আছে শুধুই অন্ধকার
আছে শুধুই অন্ধকার


(১)
মার্চ ২০১৯
নেগেটিভটা ডেভলপ করবে বলে ডার্করুমটায় ঢুকেছিল সায়ক। হঠাৎ ঝুপ করে আলো নিবে গেলো। হাতরে হাতরে দরজার কাছে এলেও দরজাটা খুলল না কিছুতেই। পুরো ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, ফোনটা বোধহয় ভুল করে পাশের বেডরুমে ফেলে এসেছে ও। জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কায় সায়ক। কিন্তু কারো সারা পায় না। এই ফ্লোরে আর কেউ থাকেও না।
কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে, গরমে ঘেমে স্নান করে গেছে ও। এবার মনে হচ্ছে বাতাসে অক্সিজেন নেই আর। বুকে চাপ লাগছে। জীবনে প্রথম অন্ধকারকে ভয় পায় সায়ক, ভীষণ ভয়। মনে হয়, ও একা নয়, আরো কেউ আছে এ ঘরে। মৃদু খসখস আওয়াজ, নিশ্বাসের গরম হল্কা..... !! কে ?
আস্তে আস্তে অসার হয়ে আসে হাত পা। জ্ঞান হারাতে হারাতে হঠাৎ মনে হয় কালো দেওয়ালে সাদা খড়ি দিয়ে কে যেন লিখছে 'ওয়েলকাম টুু দা ডার্ক ওয়ার্ল্ড।'
(২)
এপ্রিল ২০১৯
একটা চাপা অস্বস্তি আর দম বন্ধ করা গরমে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো তোরার। ঘরটা যেন ফার্নেস, মাথার উপর পাখাটা বন্ধ। ঘরের একটা মাত্র জানালা শোয়ার আগে বন্ধ করে এসিটা চালিয়েছিল ও। কিন্তু এসির আলোটাও জ্বলছে না। লোডশেডিং তো এখানে হয় না খুব একটা ?এমন জমাট অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি তোরা। উঠে বসে বালিশের পাশে মোবাইলটা টেনে নিতে চায় ও। কিন্তু অন্ধকারে হাতের ধাক্কায় ওটা যেন কোথায় ছিটকে যায়।
আন্দাজে উঠে আসে তোরা, জানালাটা খোলা খুব দরকার, দম বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। ঘরে বোধহয় এক ফোটাও অক্সিজেন নেই। কিন্তু জানালাটা খুঁজেই পায় না অন্ধকারে। হাতরে হাতরে পশ্চিমের পুরো দেওয়ালটা খোঁজে কিন্তু কোথায় জানালা !! ঘুমের ঘোরে অন্ধকারে ও কি দিক ভুল করল!! সব কটা দেওয়ালে হাত বুলিয়ে দেখে তোরা, কোথাও নেই জালনাটা!!
সারা শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। বিছানায় জলের বোতলটাও নেই। এমন কুচকুচে কালো অন্ধকার রাত তোরা আগে কখনো দেখেনি। দরজা !! দরজাটা তো খাটের পাশেই ছিল। ওটা কোথায় গেলো !! আচমকা ডানদিকের দেওয়ালে দরজাটা খুঁঁজে পায় ও। অন্ধকারেই আন্দাজে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে পাশের ঘরে। কিন্তু এ ঘরটাও ঘুটঘুটে অন্ধকার, কাচের জানালা গুলোয় কে যেন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। দেওয়াল হাতরে একটাও জানালা খুঁজে পায় না ও।
মেইন দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে, কিন্তু একি!! আবার দেওয়াল কেনো ? খাট, আলমারি ধাক্কাই খেতে থাকে ক্রমশ, ভুলে ও আবার বেডরুমে ফিরে এসেছে মনে হয়। হঠাৎ মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনের মনিটারে হলদে আলোয় একটা লেখা ফুটে ওঠে , 'ওয়েলকাম টু দা ডার্ক ওয়ার্ল্ড।' জ্ঞান হারাতে হারাতে তোরা শুনতে পায় একটা খনখনে হাসির শব্দ।
(৩)
মে ২০১৯
এই ফ্ল্যাটটায় আর থাকা যাবে না বুঝতে পারে স্মার্ত। রোজ রাতেই কেবল ফল্ট, সবার আলো থাকে। ওর থাকে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গরমে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায় রোজ। বারান্দার দরজাটা খুলে শোয় বলে এক চিলতে রাস্তার আলো এসে ঢোকে ওর ঘরে। বাকি রাতটা বাধ্য হয়ে ছাদেই কাটে ওর।
বাড়ি দেখতে গিয়ে এই দুকামরার ফ্ল্যাটটা বেশ পছন্দ হয়ে যায় ওর। দু মাসের এডভান্স দিয়ে পরের দিনই ঢুকে পরে ও।
কিন্তু আবার সেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার । এসিটাও বন্ধ!! জানালাটা খুঁজে পায় না স্মার্ত। ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে। দরজা খুলতেই যেন আরো কালো কালো চাপ চাপ অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। পাশের ঘরের দরজা খুলতেই আরেকটা অন্ধকার ঘর। জানালা বিহীন ঘর গুলোয় গোলক ধাঁধার মত ঘুরতে থাকে স্মার্ত। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে ও। এই অন্ধকার ছেড়ে আর বোধহয় আলোয় ফিরতে পারবে না কখনো। মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। চারপাশের অন্ধকার আরো ঘন হয়ে আসে। কানের কাছে কারো গরম নিশ্বাসের আওয়াজ, হাত পা কেমন অসার হয়ে আসছে। গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে স্মার্ত দেখে ওর কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠছে একটা লেখা। 'ওয়েলকাম টু দা ডার্ক ওয়ার্ল্ড'।
(৪)
নভেম্বর ২০১৮
-''আমি অন্ধকার ভয় পাই না, আমি একা একটা অন্ধকার বাড়িতে রাত কাটাতে পারবো। '' ঋষার কথায় শায়ক আর স্মার্ত হেসে ওঠে।
-''আমিও একা থাকতে পারি অন্ধকারে। এ আর এমন কি ?''
তোরা বলে ওঠে।
-''আমি একাই কত রাত কাটিয়েছি আমার ডার্ক রুমে। '' শায়কের ঘরের সাথেই একটা ছোট স্টোর রুম ছিল। ফটোগ্ৰাফির শখ আছে বলে সায়ক ওটাকে ডার্ক রুম হিসাবে ব্যবহার করে। দেওয়াল গুলো কালো রঙ করে একটি মাত্র জানালাকে বন্ধ করিয়ে দিয়েছে আগেই।
-''তাহলে পরীক্ষা হয়ে যাক, কে কে সায়কের ডার্ক রুমে একা থাকতে পারবে ? সেখানেই বোঝা যাবে কে কে অন্ধকারকে ভয় পায়।'' তোরা বলে ওঠে।
-'' থাকতে তো পারবো, কিন্তু বাড়িতে কি বলবো?'' ঋষার প্রশ্নে সবাই চুপ করে যায়।
-''ঠিক, বাইরে রাত কাটাতে দেবে না মা। '' তোরা বলে।
-''এক কাজ করি, আমরা সবাই চারদিনের জন্য দীঘা যাচ্ছি বলে দেবো বাড়িতে। তারপর চার রাত সায়কের
ফ্ল্যাটে পর পর সবাই একা থাকবো .... ও তো একাই থাকে, অসুবিধা হবে না। '' স্মার্ত বলে।
সবার পছন্দ হয় এই প্রস্তাব।
ওরা চারজন কলেজের বন্ধু, আপাতত এমবিএ পাশ করে সবাই টুকটাক চাকরী করছে। অনেক আলোচনার পর এটাই ফাইনাল হয়। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে সবাই এসে জরো হয় সায়কের ফ্ল্যাটে। সন্ধ্যার থেকে চলে পার্টি, অবশেষে লটারি করে ঠিক হয় ঋষা থাকবে প্রথম রাতটা ঐ ডার্করুমে। দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেবে ওরা। অসুবিধা হলে ঋষা ফোন করলে ওরাই খুলে দেবে। একটা তোষক আর বালিস দিয়ে রেখেছিল সায়ক ঔ ছয় বাই আট ঘরটায়।
এক বোতল জল হাতে ঋষা ডার্ক রুমে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে তালা মেরে দিলো ওরা।
-''চল, পার্ক স্ট্রিট থেকে ঘুরে আসি। আমরা পাশের ঘরে থাকলে ও এমনিতেই সাহস পাবে। ভোরে ফিরে আসবো। '' স্মার্ত বলে।
-''কিন্তু ঋষা যদি ভয় পায়, যদি ডাকে ?'' সায়ক বলে।
-''ও তো ফোন করবে, তোর এই এলিয়েট রোড আসতে আমাদের কতক্ষণ আর লাগবে, চল চল ...'' তোরাও তাড়া দেয়।
বর্ষ শেষের আলোর সাজে ঝলমলে পার্ক স্ট্রিট তখন ওদের হাতছানি দিচ্ছ। বন্ধ অন্ধকার ডার্ক রুমের দিকে একবার তাকিয়ে সায়ক বেরিয়ে আসে ওদের সাথে।
(৫)
ডিসেম্বর ২০১৮
-''কাজটা বোধহয় আমরা ঠিক করলাম না!! পুলিশে জানালেই ভালো হত। '' কাঁপা গলায় বলে সায়ক।
-''পাগল নাকি!! এটা একটা দুর্ঘটনা, ভুলে যা এসব। আপাতত তিন চার দিন ওর মা খোঁজ করবে না। তারপর নতুন কিছু ভাবা যাবে।'' স্মার্ত বলে।
-''কিন্তু ওর মা যদি ফোন করে ? ওর ফোন বন্ধ দেখলে হয়তো আমার ফোনে করবে। '' তোরা বলে ওঠে।
-''ওর ফোন থেকে একটা মেসেজ করে দে যে দীঘা পৌঁছে গেছে। সমুদ্রে নামছে তাই ফোন বন্ধ। '' স্মার্ত বলে।
-''এবার তোরা সবাই বাড়ি ফিরে যা, আগামী দু মাস আমরা কেউ কাউকে চিনবো না, দেখাও করবো না। পুলিশ এলে বলবো ঋষার সাথে দেখা হয়নি বহুদিন। '' সায়ক বলে।
-''তুই একা থাকবি এই ফ্ল্যাটে ?''
-''পাগল, গ্ৰামের বাড়ি পালাবো এখনি। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ফোন করবি না।''
-''আমিও কোথাও চলে যাবো এখনি, ঝামেলায় থেকে লাভ নেই। '' স্মার্ত ওর পিঠের ব্যাগটা তুলে নেয়।
(৬)
জানুয়ারি ২০১৯
বছরের প্রথম দিন সকালে ফোনটা এসেছিল। দমদম থানায় ঋষার মা মিসিং ডাইরি করেছে। মেয়ে পাঁচদিন আগে দীঘা গেছিল। ফেরেনি। ওর কল লিষ্ট ঘেঁটে তোরাকে ফোন করেছিল পুলিশ। তোরা জানিয়েছে সে কিছুই জানে না এ ব্যপারে।
স্মার্ত তখন সিকিমে ছুটি কাটাচ্ছে। সায়ক গ্ৰামের বাড়ি পুরুলিয়ায়।
একা এক বিধবা মা অনেক খুঁজেও একমাত্র মেয়েকে পায়নি।পুলিশ বলেছে এডাল্ট মেয়ে, নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে গেছে। হয়তো ঘুরতে গেছে কোথাও। আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে কেস। তিন মাস কেটে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার নিউজ দেখে চমকে উঠেছিল তোরা। এলিয়েট রোডের একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকত সায়ক, ওর ডার্ক রুমে ওরা চারদিনের বাসি পচা গলা দেহ পাওয়া গেছে। দুর্গন্ধ বার হওয়ায় প্রতিবেশিরা পুলিশে খবর দিয়েছিল।
এক অজানা ভয়ে কেঁপে ওঠে তোরা, কাঁপা হাতে স্মার্তর নম্বর ডায়েল করে।
-''খবর দেখেছিস, সায়ক নেই !!''
-''ও নির্ঘাত নেশা করে ও ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে গেছিল। ভুলে যা এসব। তুই ঠিক আছিস তো ?''
-''আমাদের কি পুলিশে যাওয়া উচিত ? ওটা তো দুর্ঘটনা ছিলো। যদি সব খুলে বলি? ''
-''চুপ, একদম চুপ। এতোদিন পর কে বিশ্বাস করবে তোকে ? ভুলে যা এসব। ''
-''ভয় করছে খুব। ''
ও পাশে স্মার্ত ফোন কেটে দেয় টের পায় তোরা।
(৭)
এপ্রিল ২০১৯
প্রিন্সেপ ঘাটের এদিকটায় ভোর বেলায় লোক কম থাকে, স্মার্তকে বলে তোরা -''বডিটা কি করেছিলি সেদিন।?''
-''সাইন্স সিটি পার করে যে বড় জঞ্জাল ফেলার জায়গা সেখানে ফেলে এসেছিলাম। ঐ মেশিনে ঢুকে সয়েল হয়ে মাটিতে মিশে গেছিল ঋষা। ''
-''পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। ''
-''পুলিশ বিশ্বাস করত না যে ও দম বন্ধ হয়ে মরেছে। ঘরে অক্সিজেন কম ছিল। সবাইকে ধরত খুনের অভিযোগে। ''
-''ও অন্ধকারে মরেছে। দম বন্ধ হয়ে , আমাদের ভুলে....!!''
-''তুই আর এসব ভাবিস না, সায়কের ঐ ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। ''
-''আমিও একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি অফিসের কাছে, কিন্তু আজকাল একা ভয় লাগে, লাইট জ্বালিয়ে শুই। ''
-''ধুর, ভুলে যা এসব। মনে রাখবি ওটা একটা দুর্ঘটনা। ''
তিনদিন পরের নিউজ দেখে চমকে উঠেছিল স্মার্ত। তোরা নিজের ঘরেই শ্বাসরূদ্ধ হয়ে মারা গেছে, কেবল ফল্টে এসি বন্ধ হয়ে গেছিল। সব জানালা দরজা বন্ধ ছিল। দু দিন পর ওর লাস উদ্ধার হয়েছে বন্ধ ঘরের ভেতর।
এই প্রথম একটা শীতল স্রোত শিড়দাড়া বেয়ে নেমে আসে। নাঃ এবার ফ্ল্যাটটা বদলাতেই হবে। লোডশেডিং হলেই আজকাল ছাদে চলে যায় স্মার্ত।
(৮)
জুন ২০১৯
পেপারের তৃতীয় পাতায় এক কোনে ছেপেছে খবরটা, স্মার্ত জানা নিজের বেডরুমে দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। ঠিক কি কারনে অক্সিজেন কমে গেছিল বোঝা যায়নি। তবে ও কোনো মানসিক অবসাদে ভুগছিল। দীর্ঘ এক মাস ঘরে বন্দী রেখেছিল নিজেকে। অন্ধকারে ছিল তীব্র ভয়, ঘরে আলো জ্বালিসে শুতো। টর্চ রাখত সাথে। বেশ কিছু মোমবাতি কিনেছিল ইদানিং।
বৃদ্ধার চোখ দিয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। ছেলেমেয়ে গুলো ভালো বন্ধু ছিল। ছয় মাসের ভেতর পর পর সবাই অন্ধকারে হারিয়ে গেলো। আজ অমাবস্যা, সন্ধ্যা হলেই চাপ চাপ অন্ধকার এসে দখল নেবে এবাড়ির। অন্ধকার আর ভয় পাননা উনি। অন্ধকারেই ভেসে আসে একমাত্র মেয়ের গন্ধ। ঋষাকে অনুভব করতে পারেন তিনি এই অন্ধকারের মাঝে। ঋষা হারিয়ে যাওয়ার পর ওঁর জীবনে রয়ে গেছে শুধুই অন্ধকার। যা বয়ে আনে ঋষার স্মৃতি। তাই অন্ধকারে আর ভয় লাগে না, ভয় লাগে আলোয়।