Manasi Ganguli

Tragedy

3  

Manasi Ganguli

Tragedy

সমুদ্রমন্থন

সমুদ্রমন্থন

5 mins
12.2K


#সমুদ্র মন্থন


  ভালবাসার দিনগুলো যে এত ক্ষণস্থায়ী হবে ভাবেনি কখনও রাজশ্রী। সবার অমতে শামীমকে বিয়ে করেছে সে,এর জন্য তাকে বাবা-মা,ভাই-বোন,আত্মীয়-পরিজন সকলকে ছাড়তে হয়েছে। এখনও সমাজ হিন্দু-মুসলিম বিবাহ মানতে পারে না,মুখে সবাই যতই বলুক হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। কষ্ট হয়েছে রাজশ্রীর সকলকে চিরদিনের মত ছেড়ে আসতে,খুব,খুব কষ্ট হয়েছে কিন্তু শামীমের আকর্ষণের কাছে সে সব তুচ্ছ হয়ে গেছে। আর শামীমও তাকে ভালবাসায় ভরিয়ে সেসব দুঃখ ভুলতে সাহায্য করেছে। আর ছিলেন শামীমের মা,নিজের মেয়ের মত করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন রাজশ্রীকে,আর তাই তো সব ভুলে সে থাকতে পেরেছে।

  একা সমুদ্রের ধারে বসে রাজশ্রীর মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা। কলকাতা থেকে ম্যাঙ্গালোরে মেরিন বায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করতে এসেছিল রাজশ্রী। একই সাথে পড়ত শামীম আহমেদ,কর্ণাটকেরই ছেলে। দু'জনে ভালবাসা হয়,ক্রমে ক্রমে ভালবাসা গভীর হয়। দু'জনে পাশ করে Ph.D করে। চাকরী জয়েন করে। দু'জনের দু'জনকে ছেড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে আর তখনই শতবাধা অতিক্রম করে রাজশ্রী শামীমের বাড়ানো হাতটা ধরে,বউ হয়ে আসে তার ঘরে।

    কত আনন্দের দিন ওরা একসাথে কাটিয়েছে আর মা ছিলেন ওদের দুজনেরই মা,আর তাই জন্মদাত্রী মাকে ভুলে থাকতে রাজশ্রীর কষ্ট হয় নি। কিন্তু সে সুখ বেশিদিন সয়নি রাজশ্রীর। দু'বছর পরই মা, 

মানে শামীমের মা মারা যান। দু'জনেই ওরা খুব কষ্ট পেয়েছিল। মা হারাবার কষ্টটা রাজশ্রীর বুকে বড় বাজল,এক মা থাকতেও তাকে হারাতে হয়েছে আর এক মাকে পেয়েও তাকে হারাতে হল।

    দু'জনেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে আরো ক'টা বছর পার হয়ে গেল। দু'জনে কাজের মধ্যে এতই ডুবে থাকত,যে সংসার বাড়ানোর কথা তাদের মাথায়ই ছিল না। প্রায় সাত বছর কেটে গেল তাদের একটা সন্তানের কথা ভাবতে।

   সেদিন ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা। সন্ধ্যে থেকেই আকাশ জোছনায় ভরে গিয়েছিল। শামীম ও রাজশ্রী ছাদে গিয়ে বসল। অফুরন্ত জোছনায় সেদিন ওরাও ভেসে গিয়েছিল অফুরন্ত ভালবাসায়। মনে মনে তারা যেন সেদিন ফুলশয্যার বাসর সাজিয়েছিল। সারাটা রাত সেদিন তাদের কাটল সীমাহীন আনন্দে ও ভালবাসায়। ভোর রাতে দু'জনে দু'জনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কয়েক ঘন্টাই মাত্র ঘুম। যেতে হবে কাজে। দু'জনেই উঠে ছুটোছুটি শুরু।

   সারাদিনের কাজের পরে রাজশ্রী ফিরে এল ঘরে,শামীম দু'দিন পরে ফিরবে এমনই ছিল কথা। দুটো দিন রাজশ্রী যেন স্বপ্নের দেশে ছিল। শামীমের ভালবাসা সারা অঙ্গে মেখে দুটো দিন তার বেশ কাটল। কিন্তু দু'দিন পার হয়ে গেল শামীম এল না। এভাবে দু'দিন দু'দিন আরো দু'দিন পার হতে লাগলো,দু'দিন যে আর শেষ হয় না। রাজশ্রী এবার চিন্তায় পড়ল। দেখতে দেখতে মাস পার হল,রাজশ্রীর শরীর জানান দিচ্ছে তার শরীরে শামীমের উপস্থিতি। কিন্তু এ আনন্দের খবরটা সে জানাবে কাকে! শামীম জানতে পারলে কত খুশি হত। কিন্তু কোথায় সে? একা ঘরে রাজশ্রী কেঁদে ফেলে,পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। না,এতে শামীমের অমঙ্গল হবে।

   দিন যায়,ক্ষণ যায়,শামীমের দেখা নেই তো নেই। চারিদিকে খোঁজ চলছে সরকারি তরফে,পেপারে প্রথম প্রথম সেসব খবর বেরোত,পরে আর কিছু জানা যায় না। রাজশ্রী নিজের কলিগদের মারফৎ খোঁজখবর তার মত করে চালাতে থাকে। দেখতে দেখতে রাজশ্রীর শরীর ভারী হয়ে ওঠে। শুভদিনে,শুভক্ষণে ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হয়। রাজশ্রীর দু'চোখে দুই জলের ধারা আনন্দ ও দুঃখ হয়ে বইতে লাগলো। ছেলেকে আঁকড়ে ধরে দুঃখ ভুলতে চায়। এখন ওই তো ওর একমাত্র অবলম্বন,অন্ধের যষ্টি। আশায় বুক বাঁধে,নিশ্চই তার শামীম ফিরে আসবে।না সে আশা রাজশ্রীর পূর্ণ হয় না। একাই ছেলে মানুষ করে,তার মা ও বাবার দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে পালন করার আকুল চেষ্টা। ছেলেকে বাবার গল্প শোনায়। মায়ের কাছে বাবার গল্প শুনে ছোট্ট ছেলেটির বাবার প্রতি ভালবাসায় মন পূর্ণ হয়ে ওঠে।          

    ছুটি পেলেই রাজশ্রী সমুদ্রের ধারে ধারে বিভিন্ন জায়গায় ছেলেকে নিয়ে ঘুরতে যায় আর সারাদিন বসে থাকে সমুদ্রের ধারে। সঙ্গে থাকে পারভিন,যে ছোট্ট থেকে শ্যামরাজকে দেখাশোনা করে,হ্যাঁ নিজেদের দু'জনের নাম মিলিয়ে ছেলের এই নাম রেখেছে রাজশ্রী। পারভিনের হাতে ছেলেকে ছেড়ে রেখে রাজশ্রী সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। অনেক রাতে যখন সী-বিচ জনশূন্য হয় তখন উঠে হোটেলে ফেরে আবার সূর্য ওঠার আগেই গিয়ে হাজির হয়,দৈবাৎ যদি তার শামীমের দেখা মেলে।

   এভাবেই প্রায় ছ ছ'টা বছর অতিক্রান্ত। একদিন রাজশ্রী যখন গবেষণায় মগ্ন খবর আসে শামীমকে নাকি পাওয়া গেছে। জলদস্যুরা সমুদ্রের তলা থেকে শামীমকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিল। যেহেতু শামীমের কাজ ছিল সমুদ্রের গভীরে জলজ প্রাণীদের নিয়ে,তাই ওকে দিয়ে তারা তিমিদের অবস্থান জানার জন্য আটকে রেখেছিল। জলের ভিতর জীবন্ত তিমিকে টুকরো টুকরো করে কেটে তার মাংস সংগ্রহ করা ও পরে তা বিভিন্ন দেশে বিক্রি করাই ছিল তাদের কাজ। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তিমির শরীরের কিছু অংশ কাটার পর ছটফট করতে করতে তিমিটা যখন পালাবার চেষ্টা করে তখন অন্যদিক থেকে আর একজন অপর অঙ্গচ্ছেদ করে ক্রমে ক্রমে

পুরো তিমিটাকে কেটে টুকরো টুকরো করত এরা। শামীমকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেত সমুদ্রের ধারে ধারে আর শামীমকে বাধ্য হয়ে এইসব নিরীহ প্রাণীর অবস্থান জানাতে হত। এদের জাহাজ বিভিন্ন দেশ-বিদেশে গিয়ে ভিড়ত। সরকারী নির্দেশে গোয়েন্দারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বন্দরে শামীমের ছবি দিয়ে রেখেছিল কিন্তু সঠিক সন্ধান পেয়ে তাকে উদ্ধার করতে প্রায় ছ'টা বছর কেটে গেল।

  এই ক'টা বছর নিজের মনের বিরুদ্ধে এই অন্যায় কাজ করে আর এই সমস্ত অসাধু মানুষের সংস্পর্শে থেকে শামীম দিনে দিনে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। কোনো সৎ,শিক্ষিত মানুষের সাথে এই ক'বছর তার কোনো মেলামেশার সুযোগই ছিল না। আর তাই মুক্তির খবরেও তার মনে কোনো আনন্দ উঁকি দিলনা। রাজশ্রীর সামনে যখন তাকে হাজির করা হল,রাজশ্রী ছুট্টে গিয়ে তাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল কিন্তু শামীমের কোনো হেলদোল নেই। সবাই ভাবল ছেলেকে দেখে যদি শামীমের কোনো প্রতিক্রিয়া হয়,তাই ছেলেকে আনা হল তার কাছে। ৫বছরের ফুটফুটে ছেলে বাবা বাবা বলে জড়িয়ে ধরতেই,শামীম তাকে ছিটকে সরিয়ে দিল। যার মধ্যে এতক্ষণ কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না,এখন তার চোখ থেকে আগুন ঝরতে লাগলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস,এ তার সন্তান নয়,হতে পারে না। তার অজান্তে কি করে তার সন্তানের জন্ম হয়। এ নিশ্চই তার চলে যাবার পর রাজশ্রীর ব্যাভিচারের ফল। সকলে কত বোঝাল,শামীম বুঝতে চায় না। সে কিছুতেই বাড়ী ফিরবে না। সকলে চেনে রাজশ্রীকে,শামীমের স্মৃতি বুকে আঁকড়ে যে এতদিন কাটালো,সবাই যখন মেনে নিয়েছে শামীম মৃত,রাজশ্রী কিছুতেই মানে নি,তার শামীম তার কাছে ফিরে আসবেই,এই তার বিশ্বাস,তার এই পরিণতিতে সবাই খুব কষ্ট পায়। সকলে রাজশ্রীকে ভালবাসে তার শামীমের প্রতি ভালবাসা দেখে,জীবনযুদ্ধে একা লড়াই করা দেখে।

   সকলে মিলে এবার ঠিক ক'রে শামীমকে DNA টেস্ট করার কথা বলে। শামীম কোনো কথা শুনতেই চায় না। পরে রাজী হয় এবং অবশেষে DNA টেস্টে প্রমাণিত হয় শ্যামরাজ,শামীমেরই ছেলে। শামীম ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে,রাজশ্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে যায় কিন্তু এবার রাজশ্রী নির্বিকার। যার জন্য এতদিন সে আকুল হয়ে পথ চেয়ে বসেছিল,যার জন্য সে জীবনে সব কিছু ছেড়ে চলে এসেছিল,সেই শামীম তাকে অবিশ্বাস করায় তার হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

  রাজশ্রী মুখে কিছু বলে না। শামীম তার অবসাদ কাটিয়ে উঠেছে,ছেলেকে নিয়ে মহাখুশি। শামীমের ছেলের প্রতি টান ও ভালবাসা দেখে সে নিশ্চিন্তে একদিন যাত্রা করে নিরুদ্দেশের পথে। শামীম আর কখনও রাজশ্রীকে খুঁজে পায় নি। নিজের ভুলে সে প্রতি মূহুর্তে দগ্ধ হয়েছে,মনে পড়েছে হারিয়ে যাবার আগের রাতের কথা। রাজশ্রীর কাছে শামীমের আচরণ অপমানকর লেগেছে আর তাই রাজশ্রীর এই স্বেচ্ছা নির্বাসন। যাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসা যায় তার কাছ থেকে যে এতটুকু আঘাতও সহ্য করা যায় না একথা শামীম এখন হাড়ে হাড়ে বোঝে। আর রাজশ্রী দেখল সমুদ্র মন্থন করে তার হাতে অমৃতকুম্ভ এল না এল বিষকুম্ভ। বিষটুকু সে একাই পান করল। সেই বিষে সারাশরীর জর্জরিত হয়ে সে আর কাউকে বিষাক্ত করতে চাইল না।

  স্বেচ্ছায় কেউ লুকিয়ে থাকলে তাকে সহজে পাওয়া যায় না খুঁজে আর তাই শামীমও সারাজীবন খুঁজে পায়নি রাজশ্রীকে। কেউ বলে রাজশ্রী আত্মহত্যা করেছে,কেউ বলে সন্ন্যাসিনী হয়ে গেছে,কিন্তু খুঁজে আর তাকে পাওয়া যায় নি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy