Dola Bhattacharyya

Tragedy Classics

4  

Dola Bhattacharyya

Tragedy Classics

যারা চলে যায়, ফেরে না তাে হায

যারা চলে যায়, ফেরে না তাে হায

9 mins
210



অনেক দূরের থেকে কি যেন এক সুর ভেসে আসছে কানে। আমি শুনছি কান পেতে। আস্তে ভাষাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে —

"পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার 

এই ভাঙা ঘাট কবে হল পার 

দূর নীলিমার বক্ষে তাহার উদ্ধত বেগ হানি"। 

কে গাইছে এ গান! তাকে চোখে দেখি না। শুধু তার গানের সুর টুকু রেশ রেখে যায় আমার মনে। অথচ আর কেউ তাকে শুনতে পায় না। কি অদ্ভুত তাই না! 

ওই তো শোনো ।আবার গাইছে সে। শুনতে পাচ্ছো তোমরা —

" মুগ্ধ আলসে গণি একা বসে পলাতকা যত ঢেউ 

যারা চলে যায় ফেরে না তো হায় পিছু পানে আর কেউ 

মনে জানি কারো নাগাল পাব না —তবু যদি মোর উদাসী ভাবনা 

কোনো বাসা পায় সেই দুরাশায় গাঁথি সাহানায় বাণী ।" 


না। পাচ্ছো না। জানি। আসলে এই গানটা আমার বাবাকে গাইতে শুনেছি। আর একজন গেয়েছিল এই গান। অমরকন্টকের সেই সন্ন্যাসী, যার সাথে আমার বাবার ভীষণ মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ধরা দেননি আমার কাছে। তাঁর গাওয়া সেই গানখানি আজও রয়ে গেছে আমার মনের মধ্যে। 


পশ্চিমের আকাশটা এই মুহুর্তে লালে লাল হয়ে উঠেছে। সূর্যাস্তের সময়টায় রোজই আমি এই ব্যালকনিটায় এসে দাঁড়াই। দিনের শেষটা দেখি দুচোখ ভরে। মনে হয় এভাবেই আমিও তো একদিন শেষ হয়ে যাব। মুক্তি পাব এই হতাশা ভরা জীবনটা থেকে। বড্ড ইচ্ছে করে, তিন তলার এই ব্যালকনিটা থেকে নিজেকে ছুঁড়ে ফেলতে, ওই যে, ওই কংক্রিটের রাস্তাটার ওপরে। তারপর! তারপরের কথা আর ভাবতে ইচ্ছে করে না। নাঃ। ভাবতে তো হবেই। এখনও যে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা বাকি রয়ে গেছে। তারপর আমার মুক্তি ।


আজ কতদিন হয়ে গেল, বাবা নেই বাড়িতে। কোথায় আছে, কেমন আছে তাও জানি না। এই ব্যালকনিটা বাবারও খুব প্রিয় জায়গা ছিল । বাবাও রোজ সূর্যাস্তের সময় এখানটায় এসে দাঁড়াত। আমার মতো শেষের স্বপ্ন নয়, দেখত নতুন শুরু হওয়া আর একটা দিনের স্বপ্ন। 


আজ বাবার কথা বড় মনে পড়ছে। বাবার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো মনে পড়ছে। এই তো যেন সেদিনের কথা, মায়ের জন্মদিনে মাকে সারপ্রাইজ দেব বলে বাবা আর আমি দুজনে মিলে কেক বানিয়েছিলাম। আমাদের হুটোপাটিতে মা সব জেনেই ফেলল। মাকে আর সারপ্রাইজ দেওয়া হলো না। স্মৃতি আবার পেছনে হাঁটতে শুরু করেছে । মনে পড়ে যাচ্ছে সেই সাঁতার শেখার দিনগুলো। ক্লাস ফোরে পড়ি । গরমের ছুটি চলছিল তখন। রোজ সকালে গঙ্গায় নিয়ে যেতে আমাকে সাঁতার শেখাবে বলে। ভয়ে প্রথম প্রথম তোমাকে আঁকড়ে ধরে থাকতাম। তারপর একটু একটু করে হাত পা ছোঁড়ার চেষ্টা করতাম। মাত্র সাত দিন। তারপরেই এসে গেল দারুণ জ্বর। জ্বর সারলে মা আর যেতেই দিল না গঙ্গায়। আর সাইকেল চড়া! সাঁতার যখন হলো না, তখন তুমি বললে, "চল, তোকে সাইকেল চালানোটা শিখিয়ে দিই"। সেখানেও মায়ের আপত্তি। "একদম না। মেয়েমানুষ। পড়ে গিয়ে কোথায় হাত পা ভাঙবে। শরীরে একটা খুঁত হয়ে গেলে মুশকিল। বিয়ে দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে তখন।" আর খুঁত! এই নিখুঁত শরীরটাকে নিয়েই হয়েছে যত জ্বালা। আচ্ছা বাবা! একবারও কি আমার কথা মনে পড়ে না তোমার! সেদিন যদি জেদ করে সৌনক কে বিয়ে না করতাম, তাহলে হয়তো আমাকে আজকের এই দিনটা দেখতে হত না। বাবা মা দুজনেরই আপত্তি ছিল এই বিয়েতে।তবুও হয়েছিল বিয়েটা ।রেজিস্ট্রি করে। কোনো আলো জ্বলে নি। কোনো লোকও আসেনি। শুধু আমার কলেজের দুজন সহকর্মী, আর সৌনকের দুজন বন্ধু গিয়েছিল রেজিস্ট্রি অফিসে। 

বাবার বন্ধুর ছেলে অতনুর সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছিল। ছেলেটি আমার সম যোগ্য। কিন্তু আমি তখন সৌনকের ভালবাসায় মুগ্ধ। না বুঝে হীরে ফেলে আমি কাঁচকে বেছে নিয়েছিলাম। 


বিয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে ওর স্বরূপ টা প্রকাশ পাচ্ছিল। মায়ের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে আমাদের বাড়িতে ওঠা দিয়ে শুরু হল। যতবার বলেছি, "সৌনক, এবার ফিরতে হবে তো। মা তো এখন অনেক সুস্থ।" হেসে হেসে জবাব দিয়েছে, "তুমি কি খারাপ আছো এবাড়িতে। এটা তো তোমার নিজেরই বাড়ি, এখানে থাকতে এত অস্বস্তি কিসের! এই! কেউ কিছু বলেছে নাকি"? 

"ধ্যুর! কে আবার কি বলবে!" 

"ঠিক ।আমি তো এটাই বলছিলাম। কারো কিছু বলার অধিকার নেই। এটা তো তোমারই বাড়ি। আর তোমার বাড়ি মানেই আমারও বাড়ি"। 

"আজ্ঞে না মশাই। এটা তোমার শ্বশুরবাড়ি, আর আমার বাবার বাড়ি।"


কথায় কথায় একদিন জানতে পেরেছিলাম, সৌনক পিতৃমাতৃহীন ছেলে, অনাথ আশ্রমে পালিত ।চমকে উঠেছিলাম সেদিন, " সেকি! বিয়ের আগে বলোনি তো এসব!"

" আরে! বললে কি তোমায় পেতাম! আর তুমি তো জিজ্ঞেসও করোনি "। সত্যি। কেন যে জানতে চাইলাম না সেদিন। আজ মনে হয় একজন অধ্যাপিকা হয়ে এই ভুল আমি কি করে করলাম! 


 ওকে না জানিয়েই একদিন নিজের ফ্ল্যাটে গেলাম। এতদিনে না জানি কত নোংরা জমে গেছে। ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজাটা খুলেই দেখি, বেডরুমের দরজাটা খোলা! বিছানার কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে দুটো নগ্ন শরীরের আভাস, সঙ্গমরত। টলে পড়ে যাচ্ছিলাম ।নিজেকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে সোফার হাতলটা খামচে ধরলাম। গলা চিরে বেরিয়ে এসেছিল আর্তনাদ। ছিটকে উঠে পড়ল ওরা। আমি আর এক মুহূর্তও দাঁড়াইনি ওখানে। সৌনকের কুৎসিত চেহারাটা ধরা পড়ে গিয়েছিল আমার চোখে। আর এই জানার ফল হয়েছিল মারাত্মক। প্রতি রাতে শারীরিক নির্যাতন মাত্রা ছাড়াল। তবুও ছিলাম। মেনে নিয়ে নয়, মানিয়ে নিয়ে। এসব ঘটনা যেন ঘরের বাইরে না বেরোয়। বাবা মা জানতে পারলে লজ্জার শেষ থাকবে না। আমি যে নিজেই পছন্দ করেছিলাম সৌনক কে।আস্তে আস্তে ওর লোভী হাতটা আরও অনেক কিছু গ্রাস করতে চাইছিল। প্রতি মাসে আমার মাইনের টাকাটা তো নিতোই। তাতেও হচ্ছিল না। বাবার কাছেও টাকা চাইতে শুরু করল। এই নিয়ে একদিন অশান্তি চরমে উঠল। মা ছিল হার্ট পেসেন্ট ।চরম উত্তেজনার মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ে যায় মা। আর চোখ মেলে তাকায় নি। কলেজে ক্লাস নিচ্ছিলাম। সেই সময়ে খবরটা আসে আমার কাছে। হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম, তখন সব শেষ। 


  বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারলাম মায়ের মৃত্যুর কারণ টা। সৌনক নিজেই হাসতে হাসতে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিল। মদে চুর হয়ে ছিল সেদিন ।"টাকা দিবি না মানে! আলবাৎ দিবি। তোর মাকে সেদিন এই কথাটা বলতে, তোর মা গেল ক্ষেপে। আমাকে বলল, জুতো মারতে মারতে বাইরে বের করে দেবে। ইঃ! এতবড় সাহস। আমাকে নাকি জুতো মারবে। আঁচল থেকে আলমারির চাবি টা খুলে নিতে গেলাম। শালি দিলে না। তায় আবার তোর বাপটা এসে দাঁড়াল। আমায় বলে নাকি পুলিশে দেবে। চাকুটা ধরলাম বুড়োর গলায়। আর এটা দেখেই বোকা বুড়িটা ভিমরি খেল।" আমি স্তম্ভিত। আমার একটা ভুলের জন্যে আমার পরিবার আজ বিপর্যস্ত। হে ভগবান! 

কিছুদিন পর থেকেই সৌনক বলতে শুরু করল, তোমার বাবা কে বলো, এই বাড়িটা তোমার নামে লিখে দিতে। একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম দেখে রেখেছি। তোমার বাবা সেখানেই ভালো থাকবে। এবার আর অবাক হইনি। কারণ এরকম কথা সৌনকই বলতে পারে। জিজ্ঞেস করলাম, "আমার নামে বাড়িটা বাবা লিখে দিলে তোমার কি লাভ"? 

"এই বাড়িটা তখন বিক্রি করতে সুবিধা হবে। তুমি নিশ্চয়ই না বলবে না। এখানকার পাট গুটিয়ে আমেরিকায় চলে যাব আমরা। ওখানেই একটা ব্যাবসা ফেঁদে বসব। আমার অনেকদিনের সাধ।" 

"আর এখানে আমার চাকরির কি হবে"! 

"তোমার আর চাকরি করার দরকার কি! ওখানে আমার পয়সায় খাবে দাবে, রাণীর মতো থাকবে। আর কি চাও!" 

বাবার বন্ধু পরম কাকু একজন ক্রিমিনাল লইয়ার। একদিন গেলাম পরম কাকুর কাছে। সমস্ত শুনে উনি বললেন, "এত সহজে ডিভোর্স দিতে চাইবে বলে মনে হয় না। টাকার গন্ধ পেয়ে গেছে যে। তবে ভয় পাস না। কিছু একটা উপায় হবেই। শুধু একটু সাবধানে থাকিস।" 


অশান্তি চরমে উঠল। একদিন জোর করে বাবাকে কোর্ট পেপারে সই করিয়ে নিতে গেল। আমি আটকাতে গেলে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। মাটিতে পড়ে গিয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। চোখের সামনে দেখছি বাবার হাত মুচড়ে ধরে সই করানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল আমার শরীরের মধ্যে। উঠে একদম ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। টের পেল না ও। কাগজটা আচমকা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেললাম। তারপর সপাটে মারলাম থাপ্পর। এই মারটা আশা করেনি ও। চুপচাপ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। 


বাবার কোলে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদেছি সেই রাতে। আর ক্ষমা চেয়েছি ।কোনো কথা বলেনি বাবা। অনেক রাতে নিজের ঘরে শুতে এসেছিলাম। সৌনক বাড়ি ফেরেনি রাতে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম সেই রাতে। পরদিন সকালে উঠে বাবাকে আর পাইনি। পেয়েছিলাম বাবার লেখা একটা চিঠি ।লেখা ছিল —

কল্যানীয়া 

আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা না করে সৌনকের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। অনেক আগেই আমি স্টেপ নিতে পারতাম। কিন্তু তোমার মুখ চেয়ে কিছু করতে পারি নি। কিছু প্রমাণ রেখে গেলাম। ওগুলো যদি প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে কাজে লাগাতে পার। আমার মোবাইল টা চেক করলেই পেয়ে যাবে। এটা নিয়ে আগে পুলিশ স্টেশনে যাও। আর আমার বন্ধু পরমের সাথে যোগাযোগ করো। আমার চলে যাওয়া ছাড়া এই মুহুর্তে তোমাকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় দেখছি না। ভালো থেকো, আর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করো। ইতি — শ্রী সৌজন্য চৌধুরী। 

চিঠিটা পড়ে খানিকক্ষণ বসে রইলাম স্তব্ধ হয়ে। বাবা তার মানে আমাকে ক্ষমা করেনি। 


বছর পাঁচেক কেটে গেছে। এখন আমি এই বাড়িতে একদম একলা। সৌনক জেলে। কোর্টে কেস উঠতে জানা গিয়েছিল, আমার মতো আরও কয়েকটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। বিয়ের নামে প্রতারণা, জালিয়াতি, আরও নানারকম অপরাধের কারণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল ওর। কিন্তু বাবা আর ফিরল না। আমি জানি, মায়ের মৃত্যু টা বাবা মেনে নিতে পারে নি। পরোক্ষ ভাবে আমাকেই দায়ী করেছিল। 


কলকাতার দমবন্ধ করা পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। বাইরে কোথাও যেতে মন চাইছিল। কলেজের দুই সহকর্মী রূপা আর অহনা কে নিয়ে ঘর ছাড়লাম। অমরকন্টক ।অনেকদিন ধরেই যাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। জায়গাটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আমায়। 


সন্ধ্যা ঘনিয়েছে নর্মদার তীরে ।অমরকন্টক মন্দিরে বসেছিলাম তিনজনে। নর্মদা কুন্ডের ধারে আরতীর তোড়জোড় চলছে। আমরা দেখছি। ভীড় জমছে কুন্ডের কাছে। শুরু হল নর্মদা মায়ের আরতী ।পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ভীড়ের মধ্যে। দুজন সন্ন্যাসী বড় বড় দুই দীপাধার হাতে নিয়ে আরতী করছেন।সন্ন্যাসীদ্বয়ের মুখমন্ডল দীপাধারের আলোয় আলোকিত। তাঁদের সুরেলা কন্ঠের মন্ত্রচ্চারণে মুগ্ধ আমি, আমরা । হঠাৎ, এ কী! এ কাকে দেখছি আমি। আনন্দে মন উদ্ভাসিত। এতদিন পর তবে দেখা পেলাম তোমার। এ কি সাজে সেজেছো তুমি! যাই সাজো না কেন, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারোনি। আরতী শেষ হল। প্রসাদ বিতরণ করছেন ওনারা। ছুটে গেলাম। প্রসাদ নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, "বাবা"! আমার ডাকে ফিরে তাকালেন উনি। "প্রসাদ নাও মা "। হাত পাতলাম আমি। আমার বাড়ানো হাতের ওপর একটুকরো মিছরি রাখলেন উনি। আমি তখনও তাকিয়ে আছি ওঁর দিকে। মানুষটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না । আমার বিহ্বল অবস্থা দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন, "মাগো! তুমি কি কারোকে হারিয়ে ফেলেছো "? উনি হিন্দিতে কথা বলছিলেন আমার সাথে। আমিও হিন্দিতেই বললাম, "হ্যাঁ বাবা। পাঁচ বছর আগে আমার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি। আর আপনাকে একদম আমার বাবার মতোই দেখতে"। 


