্ট হন ছাগ বা ষড়রিপুর বলিতে।তাই তো অকস্মাৎ এক অমাবস্যার অন্ধকারময় রাত্রিতে বজ্রাহত হয়ে মৃত্যু হল বিপথগ্রস্ত কাপালিকের।পরের দিন জঙ্গলে মুণ্ডারা খুঁজে পেল বাজ পুড়ে আঙার হয়ে যাওয়া তার দেহ। থেমে গেল তামসিক তন্ত্রসাধনা।


কিন্তু তাতেও রক্ষা পেল না আদিবাসী বসতি। কাপালিকের প্রেত মুক্তি পাই নি, বিভিন্ন তামসিক শক্তির মাধ্যম যেমন বেতাল,কর্ণপিশাচিনী,হাকিনী এরা হয়ে ওঠে কাপালিকের অভিশপ্ত আত্মার সহচর। আত্মা তো অবিনশ্বর,আর পাপী কাপালিকের মৃত্যু যেহেতু অপঘাতে হয়েছিল,আত্মার মুক্তি পাওয়ার প্রশ্নই নেই। আদিবাসী বসতি মহামারীর কারণে জনশূন্য হয়ে পড়ে।প্রতি অমাবস্যার রাতে জেগে উঠতে থাকে পঞ্চমুণ্ডির আসন,সেই এলাকায় যদি অনভিপ্রেত প্রবেশ কারোর ঘটে তাহলে তার মৃত্যু অনিবার্য। গোটা এলাকাটা হয়ে পড়ে পরিত্যক্ত। বহু বছর কেটে গেছে।এখনো নাকি ঘুরে বেড়ায় সেই অভিশপ্ত প্রেতাত্মা। অমাবস্যার নিকষ আঁধারে যখন ছেয়ে যায় বিশ্বচরাচর,তখন পশ্চিমের পাহাড়তলির দিক থেকে শোনা যায় অস্পষ্ট স্বরে দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ। এখনো নাকি কে বা কারা জাগিয়ে তোলে সেই পঞ্চমুণ্ডির আসনকে,হয় নানা দুর্বোধ্য তন্ত্রক্রিয়া। 

এ সবই প্রমিতবাবুর মুখে শোনা,যদিও ঘটনার সত্যাসত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় রক্তিমের মনে। 


পঞ্চমুণ্ডির আসন।কাপালিক। হ্যাঁ,মনে পড়েছে রক্তিমের। এখন রক্তিম অত্যাধুনিক নিউটাউনের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হলেও তাদের আদিবাড়ি 24 পরগণার মছলন্দপুরের কাছে চণ্ডীপুর গ্রামে। ঘরে ঠাকুরদালান আছে,নিয়মিত সন্ধ্যারতি হয়। বাড়ির পাশেই বাঁশঝাড়,আমগাছ,জামগাছ। গ্রামের পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। ধানক্ষেতে ঘেরা শস্যশ্যামল গ্রাম যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু,পঞ্চাননতলায় বিকালে ছেলেবুড়ো সবাই আড্ডা মারে। সরল পরিশ্রমী গ্রামবাসীদের স্বচ্ছ সুন্দর জীবন,গাছগাছালির শ্যামলিমা ,সন্ধ্যায় ঝিঁঝির ডাক,রাত্রে দাদুর কাছে ভূতের গল্প শোনা। এর মধ্যেই ছোটবেলা কেটেছে রক্তিমের। এই গ্রামেই ষাটবর্ষীয় একজন ছিলেন,যার নাম হারাধন গাঙ্গুলী। রক্তিমরা তো স্নেহের বশে হারুদা বলেই ডাকত। মাথায় টাক,শুকনো চেহারা।ঘন ঘন বিড়ি খান। রক্তিম মা বাবার কাছে শুনেছিল হারুদা একজন তান্ত্রিক। মারণ উচাটন প্রক্রিয়া সব হারুদার নখদর্পণে।কামরূপ কামাখ্যা থেকে দীক্ষা নিয়েছেন।

রক্তিমের দাদুর বন্ধু ছিলেন,রক্তিমের বাবা তো তাঁর হারুকাকাকে যথেষ্ট সম্ভ্রম করে চলত। বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না,যে মানুষটা মন্ত্রসিদ্ধ। শুধু নিজেকে বলে বেড়াতেন আদি পরাশক্তির ভক্ত বলে।

কিন্তু একবার এক ঘটনা ঘটেছিল যা মনে করে রক্তিমের গায়ে কাঁটা দেয়। এই গ্রামের ছেলে গৌতম বান্দ্রায় নামী কোম্পানিতে চাকরি পায়।মাঝে মাঝেই দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসত।

হল কি,একবার গৌতমের প্রমোশন হল। ছুটিতে ঘুরতে এল দেশের বাড়িতে।মনে আনন্দ আর ধরে না।ছোটবেলা থেকেই গৌতম নাস্তিক প্রকৃতির। এই গ্রামেই আছে এক কালীমন্দির। সেখানকার পুরোহিত গণেশ ভট্টাচার্য্য গৌতমকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসেন। যাই হোক,গৌতমের মা বিপাশাদেবী ছেলের জন্য মায়ের কাছে মানত করেছিলেন। আজ মায়ের কাছ থেকে গৌতম শোনে,কালীমায়ের করুণাই উন্নতি এনেছে তার জীবনে। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে গৌতম। মন্দিরে এসে রুদ্রমূর্তিতে গালাগাল দিতে থাকে গণেশবাবুকে। বলে ,যার চালচলন ঠিক নেই,যে শ্মশানে ভূতপ্রেতদের সাথে থাকে,যার নিজের রাগের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই,সে করবে মানুষের জীবনে উন্নতি। নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমের জোরে উন্নতি হয়েছে আমার,এর পেছনে ঐ পাথরের নিষ্প্রাণ মূর্তির কোনো হাত নেই।এইসব অন্ধবিশ্বাসের জন্য আপনাদের আর এই গ্রামের কোনো উন্নতি নেই। আপনারা এখনো যে তিমিরে সেই তিমিরেই আছেন। ক্রোধ এতোটাই মাথায় চড়ে গিয়েছিল যে,নিরীহ গণেশবাবুর গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা হয় না গৌতমের। লোকজন জড়ো হয়ে যায় কালীমন্দিরের সামনে। সেখানে ছিল রক্তিম আর হারুদাও। হারুদা হাত টিপে ফিসফিস স্বরে রক্তিমকে বলে উঠলেন,"অনর্থ হবে,ঘোর অনর্থ হবে। সাতদিনও সময় লাগবে না। মায়ের কোপ তো এর মাথার ওপর ঘুরছে।যেকোনো সময় নেমে আসবে কাল।" এই বলে চুপ করে গেলেন হারুদা,অবাক হয়ে নির্নিমেষ চক্ষে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকল রক্তিম। তাহলে কি বাবা ঠিক কথাই বলেছে,হারুদা কি সত্যিই মানুষের ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। 

এরপর আরো তিন দিন কাটিয়ে মুম্বাইয়ে ফিরে যায় গৌতম। আর এর তিনদিন পর আসে সেই রক্ত জল করা সংবাদ। রাতের বেলা অফিস থেকে ফিরে নিজের ফ্ল্যাটে ঘুমিয়েছিল গৌতম । আর তখনই ঘুমের মধ্যেই কোনো এক অজানা কারণে মৃত্যু হয়েছে তার। মৃত্যুর কারণ রহস্যজনক,তাও গৌতমের মুখচোখে নেমে এসেছিল এক অপূর্ব প্রশান্তি। সে যেন পাড়ি দিয়েছে অভূতপূর্ব প্রশান্তির দেশে।

রক্তিম তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে।যাই হোক,এরপরে হারুদার সাথে রক্তিমের পরিচয় আরোও গভীর হতে থাকে। শনিবার বিকালে হারুদা বাড়ি থাকলেই রক্তিম আর তার বন্ধুরা মিলে হারুদার কাছে গিয়ে ভূতের গল্প শুনত। হারুদার মুখেই রক্তিম শুনেছিল যে,বামাক্ষ্যাপার সাধনপীঠ তারাপীঠে পাঁচ বছর কাটিয়েছেন হারুদা। সেখানে কাছেই গহন অরণ্যের ভেতর এক স্থানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পঞ্চমুণ্ডির আসন,শুরু করেছিলেন শবসাধনা। মহা ভয়ঙ্কর এই পঞ্চমুণ্ডির আসন। পাঁচটা কাটা মাথা লাগে- একটি মাথা ধূর্ত শৃগালের,একটি মাথা ক্রূর গোখরো সাপের,একটি মাথা ক্ষিপ্র বেজীর,একটি মাথা চণ্ডালের আর বাকি মাথাটি ব্রহ্মজ্ঞানী হনুমানের।পঞ্চমুণ্ডির আসন মহা ভয়ঙ্কর,একবার এই আসন জাগ্রত হলেই এর ব্যাসার্ধের মধ্যে মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণী যেই অনভিপ্রেত প্রবেশ করুক না কেন,তার মৃত্যু অনিবার্য। পঞ্চমুণ্ডি আসন লোকালয় বা শ্মশানে করতে নেই,কারণ আশেপাশের কোনো ঘরবাড়ি টিকবে না।রোগব্যাধিতে মরবে সবাই। এর ভয়ঙ্করতার জন্যই সিদ্ধ সাধক ছাড়া এখানে কেউ সাধনা করতে পারে না। হারুদার ঘরে ইলেকট্রিসিটি নেই,হারিকেনের দপদপ করা আলো আঁধারিতে পঞ্চমুণ্ডির কথা শুনতে শুনতে গা ছমছম করে ওঠে রক্তিমের।

এরপরে আবার হারুদার চমৎকারের পরিচয় পায়।রক্তিম তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। গ্রাম বাঙলা। রাতের আঁধার গাঢ় হওয়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাট নির্জন হয়ে যায়,দোকানীরা ঝাঁপ ফেলে দেয়,বাড়ির লোকেরা দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়।বাঁশবনকে অন্ধকারে ভৌতিক বলে মনে হয়,বাওড়ে জ্বলে ওঠে আলেয়া,অদ্ভুত স্বরে ডেকে ওঠে রাতজাগা পাখি। সব মিলিয়ে এক আদিভৌতিক পরিবেশ। গা ছমছম করে ওঠে।

পাড়ার সম্ভ্রান্ত লোক অমিত রায় চৌধুরী। হঠাৎই খবর আসে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সৌমেন রায় চৌধুরী হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। দেশবিদেশের নামী চিকিৎসকদের দেখিয়েও কাজ হয় নি। অমিতবাবু হার মানবার পাত্র নন,তিনি কামরূপ থেকে নিয়ে আসলেন এক সিদ্ধ তান্ত্রিককে। যিনি ফিরিয়ে দিতে পারেন সৌমেনের জীবন। যাই হোক,সেই ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক শুরু করলেন পিশাচ সাধনা। গ্রামে প্রথম বারের জন্য দেখা গেল নিশিডাকের উপদ্রব।রাত তখন গভীর। সারা গ্রাম ঘুমে আচ্ছন্ন। যাকে শিকার হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে,যে ভক্ষ্য,তার বাড়ির বা আত্মীয় কারোর পরিচিত স্বরে পরপর তিনবার তাকে ডাকবে প্রেত।

সেই কুহকিনী ডাকে কেউ সাড়া দিয়েছে কি মরেছে। তিনবারই ডাকবে,তার বেশি নয়। কিন্তু সেই ডাকে সাড়া দিলেই মৃত্যু অনিবার্য। আর সৌমেনের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে জীবনীশক্তি। গোটা গ্রাম কাঁপছে,নিশির ডাকে তিনজনের মৃত্যু ঘটেছে।

গভীর রাত। আর সেদিন অমাবস্যা। বাইরের ঘরে পড়ায় ব্যস্ত রক্তিম। কিছুদিন পরেই মাধ্যমিক। হঠাৎই জানলার বাইরে শুনতে পেল,"বাবা রক্তিম ,এদিকে আয় তো।" আরে,এ তো মায়ের গলা। কিন্তু রাত বারোটা বেজে গেছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে,মা বাইরে কি করছে! নিশিডাকের ঘটনা নিয়ে মোটামুটি অবগত আছে রক্তিম আর হারুদাও তাকে সাবধান করে দিয়েছে।আবার মায়ের গলা,"রক্তিম একটু জানলাটা খোল। তোকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলবার আছে।জানলাটা তো খোল!" কিন্তু মা তো ভেতরের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তবে বাইরে এ কে, যে হুবহু তার মায়ের গলা নকল করছে। অনেক সময় কৌতুহল মনের ভয়কেও কাটিয়ে তোলে। একরাশ কৌতুহল নিয়ে জানলা খুলল রক্তিম,আর সেই সাথেই দেখতে পেল প্রেতের কঙ্কালসার মুখমণ্ডলের অঙ্গারের মতো জ্বলন্ত চোখজোড়া। তবে কি সেও নিশিডাকের শিকার,তারও কি আয়ু শেষ হতে চলেছে।আর্তনাদ করে মূর্ছিত হয়ে পড়ল সে।

সৌভাগ্যবশতঃ রক্তিমের ঘরেই ছিল তার বন্ধু বিক

াশ। বিকাশ এতক্ষণে ঘটনার ঘনঘটায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল,এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বাড়িশুদ্ধ লোককে জাগিয়ে তুলল। রক্তিমের দাদু সিদ্ধান্ত নিলেন,এই পরিস্থিতিতে কিছু করলে হারুই করতে পারে। হারুকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনা হোক।

রাত তিনটে বাজে। রক্তিমের ধুম জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় গেরুয়া কাপড় আর রক্তচন্দনের তিলক কপালে নিয়ে ঢুকলেন হারুদা। হারুদার এই রূপ রক্তিমের বাড়ির কেউ আগে দেখে নি। দু'চোখ দিয়ে দ্যুতি বেরোচ্ছে। এসেই রক্তিমের দাদুকে বললেন,"দেখ যা করবেন মা আদি পরাশক্তি করবেন। আমরা তো উপলক্ষ্য মাত্র। মায়ের ইচ্ছা যেটা সেটাই হবে।" এরপর পকেট থেকে রক্তজবা বের করে ছুঁইয়ে দেন রক্তিমের কপালে। স্তোত্র আওড়াতে থাকেন,"ওং অইম হ্রিং ক্লিম/ চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।"আসতে আসতে জ্বর কমতে থাকে রক্তিমের। কপালের কাছেই বসে থাকেন হারুদা।দুপুর বারোটা নাগাদ জ্বরের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন রক্তিমের মা বাবা। রক্তিমের দাদু হারুদাকে কিছু দিতে গেলে হারুদা বলেন,"মায়ের যেটা ইচ্ছা সেটাই হয়েছে। আমি কিছু করি নি। জানেন তো কাশীদা,ভাগ্যে যদি মৃত্যু নির্দিষ্ট করে দেন মা,সেটাকে এড়ানোর সাধ্যি কোনো তান্ত্রিকেরই নেই। আবার ভাগ্যে যদি মৃত্যু লেখা না থাকে,তাকে মারার ক্ষমতাও কোনো পিশাচসিদ্ধ কাপালিকের নেই। এ যে স্বয়ং মায়ের লীলা।" চলে যান হারুদা।

