থিমের বাহার।
থিমের বাহার।
দুর্গা পুজোয় এখন থিমের বোলবোলা। একটু থিমের ছিটে না দিতে পারলে ঠিক কৌলীন্য আসে না। মফঃস্বলের পুজো হলেও যুবক সংঘের এ ব্যাপারে বেশ নামডাক আছে। প্রতিবারই বিচিত্র থিমের নানান কেরামতি থাকে। একবার তো “যুদ্ধ নয় শান্তি চাই” থিম ফোটাতে গিয়ে অস্ত্র ছাড়া মা দুর্গা আর অসুরকে সামনা সামনি এমনভাবে বসিয়েছিল যে দেখলে মনে হবে যেন ভাইফোঁটা হচ্ছে।
বিচিত্র এই সব চিন্তা ভাবনার মূল সরবরাহকারী হল পোল্টুদা। এলাকায় বেশ প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, তাছাড়া পুজোয় মোটা টাকা যোগান দেয়, ফলে ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয় ওর থিমের যোগানটাকেও সকলকে মেনে নিতে হয়। গতবার সাক্ষরতার ওপর ফোকাস করার জন্য দুর্গার ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বর্ণ পরিচয় ধরিয়ে দিয়েছিল। দামড়া ছেলেমেয়েদের হাতে বর্ণ পরিচয় দেখে কোন এক ফক্কড় দর্শনার্থী মন্তব্য করেছিল, “বড় দেরীতে লেখাপড়া শুরু করল”। স্বেচ্ছাসেবকেরা যখন বলেছিল বইটা সাক্ষরতার একটা প্রতীক মাত্র, তখন উত্তর এসেছিল “প্রতীকটা বয়স অনুযায়ী হলে ভাল লাগত, একটা টেস্টপেপার ধরিয়ে দিলেই ত হত”। যখন বলা হল যে অত ভারি জিনিস চারদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়, তখন রসিক লোকটি বলেছিল “সেক্ষেত্রে কে সি নাগ ট্রাই করতে পারতেন”। পাঁচজনে পাঁচকথা বলবেই, সবেতে কান দিলে চলে না। শ্ত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেবার যুবক সংঘের পুজো মিউনিসিপ্যালিটির বিচারে থিমেতে তৃতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল। বিচারকদের মধ্যে নিশচই ছিদ্রান্বেষী কেউ ছিল না, তাই এই নির্ভুল বিচার। তবে শোনা গেছে বিচারকদের কেউ কেউ নাকি পোল্টুদার ইয়ার দোস্ত ছিল। সে যাই হোক মন্ডপে কাপ শোভা পেয়েছে এটাই বড় কথা।
এবারে পোল্টুদার ইচ্ছে ঠাকুরের একটা জীবন্ত ভার্সান করার। মূল মণ্ডপে থাকবে সনাতন প্রতিমা, পাশেই আর একটি মণ্ডপে পাড়ার ছেলে মেয়েরা সাজবে জ্যান্ত ঠাকুর। সকলের মাথায় হাত, সারাদিন সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকা কারো পক্ষে সম্ভভ নয়। সমস্যাটা বুঝতে পেরে পল্টুদা বলল— তোরা যা ভাবছিস তা নয় রে পাগল। রাতে যখন লোকজন বেশি থাকে তখন এক ঘন্টার একটা লাইভ শো থাকবে। ওই মহালয়ায় টিভিতে যে অনুষ্ঠানগুলো দেখিস অনেকটা ওইরকম। তবে নাচানাচির কোন সিন নেই, কেবল দাঁড়িয়ে থাকা।
সপ্তমী থেকে নবমী সন্ধ্যায় এক ঘণ্টা করে রক্তমাংসের ঠাকুরের শো হবে এমনটাই ছিল পোল্টুদার সাজেশান। গেটের মাথায় লেখা থাকবে “সন্ধ্যায় জীবন্ত ঠাকুর”। থিম ঠিক হওয়ার পরেই শুরু হল আর্টিস্ট খোঁজার পালা।
বিজনের শক্তপোক্ত শরীর। একটু মাথামোটা। অসুরের জন্য আদর্শ। একবার বলতেই রাজি হয়ে গেল। শীতলা সুইটসের নাদুস নুদুস অলোক ময়রা হল গণেশ। দেশে অনেক যাত্রাপালা করেছে ফলে এসব ওর জলভাত, বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অলোক জানিয়েছিল। দোকানের মালিক ওকে ছাড়তে চাইছিল না। পুজোর ওই ভিড়ের সময় অলোক অতক্ষণ দোকানে না থাকলে খদ্দের সামলান মুশকিল হবে এইসব বলে গাঁইগুঁই করছিল। পল্টুদা নিজে গিয়ে একটু নরমে গরমে বলাতে আর না করার সাহস পায়নি। মা দুর্গা হওয়ার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে নিশ্চিন্ত করলেন অনন্যা বৌদি। আপত্তি না থাকলে ওনার মেয়ে সুলগ্না সরস্বতী হতে পারে এও জানালেন। আবদার একটাই, মঞ্চে ওনার নাচের স্কুলের একটা বিজ্ঞাপন থাকবে। মা ও মেয়ে দুজনেই সুশ্রী, মানাবে ভাল, ফলে ঐ ছোট্ট আবদারে কেউ না করেনি।
প্রশান্ত বাবু মুখচোরা মানুষ, অল্পদিন হল পাড়ায় ভাড়া এসেছেন, তবু ওনারা বেশ পরিচিত বাড়ি। কারণটা ওনার দুই মেয়ে, চিনি আর মিনি। মিনি মাত্র ষোল বছর বয়সেই চালচলন আর চটকে পাড়ার ছেলেছোকরাদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। লক্ষ্মী হওয়ার প্রস্তাব দিতে মুখের ওপরেই বলে দিল—পূজোর দিনে অমন সং সেজে দাঁড়িয়ে থাকা, মাগো না না।
কমিটির ছেলেপুলেরাও খবর রাখে। কার্তিকের জন্য ধরল ঋত্বিককে। ছেলেটার নাম হয়ত অন্য কিছু। সারাক্ষণ ঋত্বিক রোশনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাকে নকল করার ফলে এখন ঋত্বিক নামেই লোকে তাকে চেনে। নিজেকে আরো এক্সপোজ করা যাবে হয়ত এই আশায় সম্মতি জানাল।
কান টানলে মাথা আসে। ঋত্বিকের খবরটা কানে যেতেই মিনি নিজে থেকেই একদিন এসে বলল- আপনাদের প্রস্তাবে আমি রাজি, তবে লক্ষ্মী নয় আমি সরস্বতী হব।
যার সাথে মিনি পুজোর কদিন ঘুরবে ভেবেছিল সেই যখন কার্ত্তিক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল তখন সরস্বতী হলে অন্তত পাশে তো থাকা যাবে। সবদিক বিচার করে দিকবদল মঞ্জুর হল।
ঠাকুরের এই জীবন্ত প্রদর্শনীতে কেবল ঠাকুররাই জীবন্ত তাদের বাহনরা নয়। বাহন জীবন্ত করা অনেক রিস্কের ব্যাপার। ওগুলো নানা সাইজের পুতুল দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে। সাইজ মাফিক বাহন যোগাড় করার জন্য লাল্টু আর পচাকে ক’দিন কুমারটুলিতে ঘোরাঘুরি করতে হল। শুধু বাহন লাগবে শুনে ওখানকার লোকজন প্রথমে ওদের পাগল ঠাউরেছিল। থিমের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলতে ওরা এক আধটা করে এদিক ওদিক থেকে এনে দিচ্ছে। আসলে ঠাকুর ছাড়া শুধু বাহন তো টাটকা হবে না, সব ওই ভাসানের পরে নদী থেকে তোলা মাল। অন্যগুলো যাহোক চলে যাবে কিন্তু সিংহটার অবস্থা খুব খারাপ। সমস্ত কেশর ঝরে গিয়ে তার হাল বড়ই করুণ। যাইহোক কদিন বাদে ঘষেমেজে জিনিসগুলোকে একটু উপস্থাপন যোগ্য করে ডেলিভারির সময় শিল্পী ভদ্রলোক হেসে বললেন— আমার জীবনে এমন অর্ডার এই প্রথম।
প্রাইমারী স্কুলের বড় ঘরটা ক’দিন রিহার্সাল এর জন্যে বলে কয়ে ব্যবস্থা করা হল। নাচের স্কুলের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে পরিচালকের দায়িত্বটাও অনন্যা বৌদিই সামলাচ্ছেন। সকলের সুবিধে মত সন্ধ্যের দিকে রিহার্সালের সময় ঠিক করা হয়েছে। প্রথম দিন সকলেই হাজির, যথা সময়ে রিহার্সাল শুরু হল। কাকে কি করতে হবে বুঝিয়ে দেওয়া হল। এতে তো আর ডায়লগ কিছু নেই, কেবল পজিশন আর দাঁড়াবার ভঙ্গিমাটা ঠিকঠাক হলেই হবে। যে যার পজিশনে ঠিকঠাক দাঁড়ালেও ভঙ্গিমা কিছুতেই ঠিক থাকছে না। সকলেই ক্ষণে ক্ষণে নড়াচড়া করছে। সন্ধ্যের সময় মশককুলের ভয়ানক আক্রমণ কাউকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। মশা তাড়াবার বিভিন্ন সরঞ্জাম আনিয়ে খানিকটা ঠ্যাকা হল। যে যার পজিশনে আবার দাঁড়াবার পর অনন্যা বৌদি লক্ষ্য করলেন ওনার মেয়ের কিছু অস্বস্তি হচ্ছে। ইশারায় কিছু বলতে চাইছে। কাছে যেতেই সুলগ্না মাকে আড়ালে ডেকে জানাল যে তার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। শরীর খারাপ কিনা জিজ্ঞেস করাতে মার কানে কানে জানাল যে এমন বোটকা গন্ধে আর কিছুক্ষণ থাকলে কেবল শরীর খারাপ নয় জ্ঞানও হারাতে পারে। মেয়ের অস্বস্তির কারণ যে অলোক ময়রা তা অনন্যা অল্পসময়েই বুঝতে পারলেন। গণেশের অভিনয় তাই ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত থাকার কথা কিন্তু মেয়েদের সামনে লজ্জা করবে বলে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে। গেঞ্জিটা কোন এক সময় সাদা ছিল কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে অধিক দিন ধারণ করার ফলে এখন রঙিন। তার ওপর অভিনয়টা প্রাণবন্ত করতে গিয়ে অস্ত্র সমেত বাঁ হাতটা বেশ খানিকটা ওপরে তুলে রেখেছে। ফলে উন্মুক্ত অঙ্গের বাস বিনা প্রতিরোধে চারিদিকে খেলে বেড়াচ্ছে। একেবারে পাশে থাকায় সুলগ্নার কষ্টটা সবথেকে বেশি। সেদিনের মত রিহার্সাল ওখানেই শেষ।
কয়েকদিন অনেক চিন্তা ভাবনার পর ঠিক হল ডেকরেটারের কাছ থেকে দুটো ব্লোয়ার আনিয়ে দুদিক থেকে চালিয়ে দেওয়া হবে। তাতে মশাও উড়ে যাবে গন্ধও গন্ধও উড়ে যাবে। তবে পাখা একটু তফাতে রাখতে হবে তা না হলে মশা আর গন্ধর সাথে গায়ের কাপড় চোপড়ও এলোমেলো হয়ে একটা বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে। প্রতিরোধ আরো সুরক্ষিত করতে অলোকের জন্য কেনা হল গণেশের রং এর সাথে মিলিয়ে গোলাপি রঙের স্কিন টাইট ফুলহাতা পাতলা গেঞ্জি। দূর থেকে দেখলে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃতই মনে হবে। এছাড়া টানা একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর বলে হকি ম্যাচের মত আধ ঘন্টার শো এর পর পনের মিনিটের হাফ টাইম দিয়ে আবার আধ ঘন্টা শো হবে। রিহার্সালে আর তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কেবল সরস্বতী মাঝে মাঝেই কার্তিকের একেবারে গায়ে গায়ে চলে আসায় অনন্যা বৌদির কাছে মৃদু ধমক খেয়েছিল।
পুজোর মুখে খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই কাতারে কাতারে মানুষ এল শো দেখতে।
অলোক ময়রার গায়ের গন্ধ, মশার কামড়, সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে পল্টুদার লাইভ শো হিট করে গেল। এবার আর থার্ড নয় থিমেতে যুবক সংঘ একেবারে ফার্স্ট। বেশ কিছু পুজো কমিটি পোল্টুদাকে ধরেছিল সামনের বারের থিমের জন্য, অনেক প্রলোভনও দেখিয়েছিল, কিন্তু পোল্টুদা সকলকেই খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়। জানিয়ে দিয়েছে যে ওর প্রোডাক্ট এক্সক্লুসিভলি যুবক সংঘের জন্য। অনন্যা বৌদির নাচের স্কুলেরও এখন বেশ বাড় বাড়ন্ত। অলোকের গণেশ সাজার খবরটা কিভাবে যেন ওর গ্রামে পৌছে গেছে আর তাতেই কেল্লা ফতে। সামনের শীতে বেশ কটা যাত্রার খেপ কনফার্ম। রাজনীতিতে অসুরের হেবি ডিম্যান্ড তাই বিজনের সাথে ইতিমধ্যেই নেতারা যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে। বিজনের মত শক্তিমান এবং বুদ্ধিহীন অনুগামী এই লাইনে আদর্শ।
সর্বোপরি মিনি আর ঋত্বিক এখনও পাশে পাশেই আছে।
পোল্টুদার আগামী পুজোর থিমও রেডি। বিষয় এখন বলা যাবে না, তথ্য পাচার হয়ে যেতে পারে।