STORYMIRROR

Ankita Mukherjee

Horror Fantasy Thriller

4  

Ankita Mukherjee

Horror Fantasy Thriller

বিভ্রম

বিভ্রম

6 mins
350

নাইট শিফট অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। ওদের অলটারনেটিভ ডিউটি থাকে। "একবার কনফার্ম লেটারটা পাই, তারপর তোমায় আর এসব হাবিজাবি কাজ করতে হবে না" রোস্টারে চোখ বুলিয়ে বলে রাজেন। "হুম" বলে হাসপাতালে ঢুকে পড়ে মৃণালিনী। করিডোর থেকে ঘুরে গিয়ে লিফট ধরে সে, বাইরে রাজেন একটা সিগারেট ধরিয়ে মোবাইলে মেল চেক করে। নতুন কিছু নেই।
"এমার্জেনসিতে একটা কৃটিকাল পেসেন্ট এসেছে মিনা, এবার তুই দেখ, আমি চললাম" বলেই হাটা দেয় রাজলক্ষ্মী। মৃণালিনী নিজেকে বলে, "কৃটিকাল পেসেন্ট না হলে এমার্জেনসিতে রাখবে কেনো"।
কিছুক্ষণের মধ্যেই, টি.এল. ম্যাডাম এসে কার কোথায় ডিউটি বলে দিলো। মৃণালিনী যদিও আন্দাজ করেছিলো তার কোথায় ডিউটি হবে, কারণ বেশিরভাগ সময়েই রাজলক্ষ্মী আর তার অলটারনেটিভ ডিউটি পরে। খুবই কম এর ব্যতিক্রম হয়।
পেসেন্টের ড্রিপটা দেখে নিয়ে স্যালাইনের বোতল বদলানোর সময়ে মনে হলো কেউ যেনো ওর নাম ধরে ডাকছে। কিন্তু এই কেবিনে তো অচৈতন্য পেসেন্ট ছাড়া আর কেউ নেই, তাহলে কে তার নাম নিলো। এসব ভাবনার মধ্যেই তার মোবাইল বেজে ওঠে। রাজেনের ফোন দেখেই রিসিভ করে। কথা বলতে বলতে স্যালাইন বদলানোর কথা সে বেবাগ ভুলে যায়। ম্যাট্রন টহল দিতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে বিশাল চোটে যায়। গর্জে উঠে তাড়াতাড়ি পেসেন্টের কাছে গিয়ে নিজেই স্যালাইন বদলাতে থাকে। আচমকা বোকুনিতে মৃণালিনী ঘাবড়ে যায়, তারা মোবাইলটা হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে যায়। সাফাই দেওয়ার জন্য সে কিছু বলবে তার আগেই ম্যাট্রন বলে ওঠে, "এতো ইরেসপনসিবল মেয়ে আমি আজ পর্যন্তই আমার ক্যারিয়ারে দেখিনি। কাল তোর ফায়ার লেটারটা নিয়ে যাবি আমার কেবিন থেকে। মৃণালিনী একটা জোর ধাক্কা খায় তারপর মিনমিন করে বলে, "পৌঁছে মা কে ফোন করতে ভুলে গিয়েছিলাম তাই এখন করলাম। তাছাড়া অমি এখনই রেখে দিতাম, ভেরি সরি"। মিথ্যে ওষুধে কোনো কাজ হলো না, উল্টে ম্যাট্রন বললো, "আর কত ইরেসপনসিবল হোবি, একই ভুল বারবার করবি তারপর গল্প বানাবি, ডিস্গাসটিং"। মৃণালিনী বলে, "এক্সট্রিমলি সরি ম্যাডাম কিন্তু তখন তো আমি ইন্টার ছিলাম, এক্সপিরিএনস ছিলো না"। ম্যাট্রন তাচ্ছিল্য ভাবে বলে, "এক্সপিরিএনস হয়েই বা কি লাভ হচ্ছে"।
ম্যাট্রন বেরিয়ে গেলে একটা টুলের উপর বসে পড়ে মৃণালিনী। গত বছরের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় তার। রেষারেষিতে একজন বাইক আরোহী খুব বীভৎস ভাবে জখম হয়েছিলো। স্থানীয়রা ছেলেটাকে ধরাধরি করে এই হাসপাতালে এনেছিল। মৃণালিনী তখন ইন্টার্ন। কৌতূহল হয়েছিলো বলে দেখতে ঢুকেছিল কৃটিকাল কেয়ার ওয়ার্ডে। যদিও সে অন্য ডিপার্টমেন্টে ইন্টার্নসিপ করছিলো সেই সময়ে। ডান হাত আর পায় ব্যনডেজ। হঠাৎ তার একটা হাত খপ করে ধরেছিলো ছেলেটা। আচমকা ধরায় মৃণালিনী ঘাবড়ে গিয়ে এক ঝটকায়ে হাতটা ছাড়িয়ে দু-পা পিছিয়ে যায়। মনিটরে দাগ গুলো বেশি ফারাকে উপর নিচ হতে থাকে। ছেলেটা চোখ বিস্ফোরীত করে শেষ হয়ে যাওয়া স্যালাইনের বোতলটা দেখতে দেখতে মৃণালিনীর হাতটা আবার ধরার চেষ্টা করে। সেও বোঝে বোতল পাল্টাতে হবে। কিন্তু হাসপাতালের স্টাফরা এতো ইরেসপনসিবল কিকরে হতে পারে যে এমন কৃটিকাল পেসেন্টের কাছে কোনো নন মেডিকেল স্টাফ আপয়েনট করেনি, এটা তার বোধগম্য হয়না। তার এতো ভাবনার ফলে স্যালাইনের বোতলটা আর বদলানো হয়না, ফলে মনিটরে দাগ আড়াআড়ী ভাবে সোজা হয়ে যায়। মনিটরে চোখ পড়তেই একটা জোর ধাক্কা খায় সে। রোগীর বিস্ফোরীত খোলা চোখ দুটো স্থির হয়ে তার দিকেই।
ঘটনাটা সে ভুলেই গিয়েছিল, তাহলে আজ হঠাৎ কেনো মনে পড়লো? এই একটা বছরে মুখে না বললেও মনে মনে কি তাহলে সে নিজেকেই দাই করতো সেই বাইক আরোহীর মৃত্যুর জন্য? হঠাৎ এক সম্ভবনায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। সে বেশ বুঝতে পারছে তার সমস্ত রোমকুপ দাঁড়িয়ে গেছে। চোখের আড়ায়া মনে হচ্ছে এই রোগীটাও বড়ো বড়ো চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তবু একবার সাহস করে সে দেখে আর শিরদাঁড়া দিয়ে বরফের চাঁই নেমে যায়। হুবহু সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। সেই একই চাহনি, সেই একই অঙ্গে ব্যানডেজ, চুলটাও তো একই রকম লাগছে, আর মুখ! সেটা ক্রমশ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে গত বছরের দেখা সেই চেনা মুখে। সেই মুখে ক্ররতা, ঘেন্না আর হিংস্রতা একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে। হিংসা ফেটে পড়ছে তারভয়াবহ মুখ-মণ্ডল থেকে। এর কারণ জানে মৃণালিনি। তার অসাবধানতা নয় তার বেপরোয়া ভাবই আসল কারণ। যদিও সে নিজের মনকে বলে যাচ্ছে, আচমকা হাত ধারায় সে ভয়ে পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো কিন্তু সত্যিটা সে নিজে খুব ভালো করে জানে। কারণ সে যদি অন্য কোনো স্টাফকে খবরটা দিতো তাহলে হয়তো ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
এতো ভাবনার মধ্যে কোমর সোজা করে রোগী উঠে বসে। তারপর বেড থেকে নেমে পড়ে। দৃশ্যের আকর্ষীকতায় একটু একটু করে পিছতে থাকে মৃণালিনি। পায় পায় রোগীটা তার দিকে এগোচ্ছে। এ হেন সময়ে হাতরে হাতরে দরজাটা পায়। এক টানে ভেজানো দরজাটা খুলে ফেলে করিডোরে বেরিয়ে পড়ে। ছুটে লিফটের সামনে গিয়ে বোতাম টিপতে থাকে। কিন্তু লিফট আসার নাম নেই। কেবিন থেকে বীভৎস চেহারার রোগীটা বেরোয়। বড়ো করিডোরটা পেরিয়ে মৃণালিনীর কাছে পৌঁছাতে তার বেশ কিছুটা সময় লাগবে সেটা মিনা বুঝতে পারে। কারণ বাইক অ্যাক্সিডেনটে তার পায় যথেষ্ট চোট লেগেছে। সে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। মৃণালিনী এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যেকটা লিফট ঘরের সামনের বোতাম গুলো টিপে দেয়। নিমেষের মধ্যে সব থেকে কোনার লিফটটা চলে আসে। মৃণালিনী সেটাতে উঠে পড়ে সুবিধা মতো ফ্লোরের সুইচ টেপে। বিফলে যায় এই চেষ্টাও। লিফট এক চুল নরেনা। মৃণালিনী সিঁড়ি ধরবে মন স্থির করে। লিফটের গ্রিল খুলে এগোতে যাবে তখনই সামনে এসে পড়ে বীভৎস রোগীটা। মৃণালিনী দু-পা পিছিয়ে যায়। ঘেঁষঘেঁষে গলায় রোগীটা বলে "আমায় মারলি কেনো? বল কেনো মারলি আমায়? আমি তোর কি ক্ষতি করেছিলাম? তোর কাজ সেবা করা আর তুই আমায় মেরে ফেললী"। মৃণালিনী ভয়ে ভয়ে মুখ খোলে। সে বলে "আমি মারিনি তোমায়, বরং আমি ভয় পেয়েছিলাম হুট করে হাত ধরায়"। রোগী বলে "accident এর ফলে চোয়ালের হাড় ভেঙে যায় আমার। কথা বলতে পারছিলাম না। তাই তোর হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম আমার saliner বোতলটা শেষ হয়ে যাচ্ছিলো। আর তুই, আমায় সাহায্য করা তো দূর, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মৃত্যু যন্ত্রণা উপভোগ করছিলিস। তোর জন্যে আমার মুক্তি হচ্ছে না, তোকে আমি ছাড়বো না"। তারপরই হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় মৃণালিনীর দিকে। মৃণালিনী পিছন ফিরে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পালাতে পারেনা, সামনেই খোলা ব্যালকণি। লাফিয়ে পড়বে, সে ভাবে। এই প্রথম তার ভয় লাগছে, মৃত্যু ভয়। মৃত্যু যে সুখকর নয় সেটা সে জানে। ওপারে চলে গেলে আর এপারে ফিরতে পারবে না সে জানে। রাজেনের সাথে আর থাকা হবে না।
ততক্ষণে শক্ত একটা হাত তার ঘাড়টা চেপে ধরেছে। মৃত্যুর থেকেও ঠান্ডা সেই হাত। আর একটু হলেই ঘাড়টা মোটকে যেতো কিন্তু বাঁচার শেষ চেষ্টা করে মৃণালিনী বলে "আমি পালিয়ে যাইনি। তোমায় বাঁচানোর জন্যেই সেদিন কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম"। এইটুকু বলাতেই ঘাড়ের উপর শীতল হাতটা একটু যেনো শিথিল হয়ে যায়। সে আবার বলে "আমার তখন ট্রেনিং শেষ হয়নি। মনিটরটা দেখে খুব ভয় পেয়েছিলাম। তাই সিনিয়রকে ডাকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার ভুলের কারণে কারোর প্রাণ চলে যাবে। আমি শিকার করছি, আমারই ভুল। আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু কি করতাম তুমিই বলো। সিনিয়রের অনুমতি ছাড়া কোনো patient কে ছোয়ার সাহস ছিলো না"। হাতটা আর একটু শিথিল হলো। মৃণালিনী বলে চললো "গোটা একটা বছর আমি গিলটি ফিল করে গেছি, এটা ভেবে গেছি যে, কারোর মৃত্যুর জন্যে আমি দাই, সেবা মূলক কাজের জন্য আমি অযোগ্য। সব দোষ আমার! সব দোষ আমার!"
এই কথা শেষ হওয়া মাত্র রোগীর দেহ ফিকে হতে থাকে। অবশেষে ধোঁয়ার কুন্ডোলিতে পরিবর্তন হয়ে ব্যালকণি দিয়ে বেরিয়ে বাতাসে মিশে যায়। এরপর মৃণালিনীর জ্বর আসে। মাথাটা ঘুরে যায় আর সে মাটিতে লুটিয়ে পরে।
চোখ খুলতেই সে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায়
আবিষ্কার করে। সিয়রে রাজেনকে দেখে উঠে বসতে যায়। রাজেন বাঁধা দেয়। কিছুক্ষণ তাকে জড়িয়ে ধরে থাকে তারপর বলে "এখান থেকে ফোন পেয়ে ছুটে এসেছি। তোমার যদি কিছু হয়ে যেতো, আমার কি হতো। আমিও শেষ হয়ে যেতাম মিনা। তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই"। মৃণালিনীর চোখে জল আসে কিন্তু রাজেনকে সেটা বুঝতে দেয়না। রাজেন বলে যায় "আমি জানি আমি অপদার্থ তাই তোমাকে এতো কষ্ট দি। ওভারটাইম করো তুমি আর আমি......"। তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয় মৃণালিনী। "তুমি এইসব নেগেটিভ কথা কেনো বলছো, আমি তো ঠিক আছি এখন, আর তাছাড়া একটু প্রেসার ফল করেছিলো। এত টেনসন করোনা"। রাজেন বলে "অতো জানিনা শুধু এইটুকু ছাড়া, তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কাজে জয়েন করবে না"।
সপ্তাহ খানিক পরে মৃণালিনী কাজে জয়েন করে। তার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ম্যাট্রনের সাথে কথা বলা। সেই পেসেন্ট তার ব্যাপারে জানতে চাইলে ম্যাট্রন তাকে একটা আজব কথা বলে। সেই দিনের পর থেকে নাকি রোগীটার কোনো অস্তিত্বই নেই। জল জেনতো একটা মানুষ যে এভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে, এটা ম্যাট্রনের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না। কিন্তু মিনা তো জানে, রোগীটা আসলে কে। কারণ মানুষ হলে সে কখনোই এভাবে অদৃশ্য হয়ে যেতো না।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror