উমার সংসার (শারদ সংখ্যা)
উমার সংসার (শারদ সংখ্যা)


উমা বসে বসে নাড়ু বানাচ্ছে, নারকেল নাড়ু। তিলের নাড়ু করা হয়ে গেছে; বাকি এখনো চিড়ের নাড়ু, মোয়া মুড়কি, নিমকি। দুপুরের খাওয়া শেষ করে এসব বানাতে বসেছে; সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এলো এখনো অর্ধেক কাজ বাকি। উমার ইচ্ছে আজই সব বানানো শেষ করে ফেলতে। কাল দুর্গাষষ্ঠী। উমা পরশু ভোররাতে স্বপ্ন দেখেছে সৈকত আসছে। স্বপ্ন দেখেই প্রায় লাফিয়ে উঠে বসেছিল ও আর উঠে বসেই দেখেছিলো ভোর হচ্ছে। আকাশ একটু একটু করে আলোকিত হয়ে উঠছে, সামনের আমগাছে পাখিদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তারপর মনে পড়লো সৈকত কিভাবে আসবে। ও তো…… আর পৃথিবীতেই নেই! হঠাৎ ওর মনে পড়লো ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয় তাহলে কিছু একটা অবশ্যই হবে। আর সেই আশাতেই ও বসেবসে এতরকমের খাবার বানাচ্ছে। সৈকত এগুলো খেতে খুব ভালোবাসতো।
এতোটাই ও এই কাজে মগ্ন যে খেয়ালই করেনি রান্নাঘরের দরজায় কারো আগমন ঘটেছে। তবে যার আগমন ঘটলো সে কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো না ঘরে ঢুকে বলল – পিমণি কি বানাচ্ছো এগুলো… নাড়ু! দারুণ! আমার জন্য বানাচ্ছো তো! একসিলেন্ট! তুমি জানলে কি করে আমরা আজই আসছি। বাবা তো এবার তোমাদের চমকে দেবে বলে আগে ফোনই করেনি
উমা পেছন ঘুরে রুবাইকে দেখে বলল – তোরা এসে গেছিস! আমি জানতাম তোরা আসবিই যদিও দাদা বলেনি। বাহ বাহ খুব ভালো। এবার পুজোটা দারুণ কাটবে। হ্যাঁ রে তোর মা কই? ঘরে নাকি? আর বাপি? তারপর ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো রান্নাঘরের দরজার সামনে আরও একজন দাঁড়িয়ে কিন্তু সে ভেতরে আসেনি। উমা জিজ্ঞেস করলো – ও কে রে?
রুবাই বলল – ওকে দেখাবো বলেই তো নিয়ে এলাম। দাঁড়াও ওর পরিচয়টা দিই। ও মিন্টু, ভালো নাম মৈনাক। ও আমার বন্ধু, খুব ভালো বন্ধু। ও কোনদিন দুর্গাপূজা দেখেনি তাই বাপী ওদের নিয়ে এসেছে। ওর একটা বোনও আছে মীনা, ওরফে মীনাক্ষী
- তাই নাকি! তাহলে তো খুব ভালো। তা মিন্টু তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? কাছে এসো
উমার কথা শুনে মিন্টু পায়েপায়ে রান্নাঘরের ভেতরে আসে। ও কাছে এসে দাঁড়াতে উমা হেসে বলে – নাড়ু খাবে?
মিন্টু চুপ করে থাকে, উত্তর দেয়না। রুবাই বলে – ও কোনদিন নাড়ু খায়নি
- ও তাই নাকি! তাহলে নাও একটা খেয়ে দেখো বলে একটা নাড়ু মিন্টুর দিকে এগিয়ে দেয় আর একটা রুবাইয়ের দিকে। মিন্টু ছোট্ট করে একটা কামড় দিয়ে দেখে কেমন খেতে তারপর মিষ্টি করে হাসে; মুখে বলে – আমার মাম্মা এটা বানাতো
- বেশ খাও
রুবাই বলে – দারুণ হয়েছে পিমণি
- আর নেবে?
- না এখন না, পরে আবার খাবো
- তাহলে তোমরা খাও আমি বাকিগুলো বানানো শেষ করি
বাচ্চারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর উমা আবার নাড়ু বানানোয় মন দিলো। একটু পরেই অদিতি রান্নাঘরে উঁকি মেরে বলল – কি ব্যাপার ননদিনী, খবর পাওনি নাকি এখনো আমাদের আগমনের?
উমা পেছন ঘুরে বৌদিকে দেখে হেসে বলল – তাই আবার হয় নাকি বৌদি আমার গুপ্তচররা ঠিক খবর দিয়ে গেছে
- হুম তাহলে তো তোমার সাথে ঝগড়া করবো
- কারণটা তো বুঝতেই পারছি কিন্তু তোমরা আসবে বলেই এসব তৈরি করতে বসেছি তাই উঠে দেখা করে আসতে পারিনি
- তাহলে ক্ষমা করে দেওয়া যেতে পারে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উদয়ন বলল। উমা বলল – তা ভেতরে এসে বসো, পিঁড়ি পেতে দিচ্ছি। নাড়ু বানাতে বানাতে গল্প করবো
- তুই এখনো গ্রামে থাকিস তাই তোর অভ্যেস আছে এখনো মাটিতে বসার। আমরা শহুরে মানুষ, বিদেশী আদবকায়দা শিখে চেয়ার টেবিল আর আরাম আঁকড়ে থাকতে থাকতে হাঁটুগুলো অকেজো হয়ে গেছে; একটু নীচু হতে গেলেই এমন প্রতিবাদ করে যে পূর্বপুরুষদের নাম মনে পড়িয়ে দেয়। তাই পিঁড়িতে বসতে অনুরোধ করিস না উদয়ন জার্মানিতে চাকরি করে। প্রতি বছর না পারলেও দু তিন বছর পরপর পুজোতে দেশে আসে।
- ঠিক আছে চেয়ারের ব্যবস্থা না হোক মোড়ার ব্যবস্থা করি বলেই স্বর উঁচু করে উমা ডাক দিলো – রত্না নাম ধরে ডাকার প্রায় সাথেসাথেই এক ষোড়শী এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখেই উমার নির্দেশ – জ্যেঠু জেঠিমাকে মোড়া এনে দাও বসার জন্য
উদয়ন বলল – আমার জন্য আনাস না। আমি বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে একটু গ্রাম ঘুরে আসি। মিন্টু মীনা তো এই প্রথম গ্রাম দেখছে। ওদের খুব আগ্রহ
উমা বলল – হ্যাঁ রে দাদা মিন্টু মীনা কি তোর কোন বন্ধুর ছেলেমেয়ে?
উদয়ন আর অদিতি একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো তারপর উদয়ন বলল – হ্যাঁ রে আমাদের খুব পরিচিত একজনের। এখন ঘুরে আসি পরে কথা হবে
- ঠিক আছে আয়। বৌদি বসো
অদিতি বলল – ওরা ঘুরতে যাচ্ছে, আমার এখনো ঘরে পড়ার কাপড়জামা বার করা হয়নি আমি চললাম সেগুলো সুটকেস থেকে বার করতে এই ফাঁকে
- ঠিক আছে
রত্না রান্নাঘরে ঢুকে বলল – মণি তুমি এতোসব কাজ নিয়ে বসেছো আমাকে তো ডাকতে পারতে কিছুটা সাহায্য করে দিতে পারতাম
- ঠিক আছে এখন বরং একটা সাহায্য করে দে। আমার হয়ে সন্ধ্যেটা দিয়ে আয়
- বেশ তাহলে আমি বরং সন্ধ্যেটা দিয়ে আসি তারপর তোমায় সাহায্য করবো
একটু পরে রত্না ফিরে এলো উমাকে সাহায্য করবে বলে। উমা জিজ্ঞেস করলো – হ্যাঁ রে তোর বাবা ফিরেছে মাঠ থেকে?
- হ্যাঁ। ফিরে আবার বেরোলো। বলল তোমাকে জানাতে দাদু বাবাকে ডেকেছে পুজো নিয়ে আলোচনা করতে। শেখরকাকাও নাকি এসে পড়েছে
- ঠিক আছে
এককালে উমাদের পূর্বপুরুষ বাড়িতে মা দুর্গার পট পুজো শুরু করে। এখন সেই পুজো চার শরিকে ভাগ হয়ে গিয়ে পূজাটা এখন পালিতে পর্যবসিত হয়েছে। এবার পালিটা পড়েছে শেখরদের ওপর। এতোদিন শেখরের বাবা হরিপদকাকা এসব দেখাশোনা করেছেন; আগের বছর উনি হঠাৎ মারা যাওয়ার পর অন্য পরিবারকে দায়িত্ব দিতে হয়েছিল পুজো করার। এবার পুজোর দায়িত্ব শেখরের কাঁধে এসে পড়েছে। এতোদিন এসব ওর বাবা নিজে দায়িত্ব নিয়ে করে এসেছেন বলে শেখর সেভাবে মাথা ঘামায়নি শুধু পুজোর কদিন এসে এখানে থাকতো। এবার রথের পর থেকেই শেখর মাঝেমধ্যে এসে পুজোর জন্য যা করণীয় করে যাচ্ছে।
মুড়কি মোয়া নিমকি এসব তৈরি যখন শেষ হলো তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। এদিকে সব গুছিয়ে রেখে উমা একবার বড় রান্নাঘরে দেখতে গেলো রাতের রান্না কতদূর। সারা বছর সব আলাদা হাঁড়িতে রান্না হলেও দুর্গাপঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত বড় রান্নাঘরে সবার জন্য রান্না হয়; পুজো শুরু হওয়ার সময় থেকেই এই নিয়ম করা হয়েছে। এর আর একটা কারণ হল শরিক পরিবারগুলির সবাই সারা বছর গ্রামে থাকে না তাই বছরে পুজোর সময় মিলিত হয়ে একসাথে আনন্দ উপভোগ করে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় শুতে গিয়ে উমা খেয়াল করলো রুবাই মিন্টু আর মীনা ওর বিছানাতেই ঘুমোচ্ছে। অদিতি ব্যাপারটা লক্ষ্য করে লজ্জিত হয়ে বলল – রুবাই বলছিল ও তোমার সাথে শোবে কিন্তু ওরাও যে তোমার এখানেই ঘুমিয়ে গেছে তা তো খেয়াল করিনি। দাঁড়াও আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি
শুনে উমা বলল – না না তা করো না। থাক ওরা এখানে, আমার কোন অসুবিধে হবে না
ষষ্ঠী থেকেই বাড়িতে আনন্দের হাট বসে গেলো। যারা বাকি ছিল আসতে তারাও সব এসে পড়লো বিকেলের মধ্যে। উমাও বাড়ির সবার সাথে কাজে এত ব্যস্ত হয়ে রইলো সারাদিন যে আলাদা করে দাদা বৌদির সাথে গল্প করার সময়ই পেলো না। সপ্তমীর সকালে পুরোহিতমশাইরা আবার এসে উপস্থিত হবেন পঞ্চমীর সন্ধ্যায় বেলগাছতলায় আর ষষ্ঠীতে ঘটে মায়ের আহ্বানের পর। আজ কলাবৌ স্নান হবে। তারপর সপ্তমীর পুজো শুরু হবে। পুজো শুরু হওয়ার আগে ঠাকুর দালানে প্রচুর কাজ রয়েছে তাই উমা ভোরে উঠে পুকুরে চলল স্নান সেরে আসতে যদিও বাড়িতে স্নানের সব ব্যবস্থাই আছে তবে ওর পুকুরে স্নান করতেই ভালো লাগে।। খিড়কি দরজার কাছে দেখা হল বৌদির সাথে। ও হেসে বলল – চলো বৌদি
রাস্তায় পা দিতেই দেখা হয়ে গেলো তারার সাথে। ও মাথায় পদ্মের ঝুড়ি নিয়ে আসছে। উমা হেসে বলল – কি ব্যাপার রে তারা, তুই ফুলের ঝুড়ি নিয়ে আসছিস? তোর মা কই?
তারা বলল - মা বাকি ফুল নিয়ে আসছে পিসি। আমাকে বলল দেরী হয়ে যাবে তুই এগুলো পৌঁছে দিয়ে আয়
- বেশ ঠাকুর দালানের একপাশে রেখে আয়। কুঞ্জর মা ঠাকুরঘর মুছছে
তারা মাথা হেলিয়ে চলে গেলো। অদিতি বলল – ঠাকুরঝি তুমি বোধহয় গ্রামের সব ছোটদেরই চেনো, তাই না
- সারা বছর ওদের নিয়েই তো আমার কারবার
- ছোটদের নিয়ে থাকাই তো সবথেকে ভালো; ওদের জগৎ সব জটিলতার উর্দ্ধে। তা তোমার স্কুলে কজন ছাত্রছাত্রী এখন?
- স্কুল নয় ওটা, পাঠশালা। যারা স্কুলছুট বা নানা কারণে স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে তাদেরই আমি সন্ধ্যেবেলায় নিয়ে বসি যাতে আগের পড়াগুলো ভুলে না যায় সেই কারণে
- এটা তো খুবই ভালো কাজ ঠাকুরঝি
- তা জানি না বৌদি কাজটা কতটা ভালো, শুধু সময়টা ভালো কেটে যায়
স্নান সেরে আসার পর ওরা দুজন বসেবসে আলপনা আঁকলো পুরো মন্দির আর ঠাকুরদালান জুড়ে। কাকলীদি, সেজ শরিকবাড়ির বড়মেয়ে আর ছোট বৌদি পিয়ালি এরা পুজোর বাকি সামগ্রী গোছালো বসে বসে। একটু পরে বাকি সবাইরাও চলে এলো মায়ের মন্দিরে। একটু পরেই সপ্তমীর পুজা আরম্ভ হল। এভাবেই অষ্টমী নবমী পেরিয়ে দশমীর সকাল চলে এলো। এই তিনদিন বাড়ির একজনও ফুরসতের নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পায়নি। শুধু তো পুজো নয় এতজন মানুষের তিনবেলা পাত পেড়ে খাওয়া। পুরো গ্রামের লোককে অষ্টমী আর নবমীর দুপুরে খাওয়ানো হয়। আজ দশমীর সকাল। একটু পরে দশমীর পুজো শুরু হবে আর তারপরেই মা দুর্গা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এবছরের মতো বাপেরবাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।
আজ আর ভোরে উঠে উমার ইচ্ছে করলো না তাড়াহুড়ো করে স্নান সেরে মন্দিরে যেতে। আজ মা চলে যাবে আর তারপরেই বাড়ির সব্বাইও যারা কয়েকদিনের জন্য এবাড়িতে পা দেয় তারা সব হাঁটা দেয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাত পেরোতে পেরোতে পুরোবাড়িটাই খালি হয়ে যায়। শুধু পরে থাকে কয়েকজন বুড়োবুড়ি যারা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে শহরে থাকতে পছন্দ করে না। আর থেকে যায় তারা যারা বাড়ির আর চাষের সব কাজ করে। আর থেকে যায় উমা। ওর শহরে কোথাও যাওয়ার নেই। তাই ও এ বাড়িতেই থেকে গেছে।
কিন্তু আজও অভ্যেসমতো আজও ভোরেই উঠেছে তারপর খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে পায়েপায়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলো। প্রতিবারই এরকমই মন খারাপ হয় ওর আর বসেবসে পুকুরপাড়ে চোখের জল ফেলে কিন্তু এমনভাবে যাতে কারো চোখে না পড়ে। কি দরকার পনেরো বছর আগে যা ঘটে গেছে ওর জীবনে তা যে ও এখনো মনে রেখেছে সেটা সবাইকে জানানোর কোন মানে হয় না। এসব সময়েই ওর মনে পড়ে সৈকতের কথা। ওর খুড়তুতো দাদা অনিকেতের বন্ধু ছিল সৈকত তাই মাঝেমধ্যেই স্কুল ফেরত এবাড়িতে আসতো আর বড়ঠাকুমার হাতে নাড়ু মোয়া লুচি তরকারি গুড় রুটি যেদিন যা দিতেন খেয়ে যেতো। এরকম অনেকেই আসতো তাই আলাদা করে বোনেরা তাদের ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না। এভাবে একদিন ওরা সব্বাই বড় হয়ে গেলো। এর মাঝে বাড়ির ছেলেরা কলেজে ভর্তি হল আর তাই ওদের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে আসাও কমলো। সেবার পুজোতে বহুদিন পর সৈকত এলো এবাড়িতে। উমাও ততদিনে শাড়ি পরিহিতা তরুণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। বাড়ির পূজা তাই বাড়ির মেয়েবৌরা সব্বাই ব্যস্ত পূজার কাজে। পূজার আগেপরে ব্যস্ত উমার সাথে যখনই সৈকতের চোখাচোখি হল ও খেয়াল করলো সৈকতের দৃষ্টিতে এক আলাদা মুগ্ধতা। ততদিনে অবশ্য ছেলেদের দৃষ্টির মানে ও বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু কথা বলার আর সুযোগ পায় না। শেষে দশমীর সন্ধ্যেয় মিষ্টিমুখ করার সুযোগে সৈকত উমাকে বলেই ফেলল – তোমাকে তো স্বর্গের অপ্সরা মনে হচ্ছে
সৈকতের কথা শুনে উমা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। ও উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল – যাহ্
- যাহ্ নয়। আমি তো প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গিয়েছি
সৈকতের কথা শুনে উমাও বুঝতে পারলো ও সৈকতকে ভালবাসতে শুরু করেছে। ছোট থেকে বহুবার দেখা ছেলেটিকে যে ও সত্যি মনে মনে ভালোবাসে সেটা তো সেই সন্ধ্যার আগে বুঝতেও পারেনি। এরপর ওদের ভালোবাসা পল্লবিত হতে থাকে। ওদের মধ্যে সম্পর্কটা যে ভালোবাসার সেটা প্রথম আবিষ্কার করে ওর দাদা। উদয়ন অবশ্য খুশিই হয়েছিল ওদের সম্পর্কের কথা জেনে। আর ও ঠিক করেছিল বাবা মাকে বোনের আর সৈকতের মধ্যের সম্পর্কের কথা জানিয়ে বাবাকে অনুরোধ করবে সৈকতের বাবার কাছে ওদের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যেতে। সবই যখন প্রায় ঠিক তখন একদিন উমার এক মামাতো বোন, কৃষ্ণা, যে এবাড়িতেই মানুষ হয়েছে মামী মারা যাওয়ার পর থেকে সে হঠাৎ আত্মহত্যার চেষ্টা করলো কিন্তু কপাল ভালো ওকে বাঁচানো গেলো। উমা কৃষ্ণাকে খুব ভালোবাসতো তাই বোন হঠাৎ এরকম করাতে ও ভীষণ ঘাবড়ে গেলো, বাড়ির বাকিরাও। উমা যেহেতু কৃষ্ণার খুব কাছের মানুষ তাই সবাই ওকে অনুরোধ করলো কৃষ্ণা একটু সুস্থ হলে ওর থেকে জানতে কি কারণ ওর এই আত্মহত্যার চেষ্টা। কৃষ্ণা প্রথম থেকে ভীষণ চুপচাপ স্বভাবের ছিল তারপর এই কাণ্ডের পর থেকে আরও যেন শুঁয়োপোকার মতো ওর আচরণ হয়ে গেলো। সারাদিন রাত ওকে ওর ঘর থেকে বের করা যায় না। কিন্তু উমা একেবারেই হাল না ছেড়ে সারাক্ষণ ওর সাথেসাথেই থাকতো। প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও শেষে ও উমার কাছেই জানালো ও সৈকতদাকে ভীষণ ভালোবাসে আর ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কিন্তু ওর প্রাণের দিদিও সৈকতদাকে ভালোবাসে তাই ও নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলো ওদের মাঝখান থেকে। এসব জানার পর উমা সৈকতকে ডেকে পাঠিয়ে সব জানিয়ে অনুরোধ করে কৃষ্ণাকে বিয়ে করতে। সৈকত প্রথমে রাজি হয়নি কিন্তু উমার জেদের কাছে হেরে গিয়ে রাজি হয় শেষ পর্যন্ত তবে বিয়ের পর থেকে আর কোনদিন এবাড়িতে পা দেয়নি। শুধু তাই নয় সৈকত বা কৃষ্ণার খবরও আর এবাড়িতে আসেনি। বহু বছর পর হঠাৎ সৈকতের এক বন্ধুর সাথে উদয়নের দেখা হওয়াতে ও জানতে পারে সৈকত পরিবার নিয়ে ফ্রান্স চলে গিয়েছিল; ওখানেই গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কৃষ্ণা কিন্তু ওর বাচ্চদের নিয়ে ফিরে আসেনি এদেশে। ব্যস এটুকুই।
পুরোনো ভাবনায় ও এতটাই ডুবে ছিল যে খেয়ালও করেনি কেউ ওকে ডাকছে। ও চমকালো যখন কাঁধে হাত পড়লো। পাশে তাকিয়ে দেখে ওর দাদা। উদয়ন বলল – কীরে মন খারাপ করে বসে আছিস?
- না না। জানিই তো প্রতি বছরই এ দিন আসে। আর আলাদা কি মন খারাপ করবো। আবার এক বছরের অপেক্ষা করতে হবে এই যা
- ভাবছি এ বছর তোকে এমন কিছু দিয়ে যাবো যাতে আমাদের জন্য আর এই পুজোর জন্য তোর অপেক্ষাটা কষ্টকর না হয়
- তাই! তা কি দিবি?
- মিন্টু আর মীনাকে
- এ কি বলছিস দাদা! ওরা তো ওদের বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে। এখানে থাকবে কিভাবে?
- ওরা সৈকত আর কৃষ্ণার ছেলেমেয়ে
- কি বলছো দাদা? কৃষ্ণা এদেশে এলো কবে? এ বাড়িতে ওকে নিয়ে এলে না কেন? ও কি এখনো আমাদের ওপর অভিমান করে আছে?
- না রে বোন, ও পৃথিবীর ওপরেই রাগ করে চলে গেছে
- মানে…
- মানে ও মারা গেছে
- সেকি! উমা দুহাতে মুখ চাপা দিলো। অনেকক্ষণ পর যখন শান্ত করতে পারলো নিজেকে তখন জিজ্ঞেস করলো – কবে? কিভাবে?
- সে খবর জানিনা রে। শুধু কৃষ্ণা মারা যাওয়ার আগে যে পরিবারের কাছে ওদের রেখে গিয়েছিল তারাই আমাকে খবর দেয়। তারপর আমরা গিয়ে নিয়ে আসি
- ওরা জানে ওদের মা আর নেই
- হ্যাঁ
- ওহ এইটুকু শিশুদের ওপর কি মানসিক আঘাত
- সেই কারণেই চাই তুই ওদের ভার নে। তুই তো ওদের বাবা মা দুজনকেই চিনিস। তুই পারবি ওদের ভালোভাবে মানুষ করতে
- কি বলছিস। ওরা কি আমাকে মানতে পারবে? তাছাড়া ওরা এই পরিবেশই কি মানতে পারবে? বিদেশে মানুষ হচ্ছিলো
- হ্যাঁ পারবে পেছন থেকে অদিতি বলল।
- বৌদি তুমিও!
- হ্যাঁ ভাই ননদিনী পারলে তুমিই পারবে ওদের মা বাবা হয়ে উঠতে। ওরা এখনো কাদার তাল যেমন গড়বে সেরকমই তৈরি হবে
- তা ঠিক আছে। তোমরা যখন আমার ওপরেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছো, আমি নেবো
কোজাগরী লক্ষ্মী্পুজার প্রদিন উদয়ন অদিতি আর রুবাই যখন চলে গেলো তখন এরা তিনজন একসাথে স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ওদের বিদায় জানিয়ে এলো।
ট্রেনের জানলা দিয়ে ওদের শেষবারের মতো দেখতে গিয়ে উদয়নের মনে হল এবার উমার সংসারযাত্রা শুরু হল।