STORYMIRROR

Ankita Mukherjee

Horror Romance Crime

3  

Ankita Mukherjee

Horror Romance Crime

স্মৃতির অতলে

স্মৃতির অতলে

18 mins
557

স্টেশনে মহিলা কণ্ঠের ঘোষণা শেষ হতেই পূর্ণাকে কম্পার্টমেন্টের দরজায় দেখা গেলো। সে ডানহাতের কপজি ঘুরিয়ে একবার ঘড়ির ডায়ালটা দেখলো। মিনিটের কাটা জানান দিলো রাত্রি নটা পেরিয়েছে আধঘন্টা আগেই। ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র তিন মিনিট বাকি। এমন সময় পূর্ণার চিন্তিত মুখের সামনে বরফ-ঠান্ডা বিসলেরির বোতল ধরলো অভীক। পূর্ণা এবার ঘড়ির ডায়ালটা অভীকের দিকে ঘুরিয়ে বললো, "কটা বাজছে ওভি?" তারপরই ক্ষণিকের স্তব্ধতা ভেঙে আবার পূর্ণা বলে উঠলো, "তুই খুব জেদী"। অভীক ওর হাতটা নিজের মুখের সামনে থেকে নামিয়ে উত্তরে বললো, "তুইও"। পূর্ণা অভীকের বুকে-পিঠে বাঁধা বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগে নিজের দশ মাসের শিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, "মায়ের থেকে ভালো খেয়াল সন্তানের কেউ রাখতে পারেনা ওভি"। অভীকের গলা শান্ত। ছেলেটা শিশুটার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, "পারে, ওর বাবা পারে ওর খেয়াল রাখতে। তাছাড়া তোকে তো বলেছিলাম শিফ্ট হোসনা, অন্য কোনো দফতরে অ্যাপ্লাই কর আমার মতো"।পূর্ণা অভীকের পিছনে গিয়ে বেবি ক্যারিয়ার ব্যাগের বাঁধন আলগা করে শিশুটিকে নিজের কোলে নিয়ে বললো, "না অভি, তোর মতো ইন্টারভিউ না। কারণ তোর মতো আমার চাকরি যায়নি। তুই এখন জবলেস, আর আমিও যদি শিফ্ট হওয়ার ভয় চাকরি ছেড়ে তোর মত ছুটে-ছুটে ইন্টারভিউ দিতাম, তাহলে আর লিলির জন্যে লেক্টজেন কেনা হতো না"। ছোট্ট শিশুটা ততক্ষনে তার একটি মাত্র ক্ষুরধার দাঁতের সৎ ব্যাবহার করে ফেলেছে। পূর্ণার ডান হাতের তর্জনীতে বেশ জোরেই কামড় বসিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রথমবার মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়া থেকেই সে লিলির অজান্তে দেওয়া যেকোনো চোট-ই চোট বলে মানে না।


রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসটা ছাড়বে বলে হর্ন দিতে শুরু করেছে। মহিলা কণ্ঠের ঘোষণাটাও আবার শোনা যাচ্ছে। অভীক লিলিকে নেওয়ার জন্যে দুহাত বাড়াতেই পূর্ণা বলে উঠলো, "তোর কি মনে হয় ওভী, তুই ইন্টারভিউ দিতে গেলে রত্না মাসি ওর ভালো ভাবে খেয়াল রাখবে?" অভীক পূর্ণার কাধে একটা হাত রেখে বললো, "আমি ইন্টারভিউ দিতে যাবনা। তুই আগে কটা দিন ওখানে গিয়ে থাকা শুরু কর। তারপর আমি আর লিলিও তোকে জয়েন করবো মাস খানেকের মধ্যেই"। এসমস্ত কোথায় পূর্ণা অনেকটাই সস্তি পেলো। একটা ভার যেনো মন থেকে নেমে গেলো। দশ মাসের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে চুম্মন করলো। কিন্তু পাল্টা চুম্মণ করতে গিয়ে লিলি পূর্ণার গালে নাল ঘষে দিল। মিনিট তিনেক শেষ হতেই, না চাইতেও লিলিকে অভীকের কোলে দিয়ে পূর্ণা ট্রেনে উঠে পড়ল। কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাড়িয়ে লিলির হাসি মুখটা দেখে ওর চোখটা ছলছল করছিল।


