সর্ম্পক
সর্ম্পক


মধুরিমা কখন যে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ তিতলির ডাকে ঘুম ভাঙল। তিতলি হল মধুরিমা আর অরিত্রর চার বছর বয়সের ফুটফুটে একটি মেয়ে।
অরিত্র—মধুরিমার স্বামী ও তিতলির বাবা হলেও মধুরিমার ভালবাসার মানুষ নয়। কলেজে পড়ার সময় সায়নের প্রেমে পড়ে মধুরিমা। কিন্তু নানা কারণে তাদের সেই প্রেম পরিণয়ের পরিণতি পায়নি। বাবার পছন্দ করা ছেলে অরিত্রকেই তার স্বামী বলে মেনে নিতে হয়। নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সর্ম্পকের কারণে একদিন মধুরিমা অরিত্রর সন্তান তিতলির জন্ম দেয়। বিয়ের পর প্রথম প্রথম সায়নের জন্য মন খারাপ হত খুবই। কিন্তু মেয়ে হওয়ার পর থেকে সায়নের স্মৃতির ছাপ তার মনে ক্রমশ হাল্কা হতে থাকে। এভাবে কখন যেন পাঁচটা বছর কেটে গিয়েছে।
গতকাল হঠাৎ করে গড়িয়ায় দেখা হয়ে যায় সায়নের সাথে। মধুরিমা উপলব্ধি করে যে লোকে ঠিকই বলে পুরানো প্রেমের নেশা পুরানো মদের মতোই হয়। কালকের পর থেকে সায়নের যে ছবিটা পাঁচ বছরে ধিরে ধিরে অস্পষ্ট হয়ে এসেছিল সেটা যেন এক মুহূর্তে একেবারে স্পষ্ট হয় উঠল মধুরিমার মনে। কথায় কথায় জানতে পারল মধুরিমার বিয়ে অন্য জায়গায় ঠিক হয়েছে শুনে সে কোলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে গিয়েছিল। সেখানেই এম বি এ করে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরিরত।
সায়ন বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তারপর বলল “তুমি একটুও পাল্টাওনি মধু, একদম সেই আগের মতোই আছো। শুধু তোমার পরিচয় পাল্টে দিয়েছে তোমার সিঁথিতে পরানো অন্য কারো সিঁদুর।”
মধুরিমা বলল “আমার কথা থাক, তোমার কথা বল।” সায়ন আগের মতোই প্রাণ খোলা হাসি হেসে বলল “আমি ভালো আছি, খুব ভালো। তা তোমার সন্তানাদি কটি?” মধুরিমা তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল “ এই যে আমার চার বছরের মেয়ে তিতলি।” সায়ন বলল “তোমার ফোন নম্বরটা যদি আমাকে বিশ্বাস কর তবে দিতে পারো কোলকাতা ছাড়ার আগে একবার কথা বলব।” মধুরিমা একটু ইতস্ততঃ করলেও শেষে নম্বরটা দিয়ে দিল। তারপর দুজনে দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিল।
গতকাল সায়নকে দেখার পর থেকেই কিরকম যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে মধুরিমা। কাল সারারাত ভেবেছে তার ফোন নম্বরটা সায়নকে দেওয়া ঠিক হয়েছে কিনা। যদি সায়ন ফোন করে কি বলবে সে আর মধুরিমাই বা কি বলবে— এই সব কথার ঢেউ তার মনে তোলপাড় করেছে বারবার। বিনিদ্র হয়ে কেটেছে সারারাত। অরিত্র দিন সাতেকের জন্য অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছে তাই মধুরিমার এই অস্বস্তি তাকে লুকাতে হয়নি। ভোরের দিকে তার ও সায়নের পুরানো দিনের কথাগুলি মনে করতে করতে তার দু‘চোখ জলে ভরে এল। এইভাবে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
তিতলির ডাকে ঘুম ভেঙে উঠে তাড়াতাড়ি মেয়েকে তৈরি করে প্লে স্কুলে দিয়ে এল মধুরিমা। ফেরার পর রোজকার মতো এক কাপ চা নিয়ে বসতেই বেজে উঠল মোবাইলটা। অরিত্র ফোন করেছে। অরিত্র বলল “তুমি ও তিতলি ঠিক আছো তো মধুরিমা? আমি ভেবেছিলাম তুমি আজকে সকালে ঠিক ফোন করবে।” মধুরিমা ভাবতে লাগলো অরিত্রর কথার কারণটা, কিন্তু কালকের পর যে তার নিয়মমাফিক চলা জীবনের অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে অরিত্র বলে উঠল “হ্যাপি অ্যানিভার্সারি মধুরিমা। আমার কাজটা একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল তাই আমি আজকে বিকালেই ফিরছি। সাবধানে থেকো।” মধুরিমা কিছু বলার আগেই ফোন টা কেটে গেল।
মধুরিমা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। মিনিট দশেক পর মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। একটা অচেনা নম্বর। ফোনটা কানে দিতেই ভেসে এল সায়নের কন্ঠস্বর। যে আওয়াজ শোনার জন্য একসময় সে পাগলের মতো অপেক্ষা করত আজ সেই আওয়াজ শুনতে তার কেন এত ভয় করছে! কিসের ভয়— অরিত্র কে, তিতলি কে, তার পাঁচ বছরের সংসার কে না নিজেকে হারানোর ভয়!
সায়ন বলল “মধু অনেকবার ভেবেছি কিন্তু দিল্লিতে ফেরার আগে কিছুতেই একবার শেষবারের মতো তোমার কন্ঠস্বর শোনার লোভ সামলাতে পারলামনা। আমি নির্ধারিত সময়ের আগেই দিল্লি ফিরে যাচ্ছি। আমি অনেক সফলতা লাভ করলেও সত্যি বলতে এতদিন ভালো ছিলাম না তাই হয়ত একবার দেখতে চেয়েছিলাম তুমি কেমন আছো, আমার সে ইচ্ছা ঈশ্বর পূরণ করেছেন। তুমি তোমার স্বামী ও মেয়ে নিয়ে সুখে থেকো। মধু একজন ভালো প্রেমিকা ও স্ত্রী হওয়ার থেকে অনেক বড় কাজ একজন ভালো মা হওয়া। কালকে তোমাকে দেখার পর মিথ্যে বলব না একবার লোভ হয়েছিল তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে এমন কোথাও চলে যেতে যেখানে তুমি শুধু আমার হবে। কিন্তু তক্ষুণি তোমার মেয়ের মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি আর একবার তোমাকে হারিয়ে ফেললাম। তুমি যেমনই প্রেমিকা বা স্ত্রী হওনা কেন তুমি একজন ভালো মা হবে আমি জানি।” মধুরিমার কন্ঠস্বর কান্নায় বন্ধ হয়ে আসছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে বলল “তুমি ভালো থেকো সায়ন। তুমি খুব ভালোমানুষ। তুমি কোনদিনই কোনকিছু ছিনিয়ে নিতে শেখোনি। তাই আমার মনের কোণে সারাজীবন তোমার জন্য ভালোবাসা বেঁচে থাকবে।” ফোনের অপরদিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল। ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল।