কোটার্ডস সিন্ড্রোম
কোটার্ডস সিন্ড্রোম
তেজ ছুটে ঘরে ঢোকে। শব্দ করে দরজা বন্ধ করে, ছুটন্ত গতিতে তার শোবার ঘরে গিয়ে আলো জ্বালায়। তার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত ওঠানামা করছে। পা পা করে জানালার দিকে এগোয়। সাহসে ভর দিয়ে উঁকি দেয়। বাইরেটা ফাঁকা। রাতের নিস্তব্ধতা বিদির্ন করে কুকুর ডেকে ওঠে। সেই আওয়াজে তেজের বুকটা কেঁপে যায়। কুকুরের ডাক তো সে কতোই শুনেছে কিন্তু আজ রাতের অন্ধকারে মিশে আওয়াজটা যেনো কোনো ভয়াবহ বার্তা নিয়ে আসছে। জানালাটা ওতি সন্তরপনে বন্ধ করে তেজ। ভাবটা এমন, যেনো বাইরে যে আছে তার কানে জানালার কাঁচ টানার আওয়াজটা না পৌঁছায়। তারপর লাইট অফ করে, গায়ে চাদর টেনে, চোখ বন্ধ করে বিছানার এক ধারে শুয়ে কাঁপতে থাকে। চোখ খুললেই যেনো কোনো ভয়াবহ দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হবে। তবু খসখসে আওয়াজটা বাধ্য করে তাকে চোখ খুলতে। তেজ দেখে, কালো কালো ছায়া তার ঘরে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কিসব বলছে। তাকে নিয়ে কিছু বলছে কিনা বোঝার চেষ্টা করে, কিন্তু তার শ্রবনইন্দ্রিয় তাকে সাহায্য করেনা। হঠাৎ একটা ছায়া তার দিকে ফিরে থোমকে দাঁড়ায়। তেজ নিশ্চুপ ভাবে নিজেকে আরো বেশি করে গুটিয়ে নেয়। পিছনের ছায়াটা এবার এগিয়ে আসে। তেজ ভয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। আর ঠিক তখনই ছায়াটা তার মুখের উপর ঝুঁকে পরে। ছায়াটা যে, কি করার চেষ্টা করছে সেটা তেজ জানেনা। যেমন আচমকাই ছায়াটা তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছিল, যেমন আচমকাই আবার সোরে যায়।
ডক্টর অভ্র পেসেন্টকে দেখে সটান নিজের কেবিনে চলে যায়। তার জুনিয়র তাকে অনুসরণ করে। তাদের অনুসরণ করে আরো দুজন। জুনিয়র ডক্টর পর্না, অভ্রর কেবিনে ঢুকতেই অভ্র বলে "বাকি দুজনের যা বলার বা জিজ্ঞেস করার সেটা কেবিনে এসে করলেই তো হয়"। জাভেদ আর ইউসুফ কেবিনে ঢোকে। পর্না বলে "একটা পেসেন্ট তোমাদের ম্যারাথন করাচ্ছে, আর তোমরা তার পেছনে জগিং করছো। কি যে বলবো তোমাদের বুঝতে পারছি না"। ডক্টর অভ্র পর্নাকে থামিয়ে ওয়ার্ড বয়দের উদ্দেশ্যে দু-কাপ কফি আনতে বলে। তারা চলে গেলে, পর্নাকে বলে "এতো শর্ট টেমপার্ড কেনো তুমি। এতো রাগ ভালোনা। কাজের সময় মাথা অলওয়েজ ঠান্ডা রাখতে হয়"। পর্না প্রততুতরে বলে "জানি, কিন্তু এখন আমি বেরোবো, আপনাকে আগেই বলেছিলাম। এমনিতেই কাল অনেক সকাল সকাল কল আছে"। অভ্র বলে "হ্যঁ, মনে আছে। কফি আনতে পাঠিয়েছি, খেয়ে বেড়িও"।
খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে ক্যাফেইন ছাড়া কফির স্বাধ নিচ্ছিলো তেজ। কেউ যেন তার ঘরের দড়জা খুলছে। তেজ একটু একটু করে পিছন ফেরে। একটা কালচে অবয়ব উঁকি মারছে। তেজ ভয়ে এক পা পিছিয়ে যায়। যে অবয়বটা উঁকি মাড়ছিলো, সে সন্তরপনে দড়জাটা ভেজিয়ে দেয়। তেজ ভাবে একবার দড়জা খুলে দেখবে ছায়ামূর্তিটা গেছে কিনা। তারপর ভাবে দড়জা খুললে যদি তাকে আক্রমণ করে। তাই সে আর এগোয় না। চুপচাপ নিজের বিছানায় বসে। টেবিল থেকে রেডিও নিয়ে চালায়। খবরে বলে, "জম্মু কাশ্মীরের অনন্তনাগ জেলার প্যাহেলগাঁওয়ের