ট্রেনটা যখন প্ল্যাটফর্মের নাগালের বাইরে চলে গেলো পূর্নাও একটা বড় করে নিশ্বাস নিয়ে ভিতরে ঢুকে নিজের রিজার্ভ করা সিটে বসতে গিয়ে চমকে উঠল। সেখানে একটিও লাইট জ্বলছিল না। খালি কম্পার্টমেন্টে যতদুর চোখ যায় কোনো মানুষের ছায়া পর্যন্ত নেই, আর সিটেই আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে দুটো কায়া। পূর্ণা কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখনই একটা চাদরের ঢিপি থেকে মহিলা কণ্ঠ শোনা গেলো। তার প্রশ্নের জবাবে পূর্ণা বললো, "আমার বাঙ্ক উপরে, একদম টপে, বাট আপনাদেরটা নিচে, তাই তো"। দেখে মনে হলো চাদরের ঢিপির ভিতরে যে মানুষ দুটো বসে আছে তারা যেনো উপর-নিচ মাথা দোলালো। পূর্ণা তাদের সামনের সিটে বসে ভাবতে লাগলো কম্পার্টমেন্টের একটাই দরজা খুলে সে, অভীক আর লিলির সাথে কথা বলছিল। আর যেহেতু কম্পার্টমেন্টে অন্য কোনো পাসেংজার নেই, ফল স্বরূপ বাকি দরজা গুলোও বন্ধ। তাহলে এই দুজন মানুষ কীকরে ট্রেনে উঠলো। আর উঠলোই যখন তার চোখ পড়লো না কেনো তাদের উপর। ভাবা মাত্রই পুরুষ কণ্ঠের ঢিপিটা বলে উঠলো, "যখন তুমি কম্পার্টমেন্টের দরজা ছেড়ে নেমে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছিলে তখনই আমরা অপর একটি দরজা দিয়ে উঠে সেটাকে ভেজিয়ে দিয়েছিলাম"। হালকা হাসি মেশানো মহিলা কণ্ঠের স্বর বলে উঠলো, "তোমার হয়তো খুবই কষ্ট হচ্ছে সন্তানকে ছেড়ে থাকতে। কিন্তু কি করবে বলো, তাকে ছেড়ে থাকা ছাড়া তো তোমার আর কোনো উপায়ও নেই"। পূর্ণার কপালে ভাঁজ। সে প্রশ্নদৃত কণ্ঠে বলল, "আপনি কীকরে জানলেন যে লিলি আমার মেয়ে?" চাদরের ভিতরের থেকে মহিলা কণ্ঠ বললো, "সন্তানকে বুক থেকে সরিয়ে রাখলে মায়েরই চোঁখ জলে ভরে যায়। আমরা তোমাদের অনেক্ষনি লক্ষ্য করছিলাম। তবে তোমার মতো আমারও খুব কষ্ট হয়। ছোটো থেকে আগলে ছেলেকে বড়ো করলাম আর একটা মেয়ের জন্যে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো। ও আমাদের জন্য অন্ধের হাতের লক্রি ছিল। ওর জন্য কেঁদে-কেঁদে আমরা মরে গেছি"।

পূর্ণা বোকার মতো প্রশ্ন করলো, "কোথায় গেছে আপনার ছেলে?" পূর্ণার প্রশ্নে মনে হলো ওই বয়স্ক দম্পত্তির ছেলে যেনো তাদের জানিয়েই গেছে, যেখানে গেছে। তবে তার প্রশ্নের জবাবে বয়স্কা বললো, "দলমাদল পাড়া"। জায়গাটার নাম শুনে গত বছর টুরের সৃতি মনে পড়ে গেল পূর্ণার। যদিও সে এসব ভুলেই থাকতে চায় কিন্তু মনের অন্তরালে ভয়ানক সৃতিগুলো ফাঁকফোকর দিয়ে একেবারে যে উকি মারে না তেমনটা নয়। কিন্তু এই ফাঁকা কম্পার্টমেন্টের সিটে অচেনা মানুষ দুটির জ্বলজ্বলে চোঁখের দিকে তাকিয়ে মনের গভীরে ডুব থাকা পুরনো সৃতিতে তার বর্তমান চিন্তা ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।


চারিদিকের নিঃশব্দ চিরে রূপসী বাংলা এক্সপ্রেসটা বিষ্ণুপুর স্টেশনে দাড়াতেই লাগেজ নিয়ে নেমে গেলো পূর্ণা। তেপান্তরের মাঠের মতো প্রাণহীন প্লাটফর্মে পা রাখতেই একটা আবছায়া এগিয়ে এলো তার দিকে। মুখোমুখি হতেই আবছায়া শরীরটা স্পষ্ট হলো। সে নিজের পরিচয়ও দিলো। "আমার নাম সান্তনু সান্যাল। ইউ. বি. আই. বিষ্ণুপুর ব্রাঞ্চের আমি এস. ডি. ক্লার্ক"। পূর্ণার মনে হলো এও কি সম্ভব নাকি, যে ব্যাংক থেকে একজন সিনিয়র ডিভিশন ক্লার্ককে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাউ আবার ছাপোষা একটা জ. ডি. ক্লার্ককে রিসিভ করতে। পূর্ণার ভাবনায় ছেদ পড়ল। সান্তনু সান্যাল তাকে কোয়ার্টারে যাওয়ার জন্য তারা দিতে লাগলো। প্লাটফর্মটি পেরিয়েই একটা রিকশায় চড়ে বসলো দুজনে। কথায়-কথায় বুঝতে পারলো পূর্ণা, যে সান্তনুবাবুই এই রিকশাওয়ালাকে বেশি পয়সা দিয়ে রিজার্ভ করেছেন, নইলে এই নিশুতি রাতে তাদের হেঁটেই কোয়ার্টারে পৌঁছতে হতো। কথায়-কথায় সে আরো জানতে পারলো যে সন্তনুবাবু তার পাসের কোয়ার্টারেই থাকেন।


পরের দিন সকালে রেডি হয়ে বেরোতেই সান্তনুবাবুকে তার কোয়ার্টারের গেটের সামনে সুট-বুট পরে পায়চারি করতে দেখে পূর্ণার মনে হলো ছেলেটা যেনো তার জন্যেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে-করতে পাইচারি শুরু করে দিয়েছে। তার অবশ্য এই দৃশ্য অনেকই দেখা আছে। হাইয়ার সেকেন্ডারির অনেক আগে থেকেই তার জন্যে অনেকেই অপেক্ষা করেছে কিন্তু সে রঞ্জিত ছাড়া কারোর কাছেই ধরা দেয়নি। তবে ধরা দিয়ে যে, সে সারা জীবন আটকা পড়ে যাবে, সেটা লিলির জন্মের কিছু আগেই বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু সেই সময় তার আর পিছনোর সুযোগ ছিলোনা। নেহাত অভীক সেই সময় তার দিকে সাহায্যের হাতটা

বাড়িয়ে দিয়েছিল।


অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো পূর্ণা সান্তনুবাবুর প্রশ্নে। "তাহলে এবার যাওয়া যাক নাকি?" হ্যা, সূচক ঘাড় নেড়ে মোবাইলের স্ক্রীনে সময়টা দেখে নিয়ে, সারা ওয়ালপেপার জুড়ে লিলির মুখটা দেখে স্ক্রীন বন্ধ করে দিলো। মেইন গেটটা ছেড়ে বেরোনোর আগের এক মুহূর্তে পূর্ণার মনে হলো কেউ যেনো দুটো ঠান্ডা কাঠি আইসক্রিমের ডগা ওর দুই বাহু দিয়ে তর্জনী পর্যন্ত ছুঁইয়ে দিলো। সেই শীতল স্পর্শ চামড়া ভেদ করে হাড় কাপিয়ে দিলো। পিছন ফিরে কোয়ার্টারটা একবার দেখলো সে। সান্তনুবাবুও তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো। তারপর বেরোনোর জন্য তাড়া দিলো।

অচেনা জায়গায় অচেনা মুখগুলো খুবই মিশুখে তাই অফিসের প্রথম দিনটা ভালই কাটল পূর্ণার।বেলা শেষে অফিস ফেরত সান্তনুবাবু বদলে, শুধু 'সান্তনু' হয়ে গেছে। তাই কোয়ার্টারে ঢোকার আগে গেট ধরে সান্তনু সান্যালের ডিনারের অফারটা নাকোচ করেনি পূর্ণা।


মাঝ রাতে শরীরটা কেমন যেনো ভার-ভার লাগতেই ঘুম-টা ভেঙে গেলো পূর্ণার। যদিও চোখ খুলে নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া সে কিছুই দেখতে পেলো না। চোখ দুটো বন্ধ করে পুনরায় ঘুমনোর চেষ্টা করতেই আবার শরীরের উপর সেই ভার অনুভব করলো। পূর্ণা বুঝতে পারছে ধীরে-ধীরে দুটো শক্ত হাতের বাঁধনে সে বাঁধা পড়ছে। হাত ছাড়াও উষ্ণ একজোড়া ঠোঁটের অনুভব সে করতে পারছে। ঠোঁট দুটো তার শরীরের যত্রতত্র চুম্মন করে গলার কাছে উঠলো। এই সর্গিও সুখ উপভোগ করতে-করতে পূর্ণার মুখ দিয়ে 'আহ্' শব্দটা বেরিয়ে যায়। শীতর রাতের এই আশ্লেষ ছেড়ে ওর বেরোতে মন চাইলোনা। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত আলিঙ্গন থেকে না বেরোলেই নয়। পুরুষ হস্ত দুটো এবার আরো আস্টেপৄস্টে জড়িয়ে ধরলো। গলা ছেড়ে তার ঠোঁটে মিশে গেলো সেই উষ্ণ একজোড়া ঠোঁট। মুখের উপর গরম নিশ্বাস পড়ার সাথে সাথেই ঘরটা কেমন কপার সালফেটের মত নীল আলোয় ভরে উঠছে। পুনরায় চোখ খুলতেই নীলচে আলোয় ঘরটা আলোকিত হতে দেখলেও তার সজ্জা সঙ্গিকে দেখতে পেলো না পূর্ণা। হকচকিয়ে বিছানায় উঠে বসতেই অতীতের কোনো এক মুহূর্ত মনে পড়ে গেল।


সেদিনও এই আলোর মতোই হালকা নীল ল্যাম্পের আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিল। তারাও বিছানায় অফুরন্ত সময় ধরে একে অপরের উষ্ণতায় আলিঙ্গণবদ্ধ হয়েছিল। ঘন নিশ্বাসে রিপুরুর তাপ অনুভব করেছিলো। মিশে গিয়েছিল একে অপরের শরীরে।


চিন্তার পথে বিঘ্ন ঘটলো। কি যেনো একটা আওয়াজ। নীল আলোটাও এবার কমতে শুরু করেছে। পূর্ণার মনে হলো কে যেনো একজোড়া পদধ্বনি তুলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর সাথে-সাথে নীল আলোটাও নিভে গেলো। নিকষ কালো অন্ধকারে ঘরটা ছেয়ে যেতেই সেই পদধ্বনি আবার শোনা গেলো। তার মনে হলো ক্রমশ সেটা যেনো তারই দিকে এগোচ্ছে। একসময় শব্দ আর শনা গেলো না। তার বদলে ফিসফিসিয়ে নিজের নাম শুনলো পূর্ণা। কানের পিঠ ঠান্ডা হয়ে গেল। চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে, বন্ধ হয়ে গেল।


গাঢ় ঘুমের কুয়াশা ধীরে-ধীরে ফিকে হয়ে আসে, আর তারই মাঝে সান্তনু যেনো অনেক দূর থেকে ডাকছে। একজোড়া পাতা মেলে তাকাতেই শান্তনুর চিন্তিত মুখ দেখে উঠে বসলো পূর্ণা। কিন্তু তার মেঝেতে শুয়ে থাকা নিয়ে প্রশ্ন করতেই সে পাল্টা প্রশ্ন করলো সান্তনুকে। সেই প্রশ্নের উত্তরে সান্তনু বললো, "দরজা ভেজানো ছিল। ভিতর থেকে আটকানো থাকলে আমিতো জানতেও পারতাম না তুমি কেনো অফিসে যেতে লেট করছো। আর ভালো মন্দ কিছু হয়ে গেলে......"। "আমার কিছু হয়নি, আই অ্যাম ফিট অ্যান্ড ফাইন" বলেই পূর্ণা উঠে দাড়ালো। সান্তনুও উঠে দাড়িয়ে পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ণা প্রথমে ছাড়াবে ভেবেও পরে এস. এস.কে পাল্টা আলিঙ্গন করে। শান্তনু দ্বিতীয়বার গতকাল রাত্রের ব্যাপারে আবার প্রশ্ন করলো। উত্তরে পূর্ণা শুধু মাথা ঘুরে সেন্সলেস হয়ে গেছে জানিয়ে অফিসে বেরোনোর তারা দেখাতে শুরু করলো। যদিও তার এই মিথ্যে কথা ধরতে শান্তনুর বেশি সময় লাগেনি। কারণ শান্তনুর নজর এড়ায়নি পূর্ণার কপালে ফুলে থাকা শিরা। ফুলে থাকা শিরার উপরে ঘামের দাগ গুলোও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সান্তনু। একবার ভাবলো জোর করে জানতে চাওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। তাউ এক্সট্রা কনসার্ন দেখানোর জন্যে জিজ্ঞেস করেই নিলো। মুখ দিয়ে রন্জু শব্দটা বেরিয়ে যেতে-যেতে গিলে নিলো পূর্ণা। নিজেকে এক সেকেন্ড সময় নিলো সামলাতে। তারপরই অতি স্বাভাবিক হয়ে বললো, "একচুয়ালী আমার একিউট গ্যাস্ট্রিক প্রবলেম আছে, তাই বেশিক্ষণ উপশ করে থাকলে মাথা ঘুরে যায়। কাল ডিনার ডেটের পরে ভেবেছিলাম কোয়ার্টারে ফিরে আর খিদে পাবে না, কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই এত খিদে পেয়ে গিয়েছিল যে কিচেনে যাওয়ার টাইমও পায়নি। যাবো বলে উঠে দাড়ালাম সাথে-সাথেই মাথাটা ঘুরে গেল"। শান্তনুকে এবার বিশ্বাস করতেই হলো কথাগুলো।

আজও ডিনার ডেটেই যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওদের। কিন্তু সেটা ভেস্তে গেলো অভীকের আচমকা আবির্ভাবে। কোয়ার্টারে ঢোকার মুখে পূর্ণাকে ছেড়ে দিয়ে সান্তনু এগিয়ে গেলো। গেট খুলে ঢুকতেই আচমকা অভীককে দেখে পূর্ণা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললো, "তুই? এখানে, এভাবে? কীকরে এলি? মানে জানলি কীকরে যে আমি এই কোয়ার্টারে থাকি?" অভীক উত্তরে বললো, "আমার এখানে আসার জন্যে তোর ফোনে বলা অ্যাড্রেস আর পিনকোডই যথেষ্ট ছিল। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে বেশি দিন আলাদা থাকা যায়না"। এতো কোথার মধ্যে লিলিকে না দেখতে পেয়ে পূর্ণা বিচলিত হয়ে উঠলো। মুখে রাজ্যের বিরক্তি এনে বললো, "আমার লিলি কোথায়? ইরেস্পনসিবলের মতো চলে এসেছিস, লিলিকে কার কাছে রেখে এসেছিস?" এবার অভীকও বিরক্ত স্বরে বললো, "তুই কি একটুও ভালো ভাবে কথা বলতে পারিস না। আমার মেয়েকে আমি কার ভরসায় বা রেখে আসবো। এই সময় ওর মাথায় কুয়াশা লাগল ওর শরীর খারাপ হবে, তাই ওকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তোর কোয়ার্টারের চাবি কোথায় পেলাম এই নিয়ে এখনই কোনো প্রশ্ন তুলিশ না প্লীজ। আগে ভিতরে চল"।

চুপচাপ অভীকের সাথে কোয়ার্টারে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেও পূর্ণার মনে অশান্তির শেষ নেই। হুটহাট না জানিয়ে অভীকের আচমকা আগমন তাকে দ্বন্দ্বে ফেলেছে। মেয়েটা মনে-মনে ভাবলো বিয়ের এত গুলো মাস কেটে গেলো তাউ অভীকের পসেসিভ মানসিকতাটা বদলালো না। পূর্ণার মুখের ভাব দেখেই অভীক বুঝতে পারলো তার আচমকা আবির্ভাবে পূর্ণা যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু পূর্ণা যেহেতু অভীকের কাছে লিলির জন্যে আটকা পড়েছে তাই এখনও চুপ রয়েছে। সত্যিই তো অভীক সাহায্যের হাত না বাড়ালে তার এবং লিলির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা বেড়ে যেত। অভিকের দিকে তাকাতেই দেখলো সেও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পূর্ণা একটু ভেবে বললো, "আমায় একটু বেরোতে হবে ওভি, একটা আর্জেন্ট কাজ আছে। তুই নিজের জন্যে খাবার আনিয়ে নিশ বরং। ও হ্যা, আর আমার জন্যে ওয়েট করার দরকার নেই বুঝলি। আমি রাত্রে বাইরেই খেয়ে আসবো"। অভীক বললো, "তার মানে তোর আর্জেন্ট কাজ এটাই তাই তো যে তুই বাইরে খেতে আসবি। অনেক দিন বাঁধে ভাবলাম তোর সাথে একসঙ্গে বসে ডিনার করবো বাট তুই তো দেখছি এখানে এসে আমার অভাববোদ মেটানোর মানুষ পেয়ে গেছিস। টা সেটা নিশ্চই ওই লোকটাই যে তোকে কোয়ার্টার ওপদী ছেড়ে দিল। ভালই আসিশ। পাশাপাশি কোয়ার্টারে থাকছিস। প্রয়োজনে দরকার মেটাতে পারছিস, আর কি চায়"। অভীকের আচরণে পূর্ণার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। রক্তবর্ণ চোখে বললো, "সান্তনু আমার কলিগ বুঝলি। তোর এই সন্দেহবাতিক প্রবণতাটা বন্ধ কর"। অভীকের মুখে বাকা হাসি। হাসি মাখানো বাঙার্থ গলায় বললো, "কটা দিনেই কলিগকে চোখে হারাচ্ছিস দেখছি। ওই শান্তনুর সাথেই তো বেরোবি তাই না"। হেনো কোথায় পূর্ণা যথেষ্ট বিচলিত হয়ে উঠেছে। শুধু অভীকের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবে না জেনে চুপ করে আছে। নইলে এই কথার জবাব সে ঠিকই দিতো। অভীক আবার বললো, "তোকে আটকানোর ক্ষমতা আমার তখনও ছিলোনা আর আজও নেই। তবে কি জানিস তো, তোর ইচ্ছামত খাতে নিজের জীবন বয়াতে পারিস, কিন্তু লিলির ভবিষ্যতের ডিভিশন আমিই নেবো"। এই কোথায় পূর্ণা মুখ খুললো। সে বলল, "তুই ভুলে যাচ্ছিস ওভি, লিলি যতটা তোর তার থেকেও বেশি আমার। তাই ওর অধিকার সব থেকে বেশি আমার। আর তুই সান্তনু কে নিয়ে আমায় সন্দেহ করছিস তাই তো। সে তুই কর, তোর এই একটা ব্যবহারইতো সব চাইতে বেশি নিখুঁত। আর আমায় আটকানোর কথা তুই বলবি না, কারণ আমি কোনোদিন তোর ছিলাম না"। এবার ধমকের সুরে অভীক বলে উঠলো, "তা হবি কেনো, তুই তো তোর গোটাজীবনটাই একজনের নামে সপেছিশ। দুনিয়াতে সে না থাকলেও তোর মনের অন্তর্বাসে তুই তাকে রেখে দিয়েছিস। আর তাই সেখানে আমায় কোনোদিনও জায়গা দিসনি।" "থাম ওভি! প্লীজ, আমার আর ভালো লাগছে না। আমি খুব টায়ার্ড। আমি রেস্ট......" কথা শেষ না হতেই অভীক তাকে নিজের গায় সরিয়ে চেপে ধরলো। সে বলল, "তুই এত কোল্ড কেনো পূর্ণা, রঞ্জিতের নিচে যখন শুয়েছিলিশ তখন তো গরম হয়েছিলিশ, আর আমি ছুতে গেলেই তোর শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কেনো বল? ওর একদিনের উষ্ণতায় এত সুখ পেয়েছিলিশ যে আমার শরীর কোনোদিনও উপভোগ করতেই পারিসনি। একটা কথা বল তো, আমায় কোনোদিন মন থেকে ছুঁয়েছিস, না আমার অধিকার থেকে আমায় বঞ্চিত করতে চাশনি বলে আমায় বাধা দিসনি?" এ হেন প্রশ্নে পূর্ণা একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে মুখ বিকৃত করে বললো, "ওভি আমার লাগছে। আমায় ছাড়। আর তাছাড়া তুই জানিস যে আমি রঞ্জুকে ভালবাসতাম, আর ওউ আমায় ভালোবাসতো। তাছাড়া আমার লিলি তো আমাদের ভালোবাসারই সাক্ষী। কিন্তু আজ ও নেই বলে ওর জন্যে আমার ভালোবাসা কম হয়ে যাবে এটা তুই ভাবলি কীকরে? আর আমি তোকে সেদিন বলিনি আমায় বাঁচাতে। কেনো বাঁচিয়েছিলি আমায়? ভেসে যেতে দিতিস ঝর্নার স্রোতে। এমনিতেও আমি জানতাম না যে তুইও ওখানেই বেড়াতে গিয়েছিলিশ। ঐভাবে আচমকা আমায় পিছন থেকে চেপে ধরে পাহারের কিনার থেকে টেনে না আনলে আমার সাথে লিলিও শেষ হয়ে যেত। আর সেই জন্যে তোর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তার মনে এই নয় যে তুই আমায় তোকে ভালোবাসতে বাধ্য করবি। ভালো সবাইকে বাসা যায় না, কিন্তু একবার কাউকে প্রাণপাত করে ভালোবাসলে দ্বিতীয় কাউকে আর নিজের জীবনে আনা যায়না ওভি। তাই তুই রাগ করলেও আমি অসহায়। তোকে আমি কোনদিনই ভালোবাসতে পারবো না। তবে যদি কোনোদিন সুযোগ পায়, সেদিন চেষ্টা করবো তোর এই উপকার শোধ সমেত ফেরত দেওয়ার"। "অসথের আবার কি উপকার করবে পূর্ণা?" এবার একটা ভারী কণ্ঠে তারা দরজার দিকে ফিরে দাড়াল। ফিরতেই সান্তনুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। শান্তনু আবার বললো, "পূর্ণা তোমার কি মনে হয়, এ তোমায় ভালোবাসে। না-না, তোমার অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছে। তোমায় বিয়ে করার পিছনেও এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল। তোমায় ভোগ করা। কিন্তু ও জান্তু যে রঞ্জিত ছাড়া তুমি আর কারোর না, আর কারোর হতে পারোনা। তাই তাকে হত্যা করে তোমার অসহায়তার সুযোগ নিয়েছে। যদিও লিলিকে মন থেকেই স্নেহ করে, তবুও রঞ্জিতকে অতি পরিকল্পনায় হত্যা করেছে যাতে তুমি ঘুণাক্ষরেও টের না পাও। আর হলও তাই। তুমি বুঝতেও পারনি যে অভীক রঞ্জিৎকে স্লো পয়জনিং করতো। একসাথে মেসে থাকার ফলে এই কাজে তার সুবিধাই হতো। কিন্তু যেই তোমরা এত কাজ শামলেও বছর খানেক আগে এই জায়গাতেই উইকেন্ডে কাটাতে এলে, সেটা আর এর সহ্য হলো না। পিছু নিল তোমাদের। তারপর যখন তোমরা ভালোবাসার উষ্ণতায় অতল তরঙ্গে তলিয়ে গিয়েছিলে তখনই অভীক রঞ্জিতের তরলে বিষাক্ত দ্রব্য মিশিয়ে দেয়। তুমি যেহেতু তরলে ইচ্ছুক ছিলে না তাই তোমার বোঝার কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু তরল সেবন করা মাত্রই তার প্রাণহানি হতে দেখে তুমি বিষয় হতবাক হয়ে ঝর্নার স্রোতে বিলীন হওয়ার জন্য যখন ছুটে গিয়েছিলে তখনই সে তোমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ এই ছেলেটা জানত তোমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। অতএব এবার তুমি ওরই। হলোও ঠিক তেমনটাই। কলকাতায় ফিরে প্রথমেই যথাসাধ্য চেষ্টা করে তোমায় পুলিশি ঝামেলা থেকে বাঁচালো। সাথে-সাথে বিয়ের প্রস্তাবনাও দেয়। তুমি প্রথমটায় রাজি না হলেও পরে সন্তান-সম্ভবনা হয়ে পড়ায় না করতে পারোনি"। এক টানা এত গুলো সত্যি কথা একটা অচেনা লোকের মুখের শুনে বিশ্বয়,আতঙ্কে অভীক একটু দমে গিয়েছিল। তারপর ছুটে এসে শান্তনুর শার্টের কলার চেপে ধরে এক ঘুশিতেই তাকে কাত করে দেয়। কিন্তু তার মুষ্টি শান্তনুর মুখ ছুঁতেই সারা হতে শিহরণ বয়ে গেলো। তার মনে হলো সে যেনো শান্তনুর মুখ নয় একটা শীতল বরফের চাঁই ছুঁয়ে ফেলেছে। অভীকের মাথার ভিতর একটা প্রশ্ন ভেসে উঠলো, 'মানুষের মুখ কি এত ঠান্ডা হয়। এমন ঠান্ডা শরীর মানে তো জর। কিন্তু পূর্নার এই কলিগকে দেখে একবারও মনে হয়নি অসুস্থ বলে। তবে এত কথা এই লোকটা জানলো কীকরে?' এসব ভাবনায় বিঘ্ন ঘটলো, যখন পূর্ণা পিছন থেকে এসে সান্তনুকে ওঠার জন্য সাহায্য করতে লাগলো। কিন্তু তার হাত ছোঁয়া মাত্র লাফিয়ে তিন পা পিছিয়ে গেলো পূর্ণা। এমন হিমশীতল ছোঁয়ায় তার হাতের শিরা কেপে উঠলো। শান্তনু অবশ্য বিনা সাহায্যেই উঠে দাড়ালো। অভীক রাগে,বিস্ময় লাল হয় জিজ্ঞেস করলো, "কে তুমি এতো বাজে কথা বলছো? আর বলা নেই, কওয়া নেই আমাদের ঘরে ঢুকলে কীকরে?" তারপর পূর্ণার দিকে না ফিরেই তার উদ্দেশ্যে বললো, "তোর কাছে আসে নাকি মাঝে-মাঝে?" পূর্ণা বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, "তুই এবার থাম। অনেক সময় ধরে, অনেক কথা শুনছি তোর", তারপর শান্তনুর উদ্দেশ্যে বলে, "তুমি কীকরে জানলে যে আমি কবে,কখন, কার সাথে এসেছিলাম? তুমি কি আমায় আগে থেকে চিনতে?" এই কথা শোনা মাত্র শান্তনুর মুখে ফুটে উঠলো একটা পুরু হাসি। সেই শব্দহীন হাসি কারোরই চোখ এড়ালো না। অবশ্য মৃদু টোল দুটো দেখে অভীকের কিছু না হলেও পূর্ণার চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। কারণ এইকটা দিনে তেমন ঘনিষ্ঠ না হলেও, পূর্ণা সান্তনুকে অনেক কাছ থেকেই দেখেছে, আর অভীকরা না এলে আজও কাছ থেকেই দেখতো। তাই সে খুব ভালো করেই জানে যে এস.এসের গালের একজোড়া টোল অস্বাভাবিক। এতে একজনের সাথে খুব মিল পাচ্ছে সে। তার মনে আছে রঞ্জিত যখনই হাসত একটা হালকা টোল ভেসে উঠতো তার গালে। স্মৃতির গভীর হাতড়ে তার মনে পড়ে গেলো একবার ইয়ার্কির ছলে পেনের বদলে জ্যামিতি বক্স থেকে কম্পাস বের করে ছোঁয়াতে গিয়েই বিপত্তি হয়েছিল। সামান্যই ইঞ্জুরি, আর তাতেও এই অভীকই ফার্স্ট এইড করেদিয়েছিল। অবশ্য গভির স্মৃতির তরঙ্গ ফিকে হতে বেশি সময় লাগলো না। ওরা দুজনে দেখতে পেলো শান্তনুর মুখের ধরন খুব দ্রুতই বদলাতে শুরু করেছে। ক্রমশই অতীতের এক চেনা মুখে পরিবর্তন হচ্ছে। সেকেন্ড কএকের মধ্যেই পরিবর্তনটি সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। শান্তনুর মুখটা পাল্টে মৃত রঞ্জিতের মুখ হতেই অভীক আচার্য একটা কান্ড ঘটিয়ে বসলো। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে ট্রাউজারের নীচে, মোজার ভিতর থেকে রাগার এল.সি.পি.টা বের করে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে সটান চালিয়ে দিল রঞ্জিতে রূপান্তর হওয়া শান্তনুর দিকে। গুলিটা রঞ্জিত ওরফে শান্তনুর বুকে ছেদ সৃষ্টি করলেও, ক্ষণিকের মধ্যে সেটা আবার ভরাট হয়ে গেলো মাংস, চামড়া ও লাইট ব্লু গেঞ্জির কাপড়ে। ধোঁয়া বেরোনো বন্দুকের নল থেকে আবার একটা গুলি বেরোলো এবং একই ভাবে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। আরো একবার এই একই ঘটনা ঘটার পড়ে অভীকের একটু ভয় লাগলো। অজানা ভয় ওর গা-টা শিউরে উঠলো। দু-পা পিছিয়ে গেলো সে। রঞ্জিত ওরফে শান্তনু, অভীকের শুকনো ফেকাশে মুখটা দেখে কেমন যেনো বাঙার্থে হেসে উঠলো। পূর্ণা এতক্ষন যেনো বোবা হয়েছিল। ওর আবার মনে পড়ে গেলো, যে শেষবার রঞ্জিৎকে সে ঠিক এই একই লাইট ব্লু গেঞ্জিতে দেখেছিল। সেইবারই তারা প্রথম ও শেষবারের মতো ভালোবাসার স্বাদটাও পেয়েছিল। যদিও এসব ভাবতে তার আর ভালো লাগছিলো না, তাউ সে রঞ্জিত ওরফে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করলো, "প্লীজ বলবে তুমি আসলে কে? তুমি কি সত্যিই শান্তনু না এক বছর আগে হারানো আমার রঞ্জিত?" পূর্ণার প্রশ্নে সে একবারই মাত্র ম্লান একটা হাসি দিল। তারপরই অভীকের উপর ঝাপিয়ে পড়লো আক্রমণাত্মক ভাবে। অভীক তাড়াতাড়ি এল. সি. পি. টার ঘরা চাপতে গেলো, কিন্তু সক্ষম হলো না। কারণ তার আগেই তাকে রঞ্জিত ওরফে শান্তনুর হিম শীতল হাতের থাপ্পড়ে মাটিতে আছার খেয়ে পড়তে হয়। তার সাথে সাথেই দমকা হাওয়ায় জানলার কপার গুলো খুলে গেলো। হাওয়ার তিবরতায় টেবিল ল্যাম্পটা নিচে পড়ে ভেঙে গেলো। চারিদিকে ছড়িয়ে গেলো কাঁচ গুলো। মেঝেতে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে অভীকের হাতে কাঁচের একটা টুকরো ফুটে গেলো। যন্ত্রণায় ওর মুখ দিয়ে 'আহ' শব্দটা বেরিয়ে এলো। তাও সে থেমে থাকল না। একটু এগিয়ে গিয়ে একটা কাঁচের টুকরো তুলে নিয়ে সেটাকে চালিয়ে দিল রঞ্জি ত্রফি শান্তনুর গলা লক্ষ্য করে। কিন্তু পরক্ষনেই অভিজ্ঞা অবাক হতে হয় কারণ এই আঘাতেও তার গলায় কোন ক্ষত দেখা গেল না। অভিকের মনে হলো তার মাথাটা বোধহয় সত্যিই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে পাগলের মত চেচিয়ে উঠে বললো, "কি চাস রে তুই? মরেও শান্তি দিবিনা আমায়? ভুলটা আমারই ঠিক করে দেখা উচিত ছিল যে তুমি সত্যিই মরেছিস না তোর ভিতরে প্রাণটা রয়েছে। সেদিন যদি আর একটু সতর্ক হতাম তাহলে আজ এই দিনটা দেখতে হতো না। কিন্তু তাতে তোর কোন চিন্তা নেই। সেদিন যেমন তোকে খুন করেছিলাম, তেমনি আজও তোকে একইভাবে খুন করব, তোর নিস্তার নেই। পূর্ণাকে আর তোর হতে দেব না, ও আমার আর আমারই থাকবে। এই কথা শোনা মাত্র পূর্ণার মনে হতে লাগলো ওর মাথায় অনেকগুলো পোকা বোধহয় নড়াচড়া শুরু করেছে। সবকিছু গুলিয়ে যাওয়ার আগে অভিককে জিজ্ঞাসা করল, "তুই খুন করেছিলিস মানে? তুই কাকে খুন করেছিস, রঞ্জুকে? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা যে তুই এই কথা বলছিস? ওকে খুন করে তোর কি লাভ?" অভীক রীতিমত গলাবাজির ভঙ্গিতে বলে উঠলো, "হ্যা, করেছি, আমিই খুন করেছি, আর তোর রঞ্জুকেই করেছি। এটাই শুনতে চেয়েছিলিস তো। তবে শন। তোদের একসাথে থাকা, মেলামেশা করা আমার একটুও ভালো লাগতো না। তোকে আমি ভালবাসতাম, আর তুই ওকে। এটা আমি মানতাম কি করে বল। তাই ওকে সরিয়ে ফেলা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো রাস্তা ছিল না। তাই তোরা উইকেন্ড কাটানোর জন্য এখানে যখন এলি, আমিও তোদের পিছু নিলাম। আর যখন দেখলাম তুই নিজেকে পুরোপুরি রঞ্জীতকে সোপে দিয়েছিস তখন আর নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। কৃষ্ণ লীলায় এতই মত্ত ছিলিস যে জানলাটা পর্যন্ত বন্ধ করিসনি। আর আমিও সেটারই সুযোগ দিলাম। জালনার ঠিক নিচেই টেবিল ছিল আর ঠিক সেটার উপরেই রাখা ছিল রঞ্জিতের মাদকের বোতলটা। বেশি অসুবিধা হয়নি কাজটা করতে। তবে ভেবেছিলাম আমার হটাৎ উপস্থিতিতে তুই প্রশ্ন তুলবি। কিন্তু তুলিশনি। নিজেকে খুব অসহায় ভেবেই বোধয় তুলিশনি। আমি সেই মুহূর্তেই ধরে নিয়েছিলাম তোর মনের মধ্যে আমার জায়গাটা পাকাপাকিভাবে ফিক্সট হয়ে গেছে। কিন্তু পরে দেখলাম আমি ভুল ছিলাম। তারপরে দেখলাম তুই যখন সন্তানসম্ভাবনা হোলি তখন আমি ছাড়া তোর কোন গতি হলো না। ফলে আমার ইচ্ছাটাই পূরণ হলো। আর এটাই তো হবার ছিল পূর্ণা। তাছাড়া তুই নিজেই ভেবে দেখ না রঞ্জিত তোকে কি দিতে পারতো, মদ খেত একটা পর মাতাল ছিল। হ্যাঁ, তোকে ভালোবাসতো এটা ঠিক। কিন্তু তুই একবার কাকু-কাকিমার কথা ভেবে দেখ তাদেরকি একটুও ভালো লাগতো যদি তারা দেখতো তাদের মেয়ের মাতাল স্বামী"। পূর্ণা সামনে একের পর এক বিস্ময়ের দোড় খুলতে থাকার পরে যখন সে এসে একদম অন্তিম দোরে পৌঁছলো, তখন সে শুধু একটাই প্রশ্ন করলো, "রন্জু ড্রিংকস করতে পারে, কিন্তু তার মানে তো এটা নয় যে ও খারাপ মানুষ, বা ও আমায় ভালোবাসে না, বা ভালো রাখতে পারবেনা। আসলে কি জানিস তো, তুই ওকে হিংসা কর্তিশ কারণ আমি ওকে ভালবাসতাম তোকে নয়। অভীক আমি সত্যিই জানতাম না যে তুই এতটা সার্থপর। একবারও ভেবে দেখেছিলিস ও না থাকলে ওর বয়সকো বাবা-মায়ের কি হবে। কীকরে চলবে তাদের দিন। জোয়ান ছেলেটাকে হারিয়ে কিভাবে বাঁচবে তারা"। পূর্ণার কথা শেষ হলে অভীক ওর উপর জোরদার চেঁচিয়ে বলে, "চুপ কর তুই। কোনো কথা বলবি না। তোর মুখে এত বড়-বড় কথা মানায় না পূর্ণা। বিয়ের আগেই তোর ফষ্টিনষ্টির ফলে যা ফসল তুই উৎপন্ন করেছিলিস, আমি না থাকলে বানের জলে ভেসে বেরিয়ে যেতো সেই ফসল, আর তার সাথে তুইও"। এবার বিদ্যুৎ বেগে এক চাঙ্গর বড়ফ ধ্বস নামার মতো অভিকের ঘার কে আঘাত করলো। অভীক নিজের ঘাড় চেপে ধরে বসে পড়লো। শান্তনু-রঞ্জিত বলে উঠলো, "এত কিছুর পরেও তোর প্রাণ নেওয়ার আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, যাতে আমার লিলির কখনো মনে না হয় যে ও পিতৃহারা। কিন্তু তুই আজ আমার পূর্ণাকে তার চরিত্র নিয়ে অপমান করেছিস, তাই তোর বেচেঁ থাকার আর কোনো অধিকার নেই"। একথা বলেই শান্তনু বা রঞ্জিত একটা কাচের টুকরো তুলে নিয়ে অভীকের গলা লক্ষ্য করে আড়াআড়ি ভাবে চালিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে গেলো। অবশ্য পূর্ণার সেই দিকে নজর নেই। সে ছলছলে এক দৃষ্টিতে শান্তনু অরফে রঞ্জিতের হাওয়ায় একটু একটু করে বিলীন হয়ে যাওয়া দেহটা দেখছিল।

পরের দিন সকালে শান্তনু পূর্ণার কোয়ার্টারের গেটের বাইরে অপেক্ষা করে-করে অস্থির হয়ে গেল, কিন্তু তার আর দেখা নেই। দেখা যখন পেলো তখন দেখলো সে একা নয়, তার সঙ্গে একটি লোক আছে, এবং সেই লোকটির কোলে বছরখানেক না হলেও আট-দশ মাসের একটা শিশু।

প্রথমে ওরা শান্তনুকে খেয়াল না করলেও, পূর্ণা খেয়াল করা মাত্রই ছুটে যায় শান্তনুর দিকে। তারপর দুএক কথায় আলাপও করিয়ে দেয়। লোকটা বলে, "আমার নাম অভীক। আমি আপনার কথা পূর্ণার কাছে শুনেছি। আপনি এখানে থাকেন বলেই আমি খুব নিশ্চিন্তে ছিলাম। এবার শান্তনু বুঝতে পারলো, ডেটে গিয়েও পূর্ণার তাকে দূরে রাখার প্রবণতাটা বেশি কেনো ছিল। শান্তনু মনে মনে ভাবলো, 'পূর্ণা তার বিবাহিত জীবন নিয়ে তাকে কিছু বলেনি কেনো'। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার আবার মনে হলো, তাদের মধ্যে এই বিষয় তো কোনো কথাই হয়নি, হলে নিশ্চই, পূর্ণা তাকে জানত। ভাবনার মাঝে শান্তনুর চোঁখ এড়ালো না পূর্ণার স্বামী অর্থাৎ অভীকের গালে হাসিমাখা টোল।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror