ছোটবেলার পুজোর সুখস্মৃতি (শারদ সংখ্যা)
ছোটবেলার পুজোর সুখস্মৃতি (শারদ সংখ্যা)


ঋতু সদর দরজা দিয়ে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। একটু পরেই কলাবৌ স্নানে যাবে এই পথ দিয়ে। বাবার চেনা অফিসের কাকুরাই যাবে কলাবৌকে নিয়ে দামোদরে স্নান করাতে। ওদের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে যে রাস্তা সেটা ধরেই মিনিট পাঁচ হাঁটলে দামোদর নদ। ওর মা রান্নাঘর থেকে আওয়াজ দিলো - ঋতু ওরা এসে পড়লে বলিস একটু পরেই ওর আশা পূর্ণ করে কাকুদের দল চলে এলো ওদের কোয়ার্টারের সামনে। ঋতু চেঁচিয়ে বলল – মা কাকুরা চলে এসেছে
মধুরা তাড়াহুড়ো করে দরজায় মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। কাকুরা পেরিয়ে গেলো। এবার দলে দিবাকর কাকুর বড় ছেলে সুমিতদা আর বরুণ কাকুর মেজ ছেলে রজতদাও রয়েছে। দলটা পেরিয়ে যেতে মধুরা হাত জোড় করে প্রনাম সেরে চলে গেলো রান্নাঘরে। ঋতু জানলার পাশে বসে অপেক্ষা করতেই থাকলো কলাবৌয়ের স্নান করে ফেরার। ওদের কোয়ার্টার থেকে পুজো মণ্ডপ বেশ খানিকটা দূরে তাই পুজোর কোন আওয়াজ আসে না ওদের কানে। কিন্তু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শরৎকাল এলে ঋতুর মনটা নেচে ওঠে কারণ স্কুলে তখন পুজোর ছুটি পড়বে। সারা বছর যে বাবা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে সে কদিন ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। তাছাড়া ও নতুন জুতো জামাকাপড় পড়বে এটাই ওর কাছে খুব আনন্দের বিষয়। যাইহোক এইসব আনন্দের ব্যাপার ভাবতে ভাবতেই ও ফের ঢাকের আওয়াজ পেলো। কলাবৌ স্নান করে ফিরছে। ঋতু দেখলো প্রথমে রজতদা, তার হাতে ধুনুচি তারপর তিনজন কাকুর মাথায় তিনটে ঘট তারপর সুমিতদা কলাবৌকে ধরে আছে আরেক কাকুর হাতে চামর তারপর দুজন ঢাকি একটা বাচ্চা কাঁসর বাজাতে বাজাতে আসছে। ওরা পেরিয়ে যেতেই ও শুনতে পেলো মা বলছে – এসো মা, বছর ঘুরে বাড়ি এলে। কতদিন তোমার অপেক্ষায় আছি ঋতু মায়ের মতো প্রনাম করতে করতে ভাবলো মা যে কখন রান্নাঘর থেকে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা ও বুঝতেই পারেনি।
আজ সপ্তমী। সন্ধ্যায় ওর বাবা অফিস থেকে ফিরেই বলল – নাও, তৈরি হয়ে নাও; ঠাকুর দেখতে বেরবো
ঘণ্টাখানেক পর ওরা তিনজনে বেরিয়ে প্রথমেই কোকপ্ল্যান্টের ঠাকুর দেখলো। এই ঠাকুর মন্দিরের কলাবৌ ওদের কোয়ার্টারের সামনে দিয়ে স্নানে যায়। মন্দির বলতে কাকুরা চাঁদা তুলে একটা বড় ঘর তুলে নিয়েছে যার সামনেটায় দেওয়াল নেই, ফাঁকা, আর মন্দিরের সামনে অনেক বড় উঁচু উঠোন যেখানে সবাই ইচ্ছে করলে বিকেলে চেয়ার পেতে বসে থাকতে পারে। ঠাকুর খুব সুন্দর হয় এখানকার, মা দুর্গা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে মন্দির আলো করে বসেছে। এই মন্দিরেই মধুরা আর ঋতু অষ্টমীর সকালে পুজো দিতে আসে।
তাই ঠাকুর দেখার পর ওর বাবা সুনীল এগিয়ে গিয়ে পুরোহিতের কাছে অঞ্জলির সময়টা জেনে নিলো। এরপর প্রায় আধঘণ্টার রাস্তা হাঁটা, তারপর সুনীল যে অফিসে কাজ করে সেই কোলিয়ারির ঠাকুর মন্দির। এই রাস্তাটুকু হাঁটতে গিয়ে ঋতুর প্রতিবারই মনে হতো আর দরকার নেই ঠাকুর দেখে তার চেয়ে বাড়ি ফেরা ভালো। কোলিয়ারির মন্দির সেই আগের মতোই তবে সামনের ফাঁকাটা গ্রিল দিয়ে ঘেরা, দর্শনার্থীদের ঠাকুর দেখতে সুবিধে হবে বলে। ঋতুর বাবা অবশ্য বলেছিল কোলিয়ারির মন্দিরের ঠাকুরকে সোনার গয়না পরানো হয় তাই একটু বেশি সতর্কতা নেওয়া আর কি। ঋতুর কাছে অবশ্য কোলিয়ারির ঠাকুরের বিশেষত্ব হল ঠাকুরের গায়ে ডাকের সাজ। কোলিয়ারির মন্দিরের সামনেই যে ছোট্ট মেলাটা বসে প্রতিবার, সেই মেলাটা ঋতুর কাছে খুব আগ্রহের আর সেই কারণেই পায়ের গোড়ালির ফোস্কা সহ্য করেও ও প্রতিবার আসে ঠাকুর দেখতে। সেই ছোট মেলার একপাশে বাচ্চাদের জন্য নানারকমের চরকি বসে আর একদিকে খুব সুন্দর সুন্দর মাটির তৈরি বাঁশের তৈরি পুতুল ঘর সাজানোর জন্য হাতের কাজ বিক্রি হয়, কৃষ্ণনগর থেকেও মাটির পুতুল আসে আর বিক্রি হয় অবাঙালি ময়রার তৈরি মিষ্টি। ওর বাবা অবশ্য ঐসব মিষ্টি কিনে দেয় না বলে ঐ মিষ্টিতে রাস্তার ধুলো মাছিমশা বসে, ও খেলে পেট খারাপ হবে। তবে ওর পছন্দমতো দুএকটা মাটির পুতুল কিনে অবশ্য দেওয়া হয়। তারপর ওখান থেকে আবার মিনিট কুড়ির রাস্তা হেঁটে বাজারের ঠাকুর। এটা বাজারের দোকানদাররা করতো। এই ঠাকুর দেখতে যাওয়ার রাস্তায় রাধাগোবিন্দের মন্দির পড়ে। সেই মন্দিরে ঢুকে ঠাকুর প্রনাম করে প্রসাদ নিয়ে তারপর তৃতীয় দুর্গাঠাকুরকে দেখতে যায় ওরা।
পরেরদিন ওরা সকালে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যায় বলে বিকেলে আর ঠাকুর দেখতে বেরোয় না। নবমীর বিকেলে ওরা একটু দূরের ঠাকুর দেখতে যায়। দশমীর সকালে মধুরা বেরোয় না তবে ঋতু বেরোয় ওর বাবার সাথে। বাবার সাইকেলে চেপে চলে আসে কোলিয়ারি ঠাকুরমন্দিরের সামনে। ওখানে দশমীর সকালে স্থানীয় কুমোর কামারদের তৈরি বাচ্চাদের খেলার উপযোগী রান্নাবাটির খেলনা বিক্রি হয় তবে ঋতুর কাছে মাটির রঙচঙে মাটির খেলনা বেশি প্রিয় তাই সুনীল ওগুলোই কিনে দেয় ওকে। সারা বছর ঐসব পুতুল দিয়ে খেলা চলবে পারার বান্ধবীদের সাথে। খেলনা কিনে দশমীর বিকেলের জন্য মিষ্টির দোকান থেকে ওরা ফিরে আসে বাড়ি। দুপুরের একটু পরে মধুরা আর ঋতু বেরোয় দুর্গামাকে বরণ করে নিতে। কোকপ্ল্যান্টের দুর্গাঠাকুরের মুখে মিষ্টি আর হাতে পান সুপারি দিয়ে দুর্গামাকে সপরিবারে আবার পরের বছর আসতে বলে মধুরা।
****************
বাবা রিটায়ার করার পর ঋতুরা ওখান থেকে চলে আসে। বহু বছর পর এবার ঋতু কয়েকদিনের জন্য স্কুলের এক বান্ধবীর আমন্ত্রণে সেই পুরনো কয়লার শহরে গিয়েছিল। কত জাঁকজমক করে এখন পুজো হয় সেখানে, পুজো সংখ্যাও বেড়েছে তবে দশমীর বিকেলে ফিরে আসার সময় ছোটবেলার একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছিল ওর। ঐ কয়লা শহরে ওর মায়ের মামাবাড়িও ছিল। দাদুর ছিল খুব নামকরা গোলদারির দোকান। সেবার দাদুর বাড়িতে ওরা দশমীর সকালে গিয়েছিল ওখানকার ঠাকুর দেখতে। দাদুর দোকানের কাছে হওয়া একটা বিখ্যাত দুর্গাঠাকুর দেখে পুজো দিয়ে দুপুরে ফিরে দাদুর বাড়ি খাওয়াদাওয়া করে ওরা। যখন বিকেলে নিজেদের কোয়ার্টারে ফিরছে রিক্সা করে তখন সার সার ট্রাকে বিখ্যাত অখ্যাত সব প্যান্ডেল থেকেই মা দুর্গা সপরিবারে পরপর রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে চলেছে দামোদরের দিকে বিসর্জনের জন্য। সে ঠাকুরের মিছিল যে কোন জাঁকজমককে হার মানায়। ট্রেনে চেপে সেই সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঋতু ফিরে এলো নিজের বাড়িতে।