সত্যি যদি এমন হত#
সত্যি যদি এমন হত#
নিতাই বাবু কদিন ধরে খুব চিহ্নিত মনে দিন কাটাচ্ছেন। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক করছেন না। ওনার স্ত্রীএকদিন ওনাকে বললেন, কি গো শরীর খারাপ, খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করছ না কেন? একবার ডাক্তারকে দেখাতে পার তো। নিতাই বাবু চিন্তিত মনে বললেন শরীর আমার ঠিকই আছে গিন্নি কিন্তু আমার মনে ঝড় উঠেছে। বাপ ঠাকুরদার ভিটেটা মনে হয় আর রক্ষা করতে পারব না। প্রোমোটার পলাশ রায় আমার পিছনে উঠেপড়ে লেগেছে আমাদের বাড়ি বাগান নেবার জন্য। প্রথম প্রথম আমার কাছে অনুনয় বিনয় করত। আমিও ওর কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দিতাম। এখনতো রিতিমত হুমকি দিচ্ছে ওর পোষা গুণ্ডাদের দিয়ে। সেদিন তো কজন গুণ্ডার মতো ছেলে আমাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে হুমকি দিল। প্রোমোটরের কথা না শুনলে নাকি আমার পরিবারের চরম ক্ষতি হয়ে যাবে।
ওনার গিন্নি ভয় পেয়ে বললেন, সেকি গো, তুমি রাজি হয়ে যাও এখনি। দুটো মেয়ে আমার বড় হয়েছে। ওদের যদি কিছু ক্ষতি করে ওরা? নিতাই বাবু বললেন, আমাকে এর বিনিময়ে বড় ফ্ল্যাট, অনেক টাকা দেবে বলেছে। কিন্তু এ বাড়ি আমার এই বাগান আমার বুকের দুটি পাঁজর। শরীরের অংশ দুটি বাদ চলে গেলে আমি বাঁচব কি করে?
নিতাই বাবুর বাড়িটা দোতলা। বেশ বড়। পিছন দিকটার বাগানে বড় বড় গাছ আছে। তিনটি আম গাছ, একটি পেয়ারা গাছ, জামরুল গাছ, কাঁঠাল গাছ, ও একটি বেল গাছে বাগানটি সুসজ্জিত। প্রত্যেকটা গাছ সিজিন অনুযায়ী ফল দেয়। বাগানের মাটি খুব উর্বর বলে গাছগুলো ফল দেয় প্রচুর। নিজেরা খেয়ে শেষ করতে পারেন না, তাই আশেপাশের লোকেদর ফল বিতরণ করেন। পাড়ার লোকেরা নিতাই বাবুকে ভালো মনের মানুষ বলে। কত পাখির আশ্রয়স্থল গাছগুলি। সারাদিন ধরে পাখির কলতানে বাগানটা ভরে থাকে।
নিতাই বাবু কিছু দিন যাবত মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাটালেন। অনেক কিছু ভাবার পর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন। মনে মনে বললেন, না পরিবারের সুরক্ষার জন্য প্রোমোটরের কথায় রাজি হয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। বুকে পাথর চাপা দিয়ে প্রোমোটরকে ফোন করে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন।
তারপর তিনি কিঞ্চিত আশা টুকুর ওপর নির্ভর করে সবার অলক্ষ্যে একজনকে মিনতি করলেন। আসলে নিতাই বাবুর বাগানের বৃক্ষগুলো তে পাখি পোকামাকড় ছাড়াও আর একজন আছেন বলে নিতাই বাবু বিশ্বাস করেন। তিনি বেল গাছটাতে আশ্রয় নিয়ে আছেন বলে নিতাই বাবুর ধারণা। নিতাই বাবু তাঁকে সচক্ষে না দেখলেও মনের মধ্যে অনুভব করেন।
মাঝে মাঝে বাগানে কোনো ফুলের গাছ না থাকাতেও ঠিক সন্ধ্যার দিকটাতে অপূর্ব ফুলের গন্ধ বাগান থেকে তাঁর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে, আবার কোনো সময় গোবিন্দ ভোগ চালের ভাত ঘী সহযোগে রান্না করলে যেমন সুগন্ধ ছাড়ে সেই গন্ধ তিনি পান। কোনো কোনো দিন চন্দন ধূপের গন্ধ রাত বারোটার সময় পান। আশ্চর্য ব্যাপার ওনার স্ত্রী মেয়েরা এই গন্ধ পায় না। তিনি ওদের এব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতে তারা অবাক হত। বলত আমরা তো কোনো গন্ধই পাইনা। তুমি যে কি বল।
নিতাই বাবুর দৃঢ় বিশ্বাস বেল গাছে উনি আছেন। এতদিন ধরে পরিবারের সকলের মঙ্গল করে আসছেন। কারণ নিতাই বাবু বিত্তশালী না হলেও সংসারের অভাব অনটন নেই। পরিবারের সদস্যদের শরীর স্বাস্থ্য সকলের মোটামুটি ভালোই। পরিবারে এখনো পর্যন্ত কারোর অকাল মৃত্যু হয় নি। ওনার বাবা, মা, ঠাকুর দা, ঠাকুমা কালের নিয়মে একটা বয়সের পর গত হয়েছেন।
পলাশ রায় নিজের কাজে শহরের বাইরে আছেন। সে নিতাই বাবুকে জানালো ফিরে এসে ওনার সঙ্গে দেখা করবেন কদিন পর।
একদিন ঠিক সন্ধ্যার সময় নিতাই বাবু বাগানে গিয়ে বেল গাছটার ঠিক নিচে দাঁড়ালেন। হাতজোড় করে বললেন, প্রভু আপনি আমার অলক্ষ্যে সবই দেখেছেন, আমার মনের মধ্যে কি চলছে টেরও পেয়েছেন। শতশত পাখি, পোকামাকড় আশ্রয়স্থল এই বাগান। আমাদের বাগানের বৃক্ষরাজির সুমিষ্ট ফলের স্বাদ গ্রহন করে আমরা, পাড়ার লোকেরা আনন্দ পাই। আপনিও এই বেল গাছে আশ্রয় নিয়ে আমাদের ধন্য করেছেন। আমার বাবা ঠাকুরদার বাড়ি, বাগানটিকে পলাশ রায়ের হাত থেকে বাঁচান প্রভু। আমি আপনার কাছে মিনতি করছি।
পলাশ রায় নিতাই বাবুর বাড়ি, বাগান নেবার জন্য নিতাই বাবুকে দিয়ে দলিলে সই করাল। নিতাই বাবু তাঁর পরিবারের অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করলেন, যতদিন না ফ্ল্যাট তৈরি হয়।
নিতাই বাবু মনের আশাকে বাঁচিয়ে রাখলেন।
পলাশ রায় গাছ কেটে বাগানটা নির্মূল করার জন্য গাছ কাটার লোক লাগালেন। সেদিন এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটল। গাছ কাটার লোক যে গাছের ডালে কুড়ুলের কোপ বসাতে যায় সেই গাছের ডালে কোপ বসাতে পারেনা। গাছগুলোর প্রত্যেকটা ডাল লোহার ন্যায় শক্ত ঠেকলো। সব শেষে বেল গাছটির উপরে উঠে যেই ডাল কাটতে গেল একজন লোক, তার গলাটা যেন কে চেপে ধরল। তার শ্বাস রোধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হল। কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে নিচে নেমে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বেল গাছে ভূত আছে, আমার গলা টিপে ধরেছিল। সব গাছ কাটার লোক ভয়ে পেয়ে পলাশ রায়ের ম্যানেজারকে বলল, আমরা আর গাছ কাটবো না। এই বাগানে ভূত আছে। ম্যানেজার পলাশ রায়ের কাছে তার সচক্ষে দেখা ঘটনাটি তাকে বলতে সে বিশ্বাস করল না। বলল, কত বাড়ির বাগানের গাছ নিশ্চিহ্ন করে কত ফ্ল্যাট করেছি।বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বললেই বিশ্বাস করতে হবে। ব্যাটারা নিশ্চয় বেশি টাকা চাইছে। তাই বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প ফেঁদেছে। বেশি টাকা অফার করতেও তারা ওই বাগানের পথ মারালো না।
পলাশ রায় অন্য গাছ কাটার দলকে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে কাজে লাগালো। সেদিন সে নিজে উপস্থিত ছিল সেখানে। একই ঘটনা ঘটল ওদের সাথেও। তবে বেল গাছে কেউ সাহস করে উঠল না। কারণ তারা ভূত আছে বেল গাছটায় একথা অলরেডি মুখে মুখে শুনেছিল। তারাও গাছ কাটতে রাজি হল না। পলাশ রায়ের এদিকে জেদ চেপে গেছে। সে প্রমাণ করবেই ভূতের অস্তিত্ব বলে কিছু নেই। নিজে কোনো রকমে পাঁচিলে উঠে বেল গাছটির নিচের একটি ছোটো ডালে যেই কুড়ুলের কোপ বসালো তার গলাটা একটা অদৃশ্য হাত যেন টিপে ধরল, ভয়ে পাঁচিল থেকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারলো না তাকে যেন কেউ ধরে রইল। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এল। তারপর একটা অদৃশ্য শক্তি যেন ঠেলে পাঁচিল থেকে তাকে ফেলে দিল। ততক্ষণে তার মৃত্যু ঘটেছে। পাড়ার লোকদের ভীড় উপছে পড়েছে ইতিমধ্যে। নিতাই বাবুও লোকমুখে ঘটনা শুনে নিজের বাগানে উপস্থিত হয়েছেন।বেল গাছের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রণাম জানালেন একজন কে। তবে নরম মনের মানুষ তিনি এতটা ভয়ংকর পরিণতি প্রোমোটারের চান নি। তবে তাঁর প্রভু সুযোগ দিয়েছিলেন পলাশ রায়কে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে। কিন্তু সে সেটা করল না এত ঘটনা ঘটার পরও। তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। সবুজকে যারা নষ্ট করে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় তাদেরকে শাস্তি পেতেই হয়।
