তুমি রবে নীরবে ..
তুমি রবে নীরবে ..
গীতাঞ্জলী মেট্রো স্টেশন ছেড়ে প্রতি ষ্টেশনে ১০-১২ মিনিট করে দাঁড়িয়ে অবশেষে ট্রেনটা টালিগঞ্জ, মানে মহানায়ক উত্তমকুমার-এ এল। এসি রেকের ভেতরে থিক থিক করছে লোক। তবু আরও লোক ভেতরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। দরজা যে বন্ধ হচ্ছে না সে-দিকে কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। না বলে দিলে বোঝার উপায় নেই যে এটা এসি। সাফোকেশন হচ্ছে তখন। বারবার মাইক্রোফোনে ঘোষনা হচ্ছে, “অতিরিক্ত লোক দয়া করে নেমে আসুন, নয়ত দরজা বন্ধ হবে না।” গেটের সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগীতায় সহযাত্রীদের আগের মেট্রোয় এগিয়ে দিয়ে নিজেরা পরের মেট্রোয় যাওয়ার ব্যাপারেও যথেষ্ট উদাসীন। কারনও আছে যথেষ্ট। একে অফিস টাইম তার উপর আবার গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে আত্মহত্যার ঘটনা। আজ দিনটা ২০১৪-র জুনের ২৪ । এতক্ষণ ফোনে কখনও বাবা, কখনও সুমনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল কিন্তু এখন ফোনের টাওয়ারটাও চলে গেল।
আজ সকালে সাতটা পনেরো হবে তখন। চলমান দূরভাষের আওয়াজ। ঘুম চোখে ফোনটা রিসিভ করতেই সুমনের গলা। অফিসের কাজে সে এখন কলকাতার বাইরে, কিন্তু তার কথা শুনে ঘুম পালিয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠতে গিয়ে দেখি বৃষ্টি তার টেডির বদলে আমাকে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। তবে এত খারাপের মধ্যে একটাই ভালো খবর বৃষ্টির আজ জ্বর নেই। কাল সারারাত জ্বর ছিল। উঠেই সোজা শাশুড়িমার ঘরে গেলাম। আজ নিয়ে দশদিন হল তাঁর চোখে অপারেশন হয়েছে। বললাম, “ভাতে ভাত বসিয়ে দিচ্ছি। ডাইনিং টেবিলে থাকবে। নমিতাদিকে বলে যাবো। খাবার গরম করে দেবে আর তোমার চোখের ড্রপও দিয়ে দেবে। আমি উত্তরপাড়া যাচ্ছি।" বাড়ির সব কাজ শেষ করে প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে গড়িয়া মেট্রো স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছি। এতক্ষণে সবে মাত্র রবীন্দ্র সরোবর। বিরক্ত হয়ে নেমে পড়লাম। তারপর বাসে করে সোজা হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে বর্ধমান মেন লাইনের ট্রেন। ভাবলাম একবার ফোন করে দেখি, ক
েমন আছেন ছোটকাকা। অপর প্রান্তে পরিচিত গলাটা শুনতে পেলাম না।ফোন ধরল নয়ন, আমাদের ওই বাড়ির বহু পুরনো পরিচারিকা। বলল, “তুমি তাড়াতড়ি এস। কাকু আমার বা আয়াদিদি, কারও কথা শুনছে না।” আমি বললাম, “এসেই গেছি।” দু’মিনিটের মধ্যে চমকে উঠলাম। ছোটকাকার কল। রিসিভ করতেই চেনা গলা, “মড়াখেকোগুলোকে নিয়ে আর পারলাম না। বাড়িতে মন্টিসোনার জ্বর আর আরেকজন তো কালোচশমা। তুমি কিনা ঝুলতে ঝুলতে হাওড়া স্টেশন এলে। এক্ষুনি বাড়ি ফিরে যাও।” ছোটকাকা বৃষ্টিকে মন্টিসোনা এবং সুমন ও আমাকে মড়াখেকো নামে প্রায়ই ডাকেন। বাবা আর কাকা যে অনেক জায়গায় সমার্থক হন, ছোটকাকাকে না দেখলে সেটা জানতে পারতাম না।
বেল বাজিয়ে দরজা ঠেলতেই দরজা খুলে খেল। তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে ছুটতে ছুটতে দোতালায় এলাম। উত্তরপাড়ায় এই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতে হলে প্রথমে তিন তলায় বাড়িতে প্রবেশ করার মুল প্রবেশ পথ। তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামা। দোতলার শোওয়ার ঘরে ছোটকাকা আছেন। বললাম, “আমি ডাক্তার দত্ত-কে ফোন করছি।” রাজি হলেন না। বললাম, “আরোগ্য নিকেতন নার্সিংহোমে যাবে না গড়িয়া?” বললেন, “একটা দরকারি কথা বলি, আমার যদি কিছু হয় তবে মণ্টিসোনাকে নিয়ে তুমি বা সমু দূরে কোথাও থাকবে। আর একজন অন্য কাজগুলো করবে এক ঘণ্টার মধ্যে ছোটকাকা আর তার বৌমাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স উত্তরপাড়া-এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে কামালগাজি বাইপাসের দিকে ছুটল।
আর তার ঠিক কয়েক মাস পর ৫ অক্টোবর সুমনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ীটা এল গড়িয়া শ্মশান। আর কাকার বউমা তখন তাঁর আদরের মণ্টিসোনাকে নিয়ে বেড়াতে গেছে অনেক দূর। সব কিছু শেষের পরও কত কিছু বাকি থাকে। বাকিটা আগামিকাল। আমাদের গাড়িটা যখন দোলতলা ঘাট দিয়ে যাবে, দোলতলার মেলায় হাজার হাজার লোকের ভিড়ে ঝোলা হাতে একটা লোককে কোথাও দেখতে পাব না। সে যে কোথায় হারিয়ে গেল! নাকি রয়ে গেল আমাদের অজানায়?