ফিরে আসা
ফিরে আসা
---" আমরা আদপে যা দেখি বা শুনি সবসময় তাইই ঘটে এটা কিন্তু নাও হতে পারে। জানা আর অজানার মাঝে একটা শূণ্যস্থান থাকে যা বড়ই দুর্বোধ্য। " বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে আপনমনেই বলে পল্টু।
--" মানে! তুই বলতে কি চাস? তোকে ভুতে ধরেছে?" ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
---" ঠিক তা নয়। আসলে কি যে হচ্ছে বলে বোঝাতে পারব না। আচ্ছা কেশব তোর কি মনে হয় মৃত প্রিয়জন ফিরে আসতে পারে?" করুণ মুখ করে জিজ্ঞেস করল সে।
থমকে গেলাম। গ্রামের মধ্যে আমি অন্যতম সাহসী ও যুক্তিবাদী হিসাবে পরিচিত। সেই সেবার যখন মোক্ষদাবুড়ির জমিজমা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে ডাইনি তকমা দিয়েছিল গ্রামেরই কিছু ক্ষমতাশালী লোভী মানুষ, সবার আগে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম আমিই। চক্ষুশূল হয়েছি অনেকের সত্য, তবে মোক্ষদাবুড়ির প্রাণ বেঁচেছে এটাই অনেক। আসলে প্রায় অশিক্ষিত এই গণ্ডগ্রামে এখনো ঈশ্বর ও অপদেবতা দুজনের প্রতিই মানুষের ভীতি প্রবল। পল্টুকে অন্যরকম ভাবতাম আমি, এখন দেখছি সেও ব্যতিক্রম নয়।
তেতোমুখে জবাব দিলাম,
---" যার শরীরকে জ্বালিয়ে দিয়েছিস, অস্থিটুকু নিয়ে দিয়ে এসেছিস গঙ্গায়..... সে কিকরে ফেরৎ আসে বলতো!"
পল্টু থম মেরে বসে থাকে বেশ কিছুক্ষণ, তারপর বিড়বিড় করে বলে,
---" মরে গেলেই কি সব শেষ হয় রে কেশব? শরীর বাদে কি মানুষের আর কিছুই নেই!"
মাথা থেকে পা পর্যন্ত জ্বলে গেল। ক্লাস এইট পাশের মুখে দর্শনের বাণী নিতান্ত হাস্যকর ; শুধুমুধু মাথাব্যথা সৃষ্টি করে। রুক্ষস্বরে বললুম,
--" দেখ জানগুরুদের মত কথা বলিস না, আজকের যুগের ছেলে তুই। বাড়ি গিয়ে খেয়ে ঘুমো, কাল ভোরে আবার কাজে বেরোবি। মরার পর মানুষ কেন কারোরই আর কিছুই থাকেনা; তাই ও নিয়ে ভাবা বন্ধ কর। "
পল্টু কেমন যেন দমে গেল আচমকাই, চুপচাপ উঠে পড়ল বেঞ্চ ছেড়ে। যাওয়ার সময় একবার পেছনে তাকিয়ে ম্লানমুখে বলল,
---" তাহলে তো আত্মা শব্দটাই মিথ্যে রে!"
কোনো জবাব দিলাম না, বিরক্ত হয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বিড়িতে টান দিলাম। আস্তে আস্তে পল্টু চলে গেল, পথের বাঁকে হারিয়ে গেল ওর ছোট্ট বেঁটে শরীরটা। আচমকা কেন জানিনা বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল, বড্ড কষ্ট হল ছেলেটার জন্য।
আমার আর পল্টুর বন্ধুত্বটা আজকের নয়, বিগত প্রায় আটবছরের। পল্টুর বাবা অরুণকাকু ছিলেন গ্রামের সেরা রাজমিস্ত্রী, দূরের শহর থেকে বড় বাবুরা এসে ডেকে নিয়ে যেত তাঁকে। কথায় বলে শিল্পীর হাতে শিল্প প্রাণ ফিরে পায়। অরুণকাকুর হাতেও তেমনি জ্যান্ত হয়ে উঠত ইঁট,বালি,সিমেন্টরা.....আমরা সকলে হাঁ করে দেখতাম সেই অসাধারণ নৈপুণ্য। পল্টুর মা বিভাবরী দেবী একটু অদ্ভুত ধরণের মানুষ, ছেলে নয় মেয়ে রমাকেই ঢেলে দিয়েছিলেন যাবতীয় স্নেহসম্পদ। বেচারা পল্টুকে শিশুকালে মায়ের একটু আদরের জন্য কেঁদে বেড়াতে দেখেছি আমি। অরুণকাকু বড্ড ভালোবাসতেন ছেলেকে, আগলে রাখতেন সবসময়। মেধাবী পল্টু কামারগঞ্জ হাইস্কুলের সেরা ছাত্র ছিল। কতদিন গভীর রাতে কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বাপব্যাটায় রান্না করে খেয়েছে ইয়ত্তা নেই, বিভাবরী দেবী অধিকাংশ সময় মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেতেন।
কানাঘুষো শোনা যায় বাপের বাড়ির ওখানেই কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁর, রমা সেই সম্পর্কেরই ফসল। মায়ের সর্বস্ব আদর আর বাবার স্নেহ পেয়েপেয়ে রমা দিনদিন হয়ে উঠছিল উগ্র ও স্বার্থান্বেষী। এখন ভাবলে হাসি পায় এই মেয়েকে আমি একদিন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম, আর এই মেয়ে উড়ে বেড়াত ভ্রমরী হয়ে ভিন্ন ভিন্ন ফুলে।
সবকিছু ঠিকই চলছিল, আচমকা অরুণকাকুর অ্যাক্সিডেন্ট টা শেষ করে দিল সবই। উঁচু ভারা থেকে পা পিছলে পড়ে শিরদাঁড়ায় চোট পান তিনি, অকর্মণ্য হয়েগিয়েছিলেন পুরোপুরিভাবেই। পড়াশুনা ছেড়ে সেইসময়ই কাজে নামে পল্টু, শেয়ালদা লাইনে হকারের কাজটা ওকে জুটিয়ে দিয়েছিলাম আমিই।
পানমশলা, টুকরোটাকরা মনোহারি জিনিস এসব বেচেই পরিবারের গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা করত পল্টু, কিন্তু অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অরুণকাকুর চিকিৎসা।
আমি নিজেও একজন হকার, ট্রেনে ঘুরে ধূপকাঠি বিক্রি করি। তাই আমার পক্ষেও বিশেষ সাহায্য করা সম্ভব হয়নি। যখনই পল্টুদের বাড়ি যেতাম অরুণকাকুর ব্যথায় ভেঙেচুরে যাওয়া চেহারা দেখে বড্ড কষ্ট হত, নিজের অপারগতায় লজ্জিত হতাম বারবার।
পল্টুর মা বা বোনের হয়ত এসবে বিশেষ কিছুই এসে যায়নি। কাকীমাকে কখনো দেখিনি অসুস্থ কাকুর মাথার কাছে এসে বসতে। কাজফেরত পল্টুই বাবার জন্য যেটুকু করার করত।
আজ একমাস হল অরুণকাকু আর নেই, পাঁচবছর শয্যাশায়ী থাকার পর আচমকা হৃদরোগে প্রাণ হারিয়েছেন এক ভোরে। ঘটনাটা শুরু হয়েছে তারপরেই!
একদিন সকালে হন্তদন্ত হয়ে এসে ডাকাডাকি শুরু করে পল্টু। তখন সদ্য শেষ হয়েছে অরুণকাকুর পারলৌকিক কাজ, জ্বরজ্বর ভাব থাকায় কাজে না গিয়ে বিছানায় পড়েছিলাম আমি।
উত্তেজিত গলায় হড়বড় করে পল্টু যা জানায় তার মর্মার্থ হল, গতকাল রাতে ট্রেনে ফেরি করে বাড়ি ফেরার সময় একদল ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়ে সে। এলোপাথাড়ি কিল চড় মেরে তারা কেড়ে নিতে চায় সর্বস্ব। বাধা দিতে গেলে পল্টুর ওপর আছড়ে পড়ে কিল চড় ঘুঁষি। আচমকাই যেন পল্টুর আচরণ বদলে যায়, তার ভেতরে ভর করে অমানুষিক শক্তি। ছয়জন লোককে পিটিয়ে পাটপাট করেই ক্ষ্যান্ত হয়না সে, বরং তাদের কাছ থেকে তাদের ছিনতাই করা ধনসম্পদও কেড়ে নিয়ে আসে। অতরাতে জ্বরের ঘোরে পল্টুর এই বীরত্বগাথা অতটা দাগ কাটেনা আমার মনে,একটা প্যাংলা ছোকরা যে কি করতে পারে বোকার পক্ষেও বোঝা সম্ভব। তবে তার দুর্লভতম হাসিটাকে কেড়ে নিতে ইচ্ছে হয়নি আমার, বরং দুচারকথা বলে একপ্রকার মেনে নিয়েই তাকে সেদিনের মত বিদায় করি আমি। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে এই মাত্রাতিরিক্ত ঘ্যানঘ্যান।
বাবার মৃত্যুর পরে নাকি পল্টুর উন্নতি হয়েছে, বিক্রি বেড়েছে জিনিসপত্রের। আমি এসব মন থেকে বিশ্বাস না করলেও পল্টুর মন রাখার জন্য সায় দিয়ে গেছি বারবার। কিন্তু আজকের ঘটনাটা........ নাহ এটা মেনে নিতে পারলাম নাহ!
ঘরে ঢুকে অল্প কিছু মুখে দিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমি একা মানুষ, কাল আবার ধূপকাঠির বান্ডিল নিয়ে ছুটতে হবে ট্রেন থেকে ট্রেনে। বাইরে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, বোধহয় ঝড় উঠবে মাঝরাতে।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই, দরজায় খুটখাট শব্দে আচমকাই কেটে গেল তন্দ্রাঘোর। এত রাতে কে এল!
ঘড়ির কাঁটা সময় নির্দেশ করছে রাত দুটো, বাইরে মুষলধারে বৃষ্টিপাতের শব্দ.... এতকিছুর ভেতরে বাইরের দরজায় এই খুটখুট! বিছানা ছেড়ে উঠেই পড়লাম অগত্যা, ফতুয়াটা গায়ে গলিয়ে দরজা খুলে দিলাম, নিশুতিরাতে গায়ে একখানা ঝিমকালো কম্বল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে পল্টু!
---" হ্যাঁ রে এত রাতে তুই! বাড়িতে কারো শরীর টরির খারাপ হল নাকি!" আশ্চর্য হয়ে বললাম আমি।
---" নাহ রে, একটা উপকারের জন্য তোর কাছে এলাম।" তক্তপোশের ওপর ধপ করে বসে পড়ে বলল পল্টু।
---" আচ্ছা তো সেটা কাল সকালেই বলতে পারতি। ট্রেনে তো দেখা হচ্ছেই!" বিরক্তমুখে বললাম আমি।
---" সময় হবে না রে, তাই তো তোকে এটা দিয়ে যেতে এলাম।" কম্বলের তলা থেকে একটা লটারির টিকিট বের করে আমার হাতে দিল পল্টু।
হতভম্ব হয়ে বললাম,
--" তুই কি পাগল হলি? একে সংসারের হাঁড়ির হাল, তারপরে আবার লটারি খেলার নেশা শুরু করেছিস! তুই দেখি সব্বনাশ না করে থামবি না!"
--" না রে নেশাটেশা না। আসলে পরশু রাতে আচমকাই কে যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল এই নম্বরের টিকিটটা কাটতে, মূল্য পঞ্চাশ লাখ টাকা!"
---" আর তুই ওমনি কেটে নিলি! পাগল হলি রে পল্টু!" আমি মরিয়া হয়ে বললাম।
---" তুই এটা রাখ দোস্ত, কাল প্রাইজ উঠলে এর থেকে পঁচিশ মাকে দিস আর পঁচিশ তুই রাখিস। আমার আর সময় নেই, আসি।"
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল পল্টু, হাত ধরে আটকাতে গেলাম.... গায়ে লাগতেই কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল, উফফ কি ঠান্ডা!
ততক্ষণে রাস্তায় নেমে পড়েছে সে, চেঁচিয়ে বললাম,
---" অত বৃষ্টিতে যাসনে, আজ রাতটা নাহয় এখানে থেকে যা।" চলে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল পল্টু, আনুনাসিক স্বরে বলল---
" তুই ঠিকই ছিলি রে দোস্ত, মা আমায় কখনো ভালোবাসেনি।"
থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বড্ড কষ্ট হচ্ছিল ছেলেটার জন্য, এত কঠোর পরিশ্রম করে দুবেলা অন্নের জোগান দিয়েও নূন্যতম মর্যাদা পায় না ছেলেটা।
কিন্তু এত বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আসবার পরেও ওর গায়ের কম্বলটা খটখটে শুকনো কেন! তাছাড়া শরীরটাও এত ঠান্ডা কেন! উত্তর মিলছে না কিছুতেই।
* * * * * *
এতদূর পর্যন্ত বলে থামলেন কাশীদা, খুকখুক করে কেশে উঠলেন। পটলা জলের বোতলটা এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে অনেকটা জল খেয়ে একটু সুস্থির হলেন তিনি।
ভবানী শুধোল,--- " খুড়ো এরপর কি হল?"
---" কিই বা হবে আর! সকালে জানতে পারলাম সেদিন রাতেই গলায় দড়ি দিয়ে জ্বালা জুড়িয়েছে পল্টুটা। আমার কাছে যখন এসেছিল তার থেকে প্রায় দুইঘন্টা আগে। কেন এরকম করল কেউ জানেনা, হয়ত অরুণকাকুই টেনে নিলেন ওকে, উনি ছাড়া ওর নিজের বলতে ছিলই বা কে!" ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন খুড়ো।
-- " তারপর তুমি কি করলে?" আগ্রহভরে জানতে চাইল পটলা।
--" কিই বা করব! লটারির টাকাটা তুলে অর্ধেক ওর মাকে দিলাম, তিনি মেয়ে নিয়ে অন্য গ্রামে উঠে গেলেন। শুনেছি বিয়ে করেছিলেন আবার। বাকি টাকায় গ্রামে একটা বিনা বেতনের ইস্কুল বানিয়ে দিয়েছি, বাচ্চাগুলোকে আর অতদূর গিয়ে পড়তে হয় না। " স্মিত হেসে বললেন কাশীদা।
আমরা হাঁ করে চেয়ে রইলাম এই অকৃতদার নির্লোভী মানুষটার দিকে। অতগুলো টাকা, যা পেলে তাঁর নিজের জীবন অন্যখাতে বইতে পারত, গ্রামের উন্নতিতে দান করার বুকের পাটা রাখেন কজন!
ভবানী আস্তে আস্তে বলল,
---" খুড়ো তুমি গ্রাম ছাড়লে কেন?"
---" কিই বা করতাম বল! প্রতিরাতে পল্টুর কান্নামাখা মুখটা দেখতে ভালো লাগছিল না রে। আমি থাকলে মায়া কাটাতে পারছিল না ছেলেটা, ফিরে ফিরে আসছিল। তাই চলে এলাম। " লাঠিতে ভর দিয়ে মন্দিরের দিকে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন কাশীদা। আজ প্রায় কুড়ি বছর ভদ্রকালী মন্দিরের সেবায়েত তিনি, ওখানেই খান ঘুমোন। আর সন্ধ্যাবেলা আমাদের আড্ডায় এসে তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শোনান এককাপ চা আর একটা বিড়ির বিনিময়ে।
মানুষের জীবন বড্ড অদ্ভুত, কেউ ছোটে ভোগের পেছনে,কেউ বা ত্যাগের। আর কেউ! চলে গিয়েও ফিরে আসে বারবার ভালোবাসার মানুষদের কাছে, একটু জুড়ে থাকবে বলে।।
(সমাপ্ত)