সমাজ
সমাজ
মফস্বলের ব্যস্ত গলির গায়ে গা লাগানো বাড়িগুলির একটির আঙিনা, সময় সন্ধ্যা সাতটা বেজে বাইশ মিনিট। তিনটি সন্তান নিয়ে বাস করা পরিবারটির একমাত্র রোজগেরে পুরুষ সিংহটি কাজ সেরে ফিরেছেন ঘরে, মুখে ভকভক করছে কমদামী অ্যালকোহলের গন্ধ। পুরুষসিংহের অণ্ডকোষ হতে প্রাপ্ত পুরুষত্বের বীজ গর্ভে ধারণ করে তিন সন্তানের জন্ম দেওয়া রুগ্না মহিলাটি হয়ত কিছু ভুল করে ফেলেছেন পতিদেবতার সেবায়, অগত্যা বিস্তৃত আঙিনায় ফেলে তাকে ঝাঁটা লাথির পুরস্কারে ভূষিত করছেন বারো বছরের পুরাতন স্বামী। আশেপাশে ভীড় করে মজা দেখছে পুরুষ - মহিলা, ছেলে - বুড়ো সবমিলিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীরা। মহিলার ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়াচ্ছে রক্ত, তাও দেবতার ক্লান্ত হাত থামেনি প্রহারে। এরমধ্যেই মহিলার ছেঁড়া পোষাকের আবরণ ভেদ করে আসা বক্ষবিভাজন চোখ দিয়ে চাটছে মজা দেখতে আসা কিশোর থেকে বৃদ্ধ। মহিলারা ব্যস্ত কানাকানি, একে অপরের কনুই ধরে ঠেলাঠেলিতে...... এখনও পর্যন্ত সাহায্যে এগিয়ে আসেনি কেউই। প্রতিবেশি রাগী মেয়েটা মাতাল পুরুষের হাত থেকে স্ত্রী নামক পাপীকে উদ্ধার করে পুলিশে খবর দেওয়ায় শুনল --- " ধেড়ে মাগির বড্ড আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় জড়ানো স্বভাব। " বললেন আশেপাশের বাড়িতে বাস করা কাকীমা জ্যেঠিমারা, লাইভ শো বন্ধ হয়ে গেল যে!
ব্যস্ত রাজপথ, মিনিটে মিনিটে হুশহাশ করে ছুটে দুইচাকা - চারচাকা গাড়ি। সময় সন্ধ্যা ছটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিট। একটু আগে বছর আঠাশের একটি ছেলে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে পথে, একপাশে কাত হয়ে শুয়ে এখনো ঘুরছে দামী বাইকের দুটি চাকা৷ রক্তাপ্লুত ছেলেটিকে ঘিরে ভীড় করেছে আশেপাশের দোকানী থেকে শুরু করে অতিউৎসাহী যাত্রীবৃন্দ। ছেলেটির কান - নাক - মুখ দিয়ে ছলকে ওঠা রক্ত ভিজিয়ে দিয়েছে রাজপথের পিচ, দুর্বল একহাত তুলে কোনোক্রমে সে করে চলেছে সাহায্যপ্রার্থনা। ভীড়ের কিন্তু সেদিকে মন নেই, তারা ব্যস্ত কিকরে হল অ্যাক্সিডেন্ট, দোষ কার এসবের খতিয়ান নিয়ে ; নূন্যতম অ্যাম্বুলেন্স ডাকার কথা মাথায় আসেনি কারো। কিছু মানুষ ঘটনার ভিডিও রেকর্ডিং করে দ্রুতপায়ে ছাড়লেন ঘটনাস্থল, যদি পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয়! কিছু যুবক আহতের সাথে কায়দা করে সেলফি তোলায় মগ্ন, এর মাঝেই পরম হাতসাফাইয়ে তুলে নেওয়া হল আহতের মানিপার্স, মোবাইল, হাতঘড়ি, গলার চেন। পুলিশের পেট্রলিং ভ্যান যখন এসে ভীড় সরিয়ে কোনোক্রমে ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, তার প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেছে ততক্ষণে।
পাশের বাড়ির মেয়েটা ধর্ষিতা হয়েছে গতরাতে, সকাল থেকে বাড়িতে মিডিয়া ও উৎসাহী প্রতিবেশীর ভীড়। সকলেই উৎসুক জানতে ঠিক কোন কোন খাঁজে হাত দিয়েছিল ধর্ষক, তার হাত কতটা জোরে মুচড়ে দিয়েছিল ধর্ষিতার বুকের নরম মাংসপিণ্ড ; তার পুরুষাঙ্গ কতটা আক্রোশে বিদ্ধ করেছিল নরম যোনী! সকাল থেকে জবাব দিয়ে দিয়ে ক্লান্ত মেয়েটির পরিবার, যার ওপর দিয়ে ঝড় বয়েছে সেই পাথরপ্রতিমার পাশে বসে ঘাড়ের আঁচড়ের দাগ মাপতে মাপতে হাতকাটা ব্লাউজ আর পিঠ - পেট প্রদর্শনী করা পৃথুলা কাকীমাটি জানতে চাইলেন --- " সে কি পরে বেরিয়েছিল সন্ধ্যায়? নিশ্চয় ছেলেপুলেগুলোকে ইশারা করেছিল ছেনালীপনা করে! আচ্ছা টু ফিংগার টেস্টে দুটো আঙুল যোণীগহ্বরে পুরে ডাক্তারও কি অতটাই পরিতৃপ্তি পান যতটা পায় ধর্ষণ করে ধর্ষক! "
কি হল মাথা গরম হচ্ছে? ভাবছেন বোধহয় সকাল সকাল এসব কেন লিখছি? আমার লজ্জাশরম নেই এভাবে বলতে পারলাম!
হ্যাঁ পারলাম। নিজের চারপাশে চোখ বুলান, এমন ঘটনা প্রায় প্রতিমুহূর্তেই ঘটতে দেখবেন। আজকাল মানুষ সাহায্য করে কম সমালোচনা করে বেশি। যেই আপনার একটুকু খুঁত নজরে এল, আপনার চারিত্রিক বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যাবে সেই লপ্তে। মানুষকে নিজের গুণ বোঝাতে কালঘাম ছুটবে আপনার, কিন্তু দোষ! সে মানুষ নিজেই খুঁজে নেবে।
আপনি নিজের জীবনে কতটা লড়াই করেছেন বা করে চলেছেন সেটা বড় কথা নয়, একটু চলার পথে পা ফসকাক; আপনার খোরাক হওয়া কে আটকায়! আপনার সাফল্য আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীদের যতটা খুশি করবে মিত্ররূপী শত্রুকূলের মনে জ্বালা ধরাবে বেশি। আপনার যতটা ক্ষতি আপনার শত্রুপক্ষ করবে ততোধিক করবে এই মিত্রবেশী শত্রুকূল।
কি ভাবছেন? এই সবই জানা কথা, আবার কেন বলছি? আসলে মানুষের মন বড্ড ভুলো, স্মৃতি থেকে ঘটনাক্রম হারিয়ে যেতে সময় নেয় না বেশি ; ঠিক যেমন আজ যা ট্রেন্ডিং কাল তাকে মনেও রাখেনা মানুষ।
এত অসহিষ্ণুতার কারণ কি? কেন আজ মানুষ এত অবিশ্বাসী আরেকটি মানুষের কাছে? কেন আজ মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু!
উত্তর চান? আয়নার সামনে একবার দাঁড়ান। নিজেকে প্রশ্ন করুন আজ পর্যন্ত নিঃস্বার্থে ঠিক কতজনের পাশে আপনি দাঁড়িয়েছেন আর কতজন আপনার পাশে! নিজের অন্তরের বিদ্বেষ - বিসম্বাদ দ্বারা কারো ক্ষতি করে ফেলেননি তো কখনো! কথা দিয়ে কথা রাখতে পেরেছেনই বা কতটা! নিজেকে প্রশ্ন করুন, কারন আপনাকে নিয়ে সমাজ ; আপনি শুধরালে সমাজ শুধরাতে বাধ্য। অযথা মানুষের সমালোচনা, তাকে কাঠি করার বদলে তার পাশে দাঁড়ান, ভুল করলে শুধরে দিন ; বিশ্বাস করুন সেই মানুষটি আপনাকে ভুলতে পারবে না কখনো। কেউ বিপদে পড়লে পিঠ দেখিয়ে পালাবেন না, যথাসাধ্য সাহায্য করুন; কোনোদিন আপনি বিপদে পড়লে সেও সাহায্যের হাত বাড়াতে কুন্ঠা প্রকাশ করবেনা। এই দুনিয়ায় অকৃতজ্ঞের অভাব নেই, তা আপনিই নাহয় একটু কৃতজ্ঞ হয়ে দেখুন ; আশাকরি ক্ষতি হবেনা। নিজেকে অবশ্যই ভালোবাসুন, সাথে অপরকেও ভালোবাসুন। মনে রাখবেন, কারো সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করলে নিজেই শেষমেশ ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় ; ছোটবেলায় পড়েছিলেন না সময় বৃত্তাকার.....যা বপন করবে তাই পাবে ; অতএব সাধু সাবধান।