জ্বালা
জ্বালা
ভূত চতুর্দশীর দিন রণিতা সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির বাইরে উঠোনে,পাঁচিলে তুলসী তলায় চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার শরীরটা কেমন ভারী লাগল। বাড়ির সকলের জন্য চা করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। রণিতার বর সুমন ওকে ধরাধরি করে তুলতে গিয়ে দেখল শীর্ণকায় রণিতা হঠাৎ করে যেন কত ভারী হয়ে গেছে। অবাক হল। কি হল ব্যাপারটা বুঝল না। যাইহোক ওকে কোনোরকমে বিছানায় শুয়ে দিল। হঠাৎ অজ্ঞানই বা হয়ে গেল কেন কারণ খুঁজে পেল না। শাশুড়ী মা বেলাদেবী ওর চোখে মুখে জল দিতে রণিতার জ্ঞান ফিরল ঠিকই। কিন্তু রণিতার অমন স্নিগ্ধ শান্ত রূপ হঠাৎ নিমেষে উগ্র রূপে পরিনত হল। জ্ঞান ফিরেই সে আড়মোড়া ভেঙে পা ছড়িয়ে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে ভারি এবং ফ্যাঁসফ্যাঁসে কি বিভৎস গলায় বলল,"আমি তৃষ্ণার্থ।তোদের শেষ করে তৃষ্ণা মেটাবে।" বেলাদেবীকে তুইতোকারি করে কি সব কথা বলছে বৌমা এইভেবে তিনি অবাক হলেন। রণিতার অমন মিষ্টি গলা এমনই বা শোনাচ্ছে কেন? সুমন বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে,মাকে তুইতোকারি করছ? যাতা বলছ। অমনি রণিতা একহাত বাড়িয়ে সুমনের গলাটা এমনভাবে টিপে ধরল, সুমন কিছুতেই ছাড়াতে পারল না। সুমন কাতর স্বরে বলল, "আঃ রণিতা লাগছে ছাড়।" রণিতা অমনি অট্টহাস্য করে বলল, "আমি রণিতা নয়, আমি মৌলি। মনে আছে সুমন চারবছর আগে কালী পুজোয় যখন সবাই বাজি ফাটানো নিয়ে মত্ত তুমি আমাকে একা নির্জনে দুজনে মিলে বাজি ফাটাবো বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমার গায়ে জলন্ত ফুলঝুরিটা ছোঁড়। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আমার শাড়ি। বাঁচার জন্য কত চেষ্টা করেছিলাম। তোমার মা দূর থেকে সব ঘটনা দেখছিল। কিন্তু বাঁচাতে আসেনি। । কেন আমায় মারলে সেদিন সুমন? আমার বাবা পণের পুরো টাকা দিতে পারেনি বলে।
সেদিন মা ছেলে মিলে আমাকে সর করে মেরেছিলে। দেখ আমার ঝলসে যাওয়া রূপ। রণিতার মুখটা যেন মৌলির আগুনে পোড়া ঝলসে যাওয়া মুখ হয়ে গেল। সেদিনের সব ঘটনা আজ মা ছেলের সামনে পরিস্কার হয়ে গেল। মৌলি নব্বই শতাংশ পুড়ে যাবার পর মা, ছেলে আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠল, নিজেদের হাত কিছুটা পুড়িয়েছিল যেন মৌলিকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়িয়েছে। পুরোটাই তাদের অভিনয় ছিল। আশেপাশের লোক ছুটে এসে হাসপাতালে মৌলিকে নিয়ে যেতে যেতেই তার মৃত্যু ঘটল। জবানীটাও সে দিয়ে যেতে পারল না। সবাই ভাবল বাজি পোড়াতে গিয়ে গায়ে আগুন লেগে মৌলির মৃত্যু ঘটেছে। এই বিভৎস ঝলসে যাওয়া মুখটা মা ছেলে সহ্য করতে পারছে না।চোখের মণিদুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে এসছে। প্রতিহিংসার আগুন দুটো চোখে। ফ্যাঁসফ্যাঁসে, ভয়ংকর গলায় বলে উঠল, আমার সারা শরীরে কি ভীষণ জ্বালা, এই জ্বালা মিটবে না যতক্ষণ না তোদের শেষ করব। শেষ করে দেব তোর ছেলেকে, তারপর তোকে।" বেলাদেবী কিছু ভেবে না পেয়ে সামনে রাখা গঙ্গাজল রণিতার গায়ে ছিটিয়ে দিতে রণিতা আর্তনাদ করে আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। মৌলির আত্মা রণিতার শরীর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বেলাদেবী, সুমনের বুঝতে বাকি রইল না মৌলির আত্মা রণিতার শরীরে প্রবেশ করে প্রতিশোধ নিতে চায়। এই শতাব্দীতে বাস করে সুমন বুঝে উঠতে পারছে না কি করে এটা সম্ভব? কিন্তু নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না। বেলাদেবী শেষে নামকরা তান্ত্রিক ভৈরব বাবার শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু নিজেদের কুকীর্তির কথা পুরো চেপে গেলেন। ভৈরববাবা বাড়ি সাময়িক ভাবে নিজের ক্ষমতার দ্বারা যজ্ঞ করে বেঁধে দিলেন। ফলে আপাতত মৌলির আত্মা রণিতার শরীরে কিছুদেনের জন্য প্রবেশ করল না। কিন্তু সেটা সাময়িক ছিল। মা শ্মশানকালীর সাধক ভৈরব বাবাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। সাধনায় বসে সবই জানতে পারলেন। অমাবস্যার রাতে কালীপুজোর দিন শ্মশানে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে যজ্ঞ শুরু করলেন। মৌলির আত্মাকে ডাকলেন। একটা নারীর ছায়ামূর্তি এসে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, "আমাকে যারা যন্ত্রণা দিয়ে মেরেছে, জ্বলেপুড়ে মরেছি আমি ওদের জন্য। তারপরও ওদের তুমি সাহায্য করছ বাবা?" বাবা বললেন, ওরা শাস্তি পেলেই তুই শান্তি পাবে তো?" মৌলির আত্মা বলল, "হ্যাঁ বাবা।" বাবা বললেন, "ওদের এমন অবস্থা করব ওরা নিজের মুখে পুলিশের সামনে অপরাধ স্বীকার করতে বাধ্য হবে।" পরের অমাবস্যায় মৌলির আত্মাকে মুক্তি দেবে বলে বাবা রাত বারোটার সময় ওদের ডেকে পাঠালেন। বেলাদেবী, সুমন, রণিতা এসে উপস্থিত হল হরিপুর শ্মশানে। বাবা পুলিশকেও খবর দিয়েছিলেন সব আগে থেকে জানিয়ে। শুধু প্রমাণের অপেক্ষায়। বাবা ওদের বললেন, "সব ঘটনা খুলে না বললে, মানে সত্যি কিভাবে মৌলির মৃত্যু হয়েছে সেটা না বললে ওর আত্মাকে মুক্তি দিতে পারব না।" বেলা দেবী বললেন, "আগুনে পুড়ে মরেছে বাবা?" "নিজে পুড়েছে, না কেউ পুড়িয়েছে?" "না মানে।" "সত্যি কথা বল, তা না হলে ওকে মুক্তি দেওয়া যাবে না।" বাবার কাছে মা, ছেলে সব সত্যি স্বীকার করল। আড়াল থেকে পুলিশ সব শুনল। রণিতার ঘৃণায় মন ভরে গেল। সে এতদিন জানত এটা দুর্ঘটনা। সেও ডিভর্সি চাকরিরতা ছিল। ভালোবেসে সুমনকে বিয়ে করেছিল। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে গেল মা ও ছেলের। মৌলির আত্মা কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

