Sonali Basu

Classics

3  

Sonali Basu

Classics

ভুবনবাবুর ভুল সংশোধন

ভুবনবাবুর ভুল সংশোধন

5 mins
925


ভুবনবাবু অফিস ফেরত বাজারে ঢুকেছিলেন কিছু ফলমুল বাজার করতে। পরেরদিন সাপ্তাহিক লক্ষ্মী পুজো, স্ত্রী গায়ত্রী বলে দিয়েছিল পান সুপারি কলা নিয়ে আসতে। কেনাকাটা সেরে অপুর দোকানে ঢুকলেন এক কাপ চা খেতে। অনেক বছরের চায়ের খরিদ্দার উনি এই দোকানের। বহু পুরনো দোকান অপুদের। আগে ওর বাবা চালাতো এখন অপু দেখাশোনা করছে। অপুর বাবা এখন দোকানে আসে না বিশেষ, বয়েসজনিত কারণে। আজ চা খেতে এসে ভুবনবাবু দেখলেন অপুর বাবা এসেছে। উনি জিজ্ঞেস করলেন “কি গো রাধেশ্যাম কেমন আছো?”

রাধেশ্যাম ওনাকে দেখে হেসে বলল “এখন একটু ভালো গো দাদা। মাঝখানে অনেকদিন ভুগলাম হাঁটুর ব্যাথায়”

“সে কি গো, তোমারও হাঁটু ব্যাথা?”

“হ্যাঁ দাদা। ডাক্তার দেখালাম অনেক। প্রথমে বলছিল বাত, সেরকমই ওষুধ দিয়েছিল। না কমাতে ছেলে অন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি ভালো করে পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানালেন হাঁটুতে নাকি একরকম জলমার্কা জিনিস আছে ওটা শুকিয়ে গেছে। ওই কারণে নাকি হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি লাগছে। তা ডাক্তার বলল একরকম ইঞ্জেশন দিতে হবে। তাই নিচ্ছি”

“কমেছে ব্যাথা?”

“তা একটু তো কমেছেই নাহলে আসতে পারতাম না”

ভুবনবাবু ভাবলেন গায়ত্রীও তো হাঁটু ব্যাথায় ভুগছে, ওষুধও খাচ্ছে কিন্তু সেরকম তো কমছে বলে মনে হয় না। ওকেও একবার রাধেশ্যামের বলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়? ভাবনাটা মনের মধ্যে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে উনি রাধেশ্যামকে বললেন “তুমি যে ডাক্তার দেখাচ্ছো ওনার ঠিকানা বা ফোন নম্বর থাকলে দাও তো তোমার বৌদিকে দেখাবো”

রাধেশ্যাম বলল “এসবই আমার অপু জানে” বলেই অপুকে বলল “কাকাবাবুকে ডাক্তারের ফোন নম্বরটা দিয়ে দে তো”

অপু উত্তর দিলো “হ্যাঁ দিই”

চা খেয়ে ফোন নম্বর নিয়ে ভুবনবাবু বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। বাড়ি এসে পৌঁছতে দেখলেন গায়ত্রী বসার ঘরে নেই, টিভিও বন্ধ। কি হল, ভাবেন উনি। এই সময় তো সিরিয়াল দেখা গায়ত্রীর অভ্যেস। ঘরে গিয়ে দেখেন স্ত্রী বিছানায় বসে আর ওনার মেজ ছেলে চন্দন পায়ে মলম ঘষে দিচ্ছে। ভুবনবাবু জিজ্ঞেস করলেন “কি ব্যাপার? ব্যাথা আবার বাড়লো নাকি?”

“হ্যাঁ… আর বোল না বিকেলে ঘুম থেকে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হাঁটুটা এমন করে উঠলো যে বেখাপ্পা পা’টা মাটিতে পড়ে মুচকে গেলো। খুব ব্যথা হচ্ছে! তারপর থেকে আর হাঁটতেও পারছি না। চন্দন ছিল সেই সময় বাড়িতে তাই রক্ষে। আমার ব্যথার মলম ফুরিয়ে গিয়েছিল। ও কিনে এনে এবার মালিশ করে দিচ্ছে” ভুবনবাবু ছেলে আর মাকে একবার দেখে হুঁ বলে চলে গেলেন হাত মুখ ধুতে।

হাত মুখ ধুয়ে এসে বসতে বসতেই চন্দন এসে এক কাপ চা ধরিয়ে দিলো ওনার হাতে। ভুবনবাবু চা নিয়ে প্রশ্ন করলেন “আজ দোকানে যাওনি?”

“বেরোনোর মুখেই মায়ের পা মচকালো তাই ওষুধ এনে মালিশ করে দিতে হল। এবার গিয়ে দোকান খুলে বসবো” বলে চন্দন বেরিয়ে গেলো।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভুবনবাবু ওনার বড় ছেলে সুনন্দকে ফোন করলেন। তিন ছেলের মধ্যে বড়টা মায়ের খুব ন্যাওটা ছোট থেকেই। গায়ত্রীর পা মুচকেছে এই খবর যদি না দেওয়া হয় আর ও জানতে পারে তাহলে খুব দুঃখ পাবে। ফোনটা বেজেই গেলো কিন্তু ছেলে ধরলো না। কি হল, এখনো কি অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি, ভাবতে ভাবতে উনি বড় বৌমা মহুয়াকে ফোন করলেন। মহুয়া ফোন ধরে বলল “ভালো আছেন তো বাবা?”

মহুয়ার গলায় বাবা শব্দ ওনার কানে যেন মধুর মতো লাগলো। উনি বললেন “আমি তো ভালো আছি মা কিন্তু তোমার শ্বাশুড়িমা ভালো নেই। একেই পায়ে ব্যাথা লেগেই থাকে তার ওপর পা মুচকে ব্যাথা আরও বেড়েছে”

“অতো চিন্তা করবেন না, ডাক্তার যা বলেন সেইভাবেই চলতে বলুন”

“হ্যাঁ সেটা তো অবশ্যই তবে তোমার শ্বাশুড়িমাকে তো চেন। ওই ব্যাথার মলম এনে লাগাচ্ছে। ডাক্তার দেখাতে বললে বলে দরকার হলে ঠিক যাবো। তা মা সুনন্দ বাড়ি ফেরেনি?”

না বাবা, ওর আজ একটু দেরিই হবে, বলে গেছে”

“বেশ মা, ও ফিরলে জানিয়ে দিয়ো’

“হ্যাঁ বাবা বলে দেবো”

বড় বৌমার সাথে কথা শেষ হলে উনি ছোট ছেলে নন্দনকে ফোন করলেন। সে ফোন ধরে সব শুনে বলল “মাকে ভালো ডাক্তার দেখাও বাবা। ব্যাথা বাড়লে মা কষ্ট পাবে”

মায়ের জন্য ছেলেদের চিন্তা দেখে উনি খুব খুশি হলেন।

গায়ত্রীর পায়ের ব্যাথা কিন্তু কমলো না। চন্দন রাতে বাড়ি ফিরে দেখে মা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আর ব্যাথার চোটে গায়ে জ্বরও চলে এসেছে। ব্যাপারটা দেখে ও আর সময় নষ্ট না করেই বড় ডাক্তারকে খবর দিলো। ডাক্তারবাবু এসে সব দেখেই বললেন “আমার মনে হচ্ছে পা শুধু মচকায়নি আরও গুরুতর কিছু হয়েছে। আপনি পারলে আজ রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করুন”

গায়ত্রী শুয়ে শুয়েই বলল “আজ রাতটা থাক না বাবা, কাল সকালে দিস। তোর, তোর বাবার তো খাওয়াও হয়নি”

“আমাদের খাওয়ার কথা চিন্তা করো না তো এখন” বলে চন্দন ওর চেনা এ্যম্বুলেন্সে খবর দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা এসে গায়ত্রীকে তুলে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হল চন্দন আর ভুবনবাবুও সাথে গেলেন। ওখানকার ইমারজেন্সির ডাক্তার ব্যাপার দেখে বললেন “মনে হচ্ছে পায়ের গোড়ালিতে ফ্রাকচার। কালকে এক্সরে করে নিতে হবে তাহলে বোঝা যাবে ঠিক কি হয়েছে। আপাতত আমি ব্যাথা কমানোর ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি ওতে উনি একটু আরাম পাবেন”

মাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চন্দন ওর বাবাকে নিয়ে গেলো সামনের হোটেলে। রাতের খাবার ওখানে খেয়ে বাবাকে বাড়িতে রেখে দিয়ে আবার নিজে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে রইলো।

পরেরদিন এক্সরে করে তার রিপোর্ট দেখানোর পর ডাক্তারবাবু বললেন “যা ভয় পেয়েছিলাম, তাই হয়েছে”

ভুবনবাবু সকালে এসে হাসপাতালে বসেছিলেন, ডাক্তারের কথায় ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন “তাহলে কি হবে ডাক্তারবাবু?”

“ভয় পাবেন না। ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হবে আর ওষুধ লিখে দিচ্ছি। ওগুলো খাবেন আর সম্পূর্ণ বিশ্রাম। পা একদম ঠিক হয়ে যাবে”

চন্দন প্রশ্ন করলো “আজ মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো তো?”

“বিকেলে ছেড়ে দেবো”

ভুবনবাবু অফিস যেতে আসতে আর যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন দেখেন চন্দন কেমন বাড়ির আর মায়ের সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাকি দুই ছেলে ফোনেই জেনে নেয় মা কেমন আছে।

সেদিন আবার অফিস ফেরত অপুর দোকানে ঢুকেছেন চা খেতে, অপু জিজ্ঞেস করলো “কাকিমা এখন কেমন আছেন কাকু?

“বেশ ভালো, তবে তুমি জানলে কি করে?”

“সেদিন চন্দনের সাথে দেখা হয়েছিল তা ওর ব্যস্ততা দেখে জিজ্ঞেস করাতে সব বলল” তারপর ও প্রশ্ন করলো “সুনন্দদা বৌদি ওনারা আসেননি”

ভুবনবাবুকে মিথ্যে বলতে হল “না কাজে খুব চাপ তো চেষ্টা করেও ছুটি পায়নি” উনি তো জানেন মায়ের শরীর খারাপ শুনেও ওরা কেউ দেখতে আসার কথাও তোলেনি।

“ভাগ্যিস চন্দনও ওদের মতো চাকরির হাত ধরে বাড়ির বাইরে চলে যায়নি, তাই আপদেবিপদে আপনাদের জন্য করতে পারছে”

“ঠিকই বলেছ বাবা। আজ আসি তাহলে” বলে উনি বাড়ির পথ ধরেন।

বাড়ি এসে হাত মুখ ধুয়ে চা খেতে খেতে ভাবছিলেন অনেক কিছু। বড় আর ছোট ছেলে পড়াশোনায় খুব ভালো ছোট থেকেই। পাড়ার সবাই স্কুলের সবাই ওদের রত্ন বলতো বলে ভুবনবাবুর গর্বে বুক ভরে যেতো। দুজনেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে ভালো চাকরি বাগিয়ে একজন ব্যাঙ্গালোর আরেকজন হায়েদ্রাবাদে রয়েছে। ওদের তুলনায় মেজটা পড়াশোনায় সেরকম কিছু হতে পারেনি। টেনেটুনে গ্রাজুয়েশন করেছে বাণিজ্য বিভাগে। ভুবনবাবু চন্দনের পড়াশোনার হাল দেখে আফসোস করেছিলেন “তোর দুই দাদা ভাইকে দেখেও কিছু শিখলি না। ওরা কেমন হীরের মতো জ্বলজ্বল করে আর তুই কয়লার মতো, লোকের কাছে বলতেও লজ্জা”

চন্দন উত্তর দেয়নি। ওর ইচ্ছে ছিল দোকান দেওয়ার। তার জন্য টাকাও চেয়েছিল ওনার কাছে কিন্তু ভাইদের পড়াশোনার খরচের অজুহাত দেখিয়ে উনি দেননি। চন্দনও আর টাকা চায়নি। কিছুদিন টিউশনি পড়িয়েছে। তারপর এর তার কাছে ধারধোর করে একটা কাপড়ের দোকান দিয়েছে বটে। মন্দ চলে না দোকানটা।

আজ ওনার মনে হল উনি ভুলই করেছিলেন, হীরের দ্যুতিতে চোখ ঝলসে যায় বটে কিন্তু খিদে মেটে না। খিদে মেটাতে কয়লার আগুনই কাজে লাগে। উনি ঠিক করলেন চন্দনের দোকানটা উনি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবেন। 


Rate this content
Log in