অপয়া
অপয়া


ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার৷ নিঃসীম পাহাড়ের কোলে জোনাকির স্রোতের ন্যায় জ্বলে উঠছে আলো।
হোটেলের ঘরের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল শরণ্যা। আজ প্রায় তিনদিন হলো সে এসেছে এই পাহাড়ি শহরটাতে। এখানকার জীবনযাত্রা বড়োই শান্ত, সন্ধ্যা হতে হতে গাঢ় নিস্তব্ধতার অন্তরালে চাপা পড়ে।
ইঁট কাঠ পাথরের পিঞ্জর হতে এখানে প্রায় পালিয়ে এসেছে সে। ওখানে দমবন্ধ হয়ে আসছিলো তার। মনে হচ্ছিলো সময় যেন থমকে গেছে৷ চোখের সামনে একের পর এক মৃত্যু বাকরুদ্ধ করে দিচ্ছিলো তাকে৷ হারিয়ে গিয়েছিল অনুভূতি, দমচাপা বেদনায় শিউরে উঠতে উঠতে ও অবসাদের অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে খড়কুটোর মতো সে আঁকড়ে ধরেছিল পাহাড়কে... তার প্রথম প্রেমকে।
এখানে আসার পরেও কি পুরোপুরি ভালো আছে সে! বলা যায় না সম্ভবত। এই তিনদিন নিজের ঘর থেকে বেরোয়নি সে, একপ্রকার স্বেচ্ছাবন্দীই আছে বলা যায়। শুধু জানলার পাশে দাঁড়িয়ে নীরিক্ষণ করে গেছে কিভাবে প্রহরে প্রহরে বদলে যায় পাহাড়ের রঙ। সকালের ধূসর কুয়াশার আবরণ রোদ পড়তেই সোনালী রঙ ধারণ করে, আবার বেলা বাড়তে সে হয়ে যায় হলুদ থেকে সাদা। যখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসে, মনে হয় এক সর্পিল পরজীবি কুণ্ডলীকৃত আবরণে বেষ্টন করে ফেলেছে তাকে, দূরের মঠ থেকে ভেসে আসে সমবেত প্রার্থণামন্ত্র, " বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় এসে বসে শরণ্যা। তাকে এই অবসাদ থেকে যেভাবেই হোক বেরোতে হবে, অনেক কাজ বাকি। এভাবে থেমে গেলে তার চলবে না, পুরো পরিবারের দায়িত্ব যে এখন তার কাঁধে!
কিন্তু ময়ূখ! তাকে কিভাবে ভুলতে পারবে সে! কিকরে ভুলতে পারবে যন্ত্রণাকাতর তার ভাঙাচোরা মুখখানা! এমনটাতো হওয়ার কথা ছিল না। তবে কি সবই তার পোড়া কপালের দোষ! সেই সন্ন্যাসী কি তবে ঠিক বলেছিলেন!
তার আজও মনে পড়ে কৈশোরের সেই দিনটা। টুপটুপ করে বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন, আকাশটা ছিল গাঢ় মেঘে ঢাকা। বাড়ির সামনের রাস্তায় সমবয়সী সখীদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো কিশোরী শরণ্যা। হটাৎ সামনের দিকে চোখ চাইতেই চমকে ওঠে সে। কে এই লোকটা! এমন জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে কেন তার দিকে! জটাজুটধারী, কালো কাপড় পরণে অদ্ভুত লোকটাকে একনজর দেখলেই ভয় লাগে। তারপরে চোখদুটো তার রক্তজবার মতো লাল, বোঝাই যায় নেশা করে সে। তাকে দেখেই শরণ্যার সখীরা দুদ্দাড়িয়ে দৌড়য় ভেতরবাড়ি অভিমুখে, কিন্তু সে নড়তে পারেনা। একদৃষ্টে ঠায় তাকিয়ে থাকে। লোকটার দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত সম্মোহন আছে!
লোকটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে, নাকে ধাক্কা দেয় বুনো ভ্যাপসা গন্ধ। তার দিকে আঙুল তুলে বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র পড়ে লোকটা, তারপর আচমকাই ফ্যাসফ্যাসে গলায় চেঁচিয়ে ওঠে,
" খাবি, সবাইকে খাবি তুই। তোর বাবা, মা জানে না কাকে জন্ম দিয়েছে! সাক্ষাৎ শয়তান! যাকেই ভালোবাসবি সেই মরবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না। অভিশাপ তুই, তোর বাড়ির ওপরে ছড়িয়ে থাকা কালো অভিশাপ তুই! "
কেউ চাবুক মারলেও বোধহয় এতটা যন্ত্রণা হতোনা, যতটা ওই কথা কয়টি শুনে অনুভব করে কিশোরী কন্যা। লোকটা হনহন করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে। শুধু অনড় মূর্তির ন্যায় হতভম্ব শরণ্যা বৃষ্টিভিজে দাঁড়িয়ে থাকে, দাঁড়িয়েই থাকে।
সময়ের প্রভাবে হয়ত মন থেকে মুছে যেত কটু কথার স্মৃতিগুলো, কিন্তু ঘটনাক্রম তা হতে দেয়না। স্কুলের অ্যানুয়াল ডে ফাংশনে যেদিন তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী তার চোখের সামনে স্কুলবিল্ডিং এর ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়, শরণ্যার মনে দাগ হয়ে বসে যায় সন্ন্যাসীর কথাগুলি৷
তারপর... তারপর শুধু মৃত্যুমিছিল।
চোখের সামনে প্রিয়জনের লাশ হয়ে যাওয়া। প্রতিবারেই তাদের অন্তিম মুহূর্তের সাক্ষী থাকে শরণ্যা, না চাইতেও মৃত্যু যেন তাকে ছুঁয়ে আঘাত করে তার প্রিয়জনদের।
ভালোবাসতে ভয় পেতো শরণ্যা। ভয় পেতে শুরু করেছিল নিজের ভাগ্যকে। মা - বাবার সঙ্গেও ইচ্ছে করেই দূরত্ব বাড়িয়েছিল সে দাদার মৃত্যুর পর, রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে " অপয়া " শব্দটা হয়ে গিয়েছিল কান সওয়া।
এরমাঝেই একদিন তার জীবনে এলো ময়ূখ। ভাবলেই দিনটাকে যেন স্বপ্ন বলে মনে হয় তার। কলেজ ফেস্টে কয়েকশো সহপাঠীর ভীড়ে তাকেই পছন্দ হয়েছিল ময়ূখের, যেচে এসে আলাপ করেছিল। তার ভুলভাল কবিতা আওড়ানো দেখে অনেকদিন পর হো হো করে হেসেছিল শরণ্যা, না চাইতেও কৌতুহলী হয়ে আলাপ করেই ফেলেছিল মুখচোরা ছেলেটার সঙ্গে।
তারপরের দিনগুলোকে যেন স্বপ্ন মনে হয় তার। এই তো সেদিনের কথা, কিন্তু আজ যেন তারা কত দূরে! হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়না তাদের, স্মৃতিরা বাঁচে আলোকবর্ষী দূরত্ব নিয়ে।
কলেজ ক্যান্টিন, প্রিন্সেপ ঘাট ছুঁয়ে তাদের জীবন তখন ট্রামলাইনের মত একসুরে বাঁধা। শরণ্যার ভেতরের ভয়টাকে আস্তে আস্তে কাটিয়ে তুলেছিল ময়ূখ, বাবা মাও পছন্দ করে ফেলেছিলেন তাকে।
সেদিনও ছিল বৃষ্টির সন্ধ্যা। কলেজজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার খুশিতে দুজনে মিলে বেরিয়েছিল লং ড্রাইভে। শরণ্যার জীবন এখন ময়ূখময়, কিছুতেই তাকে ছাড়া একটা দিনও ভাবতে পারে না সে। এক সুন্দর ঝিলের ধারে পূর্ণিমার সন্ধ্যাকে সাক্ষী করে তাকে বিবাহপ্রস্তাব দিয়েছিল ময়ূখ। না করার কারণ ছিলো না, কিন্তু তারপরে যেটা হয়েছিল তা ভাবলে আজও শিউরে ওঠে সে।
একটা সাপ! হ্যাঁ, কালো কুচকুচে একটা সাপ কোথা থেকে এসে দংশন করেছিল ময়ূখকে। তার চোখের সামনে যন্ত্রণায় নীল হয়ে মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিলো সে। গলা চিরে চিৎকার করেও সেদিন কোনো মানুষের দেখা পায়নি শরণ্যা, তার চোখের সামনে কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে গিয়েছিল ময়ূখ। সাপটা আশেপাশে কোত্থাও ছিলো না, শুধু মাথার ওপর ধীরলয়ে পাক খাচ্ছিলো তিনটে শকুন।
* * * * *
দরজায় ঠুকঠুক শব্দে অতীত থেকে বর্তমানে ফেরে শরণ্যা। বেয়ারা এসেছে চায়ের পেয়ালা - পিরিচ হাতে। পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকায় বেয়ারা। এ লোকটি নতুন, এই তিনদিনে একবারের জন্যও এই লোকটিকে দেখেনি শরণ্যা। চামচে করে চায়ে চিনি গুলতে গুলতে ভাঙা বাংলায় লোকটি বলে,
--" কাল একবার মঠ থেকে ঘুরে আসেন মেমসাহাব, ভালো লাগবে। "
চমকে ওঠে শরণ্যা। কিছু বলার আগেই আবার বলে ওঠে লোকটা,
--" নিজেকে বন্দী করে সমস্যার সমাধান হবেনা মেমসাহাব। জানতে হবে আপনার ওপর এ অভিশাপ কেন! যাতে অন্য কেউ আর মারা না যায়। "
শরণ্যাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় লোকটা, তার শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে নামে হিমস্রোত।
* * * * * *
সকালটা এখানে একটু বেলা করে হয়। শীতের আমেজ কাটিয়ে বেলা বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের দৈনিক জীবনযাপন শুরু করে শহরবাসী। লোকটির কথামতো আজ মঠে এসেছে শরণ্যা। তারও কতদিনের ইচ্ছে জানার, এমন কেন হয় তার সাথে! কই আগে তো এমন ছিলো না!
পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে অনেকটা উঠলে এই মঠ। সাদামাটা ছোট আস্তানাটিতে বাস করেন কিছু নানাবয়সী গেরুয়া বসনধারী লামা। ভেতরে ঢুকলে সবার আগে ধূপের গন্ধ এসে লাগে নাকে, প্রশস্ত উঠোনে সারবেঁধে দাঁড় করানো প্রেয়ার হুইলস অভয় দেয়, নিজেকে কেমন যেন নির্ভার বোধ হয় শরণ্যার।
প্রার্থনাকক্ষে তেমন লোকজন নেই। সামনের দিকে তাকালে সুউচ্চ ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি সাহস যোগায় মনকে। এক কমবয়সী লামা তাকে দেখে এগিয়ে আসে, ইশারায় জানতে চায় আসার উদ্দেশ্য। পর্যটকরা এই ছোট মঠে আসেন না, চলে যান একটু দূরের জমকালো বিরাট মঠে। তাই শরণ্যাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছে সে।
থেমে থেমে কোনোক্রমে পুরো ঘটনা বিবৃত করে শরণ্যা, গতরাতে বেয়ারার অদ্ভুত আচরণের কথাও বাদ দেয়না। লামাটি মাথা নেড়ে স্মিত হেসে তাকে অনুসরণ করতে বলে।
লম্বা করিডর পেরিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত বড় ঘরে তাকে নিয়ে যায় ছোট লামা। ঘরটি আসবাবপত্র হীন, সাদামাটা। মেঝেতে বিছানো গালিচায় পদ্মাসনে বসে এক বৃদ্ধ,পরণে লামাদের মত পোশাক। শরণ্যা ঘরে ঢুকতেই তাকে ইশারায় সামনে বসতে বলেন।
বৃদ্ধ যেন অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য। শরণ্যা বসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অল্পবয়সী লামা। বৃদ্ধ মাথা নেড়ে খাঁটি বাংলায় বলেন,
--" বড্ড দেরী করে এলে। আগে আসলে বোধহয় এতোগুলো মৃত্যু দেখতে হতোনা। "
--" আপনি বাংলা জানেন! কিকরে!" অবাক হওয়ার পালা শরণ্যার।
--" আমরা পরিব্রাজক মা। দেশ - বিদেশে ঘুরে বেড়াই। কিছুদিন তোমাদের দার্জিলিং এর মঠেও ছিলাম, তখনই বাংলা শিখি। " হেসে বললেন বৃদ্ধ।
---" আপনি কিকরে জানলেন আমি আসবো!"
বৃদ্ধ ঠোঁটে হাত দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলেন তাকে। হাতের ছোট্ট প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়েন, সামনে রাখা অদ্ভুত শিশি থেকে জল ছিটিয়ে দেন শরণ্যার মাথায়।
ঘরের ভেতর আচমকা এক আলোড়ন। এক দমকা বাতাস যেন তোলপাড় করে বেড়ায় গোটা ঘরখানাকে, উলটে পড়ে বাতিদান। একমিনিট পরে সব শান্ত, যেন বাতাস বেরিয়ে গেছে খোলা জানলার পথ দিয়ে, দূরে রোদ মেখে হাসছে পাহাড়।
--" তোমার পেছন পেছন এক কালো ছায়া প্রবেশ করেছিল এই ঘরে, তাকেই তাড়িয়ে দিলাম। নয়ত সে শুনে ফেলতো আমাদের কথা, এতে তোমার বড্ড বিপদ হতো। এরজন্যেই এত দুর্ঘটনা, এত মৃত্যু। এই ছায়াই তোমার কাছাকাছি কাউকে টিকতে দেয় না। তাদের মেরে ফেলে। " একনিঃশ্বাসে কথা কয়টি বললেন বৃদ্ধ।
--" কিন্তু এই ছায়া কার! কেন আমার সঙ্গেই এমনটা হচ্ছে!" হাউমাউ করে ওঠে শরণ্যা।
--" কারণ তোমার ওপর প্রেতপ্রভাব রয়েছে মা। এই ছায়া এক ভয়ানক প্রেতের। এর কোনো নিজস্ব রূপ নেই, আকৃতি নেই, তবে চাইলেই যেকোনো কিছুর আকৃতি গ্রহণের ক্ষমতা রাখে এ। তোমার সঙ্গে এতদিন লেপটে ছিল এই ছায়া, তুমি বুঝতেও পারোনি। ওই সন্ন্যাসী এই প্রেতকে দেখেই তোমায় সতর্ক করেছিলেন। তুমি তাকে কটুবাক্য বলে ধরে নাও, আসল কারণের সন্ধান করোনি। এরজন্যই ঘটে গেছে এত ঘটনা। "
--" কিন্তু আমিই কেন বাবা! আমার সঙ্গেই এমন কেন! কি দোষ আমার! " চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কথাগুলি বলে শরণ্যা।
--" প্রেতপ্রভাবে কারো দোষ থাকে না মা। ঈশ্বরের মতোই প্রেত সর্বত্রব্যাপী। ঠিক তোমাদের বিজ্ঞানের পজিটিভ ও নেগেটিভ এনার্জির থিয়োরীর মত। শুভ শক্তি থাকলে অশুভ শক্তি থাকবেই। শুধু তাদের প্রভাবকে কমবেশি করা যায়, এড়ানো যায় না। আচ্ছা বলো তো, ওই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কি কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল! " চিন্তামগ্ন স্বরে জানতে চান বৃদ্ধ।
-- " না মানে...তেমনকিছু...." বলতে গিয়েও থেমে যায় শরণ্যা। মনে পড়ে, কৈশোরে এক আদিবাসী গ্রামে সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে তার এক অদ্ভুত মূর্তি দেখে আকৃষ্ট হয়ে পড়া। মা বারবার বাধা দিয়েছিলেন কালো পাথরে কোঁদা ছোট্ট মূর্তিটি ঘরে আনতে, ওই মূর্তি নাকি ছিল আদিবাসীদের আরাধ্য অপদেবতার। কিন্তু শরণ্যা শোনেনি, একান্ত মুগ্ধতার বশে একরকম জেদ করেই কিনে এনেছিলো সেই মূর্তি। এতগুলো বছরে একবারের জন্যও মূর্তিটিকে কাছছাড়া করেনি সে। বরং এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও ব্যাগে করে বয়ে এনেছে তাকে এই পাহাড়ি শহরে। মূর্তিটি যেন তার কাছে অমোঘ আকর্ষণ, যাকে উপেক্ষা করার সাধ্য তার নেই।
শরণ্যার কণ্ঠার হাড়ের ওঠানামার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ছিলেন বৃদ্ধ। শেষমেশ গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
--" বেশ। আগামীকাল বুদ্ধপূর্ণিমা। ওইদিন তুমি আবার এখানে আসবে। উপাসনায় বসবো আমরা। পবিত্র বুদ্ধের কাছে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করবো মুক্তি। আমি আগেই বলেছি অশুভ শক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব নয়, তা প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। তবে শুভ শক্তি দ্বারা তার প্রভাবকে কাটানোর চেষ্টা করা যেতেই পারে। বুদ্ধের ওপর আস্থা রাখো মা, উনি কোনো না কোনো উপায় বলে দেবেনই। "
শরণ্যার হাতের কবজিতে মন্ত্রপূত কালো সুতো বেঁধে দিলেন বৃদ্ধ, মাথায় ছিটিয়ে দিলেন পবিত্র জল। তাঁকে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে মঠ থেকে বেরিয়ে এলো শরণ্যা। আকাশটা কেমন গুমোট হয়ে আছে, তবুও অনেকদিন পর আজ একটুও ভয় করছেনা তার।
* * * *
গতকাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি শরণ্যা। দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে উঠেছে বারবার। একলা ঘর রাতে যেন গিলে খেতে আসছিলো তাকে, সকাল হতেই অশান্ত মন নিয়ে সে ছুটে এসেছে মঠে।
বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে সুন্দরভাবে সেজে উঠেছে ছোট্ট মঠখানা। বিভিন্ন বয়সী লামারা সমবেত প্রার্থনায় বসেছে বুদ্ধমূর্তির সামনে, সামনের সারিতে বসে একমনে প্রার্থনারত বৃদ্ধ। শরণ্যার কেমন যেন শীত করছিলো, ব্যাগের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিলো অদ্ভুতদর্শন মূর্তি। আজকের দিনটাই স্থির করবে তার আগামী জীবন কোন খাতে বইবে।
প্রার্থনা শেষে শরণ্যাকে তাঁর ঘরে নিয়ে এলেন বৃদ্ধ। আজ সঙ্গে যোগ দিলেন চারজন বয়োজ্যেষ্ঠ লামা। অদ্ভুতদর্শন মূর্তিটিকে মধ্যখানে রেখে তার চারধারে চক্রাকারে বসলেন ওঁরা পাঁচজন। প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করলেন মন্ত্র, ঘরের এককোনে গন্ডির অন্দরে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলো শরণ্যা।
ঘরের ভেতর ছোটোখাটো ঝড়ই উঠলো বলা যায়। আগের দিনের থেকে তা যেন আরো প্রবল, ঘরে স্থিত প্রতিটি মানুষ উলটে পড়লেন হাওয়ার ঘায়ে, কিন্তু মন্ত্র পড়া থামালেন না। চক্রস্থিত মূর্তিটিকে ঘিরে ঝোড়ো হাওয়া যেন নৃত্য করতে শুরু করলো। বাইরে গুরুগুরু গর্জাচ্ছিল মেঘ, আকাশের বুক ফালাফালা করে দিচ্ছিলো রূপোলী বিদ্যুৎরেখা।
লামারা এবার সুর করে মন্ত্র পড়তে পড়তে প্রেয়ার হুইল উলটো দিকে ঘুরাচ্ছিলেন। ঝড়টা আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসছিলো, যেন সমবেত ক্ষমাপ্রার্থনার সামনে তুষ্ট হচ্ছেন অপদেবতা। আচমকাই আঁতকে উঠলেন বৃদ্ধ, যন্ত্রণায় কুঁচকে ফেললেন মুখ। বাকি লামারা সেদিকে দৃকপাত না করে মন্ত্র পড়ে যেতে লাগলেন। বুকে হাত চেপে চক্রের ভেতর মূর্তিটির পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়লেন বৃদ্ধ, মুখ থেকে ফেনা বেরিয়ে এলো তাঁর। কট করে শব্দ হলো, সারা শরীরটা ধনুকের মত বাঁকিয়ে একটু কেঁপে স্থির হয়ে গেলেন তিনি, সেইসঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল মূর্তিটা।
নিঃশব্দে উঠে এলেন ওরা চারজন। ইশারায় শরণ্যাকে বললেন চলে যেতে। কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এলো শরণ্যা, পেছন পেছন এলো আগের দিনের সেই কমবয়সী লামাটি। মঠের দরজার বাইরে শরণ্যাকে পৌঁছে দিয়ে স্মিত হাসলো সে, জড়ানো হিন্দিতে বললো,
--" গুরুজী জানতেন ওই মূর্তি তার শেষ বলি না নিয়ে যাবে না। তাই আপনার অভিশাপ খণ্ডণের বিনিময়ে নিজের প্রাণের সওদা করেছিলেন তিনি। বড়ো শক্তিশালী অপদেবতা, আদিবাসীরা এঁকে মৃত্যুর দেবতা মানে। তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন আপনি, মৃত্যু হওয়ারই ছিল। আর আপনার কোনো ভয় নেই। অভিশাপ আর ছোঁবে না আপনাকে। "
ভেতরে ঢুকে ঘড়ঘড় করে মঠের দরজা বন্ধ করলো অল্পবয়সী লামা। ভারী মন নিয়ে পথে নামলো শরণ্যা। ঈশ্বরের সন্তান নিজের জীবন দিয়ে তার অভিশাপ মুছে দিয়ে গেছেন। সে এবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে। যারা চলে গেছে তারা ফিরে আসবেনা ঠিকই, তবে আর কেউ মরবেনা তাকে ভালোবাসে।
সোনালি রোদ পিছলে যাচ্ছে পাহাড়ের গায়ে, পাহাড় হাসছে।।