নেতাজী ও বর্তমান ভারত
নেতাজী ও বর্তমান ভারত
নেতাজী বলেছিলেন, " তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো। " নরমসরম বাঙালি সমাজকে এক নতুন পথের দিশা দিয়েছিলেন তিনি, গান্ধীবাদী অসহযোগ আন্দোলন নয়, সশস্ত্র সংগ্রামই যে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র উপায় বুঝিয়েছিলেন। গান্ধীজির সঙ্গে মতান্তরে তখনকার প্রবাদপ্রতিম কংগ্রেস দল ত্যাগ করে ফরোয়ার্ড ব্লক গঠন করতেও ভাবেননি দুইবার। তিনি চেয়েছিলেন দেশমাতৃকার প্রকৃত স্বরাজ। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কি মনে রেখেছি তাঁর বাণী ও কার্যপ্রণালী! আসুন দেখে নিই। তার আগে দেখে নিই আমাদের গর্বের ইতিহাসের কিছু ঝলক।
১৯৪২ সালে সিঙ্গাপুরে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ বাহিনী, গঠন করেছিলেন আরেক বঙ্গসন্তান রাসবিহারী বসু। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হাতে ধরা পড়া ভারতীয় সেনাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল এই বাহিনী। তখন সুভাষচন্দ্র গৃহবন্দী খাস কোলকাতার বুকে৷ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছদ্মবেশে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন বার্মায়, সেখানেই তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর সাংগঠনিক প্রধান নির্বাচিত হন। তাঁর সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন কর্ণেল প্রেম সেহগাল, মেজর শাহনওয়াজ খান, কর্ণেল শওকত মালিক, মেজর জেনারেল মুহাম্মদ জামান কিয়ানি প্রভৃতি। তিনিই গড়ে তুলেছিলেন নারীবাহিনী, যা আজাদ হিন্দ মুক্তিফৌজের লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। মালয় ও ব্রহ্মদেশের বহু প্রবাসী ভারতীয় স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিলেন এই বাহিনীতে৷ গঠিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকার, যাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মোট নয়টি দেশ। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। দেশের মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনী মরণপণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দখল করেছিল অখণ্ড ভারতের অনেকখানি ভূখণ্ড। কিন্তু পরে আবহাওয়া ও পরিস্থিতির অবনতির ফলে তাঁর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়, আজাদ হিন্দ সৈনিকরা অনেকে মৃত্যুবরণ করে অথবা মিত্রবাহিনীর সেনার হাতে ধরা পড়ে। তাঁদের ঐতিহাসিক বিচারপর্ব আজও স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ভারতের ইতিহাসে, সেইসঙ্গে প্রতিটি ভারতবাসীর মনে সদা জাগরিত বীর নেতাজী।
এবার ফিরে আসি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে। আজ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কেটে গেছে অনেকটা সময়৷ কিন্তু এই স্বাধীনতাই কি চেয়েছিলেন নেতাজী? হয়ত না। আজ মানুষের অধিকার হরণ চলছে দিকে দিকে৷ রাজনৈতিক দলগুলি হয়ে উঠেছে ফতোয়া দানের আর দুর্নীতির আখড়া। মানুষের ভাবাবেগ আজ এতটাই ঠুনকো যে ছোট্টছোট্ট বিষয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে৷ হরণ করা হচ্ছে বাকস্বাধীনতার অধিকার৷ মব লিঞ্চিং এর দায়ে দীর্ণ বঙ্গসমাজ ধুঁকছে, খাদ্য - ধর্ম যা পাচ্ছে তাই নিয়ে লড়ছে মানুষ, সৌভ্রাতৃত্বের দেশে আজ বিভাজনের রাজনীতি গ্রাহ্য৷ রাজনৈতিক দলগুলির দড়ি টানাটানি এতটাই বিদ্বেষ বাষ্প ছড়াচ্ছে চতুর্দিকে যে মানুষ শ্বাস নেওয়ার আগেও ভাবতে বসছে বার দুয়েক। আর ফেসবুকে বাঙালি! তারা তো খাপোন্মত্ত জনতায় পরিনত হয়েছে। নিত্যদিন কারো না কারো চিরহরণ করেই তার শান্তি, ধর্ষণ - খুনের হুমকি মুড়িমুড়কির ন্যায় সস্তা। একবার নিজের বুকে হাত দিয়ে ভাবুন তো সকলে, আজ যদি বেঁচে থাকতেন নেতাজী তিনি কি মেনে নিতেন এই হানাহানিতে উন্মাদপ্রায় রাজনৈতিক ভারত?
আজ বীর সেনানায়কের জন্মদিন, আজ বঙ্গদেশের সেই মানুষটির জন্মদিন যিনি যেকোনো পরিস্থিতির চাপেই মাথা নোয়াতে শেখেননি৷ আজ দিকে দিকে নানা রাজনৈতিক দল স্মরণ করবে তাঁকে, তাঁর জীবন ও কর্মকে আত্মস্থ না করেই তাঁকে নিয়ে ভাষণ দেবে, নানা গিমিকে চমকে দেবে জনসাধারণকে৷ আর মানুষ! বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় দুচারলাইন লিখে দায় সারবে, হয়ত কমেন্টবক্সে একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্রও শানিয়ে নেবে৷ কিন্তু লাভ কি হবে শেষমেশ? কবে আমরা প্রকৃত নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কর্ম ও ভাবনাকে আত্মস্থ করতে পারবো? কবে রাজনৈতিক দায়ের চেয়ে প্রাধান্য পাবে দেশের দায়? দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায় ধর্মকর্ম ভেদহীনভাবে? সেদিন প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে এই দেশনায়ককে, " ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে"।।