ব্রত
ব্রত
"না না আমি দিদির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারব না। দিদি আমার জীবনের সব।" রণিতা কাঁদতে কাঁদতে কুণালকে কথাগুলো বলল। কুণাল ওর বয় ফ্রেন্ড। দুজনেই ডাক্তারী পড়ে। ডাক্তারী পড়ার সময় ওদের ভালোবাসা হয়। কুণাল বলল, "যখন জানতে পারলি তোর দিদি একজন পেশায় কলগার্ল, বড় বড় ব্যবসায়ী,ওপর মহলের লোকের সাথে এসকর্ট সার্ভিসে যায় তাদের শরীর ও মনে আনন্দ দেবার জন্য তখন সব জেনেও তুই দিদির সাথে সম্পর্ক রাখবি!"রণিতা বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ রাখব। তাতে তোর কিছু এসে যায়!তুই কী করে বুঝবি, আজ আমার দিদি যদি না থাকত আমি আজ এই অবস্থায় কিছুতেই পৌঁছতে পারতাম না! তুই কী জানিস নিজের জীবন উজাড় করে দিয়ে দিদি আমাকে ডাক্তারী পড়িয়েছে! "
কুণাল বলল, "হ্যাঁ এসে তো যায়, আমার বাবা মাকে তোর দিদির পরিচয় কী দেব বলতে পারিস! তুই যখন তোর দিদিকে ছাড়তে পারবি না তখন আমাদের সম্পর্কটা এখানেই শেষ হওয়া দরকার।" রণিতা কান্না চেপে বলল, "ওকে,আজ থেকে তোর আমার সম্পর্কটা এখানেই শেষ হল।"
জয়িতা আর রণিতা দুই বোন। জয়িতা রণিতার থেকে অনেকটাই বড়। ছোটোবেলায় ওদের বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। উনি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতেন। টাকাও সেভাবে জমাতে পারেননি। ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স খুবই কম ছিল। জয়িতা তখন জাস্ট গ্র্যাজুয়শন কমপ্লিট করেছে, আর রণিতা ক্লাস টেনে পড়ত। ওদের মা ওদের নিয়ে অকুলপাথারে পড়লেন। ওইকটা টাকা নিয়ে কী করে মেয়েদের মানুষ করবেন এই চিন্তায় পাগলের মত অবস্থা হল তাঁর। ব্যাঙ্কের জমানো টাকা ভাঙিয়ে সংসার চালাতে চালাতে সেটাও একদিন শেষ হয়ে আসল। মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করতে লাগলেন। জয়িতার পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সে নিজে থেকেই সংসারের অবস্থা দেখে পড়া বন্ধ করে দিল। রণিতা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল।জয়িতা মাকে বলল, "বোনের পড়াটা যাতে বন্ধ না হয় আর তোমাকে যাতে বাড়ি বাড়ি রান্না করতে না হয় তার জন্য আমাকে কিছু কাজ খুঁজতে হবে।" এইরকম চাকরির বাজারে বি এ পাস মেয়েকে কে চাকরি দেবে!টিউশানি করতে লাগল। তাতে আর কটা টাকাই বা পায়।জয়িতা সারা কলকাতা সে চষে ফেলল, কোথাও চাকরির হদিস মিলন না। কত চাকরির পরীক্নায় ইন্টারভিউ দিল, কিন্তু কিছুতেই একটা চাকরিও পেল না। শহরে ফাঁদে ফেলার লোকের অভাব নেই। জয়িতা যখন মড়িয়া একটা কাজ পাওয়ার জন্য সেইসময় একজন মহিলা শাড়িতে রং করার তার নিজস্ব কারখানায় চাকরি দেবে বলে জয়ি তাকে এই পথে নামায়। তারপর এই জীবন থেকে জয়িতা আর ফিরে আসতে পারেনি। এই লাইনে অনেক টাকা। কিন্তু বিনিময়ে তাকে চরম মূল্য দিতে হল,কারণ তার শরীরটা আর নিজের রইল না,কতগুলো মানুষের ভোগ লালসা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে থাকল।
প্রায় দেখতে দেখতে অনেক বছরই কেটে গেল। জয়িতার মাও ভাগ্যের পরিহাসে তাড়াতাড়ি ওদের ছেড়ে চলে গেলেন। মৃত্যুশয্যায় জয়িতার হাতদুটো ধরে বলেগিয়েছেন "বড় খুকী ছোটো খুকীকে দেখিস মা, আমরাতো বাবা মার দায়িত্ব পালন করে যেতে পারলাম না। এখন থেকে তুই ওর মা, বাবা, দিদি সব! "সেদিন থেকে রণিতা যেন আরো দিদির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। দিদিকে ছাড়া ওর চলতই না। যত আবদার, মান, অভিমান সব দিদিকে ঘিরে। সব জায়গাতেই ওর আলোচ্য বিষয়তে দিদির প্রসঙ্গ থাকবেই। "আমার দিদির মত সুন্দরী হয় না, আমার দিদির হাতের রান্না খেলে তোরা চিরদিন মনে রাখবি।" বন্ধুরা মাঝে মাঝে ওর কথা শুনে বোর হত। ও তাতে কোনো আমলই দিত না। দিদির গুণগান করেই যেত। আসলে ওর মনের অনেকখানি অংশ জুড়ে ওর দিদিই ছিল। হবে নাই বা কেন জয়িতা যে ওর মা, বাবা, দিদির একসঙ্গে ভূমিকা পালন করে আসছিল।
জয়িতাদের সংসারে এখন আর অভাব নেই। এখন জয়িতার টাকার অভাব নেই। রণিতাও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ভালো নাম্বার করে নিট পরীক্ষায় ভালো রেঙ্ক করে ডাক্তারী পড়ছে। দেখতে দেখতে ডাক্তারী পড়া শেষ হয়ে এল। তার কুণালের সাথে ভালোবাসা হয়েছে। দিদিকে সব বলেছে। জয়িতা খুব খুশি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করেছিল।
রণিতা ঠিক করল কুণালকে জয়িতার সঙ্গে একদিন দেখা করানোর জন্য তাদের বাড়িতে আসতে বলবে। কুণাল তাকে প্রায় জিজ্ঞাসা করত তার দিদি কী করে? এর উত্তর সে বলত দিদি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। জয়িতা মা এবং বোনকে একসময় এই কথাই বলেছিল। জড়িত রোজ সকাল বেলায় বেরিয়ে যেত এগারোটার পর নিত্য নতুন প্রাইভেট কার তাকে পৌঁছে দিয়ে যেত।বোনকে বলত রাত হয় বলে অফিসের গাড়ি তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়।এখন মাঝে মাঝে সে একরাত্রি বা দুরাত্রি ফিরত না,এসকর্ট সার্ভিসে যাওয়ার জন্য। রণিতা বর্তমানে হোস্টেলে থাকে দিদির না ফেরার ব্যাপারে কিছু জানতেই পারে না। যতদিন রণিতা বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে এই কাজটা নেই নি। কিন্তু রণিতা যখন হোস্টেলে থেকে ডাক্তারী পড়া শুরু করল তখন এই কাজটা ও নিল আরো টাকা উপার্জন করবে বলে,কারণ রণিতার ডাক্তারী পড়ার পেছনে খরচ প্রচুর । রণিতার বাড়িতে না থাকার সুযোগটা সে হাতছাড়া করল না।
রণিতা কিছুদিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। এইসময় একদিন সে কুণালকে বাড়িতে আসতে বলল। জয়িতা সেদিন বেরোয় নি। কুণাল সন্ধ্যাবেলায় আসবে। ডিনার করবে। জয়িতা সকাল থেকে কুণালের জন্য নানারকম রান্না করে রাখল। রান্না সেরে জয়িতা স্নান করতে গেল। যাবার সময় মোবাইলটা বন্ধ করে যেতে ভুলে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে জয়িতার মোবাইলে একটা ফোন এল।রণিতা ফোনটা ধরল, অচেনা গলায় কে যেন বলল, "আপনাকে কত করে বললাম মিঃ আগরওয়ালের আপনি মনে ধরেছেন, আপনাকে তার সাথে এসকর্ট সার্ভিসে নিয়ে যেতে উৎসহী । আপনি রাজি হলেন না। বললেন, আপনার এবারটায় অসুবিধা আছে। এখনও সময় আছে ম্যাডাম, ভাবুন। প্রচুর টাকার ডিল। মালদার লোক, খুশি করতে পারলেই টাকায় ভরিয়ে দেবে। এতে আপনারও লাভ আর আমারও। "
রণিতার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। দিদির প্রফেসনটা যে কী, সেটা তার কাছে আর গোপন রইল না। রণিতার মনের মধ্যে তখন ঝড় উঠেছে। সে মনে মনে ভাবল,"দিদি নিজের শরীরটাকে বিক্রি করে করে কেন পুরো জীবনটাকে আমার জন্য উৎসর্গ করে দিল! তার চোখ দুটো জলে ভরে গেল। একটা তীব্র কষ্টের অনুভূতিতে মনটা ভরে গেল। ইতিমধ্যে জয়িতা স্নান সেরে বেরিয়ে রণিতাকে বলল, "যা বোন, স্নানটা করে নে। রণিতার চোখে জল দেখে জয়িতা বলল, কী হয়েছে, চোখে জল কেন!" রণিতা দিদিকে এব্যাপারে কিছু জানতে দিল না। সে বলল, "বাবা মায়ের কথা মনে পরছিল রে। "কিন্তু ওর মনে যে কি চলছে শুধু সেই জানে।
সন্ধ্যাবেলায় কুণাল এল। রণিতা দিদি জয়িতার সঙ্গে কুণালকে আলাপ করিয়ে দিল। জয়িতার বেশ কুণালকে ভালো লাগল। তিনজনে মিলে গল্প করল। তারপর জয়িতা কুণালকে তার নিজের হাতের রান্না যত্ন করে খাওয়ালো।
খাওয়াদাওয়ার পর রণিতা কুণালকে একান্তে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে জয়িতার ব্যাপারে সব বলে বলল, "তুই এত কিছু জেনেও আমাকে গ্রহন করতে পারবি কী?" কুণাল বিস্মিত হয়ে গেল। সে বলল, "পারব, একটা শর্তে তোর দিদির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না।" তখন রণিতা কুণালের প্রস্তাব মানল না। কুণালের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভেঙে গেল। জয়িতা আড়াল থেকে সব শুনেছিল,সে অবাক হয়ে ভাবল, বোন কী করে তার এই প্রফেসনের কথা জানল !সঙ্গে সঙ্গে নিজের মোবাইলটা দেখল, মিঃ মুরালি ফোন করেছিল, তার ফোনটাও রিসিভ করা হয়েছে। সে তো করেনি। তাহলে রণিতা করেছিল যখন সে স্নান করতে গিয়েছিল। মুরালির কথা থেকেই রণিতা তার সম্বন্ধে জানতে পেরে গেল। সে মনে মনে ভাবল,"হায় ভগবান! স্নান করতে যাবার সময় কেন ফোনটা সুইচ অফ করার কথা মাথায় আসেনি! আমার জন্যই আজ ওদের সম্পর্কটা ভেঙে গেল। অবশ্য আজ না কাল ও তো জানতেই পারত। আমি ওর জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাব। তাহলেই ওদের সম্পর্কটা আবার ঠিক হয়ে যাবে। বোনতো এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এখন ছুটি। আমার সঙ্গে থাকলে ও সমাজে মুখ দেথাতে পারবে না। আমি সেটা হতে দেব না।"
এমন সময় রণিতা জয়িতার কাছে এসে তার হাতদুটো ধরে বলল, "দিদি, আমাকে সুখে রাখবি বলে তুই নিজেকে তিলে তিলে শেষ করছিস! কিন্তু আজ থেকে আমি তা হতে দেব না। আজ থেকে তোর দায়িত্ব আমার। এখন আমি হাউস স্টাফ। কিছু দিন পরেই আমি ডাক্তার হব। তোর আর কোনো চিন্তা থাকবে না। দুই বোনে সুখে থাকব। জয়িতা বলল, "কিন্তু আমার জন্য কুণাল যে তোকে ভুল বুঝে চলে গেল! "রণিতা বলল, "যে সম্পর্কের গভীরতা বোঝে না তার সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই ভালো!ও কিছুতেই বুঝতে চাইল না, কোন্ পরিস্থিতিতে পরে তুই এই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিস!এটাই বরং ভালো হল রে। এই ঘটনায় আমি কুণালকে ভালো করে চিনতে পারলাম। ও একদম উন্নত, উদার মানসিকতার নয়। যে তোর সম্বন্ধে সব জেনে আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে রাজি হবে তাকেই আমি মন থেকে মেনে নেব। জয়িতা রণিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল," আমার বোনটা কত বড় হয়ে গেছে!রণিতাও দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দে,আর ঐসব কাজ করে নিজেকে কষ্ট দিবি না।" জয়িতা চোখের জল আর আটকাতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে বোনকে বলল, না রে, কক্ষনো এই কাজ আর করব না।"
বর্তমানে রণিতা নামকরা কার্ডিও সার্জেন হয়েছে। বাড়িতে চেম্বার। বড় বড় হসপিটল নার্সিং হোমের সঙ্গে যুক্ত।আস্তে আস্তে খুব পসার বাড়তে লাগলো ওর। জয়িতা সময় কাটানোর জন্য অবসর সময় বাড়িতে ছোটো ছোটো বস্তির দুস্থ বাচ্চাগুলোকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ায়। দুই বোন খুব সুখেই আছে। তবে জয়িতার একটাই চিন্তা, রণিতা যদি তার মনের মত ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পায় তবে জয়িতা যেন আরো শান্তি পেত।এই আশায় সে আছে।নিশ্চয়ই তার আশা পূর্ণ হবে।