কিছুক্ষণ পরে রক্তিমের দাদুর কাছে খবর আসে রায়চৌধুরী বাড়িতে হোম করতে আসা উগ্র রক্তকালীর ভক্ত কাপালিক কোনো এক অজানা কারণে দেহ রেখেছেন। সেইসাথে মৃত্যু হয়েছে জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌমেনের।

এরপরেই হারুদা ভগবান হয়ে ওঠেন রক্তিমের কাছে। আদিপরাশক্তির এই ভক্তের সংস্পর্শে এসে রক্তিমের মনে জন্ম নেয় অগাধ কালীভক্তি। হারুদার কাছেই শোনে রক্তিম যে,মা আদি পরাশক্তিই কাল বা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করেন। সর্বমঙ্গলকারিণী আনন্দময়ী দেবী কালের ঊর্ধ্বে। তাই তো তাঁর আরেক নাম কালী। তিনিই কারণ,তিনিই কারক। এই বিশ্বপ্রপঞ্চ তো তাঁরই মায়া।তাই তো সাধক বলেছিলেন,"তোমার কর্ম তুমি করো মা,লোকে বলে করি আমি!"

কলেজে ওঠার আগেই হারুদার সাথে রক্তিম ঘুরে আসে তারাপীঠে। সেখানে আরেক চমৎকারকে উপলব্ধি করে রক্তিম। তারাপীঠের মহাশ্মশানে সোনাদার সাথে রক্তিমকে পরিচয় করিয়ে দেন হারুদা। আর সেখানে গিয়ে হারুদার কথায় সোনাদা তাকে দেন,সেই রক্তজবা,যা নাকি মায়ের মন্ত্রপুতঃ। সোনাদা বলে দেন,এই রক্তজবা তাকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবে,অশুভ শক্তি কখনো তার জীবনে প্রবেশ করতে পারবে না,আর তার উন্নতিকেও কেউ অশুভ শক্তি দ্বারা বাধা দিতে পারবে না। যাই হোক,এরপরেই স্বপ্নের উত্থান শুরু হয় রক্তিমের জীবনে। কিন্তু হারুদার প্রতি কৃতজ্ঞতা ভোলে নি সে। যখনই গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসত,চণ্ডীমণ্ডপের সামনে বা কালীমন্দিরের চত্বরে বা পঞ্চাননতলায় দেখা করত হারুদার সাথে। মানুষটা পাঁচ বছর আগে দেহ রেখেছেন,কিন্তু রক্তিমের মনে হয় হারুদার পুণ্যাত্মা সবসময় তার পাশেই রয়েছেন। মানুষটার কথা মনে করে,ভক্তিতে কপালে হাত ছোঁয়ায় রক্তিম। এই মানুষটাই তাকে বলেছিলেন যিনি হিমালয়বাসিনী পার্বতী,তিনিই বিন্ধ্যবাসিনী চামুণ্ডা। যিনিই আদি পরাশক্তি কুষ্মাণ্ডা,তিনিই ভুবনেশ্বরী,তিনিই ব্রহ্মচারিণী,আবার তিনিই মহাভয়ঙ্করী কালরাত্রি। তিনিই কমলা,তিনিই আবার ছিন্নমস্তা। তিনিই শান্তি,তিনিই অগ্নিস্বরূপা জ্বালা। তিনিই সৃষ্টি,আবার তিনিই ধ্বংস।তিনিই পরমব্রহ্মময়ী। নারায়ণী নমোহস্তুতে।



রক্তিম ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরায়। বর্ষাকালে এই ঘাটশিলা,চাকুলিয়া,ধলভূমগড় জায়গাগুলো যথেষ্ট অ্যাডভেঞ্চারাস।

 ফুরফুরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। সেপ্টেম্বর মাস।নবদম্পতি এখানে এসেছে এক সপ্তাহের জন্য। রক্তিম পুরোপুরি উপভোগ করতে চায় এখানে উদ্ভিন্নযৌবনা সবুজ প্রকৃতির অবর্ণনীয় অনিন্দ্য সৌন্দর্যকে। না,এখনো বর্ষা বিদায় নেয়নি। স্লগ ওভারে মৌসুমী বায়ু ব্যাটিং করছে।যখন তখন নেমে আসছে ঝমঝমিয়ে মুষলধারে বৃষ্টি। 

বৃষ্টিস্নাত পরিবেশের জন্য দূরের পাহাড়তলিকে ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে,মনে হয় ওখানে লুকিয়ে আছে হাজার রহস্যকাহিনী।কতো প্রাচীন জায়গা এই ছোটনাগপুর,সুপ্রাচীন ভূখণ্ড গণ্ডোয়ানাল্যান্ডের অংশ। গ্রাণাইট আর নিস শিলায় গঠিত আগ্নেয় মালভূমি হলেও কালের লীলায় বর্তমানে পরিণত হয়েছে ক্ষয়জাত মালভূমিতে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র পাহাড় আর প্রস্রবণ। আর এই অরণ্যের দেশে পাহাড়ের গায়েই আছে অজস্র গড়। ধলভূমগড় তাদের মধ্যে অন্যতম।আরোও আছে নাম না জানা কতো অজস্র গড়,প্রত্যেক গড়ের সাথে লুকিয়ে আছে না জানা কতো কাহিনী!গায়ে কাঁটা দেয় রক্তিমের।

 

এজন্যই সে কোলকাতা থেকে এনেছে নিজের সাধের নিক্কনের ক্যামেরা। হয়তো একদিন তারা কোলকাতায় ফিরে যাবে,কিন্তু ছোটনাগপুরের এই অবর্ণনীয় সৌন্দর্যপ্রভাকে ফ্রেমবন্দি করে নিয়ে যাবে। একটাই অসুবিধা,মোবাইলের টাওয়ার আসছে না। থাক গে!আপাতত কয়েকদিন ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ না হলে বন্ধই থাক।

বর্ষারাণীর ছোঁয়ায় প্রকৃতি আজ অপরূপ।অরণ্য আবার শ্যামলতা ফিরে পেয়েছে। আকাশে কালো মেঘপুঞ্জ আর সেইসঙ্গে দিগচক্রবালের ধূসর পাহাড় জায়গাটাকে আরোও রহস্যময় করে তুলেছে। এখানেই কোথায় লুকিয়ে আছে সেই কাপালিকের অভিশপ্ত রহস্য।

আর কয়েকদিন পরেই মহালয়া। শুরু হবে দেবীপক্ষ,কিন্তু সেদিন সূর্য ডোবার সাথে সাথেই পৃথিবীর বুকে নেমে আসবে সূচীভেদ্য তমিস্রা। হয়তো পশ্চিমের জঙ্গলে আবার জেগে উঠবে পঞ্চমুণ্ডির আসন,আবির্ভাব হবে কাপালিকের প্রেতাত্মার। ভাবতেই গা ছমছম করে উঠল রক্তিমের।

তবে প্রমিত পাল রক্তিমকে একটা কথা বলেন নি,সেটা হল এই গেস্টহাউসটাও পঞ্চমুণ্ডির সংলগ্ন অঞ্চলের মধ্যেই অবস্থিত। তাই তো কোনো জীবিত মানুষ এখানে তিন চারদিনের মধ্যে টিকে থাকতে পারেন না।তবে প্রমিতবাবুর কথা নিয়েও ভাবে রক্তিম । পশ্চিমের ঐ ভাঙা মন্দিরটা রক্তিম দেখেনি,কিন্তু দুপুরবেলা ঠিক বারোটার সময়ে যখন দিবাকর মধ্যগগনে বিরাজ করেন,তখন পাহাড়ের দিকে তাকালে বোঝা যায়,ওদিকে কালোমতো কিছু একটা আছে। ওটাই কি সেই অভিশপ্ত মন্দির, কিন্তু আনন্দময়ী আলোকময়ী মা যিনি সারা বিশ্বসংসারকে লালন করেন,তাঁর মন্দির কিভাবে অভিশপ্ত হয়! প্রশ্ন জাগে রক্তিমের মনে।


প্রকৃতি যখন অপরূপা,তখন মানুষের মনের আবেগের তীব্রতাও আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। রক্তিমের উষা জাগে ঐন্দ্রিলার চুম্বনে,সন্ধ্যা নামে ঐন্দ্রিলার আলিঙ্গনে।

প্রথম দু'দিন খুব আনন্দে কাটলেও তার পর থেকেই রহস্য ব্যাপারটা অনুভব করতে থাকে রক্তিম ও ঐন্দ্রিলা। দুপুরবেলা ভাত আর বনমোরগের মাংস খেয়ে রোদের আঁচ একটু পড়লে রক্তিম আর ঐন্দ্রিলা বেরিয়েছিল জঙ্গলে ঘুরতে। প্রমিতবাবু বারবার সাবধান করে দিয়েছেন,দিনের আলো পড়ার আগেই ফিরতে। কাছেই আছে সুদৃশ্য ঝরণা। জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ি ময়না, রেড স্টার্ট উডপেকারের ডাক। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে পশ্চিমের সেই জঙ্গলে চলে এসেছে,লক্ষ্যই করে নি রক্তিম আর ঐন্দ্রিলা। হঠাৎই একদিকে নজর পড়তে স্তম্ভিত হয়ে যায় তারা। জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের পাথুরে পথ বেয়ে ওটা কে ওপরে উঠছেন,দূর থেকে দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় এই ব্যক্তি জটাজুটধারী এবং গেরুয়া বসনপরিহিত। আরেকটা কথাও বোঝা যায়,ব্যক্তি বিশালবপু। কেমন যেন এক থমথমে রহস্যময়তা চারদিকে। ধরণী ছেয়ে গেছে মায়াবী নীলাভ আলোয়। বাদলা হাওয়ার পরিবর্তে যেন বইতে শুরু করেছে নরকের হিমেল বাতাস। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে হুড়ালের ডাক। একসাথে অনেকগুলো হেঁড়োল যেন এইদিকেই আসছে।

পরমুহূর্তেই এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। হঠাৎই সেই ব্যক্তি অদৃশ্য। এতো তাড়াতাড়ি গেল কোথায়,এলই বা কোথা থেকে। রক্তিম অনুভব করল এই সেপ্টেম্বর মাসেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ঐন্দ্রিলা তো রীতিমতো কাঁপছে। কয়েকমুহূর্তমাত্র আগে দেখা ব্যক্তিটি কি সত্যিই মানুষ,না কি অন্য কেউ।এ কি কোনো সাধারণ ঘটনা,না কি পাহাড়ের ইন্দ্রজাল।


যাই হোক,কোনোরকমে গেস্ট হাউসে ফিরল রক্তিম আর ঐন্দ্রিলা। সেখানেও এক বিপত্তি। তালা খুলে দরজা খুলবে এইসময়ই রক্তিমের মনে হল কেউ যেন ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে রেখেছে। কিছুতেই খোলে না,অথচ ভেতরে কেউ ঢুকলে তো বাইরে তালা থাকা সম্ভব নয়। সহসাই এক অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি অনুভব করল সে। আজই হয়তো তাদের জীবনের শেষ দিন। আজই হয়তো সাঁঝের বেলায় আক্রমণ করবে অশরীরী।মনে হয় গেস্টহাউসে কারেন্ট নেই। হঠাৎই এক অমোঘ সাহস পেয়ে বসল মা আদ্যা কালীর ভক্ত রক্তিমকে। "ওম অইম হ্রীং ক্লিম আদ্যা কালিকা/পরমেশ্বরী স্বাহা" বলে জোরে ঠেলা দিল দরজায়। নিমেষে খুলে গেল দরজা। আচমকাই জ্বলে উঠল বারান্দার আলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দুজনে। শোনা গেল, কোনো এক হেঁড়োলের ডাক দূর হতে দূরান্তরে মিলিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু প্রমিতবাবুর কোনো খবর নেই,মানুষটা গেলেন কোথায়। গেস্ট হাউসটাও আশ্চর্যভাবে নিস্তব্ধ,আশ্চর্যের কথা এখানে কি কেউ বেড়াতে আসে না। ব্যাপারটা কেমন যেন সন্দেহজনক!এমন সময়ই হন্তদন্ত হয়ে আবির্ভাব ঘটল প্রমিতবাবুর।


কৌতুহল বড়ো সাংঘাতিক জিনিস। পরের দিন অমাবস্যা। ঐন্দ্রিলাকে গেস্ট হাউসে রেখে সকালে খাওয়া দাওয়া করে গহন অরণ্যে জাঙ্গল সাফারিতে বেরোল রক্তিম। কিন্তু তন্ন তন্ন করেও কোনো মন্দির খুঁজে পেল না সে। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে গেস্টহাউসে ফেরার পথ ধরল। আজ তাকে দিনের আলো থাকতেই গেস্টহাউসে ফিরতে হবে। কারণ সন্ধ্যার পরেই এ অঞ্চলের প্রেতের শক্তি জেগে ওঠে। না,এই অঞ্চলের প্রেতের শক্তি জেগে ওঠার আগেই তাকে গেস্টহাউসে ঐন্দ্রিলার কাছে গিয়ে পৌঁছাতে হবে। তার নিজের ব্যাগেও এক রুদ্রাক্ষের মালা আছে,এটা তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করে।তাই তো যেখানেই যায়,এটা তার সঙ্গেই নিয়ে যায়।

যাই হোক,গেস্টহাউসে গিয়েই দেখল এক হাড় হিম করা দৃশ্য। সিঁড়ির সামনেই পড়ে আছে প্রমিতবাবুর প্রাণহীন দেহ। খড়্গ বা কুঠারাঘাতে কে যেন মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বারান্দায় বইছে লাল রুধিরধারা। এ ভয়াবহ দৃশ্য যেকোনো সাধারণ মানুষের জন্য সহ্য করা কঠিন। রক্তিম চিৎকার করে ডাকল,'ঐন্দ্রিলা।' আশ্চর্য,কোনো উত্তর নেই । চারদিকে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজিত। পৃথিবীর বুকে রাতের অন্ধকার নেমে আসছে,পশ্চিমাকাশে জেগে উঠেছে সন্ধ্যাতারা,উদিত হয়েছে কালপুরুষ। আকাশ এখন মেঘমুক্ত। রক্তিমের মনে পড়ল কুমারী স্ত্রী,কিন্তু ঐন্দ্রিলা তো কুমারী নয়। আততায়ী সকৌশলে শিকারকে নিয়ে কেটে পড়েছে।

কিন্তু,এখন সে করবে কি! ঐন্দ্রিলাকে উদ্ধার করার জন্য যাবে কোথায়,আর সেই ভয়ালদর্শন কাপালিকের প্রেতের সাথে লড়বেই বা কিকরে। আজ অমাবস্যা,প্রেতশক্তি নিজের শিখরে থাকবে।


কিন্তু,বিদ্যুৎঝলকের মতোই কথাটা মনে পড়ে গেল রক্তিমের। আজ যে মহালয়া,এর পর শুরু হতে চলেছে দেবীপক্ষ। হ্যাঁ,আজ দেবীর আগমনের দিন,অশুভশক্তির সংহারের দিন।হ্যাঁ,মা রঙ্কিনী তো মা চামুণ্ডা তথা তার আরাধ্যা মা কালীরই অপর রূপ। তিনিই তো মা আদি পরাশক্তি। হ্যাঁ,সে যদি নিবিষ্ট চিত্তে মাকে স্মরণ করে,তাহলে মা নিশ্চয়ই তাকে সাহায্য করবেন।রুদ্রাক্ষ তুলে নিল রক্তিম,গেস্ট হাউস তন্নতন্ন করে খুঁজে প্রমিতবাবুর অফিস থেকে খুঁজে পেল লাল সিঁদুর পরানো এক ত্রিশূল। এর জন্যই হয়তো অশুভ শক্তি প্রমিতবাবুর ধারেকাছে ঘেঁসতে পারে নি। কিন্তু,আজ সুযোগ পেয়ে তাঁর প্রাণহানি ঘটিয়েছে। ঐ তো পশ্চিম পাহাড়তলির দিক থেকে ভেসে আসছে যামঘোষক শিয়ালের ডাক,কিন্তু এখন তো শিয়াল ডাকবার সময় নয়। তাহলে কি হিমালয়শিখরবাসিনী আনন্দময়ী মা তাকে পথ দেখাচ্ছেন! সাথে হারুদার দেওয়া সেই মন্ত্রপুতঃ রক্তজবা তো রয়েইছে। রেডিয়াম টর্চ আর ব্যাগ নিয়ে অরণ্যের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল রক্তিম। না,কিছুতেই সে মরতে দেবে না ঐন্দ্রিকে। দানবের হাত থেকে নিজের সাধ্বী স্ত্রীকে রক্ষা করা তার এখন পরম কর্তব্য।


রাতের অরণ্যের আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে।রাতের অরণ্যের মায়াবী সঙ্গীতলহরী,শালপত্রের মর্মরধ্বনি,রাতজাগা পাখির ডাক যে শুনেছে,সেই মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু রক্তিমের এসব অনুভব করার মতো সময় বা মানসিক পরিস্থিতি কিছুই নেই।

 আজ চারদিক নিঝুম,এ রাত যেন মায়াবী রাত। দূর থেকে ভেসে আসছে শিয়াল-হুড়ালের গর্জন। আকাশে কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে সন্ধ্যাতারা,কালপুরুষকে।গুরুগম্ভীরনিনাদে ভেসে আসছে মেঘগর্জন, ক্ষণে ক্ষণে আকাশের বুক চিরে চমকে উঠছে ক্ষণপ্রভা। দিগন্তে আবছা দলমা পাহাড়তলিকে মায়াপুরী বলে মনে হচ্ছে।

তার মনের আশা কি পূরণ হবে না,এইভাবেই অর্থহীন ভাবে বনবাদাড়ের মধ্যে খুঁজতে হবে তার ঐন্দ্রিকে। এখনো কি বেঁচে আছে তার প্রিয়া। উজ্জ্বল রেডিয়াম টর্চের আলোকে সমগ্র বনানীর অন্ধকার দূরীভূত হয় না। আর কতোক্ষণ! অবশেষে পকেট থেকে হারুদার দেওয়া সেই রক্তজবা বের করল রক্তিম। "শক্তি দাও মা,দিশা দেখাও। অন্যায়ের সংহার করো মা,শক্তি দাও।"মা রঙ্কিনী যার অপর রূপ মা কালী,যিনি চামুণ্ডা তিনিই দিব্যজ্যোতি চন্দ্রঘন্টা- সেই মা আদি পরাশক্তির কাছে একাগ্রচিত্তে প্রার্থনা করল রক্তিম।

অবশেষে ঐন্দ্রিলাকে খুঁজে পেল রক্তিম,কিন্তু এ কি দশা হয়েছে তার,পরণের বস্ত্র ছিন্নভিন্ন। প্রচণ্ড ভয় ও উত্তেজনায় কপালের রগ ফুলে গেছে। থরথর করে কাঁপছে আতঙ্কে। সাথে জলের বোতল ছিল,সেই জলের ছাঁট ঐন্দ্রিলার মুখে দিতে থাকল রক্তিম। এতে হয়তো বা সম্বিৎ ফিরল ঐন্দ্রিলার,এরপর রক্তিমের দিকে অর্থহীন ভাবে তাকিয়ে হাতের আঙুল তুলে ইশারা করল উত্তর পশ্চিম দিকে যে দিকে তাকিয়ে হাড় হিম হয়ে গেল রক্তিমের।তাহলে কি সে এসে অবশেষে পৌঁছাতে পেরেছে সেই অভীষ্ট স্থানে,যেখানে রয়েছে অভিশপ্ত রঙ্কিণী মন্দির আর পঞ্চমুণ্ডির আসন।কড়কড় শব্দে আশেপাশে কোথাও পড়লো বাজ। বইছে ঝোড়ো হাওয়া। প্রকৃতি যেন উন্মাদ হয়ে উঠছে।

ঐ তো, তার পাঁচশো মিটার দূরত্বেই হোমাগ্নি করছেন গেরুয়া কাপর পরিহিত জটাজুটধারী এক বিশালবদন পুরুষ। "ওম অইম হ্রিং ক্লিম/ চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।"চিনতে পারল রক্তিম,একেই দেখেছিল সেই পাহাড় বেয়ে উঠতে। আর কেউ নয়,কাপালিকের প্রেত। আর ঠিক পেছনেই পাহাড়ের গায়ে ঠিক যেন কালো কষ্ঠিপাথরে নির্মিত এক ভগ্নপ্রায় মন্দির। অন্ধকারের সাথে যেন মিশে গেছে সম্পূর্ণভাবে।

গর্ভগৃহে হোমাগ্নির যা আলো পড়েছে, তাতে দেবীপ্রতিমার যেটুকু দেখা যায়,বোঝা যায় দেবী ভীষণকায়া। কাপালিকের যজ্ঞকুণ্ডের কিছু দূরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো কালো ছায়া।

অনুভব করল রক্তিম। জেগে উঠেছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। চারিদিকে বিরাজমান এক অপার্থিব পরিবেশ।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু রক্তিম জানে বৃষ্টির জলে হোমকুণ্ডের এ অগ্নি নিভবে না। এ আগুন সাধারণ নয়,এ আগুন মায়াবী আগুন। যতক্ষণ না শেষ আহুতি পড়ছে,এ আগুন নিভবে না।


আচ্ছা,কাপালিক কি যোগবলে জেনে ফেলেছে,ঐন্দ্রিলা কুমারী নয়। তাই হয়তো গহন অরণ্যের মধ্যে ঐন্দ্রিলাকে ফেলে খুঁজে নিয়েছে নিজের শিকার,এক কৃষ্ণবর্ণা মুণ্ডা যুবতী।শুধু একটা লালপাড় শাড়ি পরানো হয়েছে,কপালে রক্তচন্দনের তিলক। হয়তো বলি দেওয়া হবে। আর তাতেই সিদ্ধিলাভ করবেন পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকের প্রেতাত্মা। কিন্তু ঐন্দ্রিলা তো বেঁচে গেছে,কাপালিক হোমে ব্যস্ত। ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে সে গেস্ট হাউসে ফিরে যেতেই পারে,পরের দিন ভোর হতেই কোলকাতা পাড়ি।

মনের মধ্যে চেতনার তাড়না অনুভব করল রক্তিম ,যেভাবেই হোক এই অভাগা মুণ্ডা তরুণীকে বাঁচাতেই হবে কাপালিকের হাত থেকে। কালো ছায়ারা ক্রমশঃ তার কাছে এগিয়ে আসছে।


 ঘোরতর কৃষ্ণকায় কাপালিকের রক্তাভ দু চোখ জ্বলছে,চোয়ালের কষ থেকে বেরিয়ে আসছে একজোড়া তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত। কাপালিককে অবাক করে খিলখিল স্বরে হেসে উঠল মুণ্ডা যুবতী। সামনেই মৃত্যু,কিন্তু চোখমুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। প্রেত হয়তো জানে না,তাকে বিনাশ করতে মহাকাল আজ আবাহন করেছেন শক্তিকে। হঠাৎই এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে ঘন্টাধ্বনি শুরু হল মন্দিরে,এক অপরূপ দিব্যপ্রভায় ভরে উঠল চারদিক। কালো ছায়াদের অস্তিত্ব আর নেই।

কাপালিক আর রক্তিম দুজনকেই অবাক করে মুণ্ডা যুবতী ধারণ কলেন নিজের ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণা রূপ,তিনি মুক্তকেশিনী, নগ্নিকা,লোলজিহ্বা,চতুর্ভুজা।  কাপালিক সভয়ে দেখলেন এতদিন পর এই প্রথমবার তাঁর অভীষ্ট দেবী এসেছেন তাঁর সম্মুখে, দিতে এসেছেন তাঁর অভীষ্ট মুক্তি। তাঁর লক্ষ্য ছিল অলৌকিক শক্তিলাভ,আর সেই জন্যই পথভ্রষ্ট হয়েছিলেন তিনি।

নিজের হাতের খড়্গ দিয়ে কাপালিকের মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন দেবী। পরক্ষণেই মিলিয়ে গেলেন শূন্যে,কাপালিকের শরীরও দিব্যজ্যোতি হয়ে মিলিয়ে গেল আকাশে।


ছ দিন কেটে গেছে,আজ মহাষষ্ঠী। সারা কোলকাতা ভাসছে পুজোর আনন্দে। সন্ধ্যাবেলা দেবীর বোধনের পর ঐন্দ্রিলার সাথে পাড়ার পুজোমণ্ডপে এসে দাঁড়াল রক্তিম। মাকে প্রণাম করে নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে থাকল দশভুজা দেবীর দিকে।মা মৃন্ময়ী হলেও চিন্ময়ী।এই মুখমণ্ডল,এই অপরূপ হাসি যে তার অতি পরিচিত। এই হাসি সে দেখেছে মহালয়ার অমাবস্যা রাতে,ধলভূমগড়ের জঙ্গলে,রঙ্কিনীদেবীর মন্দিরে।










Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract