টিকিট
টিকিট
‘ও কাকু, আমাকে একটা টিকিট দাও না’ উদগ্রীব হয়ে টিকিটঘরের সামনে এসে বলল দ্যুতি।‘তোকে টিকেট দেব মানে? তুই এখনও বড্ড ছোট, এসব খেলা তোর জন্য নয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে কিছু শিখিস নি?’‘খেলা কোথায়? কি সুন্দর জীবন্ত চলচ্চিত্র হয় ভেতরে, আমি ওই উঁচু বাড়িটার জানলা থেকে উঁকি মেরে দেখতে পেয়েছি। কত রঙ্গীন সব নাটক, কত মানুষজন আনন্দ করছে ওখানে’‘ও তোর ভাল লাগবে না রে খুকি। ও সবই নাটক, সত্যি তো নয়। যবনিকা পতন হলেই দেখতে পাবি সব নাটক আনন্দের হয় না। তুই নিজেও তো তার সাক্ষী। নাটকঘরে তো এর আগেও অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিলি। আর সবই মায়া, এক মস্ত ভ্রম, বুঝলি? বুদ্বুদের মতন উড়ে গেলে দেখবি, দল ভেঙে সবাই বেরিয়ে আসবে। বেরিয়েই আর কিন্তু ওই নাটকের কথা মনে থাকবে না কারুর’‘এত মানুষ তো যাচ্ছে, আনন্দ করছে, ক্ষণিকের আনন্দ হলেও একটু দেখে আসি?’চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন টিকিটঘরের ভীষণ চেহারায় মায়াবী চাহনির লোকটা।
বহু শ্রান্ত পথযাত্রীরা ওনার এই টিকিটেই, ক্ষনিকের শিথিলকরণের অভিপ্রায়ে এই নীল বুদ্বুদের জগতে প্রবেশ করেছে। বেরোনোর সময় সকলের অভিব্যক্তিতেই চমক ভাঙার ছাপ সুস্পষ্ট। নিজের বহুবছরের অভিজ্ঞতায় উনি বেশ বোঝেন, চলচ্চিত্রঘরটা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা দরকার। এক ধারায় বছরের পর বছর বহু লোকের নিত্য পর্যটনে আর তাদের অননুমোদিত বিধিবহির্ভূত কার্যকলাপে সেটা একেবারে নরকে পতিত হবার উপক্রম হয়েছে। এই ছোট্ট পরীর মতন মেয়েটাকে উনি সেখানে কিভাবে ছাড়বেন? কিন্তু মেয়েটা একেবারে বদ্ধপরিকর! ওর এই মায়ার টান, এই বিশ্বাসকে উনি হেলায় ধূলিস্যাৎ করতে পারলেন না।‘দাঁড়া দেখছি কোন ঘরটায় কোন সীটে যাবি, আমি এবারে একটু ভাল করে দেখে দিই, তুই অপেক্ষা কর’ঘোর আপত্তি তুললো দ্যুতি।‘না না কাকু, আমি আগে থেকেই দেখে রেখেছি কোনটায় যাব, তুমি শুধু আমায় টিকিটটা করে দাও’মেয়েটার পূর্বনির্বাচিত স্থানটা দেখে যারপরনাই অবাক হল লোকটা।‘বলিস কি? ওখানে যাবি মানে? তুই তো ওই নাটকটা এর আগেও দেখতে যেতে চেয়েছিলি? দরজা থেকেই তোকে এই নিয়ে ছয়বার ফিরে আসতে হয়েছে, আবার ওখানে যাবি?‘
ও ঈশ্বরকাকু! অবতার কি সবসময় একবারেই জন্মায়? কতবার নৃশংসলীলার পরে কৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন পৃথিবীতে! তুমি ওই মায়ের কোলেই আমাকে পাঠাও। ওই মায়েরই আমাকে ভীষণভাবে প্রয়োজন। এবারে কথা দিচ্ছি, কেউ ফেরাতে পারবে না আমায়, লীলাভঙ্গের আগে। মায়ের কোল আলো করে আমি ভুবন ভরিয়ে দেব। সেই নাটকটাই আমার কাছে তখন আমার পরম উপভোগ্য জীবন হয়ে উঠবে’মেয়েটা হাতে টিকিট পেতেই, বেদম প্রসবযন্ত্রণা শুরু হল অনিমার।যাহ্, এবারেও জলটা সময়ের আগেই ভেঙে গেল! চরম হতাশায় দুচোখে অন্ধকার নামার সাথে সাথে ভাবল সে।কতক্ষন যে অজ্ঞান ছিল, তার আন্দাজ ছিল না অনিমার। চোখ খুলতেই আলোয় ঝলসে গেল চারদিকটা। আর তখনই, মুহূর্তে ভিড় করে আসা সমস্ত দ্বিধা-সংশয় দূর করে দিয়ে ওর কানে ভেসে এল ওর ছোট্ট সদ্যজাত কন্যাসন্তানের প্রথম কান্না, পৃথিবীকে আগমন জানিয়ে। সদ্যজাত শিশুটি একঝলক দ্যুতি নিয়ে প্রবেশ করল পৃথিবী নামক এক মহানাট্যমঞ্চে, আর অনিমা পৃথিবীতে থেকেও প্রবেশ করল ওর বহু কাঙ্খিত স্বর্গে।