যাদু নগরী
যাদু নগরী
বিনু এইবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বলে কথা তাই মাস তিনেক বিনু খুব পড়াশোনা নিয়ে চাপে ছিল। পরীক্ষা শেষ এখন ছুটি...., তাই বিনু জেদ ধরেছে মামার বাড়ি যাবে। ছেলের ইচ্ছা কে... মর্যাদা দিয়ে বিনুর মা বিনুকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাবে ঠিক করল।
বিনুর মামার বাড়ি যাওয়ার পিছনে একটা উদ্দেশ্য আছে!!! বিনুর মামারবাড়িটা হলো পুরনো দিনের জমিদার বাড়ির ঠিক পাশেই। আর ঐ.... জমিদার বাড়ি নিয়ে নানা রকমের গল্প কথা প্রচলিত আছে!!! জমিদার গিন্নি নাকি যাদু জানতেন তাই ঐ.... জমিদার বাড়ির ভীতরে নাকি যাদু নগরী আছে। তবে জমিদার বাড়ির পিছন দিকে আম বাগানের কাছে দুটো গাছ এমন ভাবে রয়েছে!!! দেখে যেন মনে হয় কোনো অজানা সুড়ঙ্গ!!! ছোট্ট থেকেই বিনুর বড় কৌতুহল ঐ.... জায়গাটা নিয়ে, তারপর এই সব গল্প শুনে বিনুর কৌতুহল দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু যতবার ওখানে যেতে চেয়েছে বড়রা কেউ না... কেউ ঠিক বাঁধা দিয়েছে। তবে এইবার বিনু ঠিক করেছে কাউকে কিছু জানতে না... দিয়ে একাই যাবে সেখানে।
মায়ের কথা মত পরেরদিন সকাল সকাল বিনুরা বেড়িয়ে পড়ল মামার বাড়ির উদ্দেশ্য। বিনুর মনটা কাল থেকেই ছটফট করছে!!! রাতে ঠিক মত ঘুমোতেও.... পাড়েনি শুধু মনে হচ্ছে কখন গিয়ে পৌঁছাবে মামার বাড়ি। ছেলের এই রকম ছটপটানি দেখে বিনুরমা কয়েক বার জিজ্ঞাসা করেছে ছেলেকে কিছু হয়েছে কিনা??? শরীর খারাপ লাগছে কিনা???? বিনু তখন নিজেকে শান্ত করে বলেছে কিছু হয়নি!!!
অবশেষে সমস্ত অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিনুরমা আর বিনু মামার বাড়িতে পা রাখল। বাড়ির সবাই খুব খুশি মেয়ে আর নাতিকে পেয়ে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেড়ে গল্প গুজব করে সবাই যে... যার মত বিশ্রাম নিতে চলে গেল। বিনু মনে মনে ভাবলো, এটাই উপযুক্ত সময় কৌতুহল মেটানোর । বিনু গুটিগুটি পায়ে ঘর থেকে বেড়লো আর সাথে করে নিল,একটা ছুড়ি, লাইটার, আর মোবাইল ফোন ।
বিনু মামার বাড়ির পিছন দিক দিয়ে গিয়ে ভাঙ্গা প্রাচির টপকে ঢুকে পড়লো জমিদার বাড়ির ভিতরে। বাড়িটার অবস্থা খুবই খারাপ, চারিদিক থেকে সবকিছু ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়েছে, বাড়ির দেওয়াল বেয়ে অনেক গাছ, গাছালি উঠেছে, চারিদিকে আগাছায় ভর্তি, বোঝা যাচ্ছে কেউ এখানে আসেনা। বিনু খুব সাবধানে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল আম বাগানের দিকে। বিনু পৌঁছে গেছে তার লক্ষ্যের ঠিক কাছে। বিনু চারিদিকে ভালো করে চেয়ে দেখছে সত্যি অদ্ভুত এই গাছ দুটো!!!!! আবার দেখতেও আলাদা। দেখে মনে হচ্ছে গাছদুটো যেন রাস্তা সৃষ্টি করছে অজানা দেশে যাওয়ার।
অকাশে তখনও সূর্যের অবস্থান,সে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়নি, এখনও তার তেজ বিস্তার করে চলেছে। বিনু গাছের চারিপাশটা ভালো করে ঘুরে মনের মধ্যে সাহস এনে গাছদুটোর ঠিক মাঝখানে নিজের শরীরটাকে আস্তে আস্তে ঢোকাল। হঠাৎ করে বিনুর নিজেকে একেবারে হাল্কা মনে হতে লাগল এবং তার সাথে এও মনে হল বিনু যেন প্রবল বেগে নিচে পড়ছে। সঠিকভাবে সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই বিনু ধপাস করে পড়ল নীচে। নিজেকে সামলে নিয়ে বিনু উঠে দাঁড়িয়ে দেখল সামনে একটা বিশাল বড় লোহার দরজা। আর চারিপাশ পুরো ফাঁকা কোথায় কোনকিছুর চিহ্ন মাত্র নেই। বিনু দরজার সামনে গিয়ে হাল্কা করে দরজাটা ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল আর সাথে সাথে একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ভিতরটা কেমন আলো আঁধারি পরিবেশ, বিনু দরজার ভিতরে যেই পা রাখল!!! সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। এবং একটা গলার আওয়াজ ভেসে আসল যাদুর জগতে আপনাকে স্বাগত...........।
বিনু এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগল আর সাথে সাথে সুন্দর মিউজিক বাজতে লাগল,আর রঙ বেরঙের আলো জ্বলে উঠতে লাগল। বিনু চারিদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে আর অবাক হচ্ছে কারন চারিপাশে কত সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ এবং তারা সবাই কথা বলছে চলা ফেরা করছে। এমনকি পশু পাখি সবাই কথা বলছে। বিনু অবাক হয়ে সবকিছু দেখছে তবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে কারন এটা কি.... করে সম্ভব!!!!
হঠাৎ করে বিনুর সামনে উপস্থিত হল একটা অদ্ভুত রকমের দেখতে না মানুষ, না রাক্ষস না পশু একেবারে সবার মিশ্রনে তৈরী এক অদ্ভুত প্রানি। পা টা মানুষের মতো, মুখটা রাক্ষসের মত আর দেহটা পশুর মত এমন দেখতে একজন!!! হাতে এইয়া বড় একটা যাদু লাঠি নিয়ে বিনুর সামনে দাঁড়াল। বিনু ভয় পেয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল এবং কিছুর সাথে ধাক্কা খেল। সাথে সাথে পিছন ঘুরে দেখল ঐ... রকম দেখতে অদ্ভূত কিছু প্রানি বিনুকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। ওদের মধ্যে একজন বেশ হুঙ্কার দিয়ে বলল.........
--------------কে.... তুমি এখানে কি... করে এলে?????
----------------বিনু ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে, কেঁদে ফেলে এই রকম অবস্থা!!!! তারপর হুঙ্কার শুনে কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে।
--------------আবার একই ভাবে বলে উঠল, কে..... তুমি এখানে কি.... করে এলে?????
-------------বিনু ঢোক গিলে শুকনো গলাটাকে একটু ভিজিয়ে নিয়ে কাঁপা.... কাঁপা.... স্বরে সবকিছু খুলে বলল।
সবকিছু শুনে ওরা বিনুকে চ্যাংদোলা করে ঘাড়ে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল আরও ভীতরে। যত ভীতরে যেতে লাগল তত সবকিছু কেমন অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগল, আর তার সাথে এই ধরনের এবং আরও নানা রকমের অদ্ভূত, কিম্ভূত.... কিমাকার প্রানির দেখা মিলতে লাগল। আর ভয়ে বিনুর প্রান যায় যায় হতে লাগল।
অবশেষে ওরা বিনুকে নামাল একটা জায়গায়। বিনু চারিদিকে চেয়ে দেখতে লাগল দেখে মনে হচ্ছে গভীর সমুদ্রের ভীতরে!!!! অথচ গায়ে বা... কোথাও জল লাগছেনা!!! কেউ যাদুবলে জলের ওপর একটা আস্তরন তৈরী করে দিয়েছে। হঠাৎ করে একটা বিকট হাসির শব্দে বিনুর সর্ব শরীর কেঁপে উঠল, বিনু সামনে চেয়ে দেখতে পেল একটা বয়স্ক মহিলা!!! শরীরের সমস্ত চামড়া ঝুলে গেছে, মাথার চুল জটাতে ভর্তি এবং তারা মেঝেতে লুটাচ্ছে, মাথার মাঝখানে একটা মস্ত বড় শিং, হাতে পায়ের নখ গুলো বিশাল লম্বা, লম্বা... আর দুটো অতি তীক্ষ্ণ দাঁত বেড়িয়ে আছে মুখের দুইপাশ দিয়ে। চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত আগুনের গোলার মত, পড়নে একটা অদ্ভূত আলখাল্লা রকমের পোশাক, আর হাতে একটা সোনার যাদু কাঠি। এত জোরে জোরে হাসছে যে.... সারা শরীর কেঁপে... কেঁপে... উঠছে।
মহিলাটি এক পা একপা করে বিনুর কাছে এগিয়ে আসতে লাগল, আর বিনু ভয়ের চোটে থর থর করে কাঁপতে লাগল, সর্ব শরীর ভয়ের চোটে ঘেমে উঠেছে বিনুর, চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় জল ঝরে চলেছে, বিনুর কথা যেন... হারিয়ে গেছে!!! বিনু বুঝতে পারছে আজ ওর... জীবনের শেষ দিন!!! আর ও.. মা, বাবা, বন্ধু, পরিবার, পরিজন কাউকে দেখতে পাবেনা!!!! এখানেই ওকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে!!!
--------------মহিলাটি নিজের হাত দিয়ে বিনুর মুখটা চেপে ধরে বলল এখানে কি.... মতলবে এসেছিস????? কে পাঠিয়েছে তোকে????
------------বিনু কাঁদতে কাঁদতে বলল কেউ পাঠাইনি!!! আমি ভুল করে গাছের ফাঁকে ঢুকে চলে এসেছি, আমাকে তোমরা মেরোনা.....!!! আমি মায়ের কাছে যাব!!!
------------বিনুর কথা শুনে সবাই আবার একসাথে হেসে উঠল। বিনু কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি সত্যি বলছি!!!! আমি মায়ের কাছে যাব!!!
-----------মহিলাটি বলে উঠল, এই যাদু জগতে যখন এসে পড়েছিস!!! তখন দুদিন ঘোর, খাওয়া দাওয়া কর তারপর ফিরবি বুঝলি!!!
---------বিনু বলল না... না... আমি ঘুরতে চাইনা!!! এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে চাই!!!
-------------মহিলাটি আবার বিকট হেসে বলল, যা.... ওকে নিয়ে যা.... আমাদের অতিথি শালায়!! ভালো করে আদর আপ্যায়ন করিস বুঝলি!!!!
ওরা বিনুকে যে.... ভাবে নিয়ে এসেছিল ঠিক সেই ভাবে চ্যাংদোলা করে ঘাড়ে তুলে নিয়ে যেতে লাগল। ওরা বিনুকে নিয়ে এসে একটা ধোঁয়া যুক্ত অন্ধকার ঘরের মধ্যে ভরে দিয়ে চলে গেল। বিনু চিৎকার করতে লাগল.... কিন্তু বিনুর কথা ওদের কান অবধি পৌঁছাতে পারলনা!!!! বিনু চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল।
বিনু অন্ধকারে চারিদিক হাতড়ে বেড়াতে লাগল কিছু খুঁজে পাওয়ার আশায়। কিন্তু কিছুই পেলনা!! বিনু এখন কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা হঠাৎ করে জামার পকেটে হাত দিতেই মোবাইল টা... হাতে পায়, ভয়ের চোটে এতক্ষন এগুলোর কথা ভুলেই গিয়ে ছিল বিনু!!! মোবাইলটা বার করে কোনরকমে ফ্ল্যাশলাইট অন করতেই সবকিছু যেন পরিস্কার লাগতে লাগল বিনুর। মোবাইলের আলোতে কিছু টা.... অন্ধকার কাটল। বিনু ভালো করে চারিদিক দেখতে লাগল। কিন্তু কোথাও কোনো দরজা জানলা দেখতে পেলনা। হঠাৎ বিনুর মনে পড়ল বাবার সঙ্গে যখন যাদু দেখতে গেছিল.... তখন একজনকে বাক্সের মধ্যে বন্দি করে দিয়ে ছিল আমাদের চোখের সামনে!!! কিন্তু মিনিট পনেরো পর বাক্স খুলে দেখিয়ে ছিল সে.... নেই। সে.... তখন আমাদের পিছন দিয়ে হেঁটে এসেছিল। আর বাবা বলেছিল বক্সের পিছনের দিকটা ফাঁক করার ব্যাবস্থা ছিল... আমরা লক্ষ্য করিনি!!! আসলে এটাই যাদুর খেলা। বিনু মনে মনে ভাবতে লাগল তারমানে এখানেও কিছু যাদু আছে। বিনু আবার ভালো করে চারিদিক লক্ষ্য করতে লাগল, অবশেষে দেখতে পেল একটা দড়ি ঝুলছে একদিকে, যেটা অন্য কোনদিকে নেই!!! বিনু আর কিছু না ভেবে ছুটে গিয়ে দড়িটা ধরে টান দিল.... সাথে সাথে খড়খড়ির মত দেওয়াল খুলে গিয়ে আলো ঢুকে পড়ল আর সামনে দেখতে পেল সেই একই রকম দুটো গাছ!!!
বিনু আর সময় নষ্ট না... করে নিজের শরীর টাকে গাছের ফাঁকে গলিয়ে দিল, আর ধপ করে এসে পড়ল জমিদার বাড়ির আম বাগানে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তখনও সূর্য যেখানে ছিল এখনও সেইখানেই আছে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়নি। তার তেজ বিস্তার করে চলেছে। বিনু আর কোনদিকে না.... তাকিয়ে এক ছুটে মামার বাড়িতে ঢুকে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।
ছেলের এই হঠাৎ করে কান্নার কারন মা... সঠিকভাবে বুঝতে পাড়েনি!!! তবুও ছেলেকে বুকের মাঝে আগলে নিয়ে ছিল। তবে বিনু সব কিছু নতুন করে ফিরে পাওয়ার চরম আনন্দ অনুভব করেছিল জীবনে!!! এবং মনে মনে ঠিক করেছিল ভবিষ্যতে আর কোনদিনও কাউকে কিছু না জানিয়ে এই রকম কাজ করবে না!!!!