বৈস্বরন জঙ্গলে পর্যটকদের লক্ষ্য করে জঙ্গীরা হামলা চালিয়েছে। ঘটনায় ৪ জন পর্যটক আহত হয়েছেন বলে খবর। ঘটনাস্থলে রয়েছে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী। এলাকা ঘিরে রেখে তল্লাশি চলছে। জম্মু কাস্মীরের কাঠুয়া জেলার হীরানগর সেক্টরের বনাঞ্চলে টানা তিন দিন ধরে জঙ্গী অনুপ্রবেশ রুখতে সামরিক বাহিনী ব্যাপক অভিযান চালিয়েছে। পুলিশের মহানির্দেশক নলীন প্রভাত এই অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত রবিবার সন্ধ্যায় হিরানগর সেক্টরের সারোয়াল গ্রামে জঙ্গীদের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের সহায়তায় গোটা অঞ্চল তল্লাশি চালাচ্ছে। এই তল্লাশি অভিযানে স্নিফার ডগ, ড্রোন, মানব বিহীন সামরিক বিমান অংশ নিচ্ছে। গোটা অঞ্চল নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে রেখেছে"। আর শুনতে ইচ্ছা করেনা তেজের। রেডিও বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকে। হঠাৎ আজানের রবে সচোকিত হয়ে ওঠে। মনেমনে বলে "নিরীহ পর্যটকদের খুন করে এখন নাটক করছে"। দড়জাটা আবার খুলে যায়। তেজেও উঠে দাঁড়ায়।দুটো ছায়ামূর্তি তার দিকে এগোলে, সে পিছতে থাকে। একটা সময় তার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়।তার আর পালানোর পথ নেই। সে ভয়ে চোখ মুখ হাত দিয়ে ঢেকে এক কোনায় সিটিয়ে বসে থাকে। একটা ছায়া তার দিকে ঝুঁকে অন্য ছায়াটির উদ্দেশ্যে কিছু বলে। অপর ছায়াটিও বোঝানোর ভঙ্গিতে কিছু বলে।
পর্না হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে "খুব স্ট্রেনজ কেস। এত শান্ত একজন মানুষের এরকম ভয় কি থেকে হতে পারে? উনার কেস ফাইলটা কাল স্টাডি করছিলাম। ভদ্রলোক সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন"। অভ্র বলে "শুধু তাই নয়। পুলয়োয়ামা আক্রামনের সময় উনি লেথপোরায় পোস্টিং ছিলেন। বিস্ফোরণের পর উনি প্রাণে বেঁচে গেলেও খুব গুরুতর ভাবে জখম হয়েছিলেন। তবে সেই ঘটনার পর উনাকে রেসকিউ দল উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায় কিন্ত উনি শারীরিক ভাবে সুস্থ হলেও, উনার মস্তিষ্ক খোতিগ্রোস্ত হয়। এই হাসপাতালের একটা টিমকে রিসার্চ পেপার বানানোর জন্য সেই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের টিম লিডার ওখানকার কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে তেজশ দেসপানডেকে এখানে নিয়ে আসে। লাস্ট চার ছয় বছর ধরে উনার চিকিৎসা এখানেই চলছে"। পর্না একবার ভাবলো, সরকারের থেকে পারমিশন নেওয়া হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করবে কিন্ত মন্ত্র মুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনতে শুনতে আর জিজ্ঞেস করেনা। অভ্র বলে চলে "কোটার্ডস সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি জীবিত মানুষকে মৃত মনে করে। মস্তিষ্কের ঠিক কোন কোষটা খোতিগ্রোস্ত হয় সেটা গবেষণায় এখনো কনফার্ম হয়নি। তবে উনার বোধহয় বাড়ির লোক কেউ নেই, থাকলে নিশ্চয়ই খবর নেওয়ার চেষ্টা করতো। উনার আইডি কার্ডে শুধু নামটুকু পরা গেছে বাকি সব ডিটেইলস ঢেকে গেছে জমাট রক্ত আর ধুলোতে"।
