STORYMIRROR

Tanuchhaya Mukherjee

Inspirational

4  

Tanuchhaya Mukherjee

Inspirational

চারুলতা

চারুলতা

5 mins
10

গল্প-#চারুলতা#


চারুলতা আর সুদেষ্ণা দুই জায়ের মধ্যে চারুলতা বড় জা। সুদেষ্ণা ছোটো। চারুলতার স্বামী অবিনাশ রেলে চাকরি করে। সুদেষ্ণার স্বামী পরিমল ব্যাঙ্কে চাকরি করে। যৌথ পরিবার। পরিবারের কর্ত্রী হলেন শাশুড়ি মা নিস্তারিণী দেবী।বিধবা, ধার্মিক, ঠাকুর ঘরেই ওনার অর্ধেক সময় কাটে। পঁচাত্তরের কাছাকাছি বয়স। সংসারের ব্যাপারে বিশেষ মাথা না ঘামালেও এখনো সংসারের রাশটা তাঁর হাতেই। তাঁকে না জিজ্ঞাসা করে কেউ কোনো কাজ করে না। চারুলতা ও অবিনাশের একটা দশ বছরের কন্যা সন্তান, সুদেষ্ণা ও পরিমলের একটা সাত বছরের পুত্র সন্তান। নাতি নাতনী ঠাকুমার খুবই আদরের।


চারুলতা রান্নাবান্না সব করে। সুদেষ্ণা তাকে কুটনো কেটে দেয়, বাটনা বেটে দেয়। চারুলতা আগে শাশুড়ি মায়ের নিরামিষ খাবারটা তৈরি করে সরিয়ে রেখে তারপর আমিষ রান্নায় হাত দেয়। সংসারটা মোটামুটি সুখের বললেই চলে। চারুলতা যেহেতু বড় সংসারের বেশিরভাগ কাজটাই ও করে। একএকদিন সুদেষ্ণা দেরি করে রান্না ঘরে ঢুকত। এসে দেখে চারুলতা রান্না চড়িয়ে দিয়েছে। তাতে ও ছোটো জায়ের ওপর একটুও রাগ করে না। সুদেষ্ণা দেরি করে ঢুকে বলত, ,"এই যা!তুমি রান্না চাপিয়ে দিয়েছ! ভুল হয়ে গেছে গো দিদি! আজ একটু ঘুমিয়ে পড়ে ছিলাম।" চারুলতা বলত,"তাতে কি হয়েছে, এরকম তো হতেই পারে। আমি কিছু মনে করিনি। যা আগে চা জলখাবারটা খেয়ে নে দিকি! আসলে চারুলতার নিজের বোন নেই সুদেষ্ণাকে বোনের মত ভাবত। সুদেষ্ণা প্রায়ই দেরি করে রান্না ঘরে আসত, কিছুটা ইচ্ছাকৃত বটে। কিন্তু চারুলতা ওর কোনো দোষই যেন দেখত না। নিস্তারিণী ব্যাপারটা লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে ছোটো বৌমাকে ধমক দিয়ে বলতেন, "এত ঘুম কীসের তোমার বাছা! এমনিতে তোমাদের সংসারে আমি নাক গলাই না। কিন্তু বড় বৌমাতো খেটে খেটে সারা হয়ে গেল। এতগুলো লোকের রান্না একা হাতে করে ।তোমার বর তো খেয়ে আপিসে বেরোয়। তোমার কঘ উচিত নয় তাড়াতাড়ি উঠে ওকে সাহায্য করা"! সুদেষ্ণার শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে রাগ হত। সে বলত, "রোজ তো ঘুমিয়ে পড়ি না মা, এক এক দিন এমন হয়।" নিস্তারিণী দেবী বলতেন, "আমি তো দেখছি প্রায় রান্না ঘরে ঢুকছ দেরি করে।" চারুলতা সুদেষ্ণার হয়ে বলে, "না মা, প্রায় ও এমন করেনা।" নিস্তারিণী দেবী গজগজ করতে করতে বলে চলে যেতে যেতে বলতেন, যার হয়ে বলছি সেই যদি জা কে আড়াল করে আমার কিছু বলার নেই! যা ইচ্ছে কর তোমরা।" এইরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটত। 


চারুলতা এমনই। ঈশ্বর যেন তাকে শুধু সংসার করার জন্যই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তার কোনো চাহিদা, মানঅভিমান, রাগ কিছুই নেই। আছে শুধু সংসারের প্রতি প্রবল কর্তব্য জ্ঞান। আর সুদেষ্ণা তার বিপরীত।সংসারের কাজ করে ঠিকই, তার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা ছিল না। তার কাজটা যদি তার হয়ে অন্য কেউ করে দিত তাহলে খুব ভালো। চাহিদাও প্রবল। স্বামীর টাকা ধ্বংস করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাড়ি, প্রসাধনি কিনত। সোনার গয়নার প্রতি তার একটা বিশেষ মোহ ছিল। তার যথেষ্ট গয়না ছিল তাও গয়নার প্রতি মোহটা সে ছাড়তে পারত না।


নিস্তারিণী দেবীর সত্তর ভরির কাছাকাছি গয়না ছিল। গয়নাগুলি তাঁর ঘরে সিন্দুকে থাকত। তিনি দুই বউকে দশ ভরির মত গয়না ভাগ করে দিয়েছিলেন। বাকি তাঁর সিন্দুকে ছিল। ভেবেছিলেন এক সময়ে দুই বউকে বাকি গয়না ভাগ করে দেবেন। গয়নাগুলো দুই বউকে দেখিয়েও ছিলেন।


সুদেষ্ণার কদিন ধরেই ধারণা হচ্ছিল তার শাশুড়ি মা বড় জা কেই বেশী ভালোবাসেন। এবং তার ধারণা বাকি গয়নাগুলি তাকেই দেবে। তার যে কী মতিভ্রম হল! শাশুড়ি মায়ের গয়নাগুলি চুরি করার সিদ্ধান্ত নিল। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নিস্তারিনী দেবী মাথার বালিশের তলায় সিন্দুকের চাবি রাখতেন সে জানত। নিস্তারিণী দেবী ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতেন। একদিন গভীর রাতে সিন্দুকের চাবি খুলে গয়নার বাক্স নিয়ে আবার সিন্দুকের চাবি দিয়ে নিস্তারিণী দেবীর বালিশের তলায় চাবিটা রেখে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিস্তারিনী দেবী গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলেন, টেরও পেলেন না। ।সুদেষ্ণা গয়নার বাক্সটি নিজের ঘরের গোপন জায়গায় যেখানে কারোর চোখ পড়বে না সেখানে রেখে দিল।


কিছুদিন পর নিস্তারিণী দেবী গয়নাগুলি দেখতে গিয়ে সিন্দুক খুলে দেখলেন একটা গয়নাও নেই। নিস্তারিণী দেবী আঁতকে উঠলেন। একে একে সবাই জানতে পারল। নিস্তারিণী দেবী ছোটো বৌমার গয়নার প্রতি লোভের কথা জানতেন। তাঁর সন্দেহের তীরটা তার দিকেই যাচ্ছিল। তিনি বললেন, "সদর দরজায় তালা দেওয়া। লোহার গেট (কোলাপ্সেবেল) দেওয়া চোর কী করে ঢুকবে ! বাড়ির লোকই চুরি করেছে। সবার ঘর তল্লাশি হবে। বড় খোকা থানায় খবর দে।" হরিপদ চাকর অনেক দিন ধরে নিস্তারিণী দেবী বাড়িতে আছে। বুড়ো মানুষ বিশেষ কাজ পারে না। এই টুকটাক বাজার দোকান করে দেয়। নিস্তারিণী দেবীর পায়ে পড়ে বলল, "আপনার নুন খেয়েছি গিন্নিমা, এই পাপ কাজ করা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনা!" নিস্তারিণী দেবী বললেন, "আমি জানি হরি দাদা, তাও নিয়ম রক্ষা পুলিশের কাজ করতে দাও।"


সুদেষ্ণা বিপদে পড়ল। সে মনে ভাবল, "পুলিশের চোখ থেকে কী আমি গয়নার বাক্সকে আড়াল করতে পারব! আমি ঠিক ধরা পড়ে যাব। আমি এখন কী করব!দিদি একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পারে।" চারুলতা কে গিয়ে সব খুলে বলল।"আমায় বাঁচাও দিদি! আমি পাপ করেছি! তোমাকে হিংসা আর গয়নার প্রতি লোভ আমাকে যে পাপ কাজে ঠেলে দিয়েছে!" চারুলতা ভাষাহীন হয়ে গেল। সে কী বলবে বুঝতে পারছে না। বলল, "একি করলি তুই ছোটো !শাশুড়ি মা যতই তোকে মুখে বকাবকি করেন, সেটা তোর ভালোর জন্যই। তিনি আমাদের দুজনকেই সমান ভালোবাসেন। তা বলে তুই ওনার গয়না চুরি করলি! আমি তোকে কী রে বাঁচাবো! গয়নাগুলো যে সিন্দুকে রেখে আসব তার উপায় নেই। শাশুড়ি মায়ের ঘরে পুলিশ শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।" সুদেষ্ণা বলল, "আমি আর গয়নার প্রতি লোভ করব না কক্ষনো! আমাকে বাঁচাও দিদি!"


চারুলতার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সবাই যখন নিস্তারিণী দেবীর ঘরে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত,সেই ফাঁকে চারুলতা ঝুঁকি নিয়ে সুদেষ্ণার ঘর থেকে গয়নার বাক্সটি নিয়ে পিছন বাগানের বিশাল বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে গেল।তারপর বাক্স থেকে গয়নাগুলো বার করে একটি কাপড়ের পোঁটলায় পুরল। এরপর সেখানে পোঁটলা সুদ্ধ গয়না ও পাশে বাক্সটি ফেলে দিল। এর কারণ সকলে যাতে মনে করে চোর বাউন্ডারি ওয়াল টপকে বাইরের দেওয়ালের গায়ে মোটা পাইপ বেয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে দোতলার ঘরে ঢুকে নিস্তারিণী দেবীর বালিশের তলা থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে গয়নার বাক্স চুরি করেছিল। আসলে উনি প্রায়শই বারান্দার দরজার খিল দিতে ভুলে যেতেন। সামনে দরজায় ইচ্ছা করেই কোনোদিনও খিল দিতেন না,কারণ হঠাৎ কোনোদিন রাতে তিনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন ছেলেরা যাতে সহজে তাঁর কাছে যেতে পারে। 


চোর চুরি করে যাবার সময় গয়না গুলি পোঁটলা বেঁধে নিয়ে বাউন্ডারির পাঁচিল টপকাতে গিয়ে কোনো কারণে পড়ে যায়। বাইরে হয়ত কুকুররা দলবেঁধে তাকে তাড়া করেছিল, তাই তার আবার পাঁচিল টপকে বাগানে এসে পোঁটলা নিয়ে যেতে পারিনি।


সব ঘর তল্লাশি হল কোথাও গয়না মিলল না। শেষে পুলিশ পিছন দিকের বাগানের বাউন্ডারি ওয়ালের ঠিক কাছেই গয়নার সন্ধান পেল। চারুলতার যা হিসাব কষেছিল পুলিশের হিসাবের সাথে তা মিলে গেল। সুদেষ্ণাও এ যাত্রায় রক্ষা পেল তার দিদিসম জা এর জন্য।


একজন গৃহবধূ, সংসারই যার কাছে ধর্ম কর্ম সে যে উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে ছোটো জাকে বাঁচালো তা অকল্পনীয়। সুদেষ্ণা যা শিক্ষা পেতে চলেছিল তারজন্য সে গয়নার প্রতি লোভ এমনকি অপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতি চাহিদা বর্জন করল। বাড়ির লোক চারুলতা ছাড়া তার হঠাৎ করে চরিত্র বদল দেখে যথেষ্ট আশ্চর্য হয়েছিল। আসলে বিবেকের দংশনের ফলে সুদেষ্ণা নিজেকে একেবারে পাল্টে ফেলল। 

 

তনুচ্ছায়া মুখার্জী-



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational