Sonali Basu

Romance

3  

Sonali Basu

Romance

আগমন (শরৎকাল)

আগমন (শরৎকাল)

13 mins
488


ফোনটা রিং হতে বিরক্তভাবে চোখ খুলল পৃথা। এই মধ্যরাতে কে ফোন করলো? ওফ, শান্তিতে ঘুমোতেও দেবে না। ফোনটা তুলে হ্যালো বলতে ওপাশ থেকে মায়ের গলা শুনতে পেলো ও। চৈতালী বলল – কবে আসছিস তুই?

পৃথা ঘুমঘুম গলায় বলল – মা কটা বাজে ঘড়িতে?

- আমাদের এখানে এখন সকাল ছটা এবং তোমার ওখানেও তাই। আমার মনে হয় এখন তোমার ওঠা উচিৎ

- মা এখন আমি চাকরি করি, স্কুলে পড়া ছাত্রী নই যে এখনো ভোরে উঠতে হবে বলে তুমি জোর করতে পারো


- আমি জানি। তুমি যে এখন এডাল্ট এটা কখনোই ভুলি না। যাইহোক এই তর্ক নিয়ে সকালের এই সুন্দর সময়টা আমি খারাপ করতে চাই না। আমি আজই চলে যাচ্ছি গ্রামের বাড়িতে, তোমার যদি ইচ্ছে হয় এসো বলেই ফোনটা কেটে দিলো চৈতালী। মায়ের এই এক দোষ, দুম করে ফোনটা কেটে দেয় নিজের বক্তব্য শেষ হয়ে গেলেই। অপরপক্ষেরও যে কিছু বলার আছে তা আর মনে থাকে না। গজগজ করতে করতে উঠে বসলো পৃথা। আরেকবার ফোনটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো ও তারপর খাট থেকে নেমে এগিয়ে গেলো জানলার দিকে। জানলার ওপর টেনে রাখা ভারী পর্দা সরাতে চোখে প্রথমেই এসে পড়লো সূর্যের আলো। আটতলার ওপর ফ্ল্যাটের শোয়ার ঘর থেকে সকালের সূর্য এই প্রথম দেখলো ও; অথচ এই শহরে ও আছে তা প্রায় দু বছর হতে চলল। বেশ লাগলো সকালের মিষ্টি সূর্যের আলো। মাটি থেকে এতো উঁচুতে তাই আকাশটাও এখানে বেশি নীল মনে হল, আকাশে দু একটা পাখিও উড়তে দেখা গেলো। কিন্তু এতো উঁচুতে কোন পাখি ওড়ে কি? খানিক ভাবার পর মনে পড়লো একমাত্র চিল ছাড়া তো এতো উঁচুতে কেউ ওড়ে না! আকাশ দেখা শেষ করে ও নীচে তাকালো। এতো উঁচু থেকে নীচের শহরটাও কেমন অচেনা নতুন লাগলো ওর, অথচ এই শহরের ব্যস্ত রাস্তা দিয়েই ও প্রতিদিন সকালে ছোটে অফিসে সন্ধ্যার পর হয় শপিংমলে নয় ডিস্কোতে বা বারে। আসলে এতো সকালে ও কোনদিনই ওঠে না। ওর অফিসের গাড়ি আসে ঠিক সাড়ে নটায় তাই ও ঘুম থেকে ওঠে সাড়ে আটটায়। এই এক ঘণ্টায় ওর সব কাজ সেরে নেয় ও, স্নান করা থেকে শুরু করে সকালের ব্রেকফাস্ট পর্যন্ত। প্রতিদিনের পড়া কাপড়চোপড় স্নানের সময়ই ধুয়ে বাথরুমে টাঙ্গানো দড়িতে মেলে রেখে যায়। এর বেশি কিছু ও করে উঠতে পারে না। ঘরের বাকি কাজ যেগুলো প্রতিদিনই বাকি থেকে যায় সেগুলো ও করে অফিস ছুটির দিনে, সেই রবিবার। রবিবার ওর নিঃশ্বাস ফেলারও ফুরসৎ পায় না ও, কাচাকাচি বাসন মাজা ঘর পরিষ্কার। কাজের লোক রাখেনি। সেদিন অবশ্য নিজের হাতে কিছু রান্নাও করে ও। বাকি দিন তো সেই হোটেল নয় হোম ডেলিভারির ওপর ভরসা। অবশ্য নিজের হাতে রান্না বলতে ও করতে পারে ভাত ডাল আর রকমারি ভাজাভুজি, আর মেশিনে চা কফি ব্যস ঐটুকুই।


আজ বহু বছর পর সকালের আকাশ দেখে ওর মনটা বেশ খুশিখুশি হয়ে গেলো তাই মনেমনে ধন্যবাদ দিলো মাকে। মায়ের কথা মনে পড়ার সাথেসাথেই ওর মনে পড়লো মা জিজ্ঞেস করেছিল এবার পুজোতে ও গ্রামের বাড়ি যাবে কি না। তখন উত্তর দেওয়া হয়নি, মা ফোনটা কেটে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কি ওর খুব ইচ্ছে এ বছর অনির সাথে এখানে দুর্গাপূজা কাটায়। সৌমাল্যর সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর ও খুব ভেঙ্গে পড়েছিল। এমন অবস্থা হয়েছিল তখন ওর মনের যে ও দিল্লীতে থাকার কথা পর্যন্ত আর ভাবতে পারেনি। ঐ শহরে আর থাকতে পারবে না বলে ওখানকার অত ভালো চাকরিটা ছেড়ে ও ফিরে এসেছিল বাড়ি। ঠিকই করে নিয়েছিল আর চাকরি করবে না। বাড়ি ফিরে এসে সারাদিন নিজের ঘরেই বসে থাকতো ও গুম মেরে। তখন মা খুব কাছে এসে গিয়েছিল ওর যদিও ছোট থেকে মায়ের সাথে ওর সম্পর্ক বেশ জটিল রকমের। এই জটিলতা বাবা মায়ের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকেই। যেহেতু ও বাবাকে বেশি কাছের মনে করতো তাই ওর মনে হয়েছিল বাবা মায়ের এই বিচ্ছেদের কারণও মা। কিন্তু অদ্ভুত বাবা মায়ের সম্পর্ক ছিন্ন হলেও মায়ের সাথে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক কিন্তু খারাপ হয়নি। তাই মা কয়েক মাস অন্তর এখনো শ্বশুরবাড়ি যায়। ঠাকুরদা থাকুমা বেঁচে থাকতেও যেতো এখন যে তারা নেই, তাও যায়।


যাইহোক ভালোবাসা ভাঙ্গার শোক ওর মনকে বিকল করে দিলেও মা ওকে নানান আশার কথা শোনাতো; বলতো আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে। মায়ের আগ্রহেই আবার ও চাকরির চেষ্টা শুরু করলো। এবার ওর পছন্দের কাজ পেয়েছে এই ব্যাঙ্গালোর শহরে। আর এই শহরেই আবার খুঁজে পেয়েছে একজন নতুন বন্ধুকেও। অনিকেত দে, প্রবাসী বাঙালি পরিবারের ছেলে, বহু বছর লন্ডনে ছিল, পড়াশোনা এমনকি চাকরি জীবনও শুরু করেছিল ওখানে। কোন এক কারণে ওখানকার হেড অফিস থেকে চাকরিতে বদলি নিয়ে এখানকার ব্রাঞ্চ অফিসে এসেছে কিছুদিন হল। বন্ধুত্বটা খুব বেশি গভীর হয়নি তবে যেটুকু সময় ওর সাথে কাটিয়েছে পৃথা, ওর ভালোই লেগেছে। তাই এবার পৃথা ভেবেছে আজ ও অনিকে বলবে একসাথে পুজো কাটানোর কথা। 


মাকে তাহলে বলে দেওয়া দরকার ওর ইচ্ছেটা কিন্তু ফোন করতে গিয়ে দেখলো মায়ের ফোন সুইচ অফ। কি আর করা। মনে হচ্ছে মা খুব রেগেছে আর তাই ফোনটাই বন্ধ রেখেছে। যাইহোক মায়ের মেজাজটা ঠাণ্ডা হলে মা ঠিক ফোন খুলবে। তখন মাকে জানিয়ে দিলেই হবে ওর ইচ্ছেটা। আজ তাড়াতাড়ি উঠেছে বলে তাড়াতাড়ি বাথরুমের কাজ সেরে ও গেলো তরিবৎ করে ব্রেকফাস্ট বানাতে। কয়েকদিন ধরে খুব ইচ্ছে করছে ওর লুচি আলুর তরকারি খেতে কিন্তু ও তো বানাতেই পারে না। তাতে কি হয়েছে, ফোনে নেট কানেকশন আছে কি করতে। রান্নাবান্নার ভিডিও খুলে আগে মন দিয়ে দেখলো কীভাবে রান্নাটা করতে হয়। কিন্তু ফ্রিজ খুলেই ওর সব এন্যার্জি লস হয়ে গেলো। যা দরকার এই মুহূর্তে তার কিছুই নেই এখানে। ধুত্তোর বলে ফ্রিজটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় চোখে পড়লো তিনটে ডিম আর পাউরুটি পড়ে আছে। তাহলে এটা দিয়েই আজ ব্রেকফাস্ট বানাবে। ফ্রেঞ্চ টোস্ট সবে বানানো শেষ হয়েছে ঘরের কলিংবেলটা বাজলো। এতো তাড়াতাড়ি অফিসের গাড়ি তো আসার কথা নয়, তাহলে কে এলো? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতেই দেখলো সামনে অনিকেত দাঁড়িয়ে। ও বলল – কি সৌভাগ্য আমার। সকালে তোমার কথাই ভাবছিলাম আর তুমি এলে। ভেতরে এসো


অনি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হাসলো তারপর বলল - সৌভাগ্য তো আমার বলতে হবে। সকালে যখন শহরের বাইরের ছবি তুলতে বেরোলাম তখন তো ভাবিনি যে ফেরার পথে আমার বাইকটা খারাপ হয়ে যাবে। তারপর আর কি ওটা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলাম গ্যারেজ পর্যন্ত। গ্যারেজের মেকানিক দেখে বলল বাইক সারাতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। আর ওদিকে আমার খুব খিদে পেয়েছে। তাই এদিকওদিক তাকিয়ে যখন দোকান খুঁজছি মনে পড়লো কাছেই তোমার এপার্টমেন্ট। ভাবলাম সকালবেলা, তুমি তো কিছু খাবে তাই তোমার বাড়ি এলে তোমার ব্রেকফাস্ট থেকে ভাগ বসানো যাবে

পৃথা হেসে বলল – তোমার কপাল ভালো বলতে হবে। অন্যদিন আমি কর্ণফ্লেক্স খাই দুধ দিয়ে বা ওটস। আজই আমি প্রথম ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়েছি। তবে খাওয়ার যোগ্য হবে কি না বলতে পারছি না


- কোন ব্যাপার না। তুমিও কোন রান্নার কম্পিটিশনে নাম দাওনি আর আমিও কোন জাজ নই। যা দেবে তাই খেয়ে নেবো যেমনই খেতে হোক

- ওকে অভয় দিচ্ছো তাই খেতে দিচ্ছি। এসো ডাইনিংরুমে

অনি সোফায় বসে বলল - ফর্মালিটির দরকার নেই। তুমি এখানেই দাও। প্লেট হাতে নিয়ে খাবো পৃথা ডাইনিংটেবিলে গিয়ে প্লেটে ফ্রেঞ্চ টোস্ট আর টম্যাটো সস দিয়ে নিয়ে এলো তারপর অনির দিকে প্লেটটা এগিয়ে দিলো ও। তারপর রান্নাঘরে গেলো কফিমেশিনে কফি বানাতে। অনি টোস্টে একটা কামড় দিয়ে বলল – তুমি খাবে না?


- এই তো কফি নিয়ে আসছি তারপর খাবো

দু কাপ কফি নিয়ে এসে পৃথা বসলো অনির পাশে তারপর কফিতে চুমুক দিলো। বেশ হয়েছে কফি। তারপর কফি কাপ টেবিলে রেখে ও ওর টোস্টে কামড় দিলো। টোস্টের স্বাদ নিয়ে বুঝলো মন্দ হয়নি টেস্ট প্রথমবার বানানোতে। ও বলল – অনি তুমি বললে তুমি ছবি তুলতে বেরিয়েছিলে। তুমি তো প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার নও। এটা কি শখ?


- আপাতত শখ কিন্তু বহুদিন থেকেই আমার ইচ্ছে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হওয়ার কিন্তু বাবার ভীষণ আপত্তি ছিল তাই একটা চাকরি জোগাড় করতে হয়েছিল। কিন্তু ঐ যা হয় আর কি। বহু চেষ্টা করেও আমি অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। মাঝেমধ্যে উইকএন্ডে কান্ট্রিসাইড চলে যেতাম ছবি তুলতে। হঠাৎ একদিন বারে পরিচয় হল শরত মুখার্জির সাথে। সে ওখানে চাকরি নিয়ে গেছে এই মাস ছয়েক হল তাই একটা হোম সিকনেস আছে। ঐ গল্প করেছিল সেদিন এবার ওর মন খুব খারাপ কারণ এবারই ও দেশের বাইরে থাকবে পূজার সময়। আমি লন্ডনে দুর্গাপূজা দেখেছি তাই বললাম এখানেও তো হয়, তুমি এখানে পুজো দেখো। শুনে ও উত্তর দিয়েছিল বাংলার পুজোর কাছে বিদেশের পুজো কিছুই নয়। মায়ের আগমন যে আসন্ন সেটা শরৎঋতুই আগে এসে জানিয়ে দেয়। কিরকম জিজ্ঞেস করাতে ও আমাকে প্রচুর ছবি দেখিয়েছিলো মোবাইলে। ওগুলো দেখার পর আমি ঠিকই করে নিই এবার আমায় ইন্ডিয়ায় আসতেই হবে ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখতে। তারপরই হেড অফিসে বলেকয়ে এখানে আসি। কাল অফিসে যে বাঙালি কলিগরা আছে তাদের কাছে শুনলাম দুর্গাপূজা শুরু হতে আর কয়েকদিন বাকি। তখন ভাবলাম এখন নিশ্চই ভিলেজ সিনিক বিউটি ক্যামেরা বন্দি করতে পারবো। সেই ভেবেই আজ সকালে বেরিয়েছিলাম কিন্তু চারদিক ঘুরেও আমার মনটা ঠিক ভরলো না। ছবি কিছু তুলেছি ঠিকই কিন্তু …


পৃথা অনির কথা শুনে চুপ করে ভাবছিলো হঠাৎ কিছু মনে পড়াতে ওর মুখে হাসি খেলে গেলো। ও বলল – আজ সকালেই মা ফোন করেছিল। তখন মা জিজ্ঞেস করেছিল এবার পুজোর সময় আমি গ্রামেরবাড়ি যাচ্ছি কিনা কিন্তু তখন আমার উত্তর দেওয়া হয়নি। পরে ভেবেছিলাম মাকে বলবো এবার এই শহরেই পুজোর সময়টা কাটাবো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওখানে গেলেই ভালো লাগবে। তুমি চলো আমার সাথে আমার দেশের বাড়ি, ওখানকার পুজো দেখতে পাবে হয়তো তোমার আশা পূরণ হতে পারে। কি যাবে তো?


- হ্যাঁ হ্যাঁ তা আর না যাই। আমি তো আশাতেই ছিলাম কেউ যদি নেমতন্ন করে

দুজনেই হেসে উঠলো অনির এই কথায়।

পরেরদিন তৎকালে টিকিট কেটে ওরা দুজনেই ট্রেনে উঠলো। ট্রেনে উঠে পৃথা আবার চেষ্টা করলো মাকে ফোনে ধরতে যদি কথা বলতে পারে। ও একা গেলে হয়তো এমনিই চলে গিয়ে মাকে সারপ্রাইজ করে দিতো। কিন্তু এখন সঙ্গে পরিচিত একজনকে সাথে নিয়ে যাচ্ছে। ফোন রিং হতে ও বুঝতে পারলো মা ফোনটা অন করেছে। চৈতালী ফোন ধরতে পৃথা বলল – মা আমরা ট্রেনে উঠেছি। পরশু বাড়ি গিয়ে পৌঁছাবো

চৈতালী মেয়ের কথা শুনে বলল – আমরা বলতে …

- আমি আর আমার এক কলিগ অনিকেত দে

- ঠিক আছে। বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেবো

- পাঠাতে হবে না। আমরা যা পাবো তাতেই চলে যাবো

- ঠিক আছে

দুদিন ট্রেন জার্নি করে যখন ওরা যখন হাওড়ায় নামলো তখন অনি যথেষ্ট ক্লান্ত। পৃথা বুঝতে পারছিলো বড়লোক বাড়ির বিদেশে মানুষ হওয়া অনিকেতের এরকম ট্রেন জার্নি করার অভ্যেস নেই। তাই বলল – অনি ফিলিং একজস্টেড?

অনি বিব্রত মুখে বলল – তা একটু বটে তবে অসুবিধে হবে না

- তাহলে ঠিক আছে। কারণ এখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে আরও কিছুটা যেতে হবে

ট্রেন জার্নিটা খুব একটা ভালো না লাগলেও বারাসাত স্টেশনে নেমে বাইরে আসতেই অনির ক্লান্তি বেশ অনেকটাই চলে গেছে খেয়াল করলো পৃথা। ওরা স্টেশন থেকে অটো ভাড়া করলো বাড়ি যেতে। চারদিক দেখে অনি পৃথাকে বলল – আজ ছবি তোলার আর এনার্জি নেই। কাল এদিকে এসে ঘুরেঘুরে কিছু ছবি তুলবো

পৃথা বলল – ওকে বস

ওরা যখন বাড়ি গিয়ে পৌঁছলো তখন প্রথমেই চৈতালীর সাথে দেখা হল। চৈতালী সেই মুহূর্তে বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারী করছিলো। ওদের দেখে প্রথমে হাসলো তারপর মেয়েকে বলল – আয় আয়। তোদের দেরী দেখে আমি বেশ টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম

পৃথা চৈতালীকে দেখিয়ে অনিকে বলল – আমার মা

অনি এগিয়ে গিয়ে বলল – হ্যালো আন্টি

- হ্যালো অনি

- আপনাদের বাড়িটা তো দারুণ সুন্দর

- এর জন্য আমার দাদাশ্বশুরকে থ্যাঙ্কস জানাতে হয়। বাড়িটা ওনারই তৈরী। যাক বাড়ি আর আসপাশ পরে দেখবে এখন চলো স্নান করবে খাওয়াদাওয়া সারবে। কত বেলা হয়ে গেলো

দুপুরে ওরা তিনজন যখন একসাথে খেতে বসলো তখন টেবিলের ওপর সাজানো খাবারে সম্ভার দেখে অনি বলল – এতো খাবার?

চৈতালী হেসে বলল – প্রথমবার এসেছো। আমাদের বাড়ির নিয়মমতো অতিথি আপ্যায়ন তো করা উচিৎ

খাওয়াদাওয়ার পর বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে উঠে চৈতালী মেয়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখলো মেয়ে তখনো ঘুমোচ্ছে। ও কাছে গিয়ে ঠেলা মারলো মেয়েকে। পৃথা চোখ খুলতে ও বলল – কি রে বিকেলেও পড়েপড়ে ঘুমাবি বলে এখানে এলি নাকি! অনিকেতকে একটু আসপাশটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয়। ছেলেটা কি ভাববে বল তো

পৃথা লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলো – ঈশ খুব বাজে হল। ঘুমাবো না করে করেও কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। অনি উঠে পড়েছে?

- তা জানি না। আমি গেস্টরুমের দিকে যাইনি এখনো। প্রথমে তোকেই দেখতে এলাম

 পৃথা হড়বড়িয়ে উঠে ফ্রেস হতে গেলো। একটু পরে ও অনির রুমে ঢুকে দেখলো অনি বিছানায় শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছে। পৃথা হেসে বলল – বিশ্রাম হলো?

অনি মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে হেসে বলল – হ্যাঁ

- তাহলে চলো চা খেয়ে তোমায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসি

- চলো

বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই পৃথা ওকে নিয়ে গেলো পারিবারিক দুর্গাদালানে। দেবী দুর্গা সপরিবারে মন্দির আলো করে বসেছেন। কাল মহাসপ্তমী, তাই আজ মন্দিরে খুব ব্যস্ততা। মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পরিবারের বাকিদের সাথেও দেখা হয়ে গেলো পৃথার। প্রথমেই ওকে দেখতে পেলো বড়জ্যেঠুর বড় মেয়ে কোয়েলদি। ওকে দেখেই দিদি হৈহৈ করে বলে উঠলো – কীরে কেমন আছিস? কতদিন পর দেখলাম তোকে

পৃথা হেসে বলল – ভালো আছি দি। তোমরা কবে এলে?

- নিউ জার্সি থেকে এক সপ্তাহ আগেই এসেছি। প্রথমে শ্বশুরবাড়ি থেকে তারপর এখানে এলাম

- তা রশ্মি আর ঋককে দেখছি না

- এখানেই তো ছিল। কে জানে হয়তো বনি সানির সাথে খেলছে

- ও মেজদি সেজদি এসেছে কিন্তু কোথায় দেখছি না তো

পেছন থেকে কেউ উত্তর দিলো - দেখবি কি করে। এলি দেরীতে তারপর ঘরে সেঁধিয়ে আছিস  পৃথা পেছন ঘুরে দেখলো পেছনে মৌসুমীদি, বড় কাকার বড় মেয়ে তবে ও পৃথার থেকে বয়েসে বড়। পৃথা বলল – না না এই তো বেরিয়েছি পুরো গ্রাম ঘুরে দেখবো আর দেখাবো বলে। আগে পরিচয় করিয়ে দিই এ অনিকেত দে, আমার অফিসের কলিগ। কোনদিন এদিককার পুজো দেখেনি তাই নেমতন্ন করে নিয়ে এলাম

ওর কথা শুনে রিমা, ছোটকাকুর ছোট ছেলের বৌ, যে আবার পৃথার বয়সী, মন্দিরের সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে উঠলো – স্বাগতম ভাই আমাদের গ্রামে। ঘুরে দেখুন কেমন লাগে গ্রামাঞ্চল আর সেখানকার পুজো। তারপর উপভোগ করবেন এখানকার মানুষদের অতিথি আপ্যায়ন। আজ তো জেঠিমা আপ্যায়ন করলেন। এরপর আমাদের পালা

অনি হেসে বলল – সবাইকে আমার নমস্কার। ঠিকই বলেছেন আগে গ্রাম দেখি তারপর এখানকার মানুষও দেখবো আর তাদের অতিথি আপ্যায়নও

রিমা হাসলো তারপর বলল - এই পৃথা যাও ওকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো। এরপর তো সন্ধ্যে হয়ে যাবে

পৃথা আর অনিকেত এগোলো বাকি গ্রাম দেখতে। অনি খুব উৎসাহিত গ্রাম ঘুরে। ও ক্যামেরা নিয়েই বেরিয়েছিল, যত পারলো ছবি তুলল। পৃথা ওর কাণ্ড দেখে হেসে বলল – এনার্জি বাঁচিয়ে রেখো, এরপর আরও চারদিন আছে, আরও ছবি তোলার উপকরণ পাবে

অর্ধেকের ওপর গ্রাম ঘুরে ক্লান্ত পায়ে যখন ওরা বাড়ি ফিরে এলো তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। মেয়ের কাছে অনির ছবি তোলার বৃত্তান্ত শুনে চৈতালী অনিকে বলল – তাহলে তো কাল তোমাকে অবশ্যই ভোরে উঠতে হবে। এমন জিনিস দেখবে যেটা সারাজীবন মনে থাকবে

আন্টির কথা শুনে অনিকেত বলল – তাহলে মোবাইলে ভোর চারটের এ্যার্লাম দিয়ে রাখবো

- আর রাতে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি শুতেও হবে

 পরেরদিন ভোরে যখন পৃথা আর অনি বেরোলো বাড়ি থেকে তখন আকাশে সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পৃথা আজ শাড়ি পড়েছে। অনি ওকে শাড়িতে দেখে প্রথমেই বলেছে – তোমাকে আজ যেন রাজকুমারীর মতো দেখাচ্ছে

পৃথা হেসে উত্তর দিলো – ধন্যবাদ

- আজ কোথায় যাবো?

- চলোই না দেখতে পাবে পৃথা অনিকে নিয়ে গেলো নদীর দিকের রাস্তায়। কিছুটা যাওয়ার পরই অনি চেঁচিয়ে উঠলো – মারভেলাস! কি সুন্দর জায়গায় তুমি আনলে আমাকে পৃথা। তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। এই সাদা তুলোর মতো ঘাসফুল জিনিসটা কি?

- কাশফুল! মা দুর্গার আগমনের সংবাদ এরাই আগে বয়ে নিয়ে আসে। তারপর আনে শিউলি ফুল। আর আকাশের সাদা মেঘের ভেলা। এটা প্রকৃতিমা আর শরৎ ঋতু মিলে বানিয়েছে, আমরা শুধু চোখ ভরে সেই সৌন্দর্য্য উপভোগ করি

- এই দাঁড়াও দাঁড়াও

- কি হলো বলে পৃথা ঘুরে তাকাতেই ক্লিক আওয়াজ পেলো। অনির শুরু হয়ে গেছে ছবি তোলা। কত যে তুলল তা পৃথা বলতে পারবে না। এর মধ্যে সূর্য উঠলো। নদীর জলে সেই রূপ দেখার মতো হল। হঠাৎ কি মনে পড়াতে ও বলল – অনি এবার চলো। ওদিকে কলাবৌ স্নানের সময় হয়ে যাচ্ছে

পৃথা ঘুরে সবে পা বাড়িয়েছে, অনি হঠাৎ বলে উঠলো – পৃথা একটু দাঁড়াবে। তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল

পৃথা অবাক হয়ে বলল – হ্যাঁ বলো না

- কয়েকদিন ধরেই ভাবছি বলবো কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। তুমি আমার জীবনসঙ্গিনী হবে? বাকি জীবনের রাস্তাটা আমরা যদি একসাথে হাত ধরে এগিয়ে যাই, তুমি কি আপত্তি করবে?

পৃথা অবাক কিন্তু সেই সাথে এক দারুণ ভালো লাগা ওকে জড়িয়ে ধরলো। যে স্বপ্নটা ও অনিকে নিয়ে দেখতে শুরু করেছিল তা আজ অনি নিজেই বলল ওকে। কিন্তু ওর অতীত ভালোবাসা? অনিকে সব না জানিয়ে তো এগোনো উচিৎ হবে না। যদি সেই অতীত ফিরে এসে অঘটন ঘটাতে চায়? ও হাসলো তারপর বলল – এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের খবর যে তুমি আমাকে ভালোবাসো, এমনকি বিয়েও করতে চাও। আজ আমিও স্বীকার করছি অনি যে আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু…

- এর মধ্যে কিন্তু কোথায়?

- আছে। অতীতে আমার এক ভালোবাসা ছিল; যদিও বর্তমানে নেই কারণ সে নিজেই হাত ছাড়িয়ে চলে গেছে

- যাক আমি নিশ্চিন্ত

অনির কথা শুনে পৃথা অবাক হয়ে তাকাতে ও বলল – আমারও অতীত খুব একটা পরিষ্কার নয়। আমি অনেকের প্রেমেই পড়েছি আবার আগ্রহ হারিয়ে গেলে ছেড়েও দিয়েছি। না তবে তুমি মনে করো না তোমাকেও কদিন পড়েই ছেড়ে দেবো। এই প্রেম প্রেম খেলা খেলতে খেলতে বিরক্ত হয়ে যখন এ দেশে চলে এলাম পরিচয় হল তোমার সাথে। তোমার সাথে আলাপ হওয়ার পর কথাবার্তা বলার পর বুঝলাম আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার আগের রোগটা ফিরে এসেছে কিন্তু না। যত দিন এগিয়েছে তত বুঝতে পেরেছি আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি

- হুম বুঝলাম

- তুমি কি বুঝলে জানি না তবে আমি এটা এখন জোর দিয়ে বলতে পারি যে এখন আমি কিন্তু তোমার সাথে ফ্লার্ট করছিনা। আমার মনের কথাটাই বললাম

অনির কথা শুনে পৃথা চুপ করে থাকলে অনি বলল – অতো চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার মনের কথা জানানোর আগে সময় নাও। আমি অপেক্ষা করতে রাজি

- অপেক্ষা করতে হবে না। আমি বলছি আমি তোমায় ভা…লো… বা… সি…! তুমি যেদিন বলবে আমি সেদিনই তোমার হয়ে যাবো

অনি এগিয়ে এসে পৃথার হাতে হাত রেখে বলল – আমার এখানে আসা সার্থক হল। এবার চলো

ওরা ফিরে আসতে আসতেই দেখলো মন্দিরে বেরোনোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মহাসপ্তমী থেকে দশমীর সকাল পর্যন্ত ওরা দুজনে খুব আনন্দ করলো। নিজেদের পুজো তো আছেই তার সাথে আসেপাশের সব ঠাকুর ওরা ঘুরেঘুরে দেখলো। দশমীর বিকেলে মা দুর্গার বরণ সিঁদুরখেলা সাঙ্গ করে মৃণ্ময়ী মা যখন সবার কাঁধে চেপে চলে গেলো নদীতে বিসর্জিত হতে তখন পৃথা সময় পেলো ঘরে বসার। আজও অনি নিজের ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়েছে সব মুহূর্ত ঐ ছোট্ট বাক্সে বন্দি করতে।

বারান্দার চেয়ারে চুপ করে বসেবসে ও ভাবছিলো পুজো শেষ হয়ে গেলো! আবার সেই অফিস, একঘেয়ে রেগুলার রুটিন! এমন সময় ওর কাঁধে কেউ হাত রাখলো। পৃথা ঘুরে দেখলো মা। চৈতালী বলল – কীরে একাএকা বসে আছিস?

- এমনি

- অনি কোথায়?

- ছবি তুলতে গেছে

- একটা কথা বলবো?

- বলো না

- এভাবে আর কতদিন একাএকা কাটাবি? এবার তো থিতু হ

পৃথার মনে পড়ে গেলো সকালে অনির বলা কথাগুলো। ও বলল – ইচ্ছে আছে থিতু হওয়ার শুধু দুই পরিবারের অনুমতি চাই

- মানে?

- তোমার অনুমতি আর ওদিকে অনির বাবা মায়ের

চৈতালী মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল – আমার অনুমতি সবসময়ই তোর সাথে আছে। তোরা এগিয়ে যা

                                                                                                                                                                                                                                        


   


 


  

   




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance