Debdutta Banerjee

Crime Thriller

1  

Debdutta Banerjee

Crime Thriller

তন্ত্র মন্ত্র

তন্ত্র মন্ত্র

6 mins
3.9K


জয়ন্তী নদীর ধারে পাহাড়ের গায়ে শিবা তান্ত্রিকের ডেরা খুব কম লোকেই চেনে। শিবা তান্ত্রিক লোককে তাবিজ কবচ বা মাদুলি দেয় না খুব একটা। কিন্তু তন্ত্র সাধনার এক উচ্চ মার্গে তার বিচরণ।

 পরাণ হালদার কে খবরটা দিয়েছিল মদন ডাক্তার। হাতুরে ডাক্তার হলেও এই কদমতলা সহ আসেপাশের বেশ কয়েকটা গ্ৰামে মদনের ভালো পসার। আসলে বর্ষাকালে এই অঞ্চলটার নদী নালা এমন ফুলে ফেঁঁপে ওঠে যে গ্ৰাম গুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শহরের থেকে। এই মদন ডাক্তার তখন ওদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু দু বছর আগে কাকলীকে এই মদন ডাক্তার যখন ভালো করতে পারেনি প্রথম বলেছিল ঐ তান্ত্রিকের কথা। কিন্তু বিজ্ঞানের শিক্ষক পরাণ এসব মানে না। কাকলীর অস্বাভাবিক আচরণ গুলো ওর কাছে মনে হত মৃগী বা কোনো কঠিন অসুখ। আস্তে আস্তে কেমন বদলে গেছিল কাকলী। কারো সঙ্গে মিশত না । চুপচাপ একা ঘরে বসে আপনমনে কি সব বলত। খেতো না। আবার মাঝে মাঝে জবাফুল চিবিয়ে খেতো। ওর বড় বড় চুলে জটা পড়ে গেছিল। চোখের নিচে কালি। শরীর শুকিয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। মদনের কথা না শোনার ফল সেবার হাতে নাতে পেয়েছিল পরাণ। ছয় মাসের ভেতর আদরের বোন কাকলী চলে গেছিল সব চিকিৎসার বাইরে। কিন্তু এবার আর সেই একই ভুল করবে না পরাণ। মায়ের মধ‍্যে এই অদ্ভুত পরিবর্তণ গুলো ওর বৌ পলা প্রথম লক্ষ‍্য করেছিল। মা কাকলীর শোকে বদলে যাচ্ছে এটাই ভেবেছিল পরাণ। কিন্তু গত সপ্তাহে ও নিজে দেখেছে মাঝ রাতে উলঙ্গ হয়ে মা নৃত‍্য করছিল সামনের উঠানে। মা আজ তিনমাস কথা বলে না কারো সঙ্গে। খায় না কিছুই। পলা বলেছিল মা নাকি জবা আর ধুতরা ফুল খায়। যে কয়বার মায়ের ঘরে গেছে পরাণ দেখেছে মা বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে। আকাশের দিকে চেয়ে কি সব বলছে। মায়ের চোখ টকটকে লাল। মা নাকি কাকলীকে দেখতে পায়। পলা বলে মা নাকি ওর সঙ্গে গল্প করে। পলা আজকাল ভয় পাচ্ছে এবাড়িতে থাকতে।পরাণের ছোট ভাই হারাণ বলেছিল প্রথম তান্ত্রিক বা ওঝার কথা। ছোট ভাইয়ের কথা মত পরাণ আবার গেছিল মদন ডাক্তারের কাছে। মদন সব শুনে এসেছিল একবার। কিন্তু ওদের মাকে দেখে সে আবার বলেছিল শিবা তান্ত্রিকের কথা। এ কোনো অপদেবতার ছায়া। বিজ্ঞানের শিক্ষক পরাণ এসব মানতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু সেদিন রাতে যখন দেখল মা পাশের বাড়ির মুর্গিটার ঘাড় মটকে কাচা রক্ত খাচ্ছে ভয় পেয়েছিল ভীষণ। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ওদের মা নিরামিষ খেতো। 


(২)


ছোট একটা প্রদীপ জ্বলছে বটগাছটার নিচে। সারা গায়ে ছাইয়ের প্রলেপ মেখে সম্পূর্ণ উলঙ্গ জটাধারী শিবাতান্ত্রিককে দেখলে যে কেউ ভয় পাবে। সামনে ছোট্ট একটা হোমকুন্ড। পাশে নরকরোটি, একটা পশুর ছালের আসন পাতা। একবার টকটকে লাল চোখ খুলে পরাণের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বুঝেছিল তান্ত্রিক। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ইশারায় ওকে বসতে বলল আসনে। 

তারপর অগ্নিকুন্ডে কিছু ছুড়ে দিতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুন। সেদিকে তাকিয়ে মন্ত্রচ্চারণ করতে করতে তান্ত্রিক শিবা উঠে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বলল -''এলি, কিন্তু বড্ড দেরিতে এলি। ওর শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবারের সবাইকে শেষ করবে ও। ''

-''কিন্তু বাবা কিছু তো উপায় হবে ?'' করুণ স্বরে বলে পরাণ। কিছু না বলতেই তান্ত্রিক শিবা সব জেনে গেছে । লোকটা তার মানে ভণ্ড নয়। 

-''তোর বোনের আত্মা ঘুরছে তোদের আসেপাশে। সে ডাকছে তোদের। তোর মা সারা দিয়েছে। এরপর তোর বৌয়ের পালা। এক কঠিন চক্রব‍্যূহে বাঁধা পড়েছিস তোরা। এর থেকে বেরোনো বড্ড কঠিন। '' তান্ত্রিক আবার চোখ বোঝে।

-''যত কঠিন হোক আমরা পারবো। উপায় বলুন বাবা। আমরা ঠিক পারবো।'' পরাণের কাতর আবেদনে আবার চোখ খোলে তান্ত্রিক। 

বলে -''পারবো বলা সহজ। কাজটা কঠিন, পর পর তিনটে শনিবার বিপদনাশম যজ্ঞ করতে হবে। কাক পক্ষীতেও যেন টের না পায় যজ্ঞের কথা। তৃতীয় শনিবার সবচেয়ে কঠিন কাজ। শিশুর রক্ত লাগবে , পারবি? জোগাড় করা কি সহজ ? পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন খূঁত হীন শিশুর বলি চাই। তবে মুক্তি পাবে তোর বোন। ছেড়ে যাবে তোর মা কে। নাহলে তোরা সবাই শেষ হয়ে যাবি। ভাবার মত সময় নেই, এই শনিবার শুরু না করলে আর হবে না। "


ভয়ে কেঁপে ওঠে পরাণ হালদার। এ যে কঠিন শর্ত। শিশু কোথায় পাবে সে। আরো কিছু কথা বলে দেয় তান্ত্রিক, যজ্ঞের নিয়ম কানুন সব বলে দেয়। 


(৩)


কাকলীর মৃত‍্যুর পর থেকে হালদার পরিবারটা কেমন গুটিয়ে গেছে। কারো সঙ্গে তেমন মেশে না। অরূপদের বাড়ি ওদের পাড়াতেই। কাকলীকে ইংরেজি পড়াতে যেত একসময় অরূপ, ভারি মিষ্টি মেয়ে ছিল। কিন্তু কলেজে উঠেইকেমন বদলে গেলো। বাড়িতে কিছু হয়েছিল বোধহয়। পড়াও ছেড়ে দিল। কলেজ যেত না। অরূপ দু একবার খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারপর তো দুম করে মরেই গেলো মেয়েটা। 

সেদিন সন্ধ‍্যায় ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে আসার সময় অরূপ দেখল থমথমে বাড়িটা ঘিরে রয়েছে এক অদ্ভুত ধোয়া। মৃদু মন্ত্রচ্চারণের শব্দ ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে। ধূপের গন্ধ আর ঘন্টার ধ্বনি ভাসছে। তবে কি ওরা কোনো পূজা করছে। কিন্তু পূজা হলে তো পাড়ার কাউকে ডাকবে নিশ্চই। বাড়ি ফিরে বোনকে জিজ্ঞেস করে অরূপ -''কাকলীদের বাড়ি কিসের পূজা আজ জানিস ?''

ঠোঁট উল্টে বোন বলে -''মেশেই না ওরা কারো সঙ্গে। জানব কি করে। আজ বিকেলে দেখলাম পলা বৌদির বোনের ছেলেটা এসেছে। গেটের কাছে খেলছিল । একটু কোলে তুলে আদর করতে গেলাম, বৌদি কেমন কেড়ে নিয়ে চলে গেলো। ''

ভ্রু কুঁচকে ভাবতে বসে অরূপ। মনটা কেমন কু ডাকছে। কাকলিদের পাশের বাড়িতে থাকে তমালরা। ওদের বাড়ি যায় একবার, এখনো পূজা চলছে। ও তমালের মাকে প্রশ্ন করে

-''কাকিমা, পাশের বাড়িতে কিসের পূজা হচ্ছে?''

-''জানি না বাবা, অদ্ভুত একটা পরিবার। কেমন যেন বদলে গেছে সবাই।আজকাল মাঝে মধ‍্যেই পূজা করে ঘরয়বন্ধ করে। অথচ আগে এমন ছিল না ওরা। '' 

তমালকে নিয়ে অরূপ এবার পাশের বাড়িতে যায়। কাঠের জানালা দরজা বন্ধ। তার ফাঁক দিয়ে বার হচ্ছে ধোয়া। একটা জানালার ফাটলে চোখ রেখে চমকে ওঠে। একি!! পরিবারের সবাই উলঙ্গ। সবার কপালে সিঁঁদুর। এসব কি হচ্ছে। এক সম্পূর্ণ উলঙ্গ তান্ত্রিক বসে রয়েছে মাঝখানে। হঠাৎ চোখে পড়ে তিনবছরের উলঙ্গ শিশুকে শোওয়ানো হয়েছে যজ্ঞ কুণ্ডের পাশে। পরাণের হাতে একটা ধারালো অস্ত্র। 

বাকিটা বুঝতে সময় লাগে না অরূপের। মুহুর্তের মধ‍্যে আশেপাশের বাড়ি আর ক্লাব থেকে লোক জোগাড় করে ফেলে ওরা। থানায় খবর পাঠিয়ে নিজেরাই দরজা ভেঙ্গে ফেলে। হারাণ আর পরাণ ঝাপিয়ে পড়ে অস্ত্র নিয়ে। পরিবারের মহিলারা ঢিল ছুড়তে থাকে। সেই তান্ত্রিক পালাতে গিয়েও জনরোশের কবলে পড়ে যায়। শিশুটি ভয়ে কাঁপছে। খবর পেয়ে পাশের গ্ৰাম থেকে ওর বাবা মা চলে এসেছে ততক্ষণে। পলার বোন ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বলে -''দিদি সকালে গিয়ে বলল বাবুকে একদিনের জন‍্য নিয়ে যাবে। আমি বুঝিনি এমন কিছু করতে চলেছে ওরা। দিদি তো ওকে ভালোবাসত। ও মাসির বাড়ি আগেও এসেছে। ''

অরূপ আর তমাল পরাণের দিকে তাকিয়ে বলে -''তুমি না বিজ্ঞানের শিক্ষক। কি করছিলে এটা আজকে? ছিঃ!!''

পরাণের ঘোর তখনো কাটেনি। বলে -''কাজটা তোরা ঠিক করলি না। তোদের সবাইকে দেখে নেবে কাকলী। ''

-''পরাণদা কাকলী ছিল মানসিক রুগি। ড্রিপ্রেশনের শিকার। ওর সময় মত চিকিৎসা না করিয়ে ঘরে বন্ধ করে তোমরাই ওকে মেরে ফেলেছিলে। কাকিমাও তাই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছিল মানসিক অবসাদের কবলে। তুমি বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও বুঝলে না। '' অরূপ বলে। 

ততক্ষণে পুলিশ গ্রেফতার করেছে বাড়ির সকলকে। তান্ত্রিকের সব জারিজুরি ধরা পড়ে গেছে। মদন ডাক্তার ওকে সব খবর সরবরাহ করেছিল। আর শিশু দেহটা ওর নিজের সাধনার জন‍্য প্রয়োজন ছিল। এদের মাধ‍্যমে সে নিজের সাধনার রসদ সংগ্ৰহ করছিল। মদনকে অবশ‍্য পুলিশ খুঁজে পায়নি। হারাণ, পলা ওদের মা সবাই ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গেছে। 

ওদের মা একবার কিছু বলতে যেতেই এক মহিলা পুলিশ এমন এক ধমক দিয়েছে যে সবাই চুপ। থানার ডিউটি অফিসার ওদের ভ‍্যানে তুলতে তুলতে বলে -''চল থানায় গিয়ে লকাপে কেমন ভুতুরে যজ্ঞ করিস দেখবো। রুলের গুতোয় তোদের সবার ভূত এবার নৃত‍্য করবে। ''

অরূপ আর তমালকে সবাই ধন‍্যবাদ দেয় এমন সাহসী পদক্ষেপের জন‍্য। আজ ওদের উপস্থিত বুদ্ধির জন‍্য একটা শিশু নতুন জীবন ফিরে পেল। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime