Sonali Basu

Abstract

3  

Sonali Basu

Abstract

উপলব্ধি

উপলব্ধি

6 mins
813


ছাদে দাঁড়িয়ে প্রদীপ সিগারেটে টান দিচ্ছিলো আর একদৃষ্টে তাকিয়েছিল চন্দনদার বাড়ির দিকে। পাড়ার ওই বাড়িটা এখন শোকের আবহে ঘেরা। চন্দনদার ছোট ভাই নন্দন দিন তিনেক আগে মারা গেছে। কারণ লিভার সিরোসিস, অতিরিক্ত মদ খাওয়ার কারণে ভেতরটা একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপের খুব খারাপ লাগছে বিশ্বাস জেঠিমার কথা ভেবে। বয়স্ক অশক্ত মানুষটা বেঁচে রইলো আর তার জোয়ান ছোট ছেলে মারা গেলো। শিপ্রা বলছিল যেদিন হাসপাতাল থেকে খবর এলো নন্দনদা আর নেই, জেঠিমা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হবেই তো জেঠিমার খুব আদরের ছেলে ছিল নন্দনদা, তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে সবথেকে ছোট বলে। সবাই বলে বাড়ির ছোটরা নাকি বেশি আদর কাড়ে তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে। তাই নাকি তার অন্যায় অনেক সময়ই খেয়াল করে না কেউ। সত্যিই তাই। এই পাড়াতে ওরা বহু বছরের বাসিন্দা। প্রদীপ মায়ের কাছে শুনেছে আদরে আদরে এতটাই বখে গিয়েছিল নন্দন যে পড়াশোনায় কোনদিনই মন বসাতে পারেনি। স্কুলের মাস্টারমশাইরা খুব বিরক্ত হতেন ওর পরীক্ষার ফলাফল দেখে। ক্লাস নাইনে দুবার ফেল করার পর ওনাদের বকুনিতে স্কুলই ছেড়ে দেয় নন্দন।

জ্যেঠু জেঠিমা নাকি চেষ্টা করেছিলেন ছেলের মতি ফেরাতে কিন্তু সে সাফ বলে দিয়েছিলো সে আর পড়াশোনায় আগ্রহী নয়। বিনা কোন ডিগ্রীতে যে চাকরি পাওয়া যায় না এটা সবাই বোঝে আর নন্দন এটা খুব ভালো বুঝতো কারণ স্কুলের মাস্টারমশাইরা বহুবার এ কথা তুলেছেন। আর কম পড়াশোনায় সৎপথে বেশি রোজগার সম্ভব নয় জেনে বাঁকা পথ নিতে সময় নেয়নি সে। বাঁকা পথের অফুরন্ত রোজগারের সাথে হাত ধরাধরি করে এসেছে সুরা আর নারী। যার ফল তিন দিন আগেই ঘোষণা হয়ে গেছে।   

এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই ভেতর থেকে ডাক এলো “দীপ!” শিপ্রা ওকে এই নামেই ডাকে। সচকিত প্রদীপ উত্তর দিলো “আসছি” তারপর সিগারেটের শেষাংশে জোরে টান দিয়ে ওটা ছুঁড়ে ফেলে ও নেমে এলো ছাদ থেকে। শিপ্রা ততক্ষণে প্লেটে রুটি তরকারি সাজিয়ে ফেলেছে। ও কিছু বলার আগেই শিপ্রার ঘোষণা “যাও এটা জেঠিমাকে দিয়ে এসো” বলে প্লেট ঢাকা রুটির প্লেট এগিয়ে দিলো ওর দিকে। শিপ্রা মায়ের জন্য এরকম খাবার তৈরি করতো কি? জানে না প্রদীপ।

কারণ বিয়ের দু বছরের মাথায় ওদের ছেলে হওয়ার পরই শিপ্রার ঘোষণা ও মায়ের সাথে এক বাড়িতে থাকবে না। তার পরই তো একই পাড়ায় বাড়ি খাড়া করেছে প্রদীপ। পুরনো বাড়িতে দাদা সুদীপ বৌদি বাণী আর ভাইঝি দিয়া থাকে।

প্রদীপ প্লেট নিয়ে চুপচাপ গেট খুলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো জেঠিমার বাড়ির দিকে। গেট ঠেলে ঢুকে দেখে দরজায় তালা। তবে ভেতর থেকে জেঠিমা বললেন “কে?”

“আমি দীপ, জেঠিমা”

“আয় ভেতরে আয়। চাবি দ্যাখ বাইরের ঘরের জনলার ওপর রাখা”

তালা খুলে প্রদীপ ঘরে ঢুকলো “কি করো তুমি?”

“এই তো বসে আছি। একটু আগে চা খেলাম”

“নিজে বানিয়ে?”

“না, ওই পাশের দত্তবাড়ির কাজের মেয়েটা দিয়ে গেলো”

“ও! তাহলে এখন রুটি খাও”

“আবার এসব আনতে গেলি কেন? বন্দনা একটু পরেই দাদুভাইকে দিয়ে পাঠাবে”

“দিদি পাঠাক না, ওটা পরে খেয়ো”

প্রদীপের অনুরোধে বিশ্বাস জেঠিমা মুখে খাবার তুললেন। প্রদীপ প্রশ্ন করলো “এখন শরীর কেমন আছে?”

“আর শরীর! আমার মতো বুড়ি বেঁচে রইলো আর আমার জোয়ান ছেলেটা চলে গেলো” তারপর মুখ নাড়তে নাড়তে বললেন “তরকারির স্বাদ খুব ভালো হয়েছে”

প্রদীপ হাসলো। মা কোনদিন শিপ্রার রান্নার প্রশংসা করেছে, মনে পড়ে না। বৌদির রান্নার প্রশংসা মাঝে মধ্যে করতো, বাবার কাছে শুনেছে। আসলে বিয়ের পরই তো প্রদীপ শিপ্রাকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের কাজের জায়গায়, ওখানেই রেখেছিল। তাই শিপ্রা খুব বেশীদিন মায়ের সাথে ঘর করেনি, ওই যখন অন্তসত্বা হয়েছিল তখন কিছুদিন ছিল শ্বশুরবাড়িতে। তাতেই বা কি এসে যায়। যে কদিন ঘর করেছে তার প্রতিদিনের শুধু নয় এবেলা ওবেলার অভিযোগ জমা পড়েছে ওর কাছে ফোনের মাধ্যমে। প্রদীপকে তো বাড়ির বাইরেই থাকতে হয় বছরের বেশ কয়েক মাস অতএব শিপ্রাই বারবার ফোন করতো ওর সাথে হওয়া অন্যায় দেখে। এতে শিপ্রার অন্যায় দেখে না ও, প্রদীপ ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে, তা স্ত্রী তো ওকেই তো জানাবে। অবাক ব্যাপার হল স্ত্রী এতো অভিযোগ করলেও মা কিন্তু ওকে কিছুই বলতো না। ছুটিতে যখন বাড়ি আসতো তখনো প্রদীপ স্ত্রীর হয়েই মায়ের সাথে যুদ্ধে নামতো।

জেঠিমা খাওয়া শেষ করে এক গ্লাস জল খেলেন। তারপর কথায় কথায় পুরনো কথার চর্চা শুরু হল আর যা হয় ঘুরেঘুরেই নন্দনের কথা চলে আসে। আজ হঠাৎই প্রদীপের মনে হল মাও কি তাহলে ওকে এভাবেই মনে করতো? ও তো কোনদিন ভেবেও দেখেনি। ভাববে কি করে? ছোট থেকেই ওর আর ওর মায়ের মধ্যে সবসময় যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকতো, যেন দুই শত্রু একেঅপরের দিকে বন্দুক আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দাদা সুদীপ আর দিদি শ্রীময়ীর থেকে ও অনেকটাই ছোট; তাহলে বাড়ির ছোট হিসেবে ওরই তো বেশি আদর পাওয়ার কথা। কিন্তু তা হতো না, দাদা দিদি শান্তশিষ্ট বলে সবার কাছে ওরা প্রশংসিত হতো আর ও বরাবরের একটু দুষ্টু বলে তুলনা করা হতো দাদাদিদির সাথে আর তারপরেই মার জুটতো মায়ের কাছে। বাবার কাছে জুটতো বেল্টের মার পড়া না পারলে। প্রদীপ ভেবেই নিয়েছিল এটাই স্বাভাবিক ততদিন যতদিন না দিদির বিয়ে ঠিক হল। বিয়ে ঠিক হওয়ার সময় ও প্রথম জানতে পারলো ওর দাদা দিদি ওর সৎ ভাইবোন। কথাটা বিশ্বাসই হয়নি প্রথমে। এই সৎ ব্যাপারটার সবটুকু গলধঃকরণ অনেকদিন লেগেছিল করতে আর সবটুকু জানার পর ওর রাগ বেড়ে গিয়েছিল মায়ের ওপর। সৎ ছেলে না হওয়ার পরেও মায়ের এই ব্যবহার ওর স্বভাবটা করে তুলেছিল অশান্ত ব্যবহার রূঢ়। স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট ভালো হয়নি তার ওপর ও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে নন্দনদার মতোই নেশার কবলে পড়েছিল। ভাগ্যিস বাবা হাত ধরে টেনে তুলেছিল নাহলে ও নেশার দুনিয়ায় হারিয়ে যেতো। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরির জগতে চলে এসেছে। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই দেশের নানা প্রান্তে ঘুরতে হচ্ছে ওকে, বাড়িতে আসাই হয় কম।

কোনদিনই বুঝতে চেষ্টা করেনি বা পারেওনি যে মা ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেয়েছে সবার সাথে ওর তুলনা হওয়া দেখে তাই চেষ্টা করে গেছে ওকে সবার মতো করে তুলতে যাতে সবাই ওরও প্রশংসা করে। ভালো চাকরি পাওয়ার পর অবশ্য মায়ের ভীষণ আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে ছেলের মুখ উজ্জ্বল হল। যখন শিপ্রাকে বিয়ে করে মা হয়তো কল্পনা করেছিল তার ছেলের বৌ সবার কাছে প্রশংসিত হবে তার স্বভাবের জন্য কাজকর্মের জন্য সেবাযত্নের জন্য। সেটা বোধহয় শিপ্রা হয়ে উঠতে পারেনি বা হয়তো চেষ্টাও করেনি, তাই শ্বাশুড়ি বৌমার মধ্যে সংঘাত অবসম্ভাবী ছিল। তাদের কাছে আঘাত পেয়ে মা এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছিল যে যখন চলে গেলো তখনো বোধহয় ওর মুখটা একবারও মনে করেনি। নাকি করেছিল, ও’ই বুঝতে পারেনি।

দরজা ঠেলে কারো ঢোকার আওয়াজ হল। জেঠিমা বললেন “কে?”

উত্তর এলো “আমি মা” চন্দনদা ভেতরে এলো। প্রদীপকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কি রে কেমন আছিস?”

প্রদীপ হেসে উত্তর দিলো “ভালো”

চন্দনদা তার মায়ের সাথে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, ভাইয়ের শ্রাদ্ধ সে’ই করবে। প্রদীপ উঠে পড়ে বলল “জেঠিমা তোমরা কথা বলো আমি পরে আসবো” বলে বেরিয়ে আসতে গিয়ে শুনলো চন্দনদা প্রশ্ন করছে “কাল রাতে কে এসেছিল শুতে?”

জেঠিমার উত্তর “কে আবার বুম্বা। আজ অবশ্য কে থাকবে জানি না”

প্রদীপ বেরোতে বেরোতে ভাবছিল ওদের বাড়ির মতো এ বাড়িতেও মায়ের দায়িত্ব নিতে কেউ আগ্রহী নয়। বাড়িটা জ্যেঠুর বানানো, যতদিন জ্যেঠু ছিল এক সুতোয় বেঁধে রাখতে পেরেছিল। জ্যেঠু মারা যেতেই বাঁধনের সুতো গেছে ছিঁড়ে। বাধ্য হয়ে নন্দন মায়ের দেখাশোনা করতো, চন্দনদা আর বন্দনাদি ঝাড়া হাতপা ছিল। নন্দন যেই চলে গেছে ওমনি মায়ের দায়িত্ব কে নেবে তা নিয়ে অদৃশ্য দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে।

অথচ ওর নতুন বাড়ি হওয়ার পর মা একবারও ওর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। এমনকি বাবাও গিয়েছিল কি না ঠিক মনে পড়ে না। মা বাবার কি অভিমান হয়েছিল? ও তো কোনদিন জোর করে নিয়েও যায়নি, অনুরোধও করেনি। আজ এতদিন পর এ উপলব্ধি প্রদীপকে নাড়িয়ে দিলো। ওরও তো একটিই ছেলে, খুব যত্ন সহকারে বড় করছে ও আর শিপ্রা। ভবিষ্যতে যখন ওদের লাঠির প্রয়োজন পড়বে তখন ছেলেও এরকম দায়িত্ব নেওয়ার কথায় পিছিয়ে যাবে না তো?         


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract