অসুরদলনী (শরৎকাল)
অসুরদলনী (শরৎকাল)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
![](https://cdn.storymirror.com/static/1pximage.jpeg)
‘এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার পরে
সকালবেলায় ঘাসের আগায় শিশিরের রেখা ধরে’
রবি ঠাকুরের কবিতাটা পড়তে পড়তে তুয়া ওর মায়ের দিকে তাকালো। দেখলো কাজরী বসে বসে সাজছে। মায়ের সাজা দেখে ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তুয়ার মোটেও ভালো লাগে না প্রতি বিকেলে মায়ের এই বিশেষ সাজাগোজা। ছোট থাকতে ভাবতো মা হয়তো ওকে নিয়ে বেড়াতে বেরোবে কিন্তু না মায়ের সাজ শেষ হতেহতে সন্ধ্যে নামতো তারপর ওকে যমুনাপিসির কাছে জমা রেখে কোথায় যেন চলে যেতো আর এখনো যায়। তারপর আর সারা রাতেও ফেরে না। মা কখন আসবে এই আশায় অনেক রাত অব্দি জেগে থাকে তুয়া। আর জেগে থাকে বলেই শুনতে পায় অনেক পুরুষের গলা আর মাঝেমধ্যে গান গাওয়ার বা পায়ের নূপুরের শব্দ। একবার জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখেছে রাস্তায় যে দু চারটে লোক চলাফেরা করে আদের হাঁটা কেমন জানি স্বাভাবিক নয়। যমুনা পিসি একেবারেই পছন্দ করে না রাস্তার দিকের পর্দা তোলা, দেহতে পেলে ভীষণ বকে। মায়ের মতো আরও কয়েকটা মাসি আছে যারা এই বাড়িতেই থাকে আর মায়ের মতোই তাদের বাচ্চাদের যমুনা পিসির কাছে রেখে রাতের কাজে যায়। সেই বাচ্চাদের অনেকেই তুয়ার বন্ধু। ওর সাথেই এখানকার একটা স্কুলে পড়ে। বেশি রাত অব্দি জেগে থাকলে আবার পিসি ধমকায় কারণ পরেরদিন স্কুল যেতে দেরী হয়ে যায়। তাই ভয়ে ভয়ে সময়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়তে হয় ওকে। খাবার পেটে গেলে ও আর বেশীক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। ঘুম ঠিক ওকে কোলে তুলে নেয়। রাতে অভিমান করে শুলেও সকালে ঘুম ভাঙলেই দেখে মা ওর পাশেই শুয়ে ঘুমোচ্ছে। সকালে মায়ের ঘুম ভাঙলে ও প্রশ্ন করতোই – মা কোথায় গিয়েছিলে?
কাজরী উত্তর দিতো – চাকরি করতে সোনা
- কত রাত অব্দি চাকরি করো তুমি? আমি কতক্ষণ তোমার জন্য বসেছিলাম
- আসলে বেশি রাতে গাড়ি কম চলে তো রাস্তায় তাই গাড়ি পেতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল
তখন মায়ের কথাটা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলেও এখন একটু বড় হয়েছে বলে ও বুঝতে পারে মায়ের এই চাকরিটা মোটেই সুবিধের নয়। মাকে একবার বলেও ছিল – মা তুমি দিনেরবেলার চাকরি খোঁজ না কেন? তাহলে তো রাতে আমার কাছে থাকতে পারো। ঐ পিসির কাছে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না
মা কাঁদো কাঁদো নাকি হাসি হাসি মুখ করে বলেছিল – দিনের বেলার চাকরি করতে যে যোগ্যতা লাগে তা তো আমার নেই সোনামণি তারপর ওর গাল টিপে ধরে আদর করে বলেছিল – সেইজন্যই তো তোকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি যাতে তুই বড় হয়ে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারিস যাতে আমাকে এই রাতের চাকরি করতে না হয়
এখন কবিতা পড়তে পড়তে তুয়া বলল – মা তুমি শিউলি ফুল দেখেছো?
চুল বাঁধতে বাঁধতে কাজরী উত্তর দিলো – হ্যাঁ শুধু দেখেছি নয় প্রচুর কুড়িয়েছি
- কি করতে শিউলি ফুল কুড়িয়ে?
- ঠাকুর পুজোর জন্য কুড়িয়ে আনতাম রে। তোর দিদা পুজো করতো
- তোমাদের বাড়িতে শিউলি গাছ ছিল?
- না কয়েকটা বাড়ি পরে রায় বাড়ি ছিল। ওদের বাগানে দুটো শিউলি গাছ ছিল। এতো ফুল হতো যে গাছের তলাটা ফুলে ভরে থাকতো। ওখান থেকেই নিয়ে আসতাম
- ঈশ এখানে যদি শিউলিফুলের গাছ থাকতো তাহলে আমিও কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম
চমকে উঠে কাজরী বলল – না না তার দরকার নেই। তুমি বই পড়ো। তোমাকে বড় হতে হবে তো তুয়া বুঝতে পারলো না কেন মা এই কথা বলল। ছোটবেলায় যা কুড়াতে আনন্দ পেতো এখন কি আর সেটা ভালো লাগে না? তুয়াকে বারণ করলো কারণ ততক্ষণে কাজরীর মনে পড়েছে যে ঐ ফুল কুড়াতে গিয়েই তো ওর সর্বনাশ হয়েছিল। দেখা হয়েছিল ওর এক পুরুষের সাথে যে ওকে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়ে সব লুটে নিয়েছিল। কাজরীও ভালবেসেছিল, মনপ্রাণ দিয়ে। কিন্তু ভয় পেয়েছিল যখন ও দেখলো সেই ভালোবাসার চিহ্ন ওর শরীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। কি হবে এবার যখন বাড়ির লোক পাড়াপ্রতিবেশী ব্যাপারটা বুঝতে পারবে? ও ছুটে গিয়েছিল প্রেমিক পুরুষের কাছে। সে অবশ্য সব শুনে ওকে তাড়িয়ে দেয়নি, বরং অভয় দিয়ে বলেছিল কোন চিন্তা করো না কাজরী। আমাদের সন্তান আমাদের দুজনের হাত ধরে পৃথিবী দেখবে। তাই আগে চলো আমরা বিয়ে করে নিই। তবে গ্রামে করলে তো কিছু সমস্যা হতে পারে তাই চলো যে শহরে আমি কাজ করি সেখানকার মন্দিরে তোমায় বিয়ে করবো। ভালোবাসার ঘর বাঁধবে এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে সেই পুরুষের হাত ধরে ও চলে এলো শহরে। যে বাড়িতে উঠেছিল সেই পাড়ার মোড়ে এক কালিমন্দিরে পরেরদিন সকালে তারা বিয়েও করে নিলো। তারপর বাড়ি ফিরে এসে সেই প্রেমিকপ্রবর বলল আজ আমাদের ফুলশয্যা তাই আজ প্রথমদিনই তোমায় রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না। তুমি বসো আমি খাবার কিনে আনছি। খুব আনন্দে ছিল কাজরী। খাবার খেয়ে স্বামী সঙ্গে খুব আনন্দে সেই রাত কাটলো ওর কিন্তু পরেরদিন সকালে উঠে দেখলো স্বামী হাওয়া। প্রথমে ভেবেছিল কাজে গেছে একটু পরেই ফিরবে কিন্তু না সারাদিন কেটে গেলো কেউ এলো না। সারাদিন চলে গেলো না খেয়ে। বিকেল থেকে ওর পাগল পাগল দশা। অচেনা শহর অচেনা বাড়ি অচেনা প্রতিবেশী, কার কাছে
গিয়ে ও সাহায্য চাইবে। সন্ধ্যার পর এক মাতাল এলো সেই বাড়িতে। সে এসে ওকে বলল ওর সাথে যেতে। কাজরী আপত্তি করলে হেসে বলেছিল যার অপেক্ষা করছিস সে তোকে আমার হাতে বিক্রি করে পালিয়েছে। বুঝেছিস সে আর ফিরছে না তারপর আর কি, খিদের জ্বালায়, আশ্রয়ের আশায়, নতুন যে আসছে তার কথা ভেবে ওর এই রাস্তায় আসা।
ওদিকে তুয়া কবিতা পড়তে পড়তে ভাবছিলো কেন মা ওরকম করে গ্রামের বাড়ির কোন কথা উঠলেই? এর কয়েকদিন পরে হঠাৎ এক সকালে বাড়ির সামনে হইচই শুনে তুয়া আগ্রহী হয়ে জানলা দিয়ে দেখলো কয়েকজন লোক এসেছে যাদের সাথে যমুনা পিসি খুব রেগেরেগে কথা বলছে। ওর মা সেই মুহূর্তেই স্নান সেরে ঘরে ঢুকেছে। মেয়েকে জানলায় দেখে ওর পাশ দিয়ে নীচে উঁকি মেরে দেখে খুব নির্লিপ্তভাবে শাড়ি পড়তে থাকলো। তুয়া খানিকক্ষণ ব্যাপারটা দেখে ঘুরে মাকে জিজ্ঞেস করলো – মা ওরা কে? কেন এসেছে? আর পিসিই বা রেগে রেগে কথা বলছে কেন?
- পিসির রাগার কারণ আছে মা। ঐ লোকেরা আমাদের এমনিতে পছন্দ করে না কিন্তু দুর্গাঠাকুরের মূর্তি বানানোর সময় এখানে এসে এখানকার মাটি চায়
- কেন মা দিলে কি হবে?
- যে সমাজে আমাদের জায়গা নেই সেই সমাজের লোক দেখানো শক্তি পুজোর জন্য এখান থেকে মাটি নেবে কেন?
- মা দুর্গা কি শক্তির ঠাকুর?
- হ্যাঁ। মা দুর্গা অসুর মেরে পৃথিবীর লোককে বাঁচিয়েছিলেন তাই পৃথিবীর লোক মায়ের পুজো করে
- তাহলে মা দুর্গা তোমাদের বাঁচালেন না কেন অসুরের হাত থেকে?
মেয়ের এই প্রশ্নের উত্তর কাজরী দিতে পারলো না, শুধু অবাক মুখে তাকিয়ে রইলো মেয়ের মুখের দিকে। যে কলঙ্ক ওদের মতো মেয়েদের কপালে লেপে দিয়েছে এই সমাজ সেই তাদের হাত থেকে যে দেবী দুর্গা ওদের বাঁচাতে পারেননি সেটা কত সহজেই বুঝে গেলো ও। মেয়ে যে দিনেদিনে কত বুদ্ধিমতী হয়ে উঠছে সেটাই এতদিনে খেয়াল করলো ও। ওদিকে তুয়া তখন অন্য প্রশ্নে উপস্থিত হয়েছে। - মা এখানে দুর্গা ঠাকুর যখন আসবে তখন আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবে না?
কাজরী বলল – হ্যাঁ যাবো এটা বলতে পারলো কারণ যে এনজিওর দিদিমণিরা ওদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখান ওরাই এবার ব্যবস্থা করবেন বলে কথা দিয়েছেন বাচ্চাদের আর তার মায়েদের ঠাকুর দেখানোর।
তারপর কাজরী বলল – তুয়া এবার তৈরি হও সোনা, স্কুলে যেতে হবে তো
তুয়াও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে স্কুলের দিকে হাঁটা দিলো। প্রথম ক্লাস শুরু হতে প্রতিমা ম্যাম ঢুকলেন। ওকে দেখে সবাই বলল – সুপ্রভাত দিদিমণি
- সুপ্রভাত সোনারা। বসো সবাই
সবাই বসলে তুয়া প্রথমেই বলল – দিদিমণি আজ সকালে জানো একটা ব্যাপার হয়েছে। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মা কোন উত্তর দেয়নি
প্রতিমা ম্যাম বললেন – কি প্রশ্ন তুয়া?
তুয়া সকালের পুরো ঘটনা বলে মাকে যে প্রশ্নটা করেছিল সেটাই দিদিমণিকে বলল - মা দুর্গা কেন বাঁচালেন না মায়ের মতো সবাইকে অসুরের হাত থেকে?
- তোমাকে একটা ছোট্ট প্রশ্ন করি। তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে। ধরো তুমি কোথাও বেড়াতে গেছো। হঠাৎ দেখতে পেলে বিপদে পড়েছো। কোন দুষ্টু লোক তোমাকে ধরতে আসছে। তুমি কি করবে? চেষ্টা করবে তো দৌড়ে পালিয়ে বাড়ি ফিরতে নাকি বোকার মতো কাঁদবে আর দাঁড়িয়ে থাকবে কখন কেউ এসে সাহায্য করবে বলে?
- দিদিমণি আমি চেষ্টা করবো দৌড়ে পালিয়ে বাড়ি ফিরতে
- সেটাই মা দুর্গা করতে বলে সব মেয়েকে। দেখো অসুর তাড়ানোর জন্য সব দেবতা মা দুর্গাকে অস্ত্র দিলেও যুদ্ধটা কিন্তু মা দুর্গাকেই লড়তে হয়েছিল। কেউ সাহায্য করতেও আসেনি আর মাও ভয়ে পিছিয়ে যায়নি। মা দুর্গা সব মেয়েকে সেটাই বলে যে কোন বিপদে পড়লে নিজের গায়ের জোরে হোক বা বুদ্ধির জোরে হোক তোমাকে নিজেকেই বেরিয়ে আসতে হবে। সবসময় তুমি পাশে কাউকে নাও পেতে পারো সাহায্যের জন্য
তুয়া মাথা নাড়লো, ও বুঝতে পেরেছে দিদিমণির কথা।
কয়েকদিন পর অষ্টমীর সকালে এনজিওর দিদিমণিরা বাসে করে ওদের নিয়ে চলল শহরের সব নামীদামী ঠাকুর দেখাতে। নতুন জামা পড়ে তুয়ারা সবাই খুশি। সবাই খুশিমনে বাসে উঠে বসলো। অনেক ঠাকুর দেখে এক পুজো প্যান্ডেলে দুপুরের খিচুড়ি ভোগ খেয়ে যখন ওরা ফিরলো তখন বাড়িতে ঢুকে কাজরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো – হ্যাঁরে কেমন দেখলি ঠাকুর?
- দারুণ মা
- প্রনাম করেছিস তো?
- হ্যাঁ
- মায়ের কাছে কিছু চাসনি?
- চেয়েছি তো
- কি চাইলি?
- মা দুর্গার মতো শক্তিশালী হতে যাতে যে কোন বিপদে মন শক্ত করে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে পারি
কাজরী মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল ‘ঠাকুর তোর এই প্রার্থনা যেন অবশ্যই পূরণ করে’