সন্ন্যাসী মৃদু হেসে বললেন, "দুটো মানুষ একরকম তো দেখতে হতেই পারে। একরকম দেখতে হলেও, তারা কিন্তু এক নয় গো মা। সবই ঈশ্বরের লীলা" । আরতী শেষে চলে যাচ্ছেন উনি। কি ভেবে আমিও চলতে লাগলাম ওনার পেছন পেছন। মন্দির প্রাঙ্গণ এই মুহুর্তে একদম ফাঁকা। যেখানে নর্মদা মায়ের বিগ্রহ মূর্তি রয়েছে, সেইখানে এসে দাঁড়ালেন উনি। আমাকে দেখে ডাকলেন । গেলাম ওঁর কাছে। মায়ের মূর্তির সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে বললেন," যা হারিয়ে যায়, তা আর ফেরে না। তোমার মনবাঞ্ছা মায়ের চরণে নিবেদন করো। ভুল যদি করে থাকো ক্ষমা চাও। মা নিশ্চয়ই তোমাকে আশির্বাদ করবেন।" হাঁটু গেড়ে বসলাম নর্মদা মায়ের সামনে। ভুল! হ্যাঁ। ভুল তো আমি করেছি। আমার কারণে আমার বাবা মা অশেষ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি তো জেনে বুঝে একাজ করিনি। আমাকে ক্ষমা করো ঠাকুর! চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে আমার। বাবাকে মনে পড়ছে খুব। মনে হচ্ছে, বাবা যেন আমার আশে পাশেই কোথাও আছে। মনে হচ্ছে যেন তার স্পর্শ পেয়েছি আমি। আমার অজান্তেই কখন যেন সোচ্চার হয়ে উঠেছে আমার প্রার্থনা," আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা" । নির্জন মন্দিরে আমার কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি উঠল, ক্ষমা করো। ক্ষমা করো। ক্ষমা করো ।আবার বললাম, "ফিরে এসো বাবা"। প্রতিধ্বনি বলল, ফিরে এসো। ফিরে এসো। ফিরে এসো। এক সময়ে থেমে গেল প্রতিধ্বনি। তার বদলে কানে ভেসে এল সুমধুর সঙ্গীত —


"উদাসিনী-বেশে বিদেশিনী কে সে নাইবা তাহারে জানি,

রঙে রঙে লিখা আঁকি মরীচিকা মনে মনে ছবিখানি॥

পুবের হাওয়ায় তরীখানি তার এই ভাঙা ঘাট কবে হল পার

দূর নীলিমার বক্ষে তাহার উদ্ধত বেগ হানি॥

মুগ্ধ আলসে গণি একা বসে পলাতকা যত ঢেউ।

যারা চলে যায় ফেরে না তাে হায় পিছু-পানে আর কেউ।

মনে জানি কারাে নাগাল পাব না— তবু যদি মাের উদাসী ভাবনা

কোনাে বাসা পায় সেই দুরাশায় গাঁথি সাহানায় বাণী॥"


রবীন্দ্রসঙ্গীত! এই হিন্দি ভাষার রাজত্বে ! কি অপূর্ব কন্ঠস্বর ।মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। গান থেমে গেল। হঠাৎই চমকে উঠলাম। এ কন্ঠস্বর ঠিক আমার বাবার মতো। আমার বাবা ভীষণ ভালো গান গাইত। আমি নিশ্চিত, এ কন্ঠস্বর বাবার। ছুটে বেরোলাম, কোথায় তুমি বাবা! কোথায়। আমার কান্না থামছে না । মানুষটাকে কাছে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেললাম! রূপা আর অহনা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এসেছে। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে মন্দিরের এক পুরোহিত এসে দাঁড়ালেন। সব শুনে তিনি বললেন, তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা করেছেন আপনাকে, আর ক্ষমা করেছেন বলেই দর্শন দিয়েছেন। আবার যদি আপনি তাঁর দেখা পেতে চান, কাল সকালে একবার মাই কি বাগিচায় চলে যান। যদি তাঁর ইচ্ছা হয়, দর্শন পাবেন। 


গিয়েছিলাম, পরদিন সকালে, মাই কি বাগিচা য়। পাইনি দেখা । তবে মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে ফিরেছিলাম কলকাতায়। বাবাকে ফেরাতে পারিনি। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া কোনো গানের সুর দিয়ে বাবা ছুঁয়ে গিয়েছিল আমাকে। সেই গানের সুর যে আজও শুনতে পাই আমি —

"মুগ্ধ আলসে গণি একা বসে পলাতকা যত ঢেউ।

যারা চলে যায় ফেরে না তাে হায় পিছু-পানে আর কেউ।" 


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy