প্লেগ
প্লেগ
হঠাৎই সে একদিন এই গ্রামে এসে পরে। গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা সাইনবোর্ড। সেটাতে বড়ো বড়ো করে লেখা আছে 'ইঁদুর হইতে সাবধান'। ছোটো ছোটো অক্ষরে নীচে এক লাইন লেখা 'গন্ধেও সংক্রমক রোগ ছড়ায়'। যদিও পরিব্রাজকটি ধূ ধূ গ্রামটার ফটো তুলছিলো অতয়েব সে এই সাবধান বাণী এড়িয়েই যায়।
লেন্সের সামনে দুম করে একটা মুখ চলে আসায় সে একটু ঘাবড়ে যায় আর শাটার-রিলিজ বোতামে আঙ্গুল পরে যায়। চমকে উঠে একটু পিছিয়ে সে জিজ্ঞেস করে "কে আপনি? হুট করে যে বড় সামনে চলে এলেন?" লোকটা তাকে পাত্তাই দিলোনা। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে, নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে, পা পা করে চলে গেলো। উজার হয়ে যাওয়া এই গ্রামে যে মানুষ বাস করে সেটা দেখেই সে অবাক হলো।
কেউ পিছন থেকে বলে ওঠে "মিমি হামাদি লাকিনি উই-উই নি না-নী?" সেদিকে ফিরে পরিব্রাজকটি দেখে একটা বাচ্চা ছেলে। সেও স্ব্যাহিলি ভাষায় বাচ্চাটাকে উত্তর দেয়। বাচ্চাটা তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কেনো এই গ্রামে এসেছে। উত্তরে পরিব্রাজকটি বলে, নিছকই বেড়ানো ছাড়া শখের ফটোগ্রাফি করতেও সে এসেছে। বাচ্চাটা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনা, কেবল "কুজা নানি" বলা ছাড়া। সেও বাচ্চাটার পিছন পিছন হাঁটা শুরু করে। যদিও গ্রামের বসতি তার এখনো চোখে পড়েনি। বাচ্চাটা একটা গর্তের পাসে ভাঙ্গাচোড়া হ্যান্ডপাম্পের হাতল চেপে চেপে ফোঁটা ফোঁটা জল খেলো। পরিব্রাজকটি ভাবে, এই গ্রামটার অবস্থা খুবই ভীষণ। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা তার মানে প্রচন্ড রকমের কষ্টের। সে বাচ্চাটাকে স্ব্যাহিলি ভাষায় জিজ্ঞেস করে "আর কতদূর তোমার গ্রাম?" উত্তরে বাচ্চাটা বলে "এটাই তো"? পরিব্রাজকটি এবার জিজ্ঞেস করে "তাহলে গ্রামের মানুষজন কৈ? আর তোমার পরিবার"? বাচ্চাটা বলে, তারা এখানেই থাকে কিন্তু পরিব্রাজকটি কোথায় থাকবে এখন সেই নিয়েই তার চিন্তা। পরিব্রাজকটি হেসে বলে, সে এখানে থাকতে আসেনি। ব্লগ শুট করেই সে চলে যাবে। বাচ্চাটাকে দেখে মনে হলো সে তার শেষের কথাগুলো শুনলো না। বরং একটা শামুক দেখে আকৃষ্ট হলো। উঠে গিয়ে শামুকটা তুলে পকেটে রাখলো। তারপর আশপাশে কি যেন খুঁজতে আরম্ভ করলো। পরিব্রাজকটি জিজ্ঞেস করায় বাচ্চাটা বললো, সে শীতকালীন খাবার জড়িত করতে বেরিয়েছে। আর এই মুহূর্তে সে আরো শামুক খুঁজ খুঁজে চলেছে কারণ এটা তার খুবই প্রিয় খাদ্য। যদিও সে কীটপতঙ্গ, ছারপোকা, ফল বা উদ্ভিজ্জ পদার্থ সবই খায়। পরিব্রাজকটি এবার অস্বস্তিতে পড়েছে। এইসব কথা তার একদমই ভালো লাগছে না। তাছাড়া গ্রামটার পরিবেশও সুবিধার নয়। একটা গোটা গ্রামে কেবল একটাই বাচ্চা। ব্যপারটা অতি-অস্বাভাবিক ছাড়া কিছুই না। তার এখান থেকে বেড়িয়ে যাওয়াই ভালো। বাতাসে কেমন তীব্র-ময়লাযুক্ত গন্ধ মিশে আছে। তার মাথাটা কেমন ঘুরে যায়। বমি বমি ভাব লাগছে। সে বাচ্চাটাকে বলে "আমি বরং আসি হামাদি। বেলা পরার আগে তুমিও বাড়ি ফিরে যাও"। হামাদি বলে, সেও খুব তাড়াতাড়ি এই গন্ধের সাথে থাকার অভ্যাস করে নেবে। পরিব্রাজকটি বিরক্তির সাথে বলে "কেনো আমায় এই নোংরা গন্ধের সাথে অ্যাডজাস্ট করতে হবে শুনি? এসব বাজে কথা না বলে নিজের বাড়ি যাও। এমনিতেই আমি আর এক মুহুর্তোও এখানে থাকবো না"। বলেই সে উঠে পরে। হামাদিও আর দেড়ি না করে শরীরটা খুব কায়দা করে গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঢুকে যায়। মসৃণ শরীরটাকে গর্তের ভিতর ঢুকে যেতে দেখে পরিব্রাজকটি বিস্মিত হয়। হঠাৎ যে কি হলো, সে ঠাহর করে উঠতে পারেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্যান্য গর্ত গুলি থেকে বেরোতে লাগলো পাল পাল ইঁদুর। আবহাওয়ায় তীব্র-পচা বাঁধাকপি আর অ্যামোনিয়া মেসানো একটা গন্ধ ভেষে বেড়ায়। সেই গন্ধের চোটে বমনউদ্গার হয়ে যায় আর কি। মুখ চেপে কোনোমতে সে ছুট দেয়। অবিস্রান্ত দৌড়ে গ্রামের সীমানার বাইরে যেতেই ইঁদুরের দল তার পিছু ছেড়ে দেয়।
এখানে আবহাওয়া স্বাভাবিক। বুক ভরে সে অক্সিজেন নেয়। রুকস্যক থেকে বের করে একটু জল খায়। এদিন ওদিক তাকিয়ে অস্বাভাবিক কিছুই আর চোখে পড়েনা। বন্ধ্যা জমির গ্রাম ছেড়ে সে লোকালয়ের দিকে এগিয়ে যায়।
লেন্স পরিস্কার করতে করতে কেমন যেন মাথাটা ধরে আসে তার। সকাল থেকে একটু জর জর ভাব, মুখে অরুচি। শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। গরম জলে স্নান করে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই লখ্য করে, তার নাসিকায় হালকা কালচে প্রলেপ। ঘাড়-গলার মধ্যবর্তি চর্মে ফোলা ভাব। হাত-পা উভয়ে আঙুলেই ঘা দগদগ করছে।
আজ, হপতা খানিক কেটেছে কিন্ত তার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার খমতা নেই। ফোনে ডায়াল করারও ইচ্ছা নেই। সে বুঝতে পারছে, তার হাতে বেশি সময়ও নেই। সে জানে, একটু পরেই পাড়ার লোক তার ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মড়া ইঁদুরের গন্ধ পাবে। তারপর এই পাড়াটাও প্লেগে আক্রান্ত হয়ে উজার হয়ে যাবে। এই মারন রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়বে গোটা এলাকাটায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলের মধ্যে সংক্রামিত হবে এই রোগ। মহামারীর আকার ধারণ করে গিলে খাবে গোটা রাজ্যকে। তারপর গোটা দেশ। অবশেষে গোটা পৃথিবীটা তার কবলে পরবে। তখন আর পৃথিবীর বুকে বড় বড় অটটালিকা থাকাবে না। থাকাবে শুধু মাটি অথবা বালির গর্ত। সেই গর্তের মধ্যেই সুড়ঙ্গ করে থেকে যাবে র্যাটাস নরভেজিকাস। রাজ হবে তাদেরই। এসব ভাবনার মাঝে তার দৃষ্টি শক্তি খীনতরো হতে থাকে। শ্রবন ইন্দ্রিয় আগেই অবসর নিয়েছে। এবার ঘ্রাণেন্দ্রিয় চিরতরে বিরতি নিলো।

